নাট্যব্যক্তিত্ব: শিশিরকুমার ভাদুড়ী সাফল্য পেয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণেও।
শিশিরকুমার ভাদুড়ি একাধারে নট, নাট্যাচার্য, প্রয়োগকর্তা। এঁর এই পরিচয়ই আমরা জানি। এখনও তিনি প্রাসঙ্গিক নাটক-সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনায়। কিন্তু তিনি যে এক জন চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতাও ছিলেন, সে বিষয়ে আমাদের জানাশোনা নেহাতই সীমিত। ১৯২১ সালের শেষে ম্যাডান কোম্পানিতে ‘আলমগীর’ অভিনয় দিয়ে শিশিরকুমারের সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রবেশ। ‘আলমগীর’-এর সাফল্যে ম্যাডান কোম্পানির মালিক জামশেদজি ম্যাডান শিশিরকুমারকে চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই ম্যাডান কোম্পানিই প্রথম নির্বাক কাহিনিচিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ (১৯১৯) আর প্রথম বাংলা সবাক ছবি ‘জামাইষষ্ঠী’র (১৯৩১) নির্মাতা। টালিগঞ্জ অঞ্চলে যেখানে ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো, সেখানেই ম্যাডানদের স্টুডিয়োতে শিশিরকুমার দুটো নির্বাক ছবি পরিচালনা করেন, ‘মোহিনী’ আর ‘একাদশী’। প্রধান অভিনেতাও ছিলেন তিনি। ১৯২২ সালের ২ সেপ্টেম্বর কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে সেই ছবি মুক্তি পায়। পরে ম্যাডানদের হয়ে ‘কমলে কামিনী’ বলে আরও একটা নির্বাক ছবি পরিচালনা করেন যা ১৯২৪-এ মুক্তি পায়।
শিশিরকুমার যখন ছবি পরিচালনা করছেন সে সময়ে বিদ্যুৎ সহজলভ্য ছিল না। সেট তৈরি করে ইন্ডোর শুটিং হত। দিনের আলো থাকতে থাকতে শেষ করতে হত শুটিং। যে কারণে অল্প কিছু সময়ের মধ্যে ম্যাডানদের থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে নিজের নাটকের দল করেছিলেন, ম্যাডানদের চলচ্চিত্র কোম্পানির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক একই কারণে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
ক্যামেরাম্যান ননী স্যান্যাল, নটশেখর নরেশচন্দ্র মিত্রকে নিয়ে শিশিরকুমার তৈরি করলেন তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি। এর স্টুডিয়ো তৈরি হল দমদম রোড আর নাগেরবাজার রোডের সংযোগস্থলে। প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন ব্যারিস্টার বি কে ঘোষ। তৈরি হল সিনেমায় পুরোপুরি বাঙালি প্রতিষ্ঠান। বাঙালি প্রতিষ্ঠানের আবেগে অনেকেই ম্যাডানদের চাকরি ছেড়ে তাজমহল ফিল্ম কোম্পানিতে যোগ দিলেন। ম্যাডানদের সিনেমায় টাইটেল লিখতেন দুর্গাদাস। তিনিও যোগ দিলেন তাজমহল কোম্পানিতে। এই দুর্গাদাসই পরবর্তী কালের বিখ্যাত অভিনেতা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাজমহল ফিল্ম কোম্পানির প্রথম ছবি শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারে আলো’। শিশিরকুমারের উপর পরিচালনার দায়িত্ব। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র, যোগেশ চৌধুরী, দুর্গারাণী। এই ছবিতে একটা ছোট ভূমিকা ছিল দুর্গাদাসেরও। শিশিরকুমারের উপর পরিচালনার দায়িত্ব থাকলেও পর্দায় পরিচালক হিসেবে নাম ছিল শিশিরকুমার আর নরেশ মিত্রের। আসলে একটা দুর্ঘটনার কারণে ছবির প্রথমার্ধের পর শিশিরকুমার আর পরিচালনা করতে পারেননি, ফলে শেষটুকু নরেশ মিত্র পরিচালনা করেন। তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি শুরুতে একটা বাসে করে আর্টিস্ট আর টেকনিশিয়ানদের স্টুডিয়োতে নিয়ে আসত, আবার দিনশেষে পৌঁছে দিত সেই বাসে করে। ‘আঁধারে আলো’-র শুটিং যখন মধ্যপথে, তখন বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে। শিশিরকুমার যথেষ্ট আঘাত পেয়ে কিছু দিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। ‘আঁধারে আলো’ ছিল প্রথম কোনও শরৎ-কাহিনির চিত্ররূপ। অন্যান্য চিত্রনির্মাতা যখন পৌরাণিক কাহিনি, সামাজিক প্রহসন নিয়ে ব্যস্ত, শিশিরকুমার অনুভব করেছিলেন— শরৎচন্দ্রের কাহিনির জনপ্রিয়তা আর সাহিত্যগুণকে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসা প্রয়োজন। মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শিশিরকুমার নিজে, নরেশ মিত্র, দুর্গারাণী। ছবিটি ১৯২২ সালে রসা থিয়েটারে মুক্তি পায়।
শিশিরকুমার ১৯২৯ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পের চিত্ররূপ দিয়েছিলেন। ইস্টার্ন ফিল্ম সিন্ডিকেট এটি প্রযোজনা করে। অভিনয় করেছিলেন শিশিরকুমার, বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, যোগেশ চৌধুরী, কঙ্কাবতী, শেফালিকা ও আরও অনেকে। অভিনেতাদের সকলেই ছিলেন শিশিরকুমারের নাট্যদলের সদস্য। ছবিখানি প্রথমে সেন্সর বোর্ড অশ্লীলতার কারণ দেখিয়ে আটকে দিয়েছিল। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯৩২ সালে লিবার্টি সিনেমায় মুক্তি পায়।
১৯৩১ সালে নির্বাক ছবি প্রথম সবাক হল। নির্বাক যুগের চলচ্চিত্রের আধিপত্য মূলত ছিল ম্যাডানদের হাতে। সবাক যুগে সেই আধিপত্য এল নিউ থিয়েটার্স-এর হাতে, যত দিন না সত্যজিৎ রায় এলেন। ১৯২৭ সাল নাগাদ পৃথিবীর নানা দেশে নির্বাক চলচ্চিত্র ক্রমশ মুখর হতে শুরু করলে, নিউ থিয়েটার্স-এর ধীরেন্দ্রনাথ সরকার ১৯৩০ সাল নাগাদ সবাক ছবি তৈরির উপযোগী স্টুডিয়ো নির্মাণ শুরু করেন। প্রথমেই তিনি ছবি তৈরির জন্য প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, দেবকী বসুর সঙ্গে শিশিরকুমারকেও আহ্বান করেন। এই সবাক পর্বে শিশিরকুমার বেশ কিছু ছবি পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালিত ও অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে ‘পল্লীসমাজ’, ‘সীতা’, ‘টকী অব টকীজ’, ‘চাণক্য’, ‘পোষ্যপুত্র’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৩২ সালের ১ জুলাই নিউ থিয়েটার্স-এর সবাক ছবি শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’ মুক্তি পায়। এর চিত্রনাট্য, পরিচালনা দুই-ই শিশিরকুমারের। অভিনয় করেছিলেন মূলত তাঁরই সম্প্রদায়ের অভিনেতা-অভিনেত্রী। ১৯৩৩ সালে শিশিরকুমার তাঁর বহুপ্রশংসিত মঞ্চনাটক ‘সীতা’ চলচ্চিত্রায়িত করেন। সঙ্গীত পরিচালনায় বিষাণচাঁদ বড়াল, সম্পাদনায় সুবোধ মিত্র। ২৮ অক্টোবর চিত্রা আর নিউ সিনেমায় এটি মুক্তি পায়।
এর পর সে যুগের আর এক বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান কালী ফিল্মস প্রযোজনা করে শিশিরকুমারের আর এক মঞ্চসফল নাটক ‘রীতিমত নাটক’-এর চলচ্চিত্র রূপ ‘টকী অব টকীজ’। ছবিটি ১৯৩৭-এর জানুয়ারিতে শ্রী সিনেমায় মুক্তি পায়। এর পরের ছবি চাণক্য, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মঞ্চখ্যাত ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের চলচ্চিত্ররূপ। ছবিটি ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। নিজের পরিচালনার বাইরেও তিনি বেশ কিছু ছবিতে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায়। এর মধ্যে ভ্যারাইটি পিকচার্স-এর প্রযোজনায় সতীশ দাশগুপ্তের পরিচালনায় অনুরূপা দেবীর ‘পোষ্যপুত্র’ উল্লেখযোগ্য।
চলচ্চিত্রের এই শিশিরকুমারকে আমরা মনে রাখিনি। কারণ হয়তো, ছবিগুলির কোনওটাই এখন আর পাওয়া যায় না, একমাত্র ‘টকী অব টকীজ’ ছাড়া। এগুলো সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তা সেই সময়ের পত্রপত্রিকার আলোচনা থেকে। এই আলোচনাগুলোয় শিশিরকুমারের অভিনয়ের প্রভূত প্রশংসা হলেও, সমকালীন অন্যান্য অনেক ছবির চেয়ে ভাল হয়েছে বলা হলেও, আদতে এই সব ছবিই ছিল মঞ্চ-প্রযোজনার আদলে গড়া। শিশিরকুমারের সহ-অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সম্পর্কেও তখনকার পত্রপত্রিকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। যে হেতু চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, চলচ্চিত্রের কোনও নিজস্ব ভাষা তখনও এখানে তৈরি হয়নি, তাই মঞ্চের টেকনিকই তিনি প্রয়োগ করেছিলেন চলচ্চিত্রে। মঞ্চভাবনার বাইরে গিয়ে চলচ্চিত্রের প্রয়োগ আলাদা করে তিনি ভাবতে চাননি বা পারেননি। হাতের কাছে তেমন কোনও উদাহরণ না থাকায় প্রয়োজকরাও তাঁকে দিয়ে চলচ্চিত্রায়িত করাতে চেয়েছিলেন মঞ্চসফল প্রযোজনাগুলিকেই। ক্রমশ চলচ্চিত্র তার নিজস্ব ভাষা খুঁজে পেলে এই ছবিগুলো তাই আবেদনহীন হয়ে পড়ে দর্শকের কাছে। কিন্তু প্রথম পুরোধা হিসেবে তাঁর কাছে বাংলা সিনেমার ঋণ তাতে কমে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy