Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলা না জানার আক্ষেপ ছিল

নিজে নাটক লেখার সময় ভাষার ভেদ মানতেন না। ওঁর নাটকের গান অনুবাদের ক্ষেত্রে উদার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। গল্পে গল্পে বুঝিয়ে দিতেন নাটকের তত্ত্ব, ইতিহাস, অভিনয়ের বিভিন্ন দিক। গিরিশ কারনাড বিশ্বাস করতেন, শিল্পী হবেন বিশ্বজনীন। সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়

ভূষণ: অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত থেকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার নিচ্ছেন গিরিশ কারনাড। ১৯৯৯ সালের ছবি

ভূষণ: অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত থেকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার নিচ্ছেন গিরিশ কারনাড। ১৯৯৯ সালের ছবি

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৯ ০০:৪২
Share: Save:

নিউ ইয়র্কে পিএইচ ডি শেষ করে, ১৯৯৯ সালে প্রথম পুরোদস্তুর অধ্যাপনার চাকরি পাই, বস্টনের টাফ্‌টস বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। চাকরি শুরু হতে না হতেই আমায় বলা হল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক করতে হবে। এমন কিছু, যা আগে ওই বিভাগে করা হয়নি। বহু কাল আগে, সেই আশির দশকে, কলকাতায় নান্দীকারের জাতীয় নাট্যমেলায় একটি হিন্দি নাটক দেখেছিলাম, যেটা মাথায় গেঁথে ছিল। মঞ্চ প্রযোজনার জন্য ততটা নয়, যতটা তার সাহিত্যগুণের জন্য। শুনেছিলাম, মূল নাটকটা কন্নড় ভাষায় লেখা। নাম ‘হয়বদন’। ত্রিপথগামী প্রেমের এক আশ্চর্য আখ্যান। শরীর, মন ও মননের ত্রিকোণ সংঘাতের নাটক। আদ্যোপান্ত আধুনিক বিষয়, অথচ মঞ্চপ্রয়োগ ভারতীয় (এ ক্ষেত্রে কন্নড় যক্ষগান) আঙ্গিকে বাঁধা। ফলত সাইকোলজিকাল ড্রামা হওয়া সত্ত্বেও, সংলাপ বা অভিনয়শৈলীতে প্রত্যাশিত বাস্তববাদ নিষ্প্রয়োজন। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক আশ্চর্য সমন্বয়। এক দিকে টোমাস মান-এর লেখা ছোটগল্পের অনুপ্রেরণায় নাটকটি থ্রিলারের মতো তরতর এগিয়ে চলে, কিন্তু তারই মধ্যে, ‘কথাসরিৎসাগর’-এর আখ্যানের সূত্র ধরে, স্রোত ভেঙে ঢুকে পড়েন সূত্রধর ও গানের কোরাস, বা উদ্ভট এক ঘোড়ামুখো মানুষের উপাখ্যান, আর সব মিলিয়ে বইতে থাকে দুই বন্ধুর শিরশ্ছেদী আত্মহত্যার পর দৈব-আশীর্বাদে তাদের পুনর্জীবন লাভ ও দৈব-পরিহাসে তাদের মস্তক বিনিময়ের মর্মান্তিক কাহিনি। ১৯৮৯-৯০ নাগাদ, নিউ ইয়র্কে ছাত্রাবস্থায় আলাপ হয়েছিল বি ভি করন্থের সঙ্গে, নাট্যগবেষক সুরেশ অবস্থীর সঙ্গে। তাঁদের কাছেও শুনেছিলাম ‘হয়বদন’-এর নাম। করন্থজির গলায় শুনেছিলাম নাটকটির অসামান্য কয়েকটি গান। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই, নতুন চাকরিতে অন্য ধরনের নাটক করার প্রস্তাব পেতেই মনে পড়ল এই নাটকের কথা। নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ বই-বাজারে সহজলভ্যই ছিল। লেখক ও অনুবাদকের নাম গিরিশ কারনাড।

তাঁর প্রকাশকের মাধ্যমে যোগাযোগের ঠিকানা জোগাড় করে, মঞ্চায়নের অনুমতি নিয়ে, কাজে লেগে পড়লাম। কিন্তু কিছু দূর এগিয়েই মুশকিল। নাটকে অনেকগুলো গান। অথচ তাঁর ইংরেজি অনুবাদে গিরিশ গানগুলি গদ্যরূপে অনুবাদ করেছেন। আমাকেই কলম ধরতে হল। নতুন করে ছন্দে অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম। কন্নড় ভাষা জানা নেই; অতএব, সাহায্য নিলাম শঙ্খ ঘোষের বাংলা অনুবাদের। গানগুলো অনুবাদের পর আমার এক সহকর্মী বললেন যে আইনত, শুধু নাটকটার জন্য নয়, এই গানগুলি অনুবাদের জন্যও লেখকের অনুমতি প্রয়োজন। আবার যোগাযোগ করলাম। ভয়ে ভয়ে, মোটা প্যাকেটের ডাকে পাঠালাম অনূদিত গানের পাণ্ডুলিপি। উত্তর আসে না। এ দিকে রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে, অথচ গানগুলোর কী হবে জানি না। উৎকণ্ঠায় কাটছে দিন, ছাত্রছাত্রীরাও উদগ্রীব। থাকতে না পেরে, নম্বর জোগাড় করে এক দিন ফোনই করে বসলাম ওঁকে (তখন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে যোগাযোগের এত উপায় ছিল না)। জানলাম গিরিশ আমার ডাকযোগে পাঠানো প্যাকেট আদৌ পাননি। কিন্তু গানের প্রসঙ্গ তুলতেই উনি বললেন, “আসলে গানগুলো পদ্যতে অনুবাদ করতে আলসেমি লাগছিল, তাই করিনি!” কারণটা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকল না। বললাম, “আলসেমি? আপনার?” মশকরার খোলস ছাড়িয়ে গিরিশ তখন বললেন, “সংলাপ অনুবাদ করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতের ভাষান্তর হয় কি? সেটা আসলে যে নাটকটা মঞ্চস্থ করবে, তাকে তার মতো করে, তার ভাষার শর্ত মেনে করে নিতে হবে। তোমার অনুবাদগুলো নিয়েই রিহার্সাল শুরু করে দাও। আমি ওগুলো পরে দেখে নেব। সামনের বছর থেকে তিন বছরের জন্য আমি লন্ডনে থাকব। ওই সময় পারলে লন্ডন এস। গানগুলো শুনিও। শুভেচ্ছা রইল।” ব্যস, আর কী! নাটকের কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেলো। গানের সুর করলেন আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু সম্রাট চক্রবর্তী। ছাত্রছাত্রীরাও খাটনিতে কসুর করল না। প্রায় ছ’মাস হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর নামল নাটক, ২০০০ সালের মে মাস নাগাদ। পৃষ্ঠা থেকে মঞ্চে আনার সময় একটা নাটক অনেকটা বদলে যায়, স্থান-কাল-পাত্র বুঝে সে নিজেই বদলে নেয় নিজেকে। এটা সব নাটকের ক্ষেত্রেই হয়। কিন্তু কিছু কিছু নাটক থাকে যা পাল্টে দেয় তার নির্মাতাদের, তার নিজস্ব অন্তর্লীন শক্তির জোরে। যারা নাটকটা করল, সব শেষে এসে তারা নিজেরাও পাল্টে গেল। ‘হয়বদন’ আমার জীবনে সে রকমই একটা নাটক। ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে শুধু নয়, এই নাটকটা করতে গিয়ে যেন দেশজ সংস্কৃতির মাটির সঙ্গে মেলাতে পারলাম প্রবাসের জমিকে। গিরিশ যেন নতুন করে বুঝিয়ে দিলেন, আমরা কেউ আর কখনও কোনও একটি পরিচয়ে নিজেদের অভিহিত বা চিহ্নিত করতে পারব না। নতুন শতকের মানুষেরা হবেন সংস্কৃতিতে, ইতিহাসে, ব্যক্তিজীবনে, সমাজে— সংকর। জাতীয় পরিচয় থাক পাসপোর্টের পাতায় বন্দি হয়ে।

নাটক নামার কয়েক মাসের মধ্যেই লন্ডন যেতে হল কাজে। গিয়ে কথামতো যোগাযোগ করলাম গিরিশের সঙ্গে। উনি তখন ব্রিটেনে ভারতীয় দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, নেহরু সেন্টার-এর পরিচালক। দেখা করলাম। আমাদের মার্কিন ‘হয়বদন’-এর ভিডিয়ো ক্যাসেট দিলাম, সঙ্গে গানগুলোর সিডি। ভিডিয়োটা পরে দেখবেন বলে সরিয়ে রাখলেন, কিন্তু গানের সিডিটা তৎক্ষণাৎ বসিয়ে দিলেন প্লেয়ারে। মন দিয়ে শুনতে লাগলেন। দু-তিনটে গান শুনে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। আমি ভাবলাম, এই রে! কিন্তু পরমুহূর্তেই এক গাল হেসে বললেন, “বেশ হয়েছে তো! এই সম্রাট ছেলেটি তো দুই বিশ্বের ছেলে দেখছি। ভারতীয় সঙ্গীত আর পশ্চিমের হারমনি, দুই-ই বোঝে। আর তোমার অনুবাদও তাই। এটাই আমাদের হওয়া উচিত। বিশ্বজনীন।” প্রযোজনার কিছু ছবিও দেখালাম। গিরিশ আমাকে একটা বই উপহার দিলেন। ওঁর লেখা ‘অগ্নি-বর্ষা’ নাটকের ইংরেজি তরজমা। জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি লেখো ‘সুদীপ্ত’, অথচ উচ্চারণ করো ‘শু-দীপ্ত’, কেন?” আমি হেসে বললাম, “ওটা বাংলা ভাষার একটা প্রচলনসিদ্ধ ব্যাপার।” “হুঁ… বাংলাটা শিখে নিতে পারলে বেশ হত। তোমাদের নাটকগুলো অরিজিনাল ভাষায় পড়তে পারতাম।”

আমার ঋণস্বীকার পর্ব শেষ করেই ওঁর সঙ্গে পরের কাজের প্রসঙ্গ টেনে আনলাম। আমি সেই সময়ে ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র নিয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে পরিকল্পিত একটি প্রজেক্টের সাথে যুক্ত, যাতে ভারতীয় থিয়েটারের দিকপালদের বক্তব্যের ভিডিয়ো থাকবে। তাঁদের মধ্যে গিরিশের বক্তব্য থাকলে কাজটার মূল্য বাড়বে। উনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। ইন্টারভিউ হল। বিদায়বেলায় আমার ফোন নম্বর নিলেন।

সেই সময়ে কখনও লন্ডনে এলে থাকতাম আমার কলেজ-বান্ধবী, গান-কারিগর মৌসুমী ভৌমিকের বাড়িতে। সে বারও তাই থাকছি। পর দিন সকালে হঠাৎ ঝিমলি (মৌসুমীর ডাকনাম) আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে, সামান্য ভুরু তুলে বলল, “এই নে, গিরিশ কারনাড তোকে ফোন করেছেন।” আমি অবাক হয়ে ফোন ধরতেই গিরিশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “লন্ডনে এসেছ, থিয়েটার দেখো না?” আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বললাম, “দেখতে তো চাই, কিন্তু টিকিটের বড্ড দাম যে।” “ঠিক আছে, আজ সন্ধেয় চলো আমরা হ্যারল্ড পিন্টারের ‘কেয়ারটেকার’ দেখতে যাব। মাইকেল গ্যাম্বন অভিনয় করছেন।” এ সুযোগ কেউ ছাড়ে? গেলাম। পৌঁছে দেখি উনি আমার আগেই চলে এসেছেন। ঘড়িতে দেখলাম, আমি তিন মিনিট লেট। গিরিশ হালকা হেসে বললেন, “ব্রিটিশদের কাছে এটা কিন্তু সত্যিই শেখার— সময়ানুবর্তিতা।” লজ্জা পেলাম। তার পর নাটক দেখলাম। বেরিয়ে এসেই গিরিশ প্রবল উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, “এই লোকটার নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত।” হ্যারল্ড পিন্টারের নোবেল পুরস্কার পেতে তখনও পাঁচ বছর বাকি। “কিন্তু নাট্যকারদের তো সাধারণত নোবেলযোগ্য মনে করা হয় না, দু-একজন বাদে— ও’নিল, ওলে সোয়িঙ্কা…। অথচ দেখো, নাটকটা কী ভাবে বৃশ্চিকের মতো নিজেরই বিষয়বস্তুটাকে আক্রমণ করছে! এই যে তিনটে লোক নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে, অথচ তারই মধ্যে একে অপরকে ভালবাসছে, দয়া দেখাচ্ছে, হাসছে, বিদ্রুপ করছে, আবার পরমুহূর্তেই আক্রমণ করছে, ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে— এতেই তো নাটকটা আমাদের সবার ঘরের গল্প হয়ে উঠছে। আর প্রত্যেক অভিনেতা চরিত্রগুলোকে গুলে খেয়ে, মঞ্চে এসে শুধু ‘বিহেভ’ করছে। অভিনয় যেন আর অভিনয়ই নয়। এই নেই-কিন্তু-আছে ব্যাপারটাই আসলে ভাল অভিনয়ের, ভাল শিল্পের শেষ কথা।”

সে দিনই অবশ্য শেষ নয়। সে বারের লন্ডন-সফরে আরও বেশ কয়েকটা নাটক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন গিরিশ। ব্রেশ্‌ট, শেক্সপিয়ার, বেকেট। আর প্রত্যেকটা নাটক দেখে বেরিয়ে কোনও না কোনও পাব-এ গিয়ে বিয়ার-সহযোগে প্রগাঢ় নাট্যালাপ। নাটকের থিয়োরি, ইতিহাস, নাটক লেখার প্রণালী, কেন ওঁর নাটক লিখতে বেশি সময় লাগে, অভিনয়ের বিভিন্ন দিক, ভিন্ন দেশের ভিন্ন রুচির নিরিখে পারফরমেন্স, আন্তর্জাতিকতা, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মিলমিশ ও তার নিরিখে থিয়েটারের বিবর্তন, এই সব। এমনই এক আড্ডায় জানলাম, গিরিশ নাকি নাটক লেখার সময় ভাষার ভেদ মানেন না। তাঁর জানা যে ভাষায় যখন যে সংলাপ বা মঞ্চবর্ণনা তাঁর মাথায় আসছে, সেটা তিনি সেই ভাষাতেই লিখে ফেলেন। পরে, পুরোটা লেখা শেষ হয়ে গেলে, নিজেই সেই ভাষাগুলিতে নাটকটিকে আলাদা আলাদা করে পুনর্লিখন করে ফেলেন। অর্থাৎ, এই অভিনব লেখার পদ্ধতিতে, মূল ভাষায় লেখা (ওঁর ক্ষেত্রে কন্নড়) নাটকটার পাশাপাশি তার অনুবাদও প্রায় একসঙ্গেই তৈরি হয়ে যায়। “এ ভাবে লিখলে নাটকটা খুব দ্রুত এক সঙ্গে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। নাটকের কাজই তো তাই।”

প্রতিদিন রাতে নাটক দেখে ফেরার পথে লন্ডনের টিউবে বসে ভাবতাম, গিরিশ কেন আমাকে এত অকৃপণ ভাবে তাঁর সান্নিধ্যে আসতে দিচ্ছেন। অনেক ভেবেও এর উত্তর খুঁজে না পেয়ে, অবশেষে আমার চলে যাবার আগের দিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “হোয়াই মি?” গিরিশ বললেন, “হোয়াই নট? একটা সময় ছিল যখন এই দেশে থাকাকালীন আমি অনেক নাটক দেখতে চেয়েও দেখতে পারিনি, স্রেফ পয়সা ছিল না বলে। আজ পারি। তাই সেই আনন্দটা ভাগ করে নিতে মন চায় তাদের সঙ্গে, যারা চাইলেই গিয়ে নাটক দেখে আসতে পারছে না, অথচ নাটক নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছে, লিখছে, গবেষণা করছে।” আমি হতবাক। এমনও হয়? গিরিশ বলে চলেছেন, “আমার আগ্রহ ছিল নাটকে, কিন্তু রোডস স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেছিলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। থিয়েটার নিয়ে পড়ার সাহস ছিল না বোধহয়। কিন্তু তোমাদের প্রজন্ম সেই সাহস দেখাচ্ছে। আমার কর্তব্য সেটাকে আমার সীমিত সাধ্য দিয়ে অনুপ্রাণিত করা। তোমরা দেখো, শেখো, বড় হও, নিজেদের মতো করে তোমাদের সময়ের নাটক লেখো, করো।” এর পর বহুক্ষণ আমি চোখ তুলে ওঁর দিকে চাইতে পারিনি, পাছে আমার চোখের চিকচিক ধরা পড়ে যায়।

তার পরে, উনি নেহরু সেন্টারে থাকাকালীন, আর এক বার লন্ডন গিয়েছিলাম। সে বার আর ওঁর সঙ্গী-দর্শক হতে পারিনি, কিন্তু দেখা করেছিলাম। একগাল হেসে বলেছিলেন, “পিন্টারের ‘কেয়ারটেকার’ মনে আছে তো?” “হ্যাঁ, তিনটে মানুষ হারিয়ে গেছে।” “হারাচ্ছে, খুঁজে পাচ্ছে, আবার হারাচ্ছে…।”

২০০৮ সালে— আমি তখন ইংল্যান্ড-নিবাসী— আবার দেখা পেলাম গিরিশ কারনাডের। একজ়িটার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কনফারেন্সে গেছি, সেখানে মূল বক্তা গিরিশ। অনেক দিন পর দেখা। পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আজ আমি বক্তৃতায় কিছু কথা বলব যা হয়তো তোমার ভাল লাগবে না। তুমি কিন্তু সেটা পার্সোনালি নেবে না, ঠিক আছে?” আমি খানিকটা অবাক হয়ে একটু চালাকি করে জবাব দিলাম, “আগে শুনি তো!” ভুরু কুঁচকে, ওঁর আয়ত চোখের সমস্ত মমতা ঢেলে দিয়ে বললেন, “আট বছরে অনেকটা বড় হয়ে গেছ!” বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ভারত ও ব্রিটেনের নাট্য-সম্পর্ক’। সে দিনের বক্তৃতায় অনেক কথা বলেছিলেন। বক্তা সুবক্তা হলে শ্রোতা মুগ্ধ হয়েই শোনে। আমিও শুনছিলাম। হঠাৎ, বক্তৃতার শেষ দিকে একটা কথায় একটু বেসুর বাজল। ঠিক বাক্যটি আজ আর মনে নেই, কিন্তু গিরিশ যেন কিছুটা অবজ্ঞার স্বরেই বললেন, “উনিশ শতকের ভারতীয় নাটকে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা গৌণ। ওঁর নাটক সে সময়ে দেশের মানুষ দেখেনইনি, বোঝা দূরে থাক। পেশাদাররা তাঁর নাটক সে সময়ে ছুঁয়েও দেখতেন না। আসলে বড় কবিমাত্রই যে বড় নাট্যকার হবেন তার তো কোনও মানে নেই। রবীন্দ্রনাথের নাটকের যে অনুবাদগুলো অবাঙালিরা পড়েন, তার ভিত্তিতে অন্তত রবীন্দ্রনাথের নাটককে আমি উচ্চাসনে বসাতে পারব না।”

প্রথমে রাগ হল। তার পর হঠাৎ মনে পড়ে গেল আট বছর আগে গিরিশের খেদোক্তি, “বাংলাটা শিখে নিতে পারলে বেশ হত। তোমাদের নাটকগুলো অরিজিনাল ভাষায় পড়তে পারতাম।” নিলেই পারতেন। তা হলে শুধু পিন্টার, শেক্সপিয়ার, ব্রেশ্‌ট, বেকেটকেই নয়, রবীন্দ্রনাথকেও পেতেন। কিন্তু এক জন্মে আর কত করা যায়? তবে, বাংলা না শিখেও, নিজের জানা ভাষাগুলিতেই তো আরও কয়েকটা নাটক লিখে গেলে পারতেন, গিরিশ!

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Girish Karnad নাটক Drama Induian Drama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy