ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
আমি বললাম, “আমিও জানতাম। কিন্তু তোকে বলিনি।” পুঁটি মাথা নাড়ল। বলল, “আমরা আমাদের কষ্ট দেওয়ার অধিকার অন্যকে দিয়ে দিলে, সে সেটা মিসইউজ় করবেই, জানিস।”
আমি চোয়াল শক্ত করলাম। তার পর সামান্য ঝুঁকে পুঁটির হাতটা ছুঁলাম একটু। বললাম, “তুই মনখারাপ করিস না।”
পুঁটি তাকাল আমার দিকে। গলাটা দুর্বল বেশ। বলল, “মন? আমার?”
আমি বললাম, “আমি জানতাম এনার ব্যাপারটা। কিন্তু তোকে বলিনি তুই কষ্ট পাবি বলে। তুই কষ্ট পাস, আমি কখনও চাইনি পুঁটি।”
“তাই!” পুঁটি তাকাল আমার দিকে। তার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা হলে আমার ইমেলে কেন আননোন আইডি থেকে এনা আর ওই ছেলেটার চুমু খাওয়ার ছবিগুলো পাঠালি আমায়!”
কথার আকস্মিকতায় আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কী বলব বুঝতে পারলাম না। এটা কী হল! কী করে বুঝল পুঁটি! ও নিশ্চয়ই আন্দাজে বলছে!
আমি কিছু বলতে গেলাম। কিন্তু পুঁটি হাত তুলে আমায় থামাল।
আমি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে গেলাম।
পুঁটি বলল, “তুই ছবিটা তোলার সময় খেয়াল করিসনি যে, তোর ছায়া কাফের সামনের কাচে পড়েছে। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই চেনা যাচ্ছে তোকে। এমন কেন যে করিস! আমায় কষ্ট দিতে চাস না বলিস। কিন্তু তাও এ সব... আমি তো তোর কোনও ক্ষতি করিনি সাবু। তুইও এমন করলি! আমি কি গত জন্মে খুব খারাপ কিছু করেছিলাম! এ কী পূর্বজন্মের পাপের ফল! তোর কী মনে হয় বল তো।”
১৫
পুঁটি (দিন : আটচল্লিশ)
বাগালের অফিস থেকে বেরিয়ে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। অগস্টের কলকাতায় আজ মেঘ নেই। আকাশ ঝকঝক করছে। অনেক দিন পরে এমন নীল রং দেখছি। একটা প্লেন আকাশে চকখড়ির মতো ধোঁয়ার দাগ টেনে চলে যাচ্ছে।
ছোট থেকেই আমার প্লেন দেখতে ভাল লাগে। কোমরে হাত দিয়ে মাথা উঁচু করে প্লেন দেখার মধ্যে কিসের যে একটা আনন্দ আছে বুঝি না। কিন্তু আছে একটা আনন্দ! পাখির মতো সব কিছু ছাড়িয়ে উড়তে পারার আনন্দ কি! হতে পারে! আমাদের জীবনের সব কিছু আমরা বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে কেন যে মনখারাপ হয়, সব সময় তা যেমন স্পষ্ট বুঝি না, তেমন মাঝে মাঝে আনন্দের কারণগুলোও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় না। শুধু একটা ভাল লাগা আসে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড হাওয়ায় চুল এলোমেলো হয়ে যাওয়ার মতো ভাল লাগা!
আজ আমারও তেমন লাগছে।
আমি ডান হাত আকাশের দিকে তুলে ছোট্ট প্লেনটাকে বুড়ো আঙুলের মাপে মাপার চেষ্টা করলাম। আমার নখের চেয়েও ছোট। কী সুন্দর লাগছে! সব বড় জিনিসকেই দূর থেকে ছোট লাগে। সমস্যাকেও। তাই সমস্যাদের সব সময় নিজের থেকে দূরেই রাখতে হয়।
“কী রে! তার-ফার কেটে গেল না কি তোর? আকাশের দিকে হাত তুলে কী মাপছিস শালা?” পাশ থেকে রিজু হাত দিয়ে ঠেলল আমায়।
আমি হেসে বললাম, “এরোপ্লেন!”
“আরে! খোকার মুখে যে হাসি ফুটেছে!” রিজু সামান্য অবাক হলেও হাসল।
আমি দাড়িতে হাত বোলালাম। এ ক’দিনে বেশ বড় হয়েছে। কেমন লাগছে একটা। কলেজ জীবনে পরীক্ষার আগে দাড়ি শেভ করতাম না শুধু। পরীক্ষা হয়ে গেলেই শেভ করে নিতাম।
আজ কেন কে জানে, মনে হচ্ছে পরীক্ষা শেষ হয়েছে। দাড়ি কামিয়ে ফেলতে হবে।
“দাড়িতে খারাপ লাগছে না কিন্তু।” রিজু পাশ থেকে বলল, “আজকাল তো সবাই রাখছে। তুইও রেখে দে।”
আমি তাকালাম ওর দিকে। বললাম, “তুই ঠিক মতো টেন্ডারের কোটটা দেখে দিয়েছিলি তো? যা বলেছিলাম টাইপ করেছিলি তো ঠিক করে?”
“আরে, তুই নিজেও তো দেখলি!” রিজু ভুরু কুঁচকে বলল, “সারা ক্ষণ টেনশন করিস না তো! এক্সেল শিট-এ করা। নিজে থেকেই তো যোগ হয়েছে। বেকার ভাবছিস। সব ঠিক আছে।”
তা ঠিক। এক দিন আগেই আমরা প্রাইস জমা দিয়ে দিয়েছি। বাগালে খুশি হয়েছেন। বলেছেন দেখবেন। দেখা যাক কী হয়।
রিজু বলল, “শোন না, আজ আর অফিস যাব না। একটা কাজ আছে।”
“কী কাজ?” আমি অবাক হলাম।
রিজু হাসল, “নন্দনে যাব। একটা সিনেমা এসেছে। দেখব।”
“তুই আবার কবে থেকে নন্দনের সিনেমা দেখতে যাস? তোর তো পাড়ার হল ছাড়া কিছু ভাল লাগে না!”
“আরে আমার জন্য না কি!” রিজু কেমন যেন লজ্জা লজ্জা মুখ করল।
“ওরে শালা, তবে কার জন্য? তুই আবার কার জন্য নিজেকে শহিদ করার প্ল্যান করছিস রে? না কি এটাও অমলা কেস!” আমি গোল গোল চোখ করে ওর দিকে তাকালাম।
রিজু ঢোঁক গিলল খানিকটা। তার পর বলল, “ইলোরা!”
“কবে থেকে?” আমি এখনও অবাক, “আলাপ কী করে? কিছুই তো বলিস না!”
রিজু হাসল। ছেলে তো লজ্জায় আপেল হয়ে যাচ্ছে দেখছি!
“মেট্রোয় আলাপ। না মানে, আমি আলাপ করিনি। জানিসই তো এই সব ব্যাপারে আমার ধক নেই একটুও। ও নিজেই এক দিন কালীঘাটে আমায় ধরল!”
“ধরল মানে? ছেলেধরা না কি?”
“ধ্যাত! শোন না।” রিজু আলতো করে মারল আমায়, “ও নাকি আমায় দেখে প্রায়ই। মাসদুয়েক হল কলকাতায় এসেছে ও। মাস্টার্স করেছে মাস কম-এ। সে দিন স্টেশনে তাই আলাপ করেছে। কানপুরের বাঙালি ওরা। বাবা রিসেন্টলি বদলি হয়ে এসেছে কলকাতায়। ও চাকরি খুঁজছিল, পেয়েও গিয়েছে।”
“এটা ভাল হয়েছে।” আমার ভাল লাগল খুব।
রিজু বলল, “আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। আমায় কেন ভাল লাগবে বুঝতে পারিনি।”
আমি বললাম, “তুই বুঝিসটা কী জীবনে! স্কুলে বার্লোজ় হুইল পর্যন্ত বুঝতে পারতিস না তো প্রেম! কোনও চাপ নেই। চলে যা নন্দন। তুই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস!”
রিজু বলল, “মেয়েটা আমার চেয়ে এক ইঞ্চি লম্বা। দেখতে সাধারণ। গান করে সাংঘাতিক। আমি যে কী করব!”
“তোর পছন্দ তো ওকে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম রিজুকে।
রিজু মাথা নামিয়ে হাসল।
“ব্যস ব্যস!” আমি হাসলাম, “চলে যা এক্ষুনি। টাকা আছে তো সঙ্গে? না কি দিয়ে দেব?”
রিজু হেসে বলল, “আছে, আছে। ওর সঙ্গে বেরোব প্রথম। তৈরি হয়েই এসেছি।”
“ভাগ মিলখা, দাঁড়িয়ে কেন!”
রিজু মাথা নেড়ে দু’পা এগিয়েও আবার থমকে গেল। আমার কাছে ফিরে এসে বলল, “তুই এমনই হাসিখুশি থাকিস পুঁটি। আবার ওই হিজিবিজি হয়ে যাস না!”
আমি কিছু না বলে হাসলাম। রিজুও হেসে দ্রুত মেট্রো স্টেশনের দিকে চলে গেল।
আমিও তো যাব। কিন্তু এখনই নয়। আমি একটু বই কিনব আজ। বহু দিন হয়ে গেল বইপত্তর কেনা হয় না। গত বেশ কিছু দিন আমি যেন কেমন হয়ে ছিলাম! কে যেন আমায় একটা বিরাট বড় কালো চাদর দিয়ে ঢাকা দিয়ে রেখেছিল। আজ সকালে সেই চাদরটা উঠে গিয়েছে! মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে গিয়েছি!
আমি মানিব্যাগ বের করে দেখলাম। না, ডেবিট কার্ডটা আছে। সেই জুনের আঠারো তারিখের পরে আর কার্ড ইউজ় করিনি আমি। কিছুই ইউজ় করিনি।
পার্ক স্ট্রিট মোড় থেকে আমি বড় বইয়ের দোকানটার দিকে পা বাড়ালাম। দেখি নতুন কী বইপত্তর এল।
“যাক, আপনাকে পাওয়া গেল।”
আচমকা পাশ থেকে গলাটা শুনে আমি একটু চমকেই গেলাম। পাশে তাকিয়ে দেখলাম, চন্দন সিং। আবার!
“আপনি তো সেই দার্জিলিঙের পর থেকে গায়েবই হয়ে গেলেন। ফোন করলেন না! দেখাও করলেন না!” চন্দন হাসল।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। হ্যাঁ ঠিকই। ওর সঙ্গে আর দেখা করিনি।
চন্দন বলল, “চলুন না কোথাও বসি।
কথা আছে।”
আমি হাসলাম, “আমার যে নেই কথা।”
“আরে! আপনি সব ভুলে গেলেন! কী ইনফো দিয়েছিলাম, সব ভুলেই গেলেন!” চন্দন এমন মুখ করল যেন আমি টু প্লাস টু কত হয় ভুলে গিয়েছি।
“আপনি প্লিজ় আর আমায় নিয়ে মাথা ঘামাবেন না!” ঠান্ডা গলায় বললাম আমি।
চন্দন হাসল, “এত বড় কাজ। মাথা না ঘামালে হবে! আচ্ছা শুনুন এক কোটি নয়, এক কোটি কুড়ি লাখ। ডান করুন। এখুনি চলুন আমার সঙ্গে। কিছু নিয়ে নেবেন। প্রাইস তো আজ জমা দিলেন। আপনি সেটার একটা প্রিন্টআউট আমায় দিয়ে দিন। মেল করে দিন অফিসে গিয়ে। আর আমি কথা দিচ্ছি মিজ়োরামে একটা বড় কাজ আপনাদের পাইয়ে দেব। তিরিশ কোটির কাজ।”
আমি তাকালাম চন্দনের দিকে। বুঝলাম ও ডেসপারেট একদম।
“আচ্ছা, এর আগে আপনি আমাদের কাজ পাইয়ে দেবেন বলে টাকা নিয়েও সেই কাজ অন্যদের দিয়ে দিয়েছিলেন কেন?” আমি সরল মুখে
জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি!” চন্দন কেমন যেন থতমত খেল। কিন্তু কনফিডেন্স হারাল না। বরং বলল, “আরে সে একটা ভুল বোঝাবুঝি হল। আমি তো টাকাও ফেরত দিয়েছিলাম আপনার ছোটকাকে। আপনারা জানেন না! তবেই ভাবুন তলায় তলায় কী ভাবে মাল সরাচ্ছে! আপনি শুনুন, আপনার চান্সটা নিন। এত টাকা ক্যাশ কেউ দেবে না। জাস্ট একটা পাতার প্রিন্টআউটের জন্য এত টাকা! আপনি লেক গার্ডেন্সে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে নিতে পারবেন। গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ইউরোপ ঘুরে আসতে পারবেন। গার্লফ্রেন্ড না থাকলে সেটাও আমি বন্দোবস্ত করে দেব। দারুণ জিনিস। ইউক্রেনিয়ান। জাস্ট হেল্প মি টু হেল্প ইউ। আপনার এই বয়স, কেন বেকার বরবাদ করছেন! চলুন লেট’স ডু ইট।”
আমি হাসলাম এ বার। বেশ জোরে, প্রাণ খুলে। আশপাশ দিয়ে যাওয়া লোকজন অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু আমি পাত্তা দিলাম না। আমার এত মজা লাগছিল!
আমি বললাম, “আপনি বেকার ব্যাটারি খরচ করছেন। আমি এটা করব না। প্লাস একটা জিনিস ভাবুন। আপনি যে কোম্পানির হয়ে এ সব করতে এসেছেন তারা গুজরাত আর ঝাড়খণ্ডে ব্ল্যাক লিস্টেড হয়েছে রিসেন্টলি। আমি জেনুইন খবর নিয়েছি উইথ পেপার কাটিং। আমি আজ বাগালে সাহেবকে সে সব দিয়েও এসেছি। ফলে আপনারা ফ্রি-তে যদি কাজটা করে দেন, তা হলেই একমাত্র কাজটা পেতে পারেন। লোয়েস্ট হলেও লাভ নেই। আমি তো আমার দাম আপনাকে বলে দিয়ে প্রথম চোটে যা টাকা পাওয়া যায় আপনার থেকে নিয়ে নেব, কিন্তু আপনাদের কোটেশন যখন বাগালেরা আপনাদের মুখেই ছুড়ে মারবে, তখন কী হবে! কাজও পাবেন না আর আমায় দেওয়া টাকাটাও যাবে। তাই না!”
চন্দন কী বলবে যেন বুঝতে পারল না।
আমি একটু থেমে চন্দন সিংকে বললাম, “সারা ক্ষণ দু’নম্বরি কাজ করতে যান কেন? বেকার নিজের বদনাম করেন! আমরা সবাই টাকা রোজগার করার চেষ্টাই করছি। কিন্তু সেটাতেও একটা ফেয়ারনেস থাকবে তো রে বাবা! এ সব জানলে আপনার বাচ্চারা আপনাকে কী ভাববে? ভাববে না যে, আপনি চোর! ঠগ! জোচ্চোর! সেভ ইয়োর ডিগনিটি। টাকা অনেক কিছু, কিন্তু সব কিছু নয়। টাকার চেয়ে লয়ালটি অনেক বড়। এটা অন্তত বুঝুন!”
চন্দন যেন কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। বলল, “আপনারা ওই কাজ করতে পারবেন না। পলিটিক্যাল প্রবলেম হবে।”
“সে আমরা বুঝে নেব। আপনি প্লিজ় এই নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আপনি আসুন।”
চন্দন মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “চা খাবেন? বা অন্য কিছু!”
চন্দন হাসল, বলল, “নেক্সট টাইম। উই উইল মিট আগেন।”
আমি হেসে বললাম, “এনি টাইম। তবে অফিসে আসবেন না। আমার বাবা-কাকারা কিন্তু আমার মতো নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy