ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
বন্দুক সওদাগরের মন্দির দেখতে এসে যে এ ভাবে কাদায় আছাড় খেতে হবে, দীননাথ দত্ত ঘুণাক্ষরেও আঁচ করেনি।
মন্দিরটা সুন্দরবনের এক দ্বীপে। বিশেষত্ব তেমন কিছু নেই, গ্রামবাংলায় ‘ঠাকুরের থান’ যেমন হয় আর কী! ছোট্ট চালাঘর, সামনে ইঁদারা, একটা চাতাল। ইটের তৈরি মন্দিরের গায়ে বিবর্ণ কিছু টেরাকোটার কাজ। ভিতরটা অন্ধকার, এক ধারে ত্রিপল টাঙিয়ে কিশোর রফি বাস করে। রফির মা-বাবা কেউ নেই, দাদুও বছর কয়েক আগে মারা গিয়েছেন। দাদু ‘বাউলে’ ছিলেন, বাঘের ডাক বুঝতে পারতেন। আর এই মন্দিরের দেখভাল করতেন।
মুসলমান কেন মন্দিরের দেখভালে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। আমেরিকা-প্রবাসী দীননাথ জানে, সুন্দরবনে জল-জঙ্গলের সংস্কৃতিই এ রকম। বনবিবির কাছে হিন্দু, মুসলমানে ফারাক নেই। দীননাথ একদা বাংলার লৌকিক কাব্য মনসামঙ্গল নিয়ে গবেষণা করত। ফলে, এ সব বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার।
কিন্তু দ্বীপটা কোথায়? বাসন্তী থেকে ভটভটি নৌকো। মাতলা, রায়মঙ্গল বেয়ে যেতে যেতে খাঁড়ির দু’পাশে সবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বই আর কিছু দেখা যায় না।
এমনিতেই সুন্দরবনের প্রকৃতি অন্য রকম। আজ নাম-না-জানা একটা দ্বীপ জেগে ওঠে, কিছু দিন বাদে নদী গতিপথ বদলালে সেই দ্বীপটাও তলিয়ে যায়। লোনা জলের মীন, কাঁকড়া, কুমির, কামট, গরান গাছের উঁচিয়ে থাকা শিকড় সব নিয়ে এক-একটা নদী যেন আলাদা বাস্তুতন্ত্র।
দীননাথ শুনল, ২০০৯ সালে আয়লার পর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মাছ-ধরা ট্রলার নিয়ে নদীর গভীরে গেলেও জালে আগের মতো মাছ আর ওঠে না, গ্রামের লোকে নদীতে বাঁধ দেওযার চেষ্টা করলেও কয়েক মাস পরে বিশাল জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে। পানীয় জলের কুয়ো খুঁড়লেও আর্সেনিকে দূষিত জল ছাড়া গত্যন্তর নেই। চাকরি নেই, চাষবাস নেই, রুজির খোঁজে ছেলেমেয়েরা তাই এখান থেকে পালিয়েছে। মেয়েরা কেউ কেউ আড়কাঠির পাল্লায় পড়ে লালবাতি এলাকায়, ছেলেরা দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো বড় শহরে ঠিকাদারের অধীনে খাটতে। অনেকে নদী পেরিয়ে ও পারে বাংলাদেশে। তার পর ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া। ঝড় সুন্দরবনকে তছনছ করে দিয়েছে।
খাঁড়ি বেয়ে চলতে চলতে এক সময় বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখা গেল সেই মন্দিরকে। খাঁড়িতে ভাটার টান, পাড়ভর্তি কাদা। জিনস বা ট্রাউজার্সে এখানে হাঁটাচলা অসম্ভব, দীননাথ সারেং-এর বাড়তি লুঙ্গিটা গলিয়ে নিল। সারেং পাড়ে লঞ্চ ভিড়িয়ে ততক্ষণে পাটাতন পেতে দিয়েছে, ‘‘এগিয়ে আসুন। আস্তে।’’
আর আস্তে! পাড়ে নেমেই এক হাঁটু কাদায় পিছলে পড়ল দীননাথ। চোখে, নাকে, মুখে প্যাচপ্যাচে কাদা। ‘‘তখন বললাম, একটু গাঁজা টেনে নিতে। শুনলে আপনার এত অসুবিধে হত না,’’ স্থানীয় কিশোর টিপু জ্ঞানবার্তা দিল প্রবাসী দীননাথ দত্তকে।
এ ভাবেই শুরু হয়েছে অমিতাভ ঘোষের সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস ‘গান আইল্যান্ড’। চিন সমুদ্র, হংকং, সাংহাই হয়ে প্রায় দেড় দশক পর ঘরে ফিরলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত লেখক।
দেড় দশকই বটে! এই সুন্দরবনের পটভূমিতেই ২০০৪ সালে বেরিয়েছিল তাঁর উপন্যাস ‘হাংরি টাইড’। সেখানে ঝড় ছিল, ছিল মরিচঝাঁপির কথা। পরের ১৫ বছর ধরে লিখে গিয়েছেন চিনে আফিম যুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর তিন খণ্ডের ‘আইবিস ট্রিলজি’। অতঃপর আজ আবার মাতলা, রায়মঙ্গল নদীতে ফেরা।
কিন্তু এই উপন্যাস মোটেও ‘হাংরি টাইড’-এর সিক্যুয়েল নয়। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে, মা মনসার অভিশাপ থেকে রেহাই পেতে বাংলার বন্দুক সওদাগর বেরিয়ে পড়েছিল বাণিজ্যে। অতঃপর ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে, তারা শিকলে বেঁধে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। ইলিয়াস নামে এক বণিক কিনে নেন তাকে। তার পর ‘কড়ির দ্বীপ’, ‘তালমিছরির দেশে’ নানা জায়গায় বাণিজ্যে যায় তারা।
কিন্তু কোথাও মড়ক, কোথাও বা অন্য দুর্ভোগ। নিস্তার নেই। ভেনিস শহরে এসে এক দিন মনসার চোখে পড়ে যায় সওদাগর। আতঙ্কিত হয়ে দেশে ফিরে আসে। তার পরই সে অরণ্যে তৈরি করেছিল এই থান। দীননাথ জানে, এই বন্দুক সওদাগরকে নিয়ে এখানকার লোকে পাঁচালিও গায়, ‘কলকাতায় তখন না ছিল লোক, না মকান/ বাংলার পত্তনি তখন নগর-ই-জাহান।’ কিন্তু ওই পাঁচালির কোনও পুঁথি নেই। বন্দুক সওদাগরের নির্দেশ ছিল, এটি কখনও লেখা যাবে না।
ওরাল ট্রাডিশন, পাঁচালি গান, মনসার পালা, সব মিলিয়ে এই উপন্যাস প্রায় মনসামঙ্গলের আধুনিক পুর্নলিখন।
বিশ্বজোড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিং-ই এই পুর্নলিখনকে সম্ভব করেছে। উপন্যাসের এক জায়গায় লস অ্যাঞ্জেলেসের সমুদ্রতটে গিয়েছে দীননাথ। সেখানে ইটালীয় মেয়ে জিসা এবং তার দুই ছেলেমেয়ে তাদের পোষা কুকুরটিকেও নিয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা ঢেউয়ে বল ছুড়ে দিচ্ছে, কুকুরটি কুড়িয়ে আনছে। এক সময় সে ঢেউয়ে মুখ ডুবিয়ে কী একটা খোঁজে, তার পর পাড়ে এসে লুটিয়ে পড়ে। তার মুখে হলুদ-কালো এক সাপ!
পরের দিন এক বন্ধু ই-মেলে দীননাথকে জানান, ‘হ্যাঁ, এটা অন্য জায়গাতেও ঘটছে। বিষাক্ত এই সাপগুলি আরও দক্ষিণে, সমুদ্রের উষ্ণ স্রোতেই এত দিন থাকত। কিন্তু সারা দেশের সমুদ্রস্রোত উষ্ণ হয়ে যাওয়ায় তাদের আজকাল এ দিকেও দেখা যাচ্ছে।’ লোহার বাসরঘরে একটি ছিদ্র বেয়ে কালনাগিনী ঘরে ঢুকে পড়তে পারে, লখিন্দর মৃত্যুযন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে পারে, ‘জাগ ওরে বেহুলা সায়বেনের ঝি/ তোরে পাইল কালনিদ্রা, মোরে খাইল কী।’ কিন্তু গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর দৌলতে হাজার হাজার সাপ আজ আমেরিকার সমুদ্রস্রোতেও যখন-তখন হানা দিতে পারে।
শুধু সাপ নয়। ভেনিসে এক ইটালীয় বান্ধবীর বাড়িতে বসে দীননাথ দেখে, জানলার শার্সি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে বাদামি এক মাকড়সা। পরে জানা যায়, loxosceles reclusa নামের এই মাকড়সাগুলি প্রবল বিষাক্ত। ইউরোপের জলবায়ু যত গরম হচ্ছে, ততই এরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বছর দুয়েক আগে ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট’ নামে এক নিবন্ধগ্রন্থ লিখেছিলেন অমিতাভ, সেখানে প্রশ্নও তুলেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের গল্প, উপন্যাসে ঠাঁই পায় না কেন?’
সেই উপন্যাস শেষ অবধি নিজেই লিখলেন তিনি। মারিও ভার্গাস লোসা থেকে ওরহান পামুক, মায় সলমন রুশদি, বিক্রম শেঠ... দুনিয়ার কোনও লেখক এখনও সাম্প্রতিক বিশ্বজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের পটভূমিকে সাহিত্যে আনার সাহস করেননি। সেখানেই এই বাঙালি লেখকের উজ্জ্বল উদ্ধার।
লেখক এখন বিদেশে। আগামী শুক্রবার এই বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ উপলক্ষে কলকাতায় আসবেন। ই-মেলে এক প্রশ্নের উত্তরে চেতাবনি দিলেন, ‘‘দেখবেন, বাংলা এবং তামাম ভারতই এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপজ্জনক জায়গায়। সে দিন ওড়িশায় ‘ফণী’ এল। আর এখন তো উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় দেখছি, দুর্বিষহ তাপপ্রবাহ। যে কোনও দিন বহু জায়গায় খরা হতে পারে। কিন্তু আমাদের হেলদোল নেই। এখনও কোনও সঠিক পরিবেশ-নীতি নেই, উল্টে একের পর এক নগরায়ণ-প্রকল্প। ভবিষ্যৎ সুখের বলে মনে হয় না।’’
আসলে ঝড়, নদীর গতিপথ বদল ও জলবায়ু পরিবর্তন কী ভয়ঙ্কর ভাবে হানা দিতে পারে, লেখক নিজের জীবনেই বারংবার টের পেয়েছেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা ফরিদপুরের লোক। ১৮৫০ নাগাদ পদ্মা গতিপথ বদলায়, অমিতাভদের গ্রাম তলিয়ে যায়। লেখকের পূর্বপুরুষরা তখন গ্রাম ছেড়ে অভিবাসী হন, পশ্চিমে বিহারের গঙ্গাপাড়ে এসে থিতু হন।
এ নাহয় পূর্বপুরুষদের গল্প। ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে লেখক নিজে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি ফিরছেন, আকাশে ফানেলের মতো কালো মেঘ। টিপটিপ বৃষ্টি। তার পরই প্রবল ঝড়। পার্কিং লটে দাঁড়ানো বাইক, মোটরগাড়ি থেকে আশপাশের টিনের চাল, সব ঘুরতে ঘুরতে উড়ে যাচ্ছে। আশপাশের বাড়ির ঘুরন্ত ইলেকট্রিক ফ্যানগুলোকেও কে যেন দুমড়ে-মুচড়ে রাস্তায় ছুড়ে দিচ্ছে। অমিতাভ কোনও ক্রমে দু’হাতে মাথা গুঁজে রাস্তায় শুয়ে পড়লেন। পর দিন, ১৮ মার্চ খবরের কাগজে বেরোল, ‘মৃত ৩০। আহত ৭০০। দিল্লি শহরে প্রথম টর্নেডোর আক্রমণ।’ লেখক সে দিনটাকে এখনও ভোলেননি: ‘‘আজ বুঝতে পারি, ওই যে রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলাম, তখন আমি ঝড়ের কেন্দ্রে। মানে, ‘আই অব দ্য স্টর্ম’ আর কী! ফলে ধ্বংসলীলাটা আমার আশপাশে হল, আমি অক্ষত রয়ে গেলাম।’’
কিন্তু ঝড়, আয়লা আর জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে শেষ অবধি মনসামঙ্গলকে আশ্রয় করতে হল? ই-মেলে উত্তর এল, ‘বাংলার ভূখণ্ডে ওটাই বাস্তব। সঙ্গে একটা ছবি ফরোয়ার্ড করলাম। ১৯৪৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তমোনাশচন্দ্র দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বেরোনো সুকবি নারায়ণ দেবের ‘পদ্মপুরাণ’-এর দুটি পৃষ্ঠা।’ দেখলাম, সেখানে লেখা, ‘সর্পের অতর্কিত দংশন ও ভীষণতম হিংস্রতা হেতু গৃহস্থের বিপদ সর্বাধিক...পল্লীগৃহস্থের নিদারুণ সর্পভীতির ফলে সর্পের একটি দেবী পরিকল্পিত হইয়া বাঙ্গালা সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিবেন, তাহা আর বিচিত্র কি?’ বুঝলাম, অমিতাভ ঘোষের নতুন উপন্যাসের ছায়ারেখা একটিই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদও সাপের মতো যে কোনও মুহূর্তে নিঃশব্দে ছোবল মারতে পারে।
আধুনিক সভ্যতাতেও কি নেই এই নিঃশব্দ সরীসৃপ-চলন? উপন্যাসের এক জায়গায় আমেরিকার পাহাড়ি অরণ্যে ‘ডার্ক বিটল’ নিয়ে কাজ করছেন এক পতঙ্গবিদ। এই পোকাগুলি অনেকটা ঘুণপোকার মতো, গরমকালে গাছের ভিতরটা ফোঁপরা করে দেয়। দাবানলের আগে এদের দেখা যায়। পাহাড়ে সেগুলি দেখে গবেষক শহরের মেয়রকে দাবানলের আশঙ্কার কথা জানালেন। মেয়র যথারীতি ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন।
তার পরই দাবানল। গবেষককে ধন্যবাদ নয়, উল্টে ইন্টারনেটে ট্রোলড হলেন তিনি। সবাই বলল, গবেষণার তহবিল বাড়াতে পতঙ্গবিদ নিজে আগুন লাগিয়েছেন, খুনের হুমকি-চিঠিও এল।
নেটের ভয়াবহতা সুন্দরবনেও। প্রথম আলাপেই টিপু দীননাথকে জানিয়েছিল, ‘‘আপনার সবই আমি জানি। কোথায় দেশ ছিল, আমেরিকায় কী করেন।’’ দীননাথের সোশাল নেটওয়ার্ক সাইটে গিয়ে ইতিমধ্যেই সব বার করে ফেলেছে টিপু। দীননাথ অবাক, ‘‘সে কী, এখানে তো ইলেকট্রিকও থাকে না। তা হলে কম্পিউটার চলে কী ভাবে?’’ টিপু পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে, ‘‘আপনারা বোঝেন না, পকেটের এই যন্ত্রটা থাকলেই হয়।’’ দীননাথ ক্রমে বোঝে, সুন্দরবনের এই ছেলে সীমান্ত পেরিয়ে মানুষ পাচারের দালালিতে যুক্ত। এই যে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া বেআইনি ভাবে অজস্র অভিবাসী বিশ্ব জুড়ে যাতায়াত করে, সেখানে ইন্টারনেটই জাদু কার্পেট। টিপুদের প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন দিতে হয় না, চেনাজানাদের মাধ্যমে সোশাল নেটওয়ার্কেই কাজটা হয়ে যায়।
অমিতাভ ঘোষ।
পড়তে পড়তে মনে পড়ল, ভোটের খবর করতে মাস কয়েক আগে উত্তরবঙ্গের এক বন্ধ চা-বাগানে গিয়েছিলাম। সেখানে তরুণ-তরুণীরা বেশির ভাগই কাজের খাতিরে ভিন রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, আড়কাঠিরা তা হলে এখানে খুব যাতায়াত করে বলুন! ওঁরা হেসে বলেছিলেন, ‘‘আড়কাঠি আজকাল লাগে না দাদা। হোয়াটসঅ্যাপই যথেষ্ট।’’ অমিতাভ ফের জানালেন, সংবাদপত্রের থেকে গল্প, উপন্যাসে সমাজবাস্তবতা অনেক বেশি।
উপন্যাসেও আরও যে কত ছবি! টিপু ও তার সঙ্গীরা নৌকোয় ভেসে ইউরোপের দিকে পাড়ি দিয়েছে, ইটালি, ফ্রান্স সশস্ত্র গানবোট পাঠিয়েছে। বেআইনি অভিবাসীদের তারা ইউরোপে ঢুকতে দেবে না।
এখানেই আজকের পৃথিবী। জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে সিরিয়া, সুদানে ক্রমশ বেড়ে চলে খরা। লোকে পালাতে বাধ্য হয়। ‘‘আমার দেশের নাগরিকদের নিরাপদ লাইফবোটে রাখার মতো সশস্ত্র ভঙ্গিতে সীমান্ত আটকাব, এই যুদ্ধবাজ জঙ্গি জাতীয়তাবাদ দিয়ে আর যাই হোক, জলবায়ু পরিবর্তনকে রোখা যাবে না,’’ বলছেন লেখক।
কিন্তু আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ তো আজও জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কাকে ধাপ্পা মনে করে! ই-মেলে ফের ঝটিতি উত্তর, ‘ভাববেই। কেন না জলবায়ু পরিবর্তন বুঝিয়ে দেয়, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং কার্যকারণবোধ নিয়ে ইউরোপ যে সংস্কৃতি দুনিয়ায় চারিয়ে দিয়েছিল, তা কত বড় ভুল ছিল। পাশ্চাত্যের শেখানো ওই জাতিরাষ্ট্র, উন্নয়নের বয়ান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাক-আধুনিক কালেও ভারতীয় রাজনীতিতে একটা নিয়ম ছিল। সিংহাসনে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান যে রাজাই বসুন না কেন, তাঁরা কিন্তু শুধু নিজেদের প্রাসাদ তৈরি করতেন না। তাঁদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল, প্রজাদের জন্য কূপ খনন ও সেচ প্রকল্প। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান আর উন্নয়নের বাইরে ওই দেশজ বয়ানটা নিয়েও আজ ভাবতে হবে।’
এতক্ষণে একটা ধোঁয়াশা কাটল। উপন্যাসের এক জায়গায় এক ইটালীয় অধ্যাপককে দীননাথ বলেছিল, ‘‘মনসার পাঁচালি-টাচালি ঠিক আছে। কিন্তু আমি আজকের ভারতীয়। কুসংস্কারে, অতিপ্রাকৃত কোনও জিনিসে বিশ্বাস করি না। আই ডোন্ট বিলিভ ইন সুপারস্টিশিয়াস মাম্বোজাম্বো।’’
অধ্যাপক শান্ত স্বরে হাসেন, ‘‘বেশ। তা হলে এত ধর্মীয় শব্দ বলছ কেন?’’
ধর্মীয় শব্দ! দীননাথ হতবাক। অধ্যাপক এ বার জানান, ক্যাথলিকরা যখন লোককে পুড়িয়ে মারত, সেই ইনকুইজ়িশনের সময় কুসংস্কার বা সুপারস্টিশন শব্দটি জনপ্রিয় হয়। বিচারকদের উদ্দেশ্য ছিল, অপরাধীর ভিতর থেকে ‘কুসংস্কার’ মুছে প্রকৃত ধর্মচেতনার উদ্ভাস। ইনকুইজ়িটর বা ধর্মীয় বিচারকই ঠিক করে দিতেন, কোনটা প্রাকৃত, কোনটা ‘অতিপ্রাকৃত’। শব্দের উৎস ও ব্যুৎপত্তি ধরেই লেখক জানিয়ে দেন, ধর্মীয় চেতনার গভীরেই আজকের প্রগতিমুখর শব্দদের উদ্ভব।
বাংলাতেও কি তাই? জায়গাটা পড়তে পড়তে ‘সংস্কার’ শব্দটা নিয়ে অভিধান ঘাঁটতে বাধ্য হলাম। আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যে সংস্কার মানে খারাপ কিছু নয়। জাতকের নামকরণ, অন্নপ্রাশন, সিঁদুরদান, বিবাহ ইত্যাদি দশটি শাস্ত্রীয়কর্মের নাম সংস্কার। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ শব্দটির প্রথম অর্থই বলছেন, প্রতিযন্ত্র; মন্ত্রপ্রোক্ষণাদি দ্বারা শোধন। অতঃপর জীর্ণ দুর্গসংস্কার, মেরামত ইত্যাদি। রাজশেখর বসু আবার ‘চলন্তিকা’য় সমাজসংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কারের অর্থ বলছেন, উৎকর্ষসাধন বা সংশোধন। আরও আধুনিক ‘সংসদ’ অভিধান জাতকর্মের পাশাপাশি শিক্ষাসংস্কার, কুসংস্কার, সমাজসংস্কার, অনেক কিছুই রেখে দিয়েছে।
এখানেই অমিতাভের বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বেআইনি অভিবাসন নিয়ে উপন্যাসেই জানিয়ে দেন, পাশ্চাত্যের সুপারস্টিশন ধর্মীয়। আর বাঙালির সংস্কার বহুমাত্রিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy