ছবি: প্রত্যয়ভাস্বর জানা
ভরা শ্রাবণেও শিলাবতীতে খরা। বুকে তার এক ফোঁটা জল নেই। একেবারে শুকনো খটখটে। যত দূর চোখ যায় শুধুই ধু-ধু সাদা বালুকারাশি। না, এমন বন্ধ্যাদশা শিলাবতীর এর আগে কখনও হয়েছে বলে মনে করতে পারল না রাধানাথ। তার আশি বছরের জীবনে অন্তত এমনটা দেখেনি। দু’চার বার জল যে শুকিয়ে যায়নি তা নয়। তবে সেটা হয়েছে প্রখর গ্রীষ্মে। তাও দু’চার দিনের জন্য। বৃষ্টি হওয়া মাত্রই আবার জলে ভরে উঠেছে শিলাবতী। তা বলে শ্রাবণেও শিলাবতীতে জল বইবে না! এটা যেন সব হিসাব-নিকাশের বাইরে, চিন্তা-ভাবনার বাইরে। এত দিন পর্যন্ত রাধানাথ দেখে এসেছে শ্রাবণের শিলাবতী মানেই জলে থইথই, ভরাট প্রাণবন্ত তার রূপ। নৌকা ছাড়া পারাপারের কোনও ব্যাপারই নেই।
শিলাবতীর বুকে জল নেই। ঘাটের নৌকাগুলোর কাছি এবার খুলতে হল না। বছরভর জল-রোদ খেয়ে খেয়ে তাদের চোকলা উঠতে শুরু করেছে। নদীটারই বা কী দোষ। সারা বছর তেমন বৃষ্টিই হল না, নদীর বুকে জল আসবে কোত্থেকে? তেঁতুলতলার মোড়ে পাড়ার ছেলেগুলো সে দিন বলাবলি করছিল, আয়লার ঝড়টা এসে নাকি আবহাওয়ার একটা অভিমুখ বদলে দিয়ে গিয়েছে। এ অঞ্চলটায় নাকি আর তেমন বৃষ্টিপাত হবে না। রাধানাথ শিউরে উঠে। আতঙ্কের একটা ঢেউ খেলে যায় তার মনের ভিতরে। বৃষ্টি না হলে তো সর্বনাশ! নদীতে জল আসবে না। গাঁয়ের পাশে নদী, অথচ তাতে জল থাকবে না— এ কেমন কথা!
একটা বছর নদীতে জল নেই, তাতেই গাঁয়ের মানুষগুলোর কী অবর্ণনীয় কষ্ট, দুর্দশা, তা তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে রাধানাথ। চাষিরা চাষের খেতে জল দিতে পারছে না। জলের অভাবে সোনার ফসল শুকিয়ে মরে একসা হচ্ছে। মাঠের কাজকর্ম সেরে দুপুরবেলায় শিলাবতীর সুশীতল জলে মাথা ডুবিয়ে তবেই ঘরে ফেরে চাষির দল। এ বার মাথা ডুবানো তো দূরের কথা, পায়ের চেটো ভেজানোর মতো জল নেই। নদীর ধারে বাস করেও জলের জন্য এমন হাহাকার কস্মিনকালেও দেখেনি রাধানাথ।
জলের অভাবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে ঘরের মেয়েদের। গাঁয়ের মেয়েদের কাছে নদীটা হল সই। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে এই চিরকালের বন্ধুকে ঘিরে। মেয়েরা দল বেঁধে নদীতে যায়। প্রাণ ভরে স্নান করে। জলকেলিতে মেতে ওঠে। তার পর কলসি ভরে জল এনে রান্না চড়ায়। মেয়ে-বউদের কাঁখে এ বার কলসি দেখতে পাচ্ছে না রাধানাথ। কাপড় কাচার অসুবিধা। ময়লা জামাকাপড় যে কাচবে তার উপায় নেই। শুরু হয়েছে পানীয় জলের সমস্যাও।
রাধানাথ সে দিন শুনল, তার বড় বউমা নাতিকে ধমকের সুরে বলছে, ‘‘এই, জামাকাপড় একদম বেশি ময়লা করবি না। নদীতে এক ফোঁটা জল নেই। কাচতে পারব না।’’
পাশের বাড়ির বউমার মুখেও সেই একই সুর। সে তার স্বামীকে বলছে, ‘‘শীত তো ফুরিয়েছে। সোয়েটার, চাদরগুলো ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে দিচ্ছি।’’
স্বামী বলে, ‘‘সে কী! ওগুলো তো ময়লা! আলমারিতে তুলে দেবে কী? গন্ধ ছেড়ে যাবে যে। একটু কাচাকাচি করে তুলবে না!!’’
বউমা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘‘জল কোথায় যে কাচব? কল পাম্প করে কাপড় কাচার গতর আমার নেই। নদীতে যবে জল আসবে তখন নাহয় বের করে কেচে দেব।’’
জলের এমন আকাল রাধানাথ এর আগে কখনও দেখেনি। জীবনের যত সমস্যা এখন যেন নদীতে জল না থাকার জন্য।
******
এ বছর গাঁয়ের একটা মানুষও মকর সংক্রান্তির দিন মকরস্নান করতে পারেনি। শিলাবতীতে জল ছিল না যে। স্নান করবে কোথায়? মকরস্নানের যে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ, যে খুশি, তার সবটাই এ বার মাঠে মারা গিয়েছে। রাধানাথ এত দিন দেখে এসেছে, মকরস্নানকে ঘিরে গাঁয়ের মানুষগুলোর কী উত্সাহ, কী আবেগ! ওই দিন ভোর না হতে হতেই ছেলে-বুড়ো, মেয়ে-বউ সবাই ঘাটে ঘাটে জড়ো হত। টুসুর ভাসান দিয়ে তার পর স্নান করত ডুব দিয়ে। কোন অনাদি-অনন্ত কাল থেকে নিয়ম চলে আসছে, পুব মুখ করে এ দিন কম করেও তিনটে ডুব দিতে হবে। ফুল ভাসিয়ে তবে আবার স্নান। রাস্তার দু’পাশে ফুটে থাকত হলুদ সরষেফুল, কিংবা সাদা মুলোফুল, নতুবা রঙবেরঙের গাঁদা ফুল। যে যার পছন্দ মতো সেই ফুল তুলে এনে জলে ভাসিয়ে ডুব দিত। আর বাচ্চাদের জল ছিটিয়ে সে কী সাঁতার কাটা! তাদের দৌরাত্ম্যে হাড় হিম করা কনকনে ঠান্ডাও ভয়ে মুখ লুকোত। দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত রাধানাথের। স্নান সেরে এ দিন সবাই নতুন জামাকাপড় পরত। বাড়ি ফিরে শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে চলত আয়েশ করে পিঠে খাওয়া। সে পিঠের স্বাদই ছিল অন্য রকম!
রাধানাথের নিজের কাছেও এই মকরসংক্রান্তির সকালটা ছিল এক মধুর সকাল, মন কেমন করা মিষ্টি ক্ষণ। সূর্য ওঠার আগেই বাড়ি থেকে তেল মেখে খালি গায়ে বেরিয়ে পড়ত। মনের আনন্দে নদীর ঠান্ডা হিমশীতল জলে ডুব দিত। বাড়ি ফিরে তবে পোশাক পরত। নদীটার সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সখ্য। সেই ছোটবেলা থেকেই নদীর সঙ্গে তার ভাব। এই নদীর জলেই সাঁতার শেখা। এক দিন তো সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবেই যাচ্ছিল। কপালের জোরে বেঁচে গিয়েছিল। ডুবতে ডুবতেই শেষে সাঁতার শিখে ফেলল সে। আর এক দিন এলাকার বিখ্যাত সাঁতারু হয়ে উঠল রাধানাথ। ওই সময়ে বর্ষায় সে কত দিন গরুর লেজ ধরে ভরা শিলাবতী পার হয়েছে। গরুর লেজ ধরে নদী পার হওয়া সে এক আলাদা মজা, আলাদা আনন্দ!
নদী-ভর্তি জল। তার উপর তরতর করে বয়ে চলেছে নৌকা। মানুষজন পারাপার হচ্ছে। এ গাঁয়ের, দূর গাঁয়ের, ভিন গাঁয়ের লোকজন। এই দৃশ্য সে অনেক দিন বসে বসে দেখেছে। কী যে হল এ বার, এই বর্ষায় সেই দৃশ্য এক বারও দেখতে পেল না রাধানাথ। রাধানাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুকের কোণে আপশোস ঝরে পড়ে। প্রাণচঞ্চলা, বেগবতী নদীটা এ ভাবে শুকিয়ে শেষ হয়ে যাবে, ভাবতেই পারছে না সে।
নদীতে জল নেই। এক দল মানুষ তার সুযোগ নিয়েছে। সারা বছর ধরে নদীর বুক খুঁড়ে বালি তুলে নিচ্ছে। ট্রাক-ভর্তি বালি তাদের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে দূরে কোথাও, শহরে। এমনকী পাশের গাঁ-ঘরগুলোতেও সেই বালিতেই উঠোন ভরাট হচ্ছে। রাধানাথের মনে হচ্ছে এ ভাবে বালি তুলে নেওয়ায় নদীটাকে বড় লাগছে, হয়তো নদীটার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার কান্নার খবর, যন্ত্রণার খবর কে রাখছে? মানুষের এই অত্যাচার অসহায় শিলাবতী নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। রাধানাথ আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নদীতে জল নেই মানে তার প্রাণও নেই। একা বসে সে ভাবতে থাকে এক অলীক ভাবনা।
রাধানাথ জীবনে বহু বার গরুর গাড়ি করে নদী পারাপার করেছে। মাঠের থেকে পাকা সোনার ধান বোঝাই করে এনে খামারে তুলেছে, আলুর সময় আলু। গাড়ি টানার সময় অবলা বলদ মোষগুলো এই নদীতে মুখ ডুবিয়ে গোগ্রাসে জলপান করেছে। অনেক সময় নিজে গাড়ি থেকে নেমে বলদ-মোষগুলোর গায়ে নদীর ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দিয়েছে। এ বার বেচারা গরু-মোষগুলোর কী দুর্গতি, কী কষ্ট! নদীতে নেমে পেট ভরে পান করার মতো জলটুকুও পেল না। রাধানাথ বেশ বুঝতে পারছে, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সামগ্রিক জীবনযাত্রায় বড় রকম একটা প্রভাব পড়েছে। নদী তো আসলে মা। সেই মায়ের বুকেই জমাট বেঁধেছে শূন্যতার হাহাকার। নদী আবার কবে জলে ভরে উঠবে, ঢেউ তুলে খলখল রবে বয়ে যাবে, সেই চিন্তায় অস্থির রাধানাথ।
রাধানাথের বয়স হয়েছে। সে বুঝতে পারছে, তার আর এ সংসারে বেশি দিন থাকা হবে না। জীবনের অনিবার্য নিয়ম মেনেই তাকে চলে যেতে হবে। পরপারে যাওয়ার আগে নদীর এমন মরণদশা দেখে যাওয়া বড় দুঃখের। যন্ত্রণার।
সেই কোন কাল থেকে কত জনের কত চিতা সাজানো হয়েছে শিলাবতীর বালুচরে। তাদের নশ্বর দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর শিলাবতীর জল দিয়েই চিতার আগুন নেভানো হয়েছে। মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তি পেয়েছে কি না জানা নেই, তবে সেই গনগনে আঁচকয়লা মুহূর্তে শীতল হয়ে গিয়েছে। রাধানাথ তার পরিবারের কত জনের শব দাহ করেছে এই নদীতীরে। কলসি ভরে জল নিয়ে নিভিয়েছে তাদের চিতার আগুন।
******
এখন যারা মরবার পর শেষ আশ্রয় পেতে শিলাবতীর তীরে এল, তারা বড়ই দুর্ভাগা। শিলাবতীর একটু জল তারা পেল না। ঘর থেকে জল বয়ে এনে তাদের চিতা নেভাতে হয়েছে।
রাধানাথ আরও ভাবতে থাকে, হঠাৎ করে আজ যদি সে মরে যায়, তার শেষ শয্যাও তো পাতা হবে এই শিলাবতীরই চরে। তারও চিতা নেভানোর জলটুকু এই নদীর বুক থেকে পাওয়া যাবে না। যে নদীটাকে সে জীবন ভর ভালবাসল, আপন করে নিয়ে জীবন কাটাল, সেই নদী-মায়ের সামান্য স্নেহটুকুও সে পাবে না তার শেষ সময়। মনটা ভারী হয়ে আসে রাধানাথের। গলার কাছে একটা চাপা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে। শিলাবতীর বুকে একটুখানি জল যদি দেখে যেতে পারত, তবে মরেও সে শান্তি পেত খানিক।
******
ক’দিন পর হঠাত্ই এক দিন বিকেলবেলা পশ্চিম আকাশে এক খণ্ড কালো মেঘের উদয়। পর ক্ষণেই সে মেঘ ঘন রূপ ধারণ করে সারা আকাশটাকে গিলে ফেলল, আর বিশাল দৈত্যের মতো দাপিয়ে বেড়াতে লাগল। ঝোড়ো হাওয়া বইছে, বাজ পড়ছে কড়কড় করে। ভেঙে পড়ছে গাছের ডালপালা। তার পরই ঝেঁপে এল বৃষ্টি। কয়েক ঘণ্টা একটানা চলল বৃষ্টির দাপট। এক রাতের মধ্যে শুকনো পৃথিবীটা ভিজে একাকার। চার দিক জলে জলময় হয়ে গেল।
সকাল হতে না হতেই গাঁয়ের মানুষজন ছুটে চলেছে নদীর ধারে। নদীতে জল এসেছে। অনেক দিন পর শিলাবতীর বুকে জল বইছে। মানুষজন আনন্দে আত্মহারা। বড় ফেনার দলা নিয়ে, ঘোলা জল বুকে শিলাবতী ছুটছে। বহু দিন বাদে সে আবার প্রাণচঞ্চলা হয়েছে। মানুষের চোখেমুখে আবেগ।
ও দিকে নদীর পাড় ঘেঁষে চিতা সাজানো হয়েছে রাধানাথের। সে দিন ঝড়-জলের রাতেই সে দেহ রেখেছে। ডাক্তার ডাকবার সময়টুকু পর্যন্ত দেয়নি ছেলেদের। নদীতে জল এসেছে, তা যেমন গাঁয়ের মানুষগুলোকে স্বস্তি দিয়েছে, তেমনই রাধানাথের মৃত্যুও তাদেরকে শোকে বিহ্বল করে তুলেছে।
বয়স হলেও এ ভাবে রাধানাথের আচমকা চলে যাওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারছে না গাঁয়ের অনেকেই। রাধানাথ মানুষটা যে গাঁয়ের সব লোকের চোখের মণি ছিল। রাধানাথের মৃত্যু যেন একটা যুগের অবসান। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে মানুষটা যে সারা জীবন গাঁয়ের মানুষদের পাশে ছিল। চোখের জলও ঝাঁপিয়ে এল।
রাধানাথের দাহকার্য শেষ হল। জানতেও পারল না সে, শুধু গাঁয়ের মানুষগুলো নয়, শিলাবতী পর্যন্ত তার শোকে কেঁদেছে। বুক ভরে বয়ে এনেছে জল, আর সেই জলেই তার চিতা নেভানো হয়েছে।
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy