ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ
আপনি নিজেকে বেশ জ্ঞানী মনে করেন, তাই না?’’ চমকে মুখ তুলে তাকালেন প্রিন্সিপাল অমিতেশ সরকার। কপালে ভাঁজ।
সামনে, কতকগুলো চেয়ার দখল করে বসে বেশ কয়েকটি ছেলে। এবং তাদের মধ্যে এক জন মধ্যবয়সি। প্রশ্নটা তার মুখ থেকে এসেছে।
এর মধ্যে কখন যেন এসে বসেছেন বাংলা, ইতিহাস, ভূগোলের অধ্যাপকরা। অধ্যক্ষের ঘরে তাঁর অনুমতি ছাড়া কলেজের অধ্যাপকেরা ঢুকে এসেছেন, এমন তো এক বছরের চাকরি জীবনে কোনও দিন হয়নি! ঠান্ডা মাথায় অমিতেশ বললেন, ‘‘জ্ঞানের দাবি আমার নেই। আমি জ্ঞানের অনুরাগী মাত্র।’’
বাংলার অধ্যাপক নিখিল শূর একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘‘আপনি নাকি ছাত্রছাত্রীদের বলেছেন সব কিছুকে সন্দেহ করতে? এটা নিয়ে কলেজে হইচই পড়ে গিয়েছে। কলেজ অশান্ত। যে কোনও মুহূর্তে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে।’’
‘‘এ ভাবে ব্যাপারটাকে প্রেজ়েন্ট করবেন না নিখিলবাবু। আমি বলেছি সন্দেহ থেকে প্রশ্নের শুরু, প্রশ্ন থেকে দর্শনের শুরু। যে কোনও জ্ঞানপ্রার্থীকে শুরু করতে হয় সংশয় এবং সন্দেহ নিয়ে। মহাশূন্যের ঘূর্ণির ভিতর, অসীম রহস্যের ভিতর দিয়ে এগোতে এগোতে মানুষ প্রথমে প্রশ্ন করেছিল, ‘কে আমি?’ ‘কোথা থেকে এলাম আমি?’ ‘ফিলস’ কথাটির অর্থই হল জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ। আমার সঙ্গে জগৎ ও জীবনের সম্পর্ক কী? সাদা কথায় জীবন-জিজ্ঞাসা। জীবনের অতিরিক্ত কিছু...’’
‘‘আরে রাখেন তো মশাই আপনার দর্শন! মানুষ কি দর্শন ধুয়ে খাবে?’’ বললেন সেই মধ্যবয়সি মানুষটি।
‘‘আপনি?’’
‘‘স্থানীয় নেতা। কলেজটাকে তো আপনার চামচা বানানোর কারখানা বানিয়ে ফেলেছেন। ভাবছেন বেশ ক’টা ডিরোজিয়ো তৈরি করে নেবেন। ও আমরা হতে দেব না। কাদের দালালি করছেন, জানি না ভেবেছেন? ’’
‘‘এই শব্দগুলোর সঙ্গে ঠিক আমার পরিচয় নেই।’’
‘‘এ বার পরিচয় করুন। অনেক দিন ধরে বাড়াবাড়ি করছেন।’’
অমিতেশ চুপচাপ বসে থাকা, দূর গ্রহের জীবের মতো মিটমিট করতে থাকা অধ্যাপকদের দেখলেন। তার পর বললেন, ‘‘বলা নেই, কওয়া নেই, দুম করে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে বলছেন, বাড়াবাড়ি?’’
‘‘হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি। এ রকম হলে কলেজ চালাতে দেব না,’’ হঠাৎই একটি নিতান্ত গোবেচারা ছেলে, অধ্যক্ষকে দাবড়িয়ে কথাটা বলল।
অধ্যক্ষ এ বার কঠোর হলেন, ‘‘এ বার আমাকে আমার অধিকার প্রয়োগ করতে হচ্ছে। জানেন কি, কর্তব্যরত প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে ভয় দেখানো, কলেজে শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গের উস্কানি দেওয়া ইত্যাদির অভিযোগে আমি আপনাদের গ্রেফতার করতে পারি? বাইরে থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বেরিয়ে যেতে বলুন। কলেজে পরীক্ষা চলছে। আপনারা যা যা করছেন সিসি টিভিতে ধরা পড়ছে। আইন মেনে কাজ করুন।’’
ঘর খালি হয়ে গেল। কিন্তু স্থানীয় নেতাটি উঠলেন না।
‘‘আমি কিন্তু চলে যাওয়ার জন্য আসিনি স্যর। আমি এসেছি স্থানীয় মানুষের দাবি নিয়ে।’’
অমিতেশ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বলুন কী বলার আছে আপনার।’’
‘‘লোকাল মাস-এর দুটো ডিমান্ড।’’
‘‘ডিমান্ড ? আমার কাছে ? আমি তো প্রশাসনের কোনও কর্তাব্যক্তি নই, মন্ত্রীও নই!’’
‘‘আগে কথাটা শুনুন। আপনি প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় পঞ্চাশ জনকে ফেল করিয়ে দিয়েছেন। ওদেরকে সেকেন্ড ইয়ারে তুলে দিতে হবে। দুই, কলেজের পুরনো সায়েন্স ল্যাব-এর বিল্ডিং ভেঙে যে নতুন বিল্ডিং হচ্ছে, ওখানে লোকাল ছেলেদের মাল সাপ্লাই এবং কন্সট্রাকশনের কাজের দায়িত্ব দিতে হবে। আপনাকে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। এর মধ্যে আপনার সিদ্ধান্ত জানান। মনে রাখবেন, আমি একা নই। আমার সঙ্গে আছে গোটা এলাকার মানুষ। আছে বলরাম, কাল্লু, ল্যাংড়া, পাপ্পু, পেটো...’’
‘‘এরা কারা?’’
একটা ধূর্ত হাসি দিয়ে নেতা বললেন, ‘‘মশাই কি মঙ্গলগ্রহে থাকেন নাকি? রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানের ছোঁড়াটাকে শুধোবেন, ও বলে দেবে এরা কারা।’’
‘‘আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি আমি কোন সিদ্ধান্ত না নিই?’’
‘‘ঘেরাও হবেন, কলেজে ঢুকতে পারবেন না। গেটে অবরোধ চলবে। কলেজে অচলাবস্থা তৈরি হবে। তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনি।’’
‘‘কত শতাংশ মানুষ আপনার সঙ্গে আছে?’’
‘‘ব্যঙ্গ করছেন?’’
‘‘কত সাল থেকে আপনি এ পাড়ায়?’’
‘‘এ প্রশ্নের জবাব আপনি পাবেন। অপেক্ষা করুন,’’ বেশ জোরের সঙ্গে কথাটি বললেন নেতা।
‘‘দেখুন এলাকার প্রতিটি কোনা হাতের তালুর মতো চিনি। এখানকার অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান আমার প্রত্যক্ষ প্রেরণায় তৈরি হয়েছে। উদ্বোধনও করেছি আমি।’’
‘‘ও সব দিনের কথা ভুলে যান। এখন জমানা বদলে গিয়েছে। পুরনো বুলি কপচে লাভ নেই। আপনাকে আল্টিমেটাম দিয়ে গেলাম। ভেবে দেখবেন।’’
******
পাড়ার মোড়ে চালু চায়ের দোকানটি শিউপূজনের। ল্যাংড়া এক দিন শিউপূজনকে বলল, ‘‘পূজন, এ তেরা পিছেবালা জো খোপরি হ্যায় না, উও মেরে কো
দে দো। ’’
‘‘কিঁউ? মেরা বেডরুম, মেরা পার্সোনাল।’’
‘‘কান খোল কর শুনলো। ও পিছেবালা খোপরি আজসে ‘অ্যাডমিন সেল হোগা। দাদা বোল দিয়া। কালিজসে অ্যাডমিন হোগা, লেড়কা লেড়কি হম সব ইধার লেকে আয়েঙ্গে। ইন্টারভ্যু হোগা। কাল দো সো রোটিয়াঁ বানা দেনা, কামরিড লোক আয়েঙ্গে।” শিউ চুপ করে গেল।
******
অমিতেশ ক্লাস নিচ্ছিলেন।
‘‘এক মহান দার্শনিক একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। আমাদের কারও কারও অবস্থা সেই পাগলটার মতো, যে খালি কৌটো বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিবার ঢাকনা বন্ধ করবার আগে কৌটো বাজিয়ে সে জানান দিতে থাকে, আমি আছি। আমাদেরও অবস্থাটা ঠিক এ রকম। ফুটো পাত্র বাজিয়ে গলাবাজি করছি, স্তাবকেরা আমাদের অনুসরণ করছে। এরা জ্ঞানহীন, মাঝে মাঝেই কৌটো বাজায়। নিজেদের ছবি টাঙিয়ে মহাপুরুষ হয়ে যায়। কিন্তু এরা জানে না, এ ভাবে বেশি দূর এগোন যায় না। তোমাদের জ্ঞান হোক সত্য। কৌটোর আস্ফালন নয়।’’
ক্লাসের মধ্যে টেবিল চাপড়ানোর শব্দ হল। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অস্বস্তি। কিছুটা আলোড়ন।
‘‘আবারও আপনি পলিটিক্স মারাচ্ছেন স্যর।’’
অমিতেশ অন্যমনস্ক হলেন। কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস থেকে।
এ বার দু’দল ছাত্রছাত্রীর মধ্যে তর্কাতর্কি, হাতাহাতি, মারামারি, চেয়ার টেবিল ভাঙা... এমনকি দু’দল দু’দলকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ঢিল, হকি স্টিক, সাইকেলের পরিত্যক্ত চেন যথেচ্ছ ব্যবহার করা হল। কলেজ গেটে বোমা পড়ল। কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।
******
কলেজের গভর্নিং বডি, টিচার্স কাউন্সিলকে নিয়ে জরুরি মিটিং ডাকা হল। মিটিং চলাকালীনই আবারও হুড়মুড়িয়ে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঢুকে পড়লেন স্থানীয় নেতাটি।
প্রিন্সিপাল ধীর গলায় বললেন, “টি সি-র জরুরি মিটিং চলছে। দয়া করে বাইরে অপেক্ষা করুন। আমাদের মিটিং শেষ হলে পিওনকে স্লিপ দেবেন। আমি সই করে দেব। তার পর ঢুকবেন। এটা পার্টি অফিস নয়। হিয়ার আই অ্যাম দি
লাস্ট ওয়ার্ড।”
হঠাৎই বাংলার নিখিলবাবু বলে উঠলেন, ‘‘স্যর একটার পর একটা ঝামেলা পাকিয়ে বসে আছেন। আপনি যদি অবস্থা বুঝে একটু মানিয়ে নিতেন, তা হলে আজ এই অবস্থা হত না।’’
রসায়ন, ভূগোল, ইতিহাস— এঁরাও সমর্থন করে বললেন, পরিবর্তনের নিয়মে নিজেদের পরিবর্তন করে নিতে হয়। না হলে, ঝামেলাগুলো জিইয়ে থাকবে, কোনওটারই সমাধান করতে পারবেন না।’’
“নিখিল, এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এঁদের সামনে নয়।”
‘‘নয় কেন, যা হবে, সবার সামনেই হবে।’’
নেতা আসরে নামলেন, ‘‘রাজার ভাত খাবেন, রাজার বিরুদ্ধে ছুরি শানাবেন? এই যে এঁরা এসেছেন, শিক্ষাপ্রেমী, কলেজের শুভানুধ্যায়ী। এঁরা সব্বাই ডেভেলাপমেন্ট কমিটির মেম্বার।’’
“প্রতিটি মেম্বারকে আমি চিনি, জানি। এঁদেরকে তো কোনও দিন দেখিনি!”
“আগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, আপনি জানেন না?”
‘‘কে ভাঙল? কার অনুমোদনে? কখন এই বেআইনি সিদ্ধান্তটি হল?’’
“আইন দেখাবেন না। আইন আমাদেরও আছে। আগের কমিটির প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ফান্ড তছরুপের মামলা ঝুলছে।”
‘‘কারা এই মামলাটি করল?’’
‘‘এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী এবং দু’জন অভিভাবক।’’
‘‘আমি প্রিন্সিপাল। আমার একটা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব আছে। গভর্নিং বডির কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হয়। সরকারের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেও আছে আমার দায়বদ্ধতা। আমি এখনই রিপোর্ট পাঠাব।’’
‘‘আপনি আর প্রিন্সিপালই থাকছেন না, রিপোর্ট পাঠাবেন কী করে? অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে সই করিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছি। আপনার দুর্গ পড়ল বলে।’’
মিটিংয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা গেল না। হট্টগোলই সার হল।
এ বারও নেতা চাঁছাছোলা গলায় বললেন, ‘‘দেখুন, বেকার ছেলেরা কাজ চায়। কাজ মানে উন্নয়ন। কলেজে যা কিছু কাজ হবে তা ওদের তত্ত্বাবধানে যদি হয়, তা হলে কলেজেরই মঙ্গল। আপনি বাগড়া দেবেন না। আমাদের দরকার আপনার সই।’’
অমিতেশ বললেন, ‘‘এর পরে যিনি নতুন প্রিন্সিপাল আসবেন, তাঁকে দিয়েই সইটা করিয়ে নেবেন।’’
‘‘তার মানে আপনি কিছুতেই সই করবেন না?’’
নেতার কথার মাঝে বলরাম এসে যোগ দিল, “কলেজ চালাতে পারবেন?”
অমিতেশ এক বার বলরামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি?’’
“ছাত্রসংসদের নতুন জেনারেল সেক্রেটারি। সমীহ করে কথা বলুন।”
“ইলেকশন কবে হল?”
“সব জানতে পারবেন।’’
“কালনেমির লঙ্কাভাগ?”
“মানে?”
“তোমার ঘটে ঢুকবে না এটা। কী জন্য তোমার আগমন?”
“আপনি নির্দেশ দিয়েছেন, এ বারেও ছাত্রভর্তি অনলাইনে হবে?”
“এটা শিক্ষা দফতরের নির্দেশ। আমি নিরুপায়।”
‘‘আইন থাকলে আইনের ফাঁকও আছে। হাজার হাজার দুঃস্থ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হতে আসে। ওরা কম্পিউটারের ক’ও জানে না। এ বারের মতো, ফর্ম ফিল-আপ অনলাইনের বদলে অফলাইন করে দিন। না হলে ব্যাপারটা কিচাইন হয়ে যাবে। আমরা ওদের প্রমিস করেছি।”
“আর কিছু?”
“ইস্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিটির জন্য মোটা টাকা দেয় ইউনিভার্সিটি। এর অনেকটাই আপনি ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের পোঁদে ঢুকিয়ে মেরে দিয়েছেন।”
“ভদ্রভাবে কথা বলো।’’
‘‘শুনুন, পুরো ফান্ড আমাদের হাতে চাই। ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হবে, ফেস্ট হবে। আপনি অ্যাকাউন্টকে সে ভাবে নির্দেশ দেবেন। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক নেবেন না। ক্যাশ চাই।”
“আমার ফাইনাল ডিসিশন, অ্যাডমিশন হবে অনলাইন মারফত। আমরা ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করার জন্য একটা সেল বানাচ্ছি।”
“একটা কাজ তো করতে পারেন অর্ধেকটা অনলাইন, অর্ধেকটা অফলাইন? একটু ঢিমে তালে এগোলেন। যখন টাইম শেষ হয়ে আসবে, অথচ অনেক সিট ফাঁকা পড়ে আছে, তখনই এদের দিয়ে দিন, দেখভাল করার জন্য। ব্যস,
আপনার কোনও দায় রইল না।”
“এর জন্য ইউনিভার্সিটির পারমিশন লাগে।”
“ও আমরা ম্যানেজ করে নেব।”
“তার মানে আমি শুধু শিখণ্ডী হয়ে সই করে যাব?”
“এইটেই আজকের দিনে বাঁচার মন্ত্র।”
“আমি যে এই মন্ত্রে দীক্ষিত নই!”
বলরাম বলল, “আপনি ইস্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিটির টাকাটা আটকে রেখেছেন?”
‘‘স্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিটির মানে কলেজ সোশ্যালে উদ্দাম উলঙ্গ অ্যাক্টিভিটি, মানে নাচানাচির সঙ্গে টাকা ছোড়াছুড়ি, সহপাঠিনীদের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ? সুস্থ সাংস্কৃতিক কাজকর্মের খসড়া দাও। একটা এক্সপার্ট প্যানেল সেটা অনুমোদন করবে, টাকা পেয়ে যাবে।”
“কলেজ সোশ্যাল, না সধবার একাদশী?”
“তোমরাই ঠিক করো।”
******
ঘরে ঢুকে নিজের আলমারি খুলে অবাক হলেন অমিতেশ। মনে হল তাঁর অজান্তে কেউ আলমারি খুলে সব কিছু ঘেঁটেছে। স্ট্রেঞ্জ! চাবি তো তাঁর পকেটে। এত দিনের চাকরি জীবনে এ রকম একটি অস্বস্তিকর ঘটনার মুখোমুখি হননি তিনি। পাল্লা খুলতেই ঝপঝপ করে পড়তে শুরু করল রেকমেন্ডেশনের চিঠি। নির্দেশ মন্ত্রীর প্যাডে। এগুলির জন্য তিনি তো কিছু পাঠাননি! তা হলে কী?
দরজার ফাঁকে একটি ফুটফুটে মেয়ের মুখ। স্ট্রেঞ্জ, মেয়েটি জানল কী করে তিনি রবিবারেও কলেজে আছেন? মেয়েটি চেম্বারে ঢুকল। কুণ্ঠিত মুখ। মেয়েটিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বলো তোমার জন্য কী করতে পারি?’’
‘‘স্যর, আমি অনলাইনে ফর্ম ফিল-আপ করেছি। সিলেক্টেডও হয়েছি। লিস্টে আমার নামও উঠেছে। অথচ কলেজে ঢুকতেই এক দল আমাকে ঘিরে ধরে, শাসিয়ে বললেন, ভর্তি হতে গেলে তাদের
ইউনিয়নে জয়েন করতেই হবে। নগদ তিরিশ হাজার টাকা দিতে হবে।
তবে এখানে নয়, কে এক জন শিউপূজন আছে, তার লন্ড্রিতে টাকাটা দিয়ে আসতে হবে। আর যদি না দিই, পুলিশে জানাই, তা হলে রেপ করিয়ে দেবে।’’
মেয়েটি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। অমিতেশ চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। মেয়েটির কাছে গিয়ে সস্নেহে তার মাথায় হাত রাখলেন। কোথায় যেন একটা ক্লিক শব্দ হল।
‘‘বিশ্বাস রাখো নিজের উপর। বাড়ি যাও, কলেজে ক্লাস শুরু হলে চলে এস। নোটিস বোর্ডটা দেখে যেও। কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’’
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে প্রণাম করল।
সেই মুহূর্তে এক দল লোক ঢুকে এল ঘরে। অধ্যক্ষ তাদেরকে চেনেন না। দেখে একটু অবাকই হলেন।
‘‘বাহ্! কলেজে ছুটির দিনে, প্রিন্সিপাল মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করছে... আবার বাছুরের মোতার মতো ছরছর করে সততার বুলি আওড়াচ্ছে?’’
‘‘মুখ সামলে কথা বল,’’ গর্জে উঠলেন অধ্যক্ষ।
‘‘বেশ, নাহয় তাই করলাম। কিন্তু আমার ক্যামেরাটা তো থেমে থাকবে না স্যর! ডাউনলোড হবে, পাঁচশো কপি প্রিন্ট হবে, চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। আপনার বৌয়ের কাছে যাবে কপি, মেয়ের কাছে, চিফ মিনিস্টারের কাছে...’’
‘‘না! প্লিজ এটা করবেন না!’’
‘‘এই তো, পথে এস বাবা যুধিষ্ঠির। তা হলে সই করবে, বলুন আমাদের প্রস্তাবে রাজি?’’
থমকে দাঁড়ালেন অমিতেশ। ইতিহাস জুড়ে তার মাথা। মাথা ক্রমশ উঁচু হতে লাগল, আরও উঁচু। তিনি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎকে কাঁপিয়ে দিয়ে বললেন, “না!”
‘‘আচ্ছা! হ্যাঁ করাতে বেশি ক্ষণ লাগবে না, বুঝেছ শুড্ডা!’’
‘‘এই, উঠাকে লে চল্ ...’’
******
কোথায় তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে কিছুই জানেন না অমিতেশ। এখন কি দিন না রাত? দূর থেকে মানুষজনের শব্দ ভেসে আসছে। দরজা বন্ধ।
দরজা খোলার শব্দ হল। কেউ এক জন ঢুকলেন।
‘‘অধ্যাপক, নীতি খুব সহজ কিন্তু রাজনীতি খুব কঠিন। আপনি টিকে থাকতে পারবেন, যদি দু’টোকে ভাল করে ককটেল বানিয়ে নিতে পারেন।’’
‘‘আপনি কে? ক্রিটো, অ্যানিটাস, মালিটাস?’’ ঘোরে বলে উঠলেন অমিতেশ।
‘‘যা ব্বাবা! এরা আবার কোন মাল?’’
‘‘এরা সব আমার বিচারক। আমার শেষ পরিণামের দর্শক। আচ্ছা, প্লেটো কোথায়, প্লেটো?’’
‘‘এ তো ভুল বকছে রে! কে প্লেটো? কোন পার্টির? ধুসস! ’’
এ ভাবে সময় টিকটিক করে এগোতে এগোতে শতাব্দী পার করে দিল। অমিতেশ হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘বোর হয়ে যাচ্ছি। আমাকে নিয়ে কিছু একটা করো তোমরা? আরে তোমরা সব ঢুলছ কেন? ওঠো, জাগো, অ্যাকশন করো! ডু সামথিং!’’
‘‘একদম চুপ! এর পর আপনি ছবি হয়ে যাবেন। সবাই মালা দেবে আপনাকে।’’
******
রাত বেড়েই চলল। অনেক অনেক অন্ধকার এসে জড়ো হল। কারা যেন ফিসফিস করে কিছু বলছে। কারা দাঁড়িয়ে আছে ও দিকে ?
অমিতেশের হাত-পা বাঁধা। পা ভারী হয়ে আসছে। আর বুঝি পারছেন না। অমিতেশের মনে হল, কেউ যেন কাঁদছে।
‘‘কাঁদছ কেন অ্যাপোলোডোরাস?’’ টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন অমিতেশ। যে দিক থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছিল সে দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “বন্ধু, তুমি তো এ সব ব্যাপারে দক্ষ। বলে দাও কী ভাবে এগোতে হবে?”
অমিতেশ যেন শুনতে পেলেন তাঁকে কেউ ফিসফিস করে
বলছে, “পান করা হয়ে গেলে তুমি ঘরময় পায়চারি করতে থাকবে। পা যখন ভারী হয়ে আসবে, তখন শুয়ে পড়বে।’’
অমিতেশ শুয়ে পড়লেন না। ধীরে ধীরে ক্রিটো, মালিটাস-এর ছায়া মাড়িয়ে হেঁটে যেতে লাগলেন আগামীকালের দিকে। তাঁর
পিছনে তখন হেঁটে চলেছেন অসহায় প্লেটো, ‘‘স্যর, কিছু বলুন... স্যর?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy