Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Short story

short story: সুতানুটির চুপকথা

সিকদার বাগানের মিত্তিরবাড়ির মেয়ে। গল্প করতে বেশ ভালই লাগছিল। নতুন অভিজ্ঞতা। যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, “আবার কবে দেখা হবে?”

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

বাণীব্রত গোস্বামী
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২২ ০৮:২১
Share: Save:

সে  দিন হরিমাধবের শ্রাদ্ধ। তাঁর তিন ছেলে। রাখহরি, প্রাণহরি, আর নরহরি। ভাগ্যিস আর একটা ছেলে হয়নি! কে জানে, হলে হয়তো তার জন্য বলহরি নামটাই বরাদ্দ হত! তিন জনের গায়েই সাদা জামা, পরনে সাদা হাফপ্যান্ট, ন্যাড়া মাথায় ‌সাদা টুপি, পায়ে সাদা মোজা, আর কেড্স। প্রত্যেকের গলায় লাল ফিতে দিয়ে ঝুলছে একটা সবুজ হুইসল, যেমন রেফারিদের গলায় থাকে।

দোতলার ছাদে ছোট ভাই নরহরি খাওয়াদাওয়ার তদারকি করছে। ক’টা পাত খালি আছে, বাঁশি বাজিয়ে দোতলায় দাঁড়িয়ে ‌থাকা মেজদা প্রাণহরিকে আঙুলের ইশারায় বলে দিচ্ছে। নীচে বড়দা রাখহরি অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। মেজভাই প্রাণহরি একই কায়দায় বড়দাকে লোক পাঠাতে বলছে। বড়দা বয়স, বাসস্থানের দূরত্ব ইত্যাদি বিচার করে লোক নির্বাচন করছে। তার পর চিরকুটে সই করে নির্বাচিত লোকের হাতে ‘গেট পাস’ দিয়ে দিচ্ছে। সেই ছাড়পত্র প্রাণহরির হাতে দিলেই, ছাদে যাওয়ার অনুমতি মিলছে।

আমি এখানে নিমন্ত্রিত মাস্টার ‌হিসেবে। ও বাড়ির ছেলেমেয়েদের অঙ্ক আর বিজ্ঞানের মাস্টার। বড় বৌ গৌরী, মেজ বৌ গীতা, আর ছোট বৌ টুকু দোতলার ঘরে। তারা পানের ডিবে নিয়ে পরচর্চা পরনিন্দায় ব্যস্ত। গঙ্গার ধারে কিছু গুদামঘরের ভাড়া, বাড়ির সামনে দোকানঘরের ভাড়া, আর ব্যাঙ্ক-পোস্টাপিসে বাপ-ঠাকুরদার জমানো আমানতের সুদ, ওদের আয়ের উৎস। শরীরে কিন্তু বনেদি রক্ত। সংস্কৃতি বলতে নীলষষ্ঠী, অম্বুবাচী, বিপত্তারিণী, ইতুপুজো, জয়মঙ্গলবার আর আঁশ-এঁটো-সকড়ির নানা আইনকানুন।

হঠাৎ সারা বাড়ি অন্ধকার। রাখহরি চিৎকার করে উঠল, “ইলেক্টিকিটি চলে গেছে!”

প্রাণহরি দৌড়ে টর্চ নিয়ে নেমে এল। আমি বললাম, “এক বার মিটার ঘরটা দেখব।”

মেজভাই ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। গিয়ে দেখলাম, ওভারলোডের জন্য ফিউজ় কেটে গেছে। ঠিক করে ‌দিলাম। গলা নামিয়ে প্রাণহরিকে বললাম, “বড়দা এক বাড়ি লোকের মধ্যে ইলেক্টিকিটি বলল!”

মেজভাই আস্তে করে বলল, “ও সব বাদ দ্যান দিইনি, সবার সব ক্যাপাকিটি থাকে না।”

ওপরে যখন খেতে গেলাম, নরহরিদাকে পুরো ব্যাপারটা বললাম। উনি বললেন, “ঠিকাচে, ঠিকাচে... এ নিয়ে আপনি আর পাবলিকিটি করবেন না।”

বুঝলাম, ‌এই উচ্চারণ আসলে ওদের বংশমর্যাদা।

খাবারের জায়গায় পৌঁছে দেখলাম, একেবারে এলাহি বন্দোবস্ত। হরিমাধব যা যা খেতে ভালবাসত, সব আমরা খেয়ে তাঁর আত্মাকে শান্তি দিলাম। শেষপাতে আবার ‘ন্যাংড়া’ আম। অনেকে লৌকিকতার খাতিরে খেয়েদেয়ে উঠে আঁচিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলছে, “তোমাদের এখন শক্ত হতে ‌হবে, মাথার ওপর থেকে ছাতা সরে গেল।” ছাতা সরে গেল, না কাঁটা সরে গেল জানি না, তবে আমার মনে হল এ সবের প্রয়োজন নেই। কারণ ওরা তিন ভাই তখন ব্যস্ত, কলকাতার কোন বিখ্যাত দোকান থেকে কী এসেছে তার ফিরিস্তি দিতে।

শ্রাদ্ধশান্তি মিটল। আমি পড়াতে যাওয়া শুরু করলাম। ওদের ছাদে একটা মন্দির আছে। বাঁকা ঠাকুরের মন্দির। এ বাড়িতে কৃষ্ণের ওই নামই জুটেছে। কারণ তাঁর অষ্টোত্তরশতনামের সবগুলোই এঁদের কোনও না কোনও পূর্বপুরুষের দখলে। ফলে মুখে আনা যাবে না।

হরিমাধবের স্ত্রী মনমোহিনী আগে ওই মন্দিরেই বেশি সময় কাটাতেন। কখনও ঠাকুরের গায়ে মশা মারতেন, আবার কখনও ঠাকুরকে ‌পাখার বাতাস করতেন। শ্রাদ্ধের পর দিন যখন‌ পড়াতে গেলাম, দেখলাম বিকেলের উনুন ধরানো হচ্ছে, নীচের বারান্দার কোণে। কাঠকয়লার সঙ্গে গোছা গোছা বাসি লুচি উনুনে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে।

আমি থাকতে না পেরে বললাম, “বাগবাজার ঘাটের ওখানে কত ভিখিরি আছে, ওদের দিলে তো ওরা খেয়ে বাঁচত।”

বিধবা বুড়ি খেঁকিয়ে উঠলেন, “ওঁর ছেরাদ্দের নুচি ওই সব অজাত‌-কুজাতকে দিলে, ওঁর অকল্যেন
হবে না?”

বুড়ি এখন সারা বিকেল বারান্দায় ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে থাকেন। সন্ধেবেলা ছোট বৌ হেঁশেলে ঢোকে না। বিকেলে ওর ছুটি। তখন বড় বৌ রুটি বেলে, মেজ বৌ সেঁকে। উঠোনের কোণে টালার জলের কলে, ছোট বৌ রোজ গা ধোয়, ঠিক আমি যখন নীচের ঘরে ভুতোকে অঙ্ক করাই। ভুতো মেজ ভাইয়ের ছেলে। বড় জনের দুটোই মেয়ে। গেঁড়ি আর বুড়ি। ছোট বৌয়ের বছর দশেক বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। আমার ঘর থেকে কোনাকুনি কলতলাটা‌ দেখা যায়। আমি ওদিকে তাকাই না।

শাশুড়ি রোজই খর গলায় বলেন, “অ ছোট বৌমা, ম্যাস্টরটা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আচে, কাপড়-চোপড় সামলে নিয়ো।”

ছোটবৌমা তাতে কর্ণপাতও করে না। পাতলা ভিজে লেপটানো শাড়ি, গায়ে ব্লাউজ় নেই, পিঠটা খোলা, শাড়িটা খাটো করে পরে, গজগামিনী চালে ফিক করে হেসে আমার পড়ানোর ঘরের সামনে দিয়ে চলে যায়।

আমি কোনও দিন প্রেম করিনি। কলেজে মণিকা বলে একটা মেয়ে ছিল। ভাল লাগত, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। জামশেদপুর পিকনিকে গিয়ে, দলমা পাহাড়ে একটা ন্যাড়া পাথরের ওপর লাল ইট দিয়ে লিখেছিলাম, ‘যতীন+মণিকা’। এটাই আমার প্রেমের সর্বোচ্চ সাফল্য এবং কৃতিত্ব।

হরিমাধবের শ্রাদ্ধের মাসখানেক পর থেকে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। কোত্থেকে একটা বাচ্চা হুলো হরিমাধবের ঘরে আশ্রয় নিল। দিনের বেলা খাটের‌ তলায় শুয়ে থাকত, রাত্তিরে খাটে উঠে মনমোহিনীর পাশে নরম গদিতে শুত। আসলে হরিমাধব যদ্দিন বেঁচেছিল, বৌয়ের জন্য লুকিয়ে চপ-কাটলেট নিয়ে আসত। আর দুপুরবেলা বৌকে সোহাগ করত। এ বাড়িতে দুপুরবেলা ছেলেমেয়েদের উঠোনে খেলতে বলে, ঘরে দোর দিয়ে শোওয়ার রেওয়াজ বহু দিনের। তিন ছেলেও এর ব্যতিক্রম নয়। কারণ রাতে সবাই তরল-প্রভাবে থাকে। স্বামী মারা যাওয়ার পর, বাইরের খাবার খাওয়া এক রকম বন্ধই হয়ে গেল মনমোহিনীর। লোভটাও বাড়ল। রান্নাঘর থেকে চানাচুর, বিস্কুট, নাড়ু চুরি করে গদির নীচে লুকিয়ে রাখতেন। যথারীতি ইঁদুরের উৎপাত। আর সেই কারণেই হুলোর আগমন এবং আদরের প্রশ্রয়ে আশ্রয়। কারণ ওঁর বিশ্বাস, স্বামী হুলো হয়ে ফিরে এসেছেন। উনি রং চড়িয়ে সবাইকে গল্প বললেন যে, ভোররাতে হরিমাধব স্বপ্নে এসেছিলেন— ধুতি পাঞ্জাবি পরা, কিন্তু মুখটা হুলোর মতো। বুঝলাম ভুতোর ছোটবেলার বইয়ের ‘খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি’ কবিতার পাশের ছবিটা তুলে ধরেছেন। ছেলে বৌমারাও মোটামুটি ‌হুলোটাকেই বাবা বলে মেনে নিল। মাছ আর দুধ বরাদ্দ হল বাবার জন্য। মেয়ে রাধারাণীও হাটখোলা থেকে ছেলেমেয়ে, মাছ আর দুধ নিয়ে এসে বাবাকে আদর করে গেল। নাতি-নাতনিরা প্রণাম করেছিল কি না জানি না।

এ বার এ বাড়ির লেখাপড়ার কথায় আসি। গেঁড়ি আর বুড়ি আমার কাছে আর পড়ে না। আমি অনেক কষ্টে ওদের মাধ্যমিকের ইংলিশ চ্যানেল পার করে দিয়েছি। তার পর ওরা পড়া ছেড়ে দিল। যুক্তি হল, এর চেয়ে বেশি পড়লে উত্তর কলকাতায় এ রকম বনেদি ঘরের পাত্র পাওয়া মুশকিল। এখন বিয়ের জন্য দুটো গানই রোজ গায়। ‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’ আর ‘আমার হিয়ার মাঝে’।

ঠাকুমা বেশ জোরেই এক দিন বলছিলেন, “ডাগর ডাগর সোমত্থ মেয়ে সব ব্যাটাছেলে ম্যাস্টরের কাছে পড়বে, টেবিলের নীচে পায়ে পায়ে কতা হবে, তাপ্পর এক দিন বংশের মুখে চুনকালি দিয়ে হাত ধরে পালাবে। কী দরকার বাপু? সেই তো বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার মা হবে।”

সে দিনই ভেবেছিলাম টিউশনিটা ছেড়ে দেব। কিন্ত আমি নিরুপায়। এখন‌ আমার কাছে পড়ে ভুতো। ভাল নাম কেশব দত্ত। ক্লাস সিক্সে পড়ে।‌ এখনও চোখে হালকা কাজল পরে। টিফিনের সময় দিনু মোটা কাচের শিশি করে দুধ নিয়ে স্কুলে যায়। আর লুচি আলু-চচ্চড়ি। দিনুর এই বাড়িতেই জন্ম। ওর মা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে এ বাড়িতে থাকা খাওয়ার কাজ নিয়েছিল। দিনু তখন পেটে। এ গল্প আমাকে জলখাবার দিতে এসে দিনুই এক দিন বলেছিল। আমি টুকটাক গল্প করতাম মাঝেমধ্যে। এই বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটেই জীবন কাটিয়ে দিল। ওর চেহারার আদল দেখে আমার সন্দেহ হয়, ও কি ওর মায়ের পেটে এ বাড়িতে আসার আগে এসেছিল! না পরে! সেটা ঈশ্বর জানেন। বনেদি বাড়ির দিনুরা এই ভাবেই নিজের হাতে নিজেদের জীবন-যৌবন নষ্ট করে দিত।

ফর্সা লাল আপেলের মতো গাল, থলথলে ভুতোর মাথাটা ছিল নিরেট। কেশব নাগের চৌবাচ্চার অঙ্কটা দিলে, ওর সব ক’টা জলের নলই খুলে যেত। তাই ওকে অঙ্ক মুখস্থ করতে দিয়ে, আমি কাগজ পড়তাম। ক্লাসে এক দিন পিতা-পুত্রের অঙ্কে ছেলের বয়স বাবার থেকে বেশি এসেছে ভুতোর উত্তরে, তা-ও ভুল হয়েছে, বুঝতে পারেনি। তার পর থেকে ওর বন্ধুরা খেপাত ‘প্রাণহরির দত্ত-ব্যাটা, বাপের থেকেও মাথামোটা’।

এক দিন ভুতোকে ভৌত রাশি পড়াচ্ছি, হঠাৎ একটা কাগজের দলা এসে পড়ল কোলের ওপর, আড়াল করে খুললাম, দেখি লেখা রয়েছে ‘বোকা!’। কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে পড়ানোর পর টালা ব্রিজ দিয়ে পাইকপাড়ার দিকে হাঁটতে লাগলাম। তখন আমি পঞ্চানন বেরার বেড়ার বাড়িতে একটা ছোট ঘর নিয়ে, পনেরো টাকা ভাড়ায় থাকি। ‘পঞ্চু বেড়ার বাড়ি’ বলেই সবাই চেনে। আসবাব বলতে একটা তক্তপোশ, একটা আলনা আর একটা টেবিল। তক্তপোশে শুয়ে শুয়ে ভাবছি, আমাকে ওই কাগজটা দিল কে? আর কেনই বা দিল? গেঁড়ি? না বুড়ি? না কি অন্য কেউ?

পরের দিন আবার পড়াতে গেলাম। পড়িয়ে যখন বেরোচ্ছি, দেখি জুতোর মধ্যে আবার কাগজের দলা। হাতে তুলে পকেটে ভরলাম। বাইরে বেরিয়ে খুলে দেখি লেখা, ‘দেখলে, সোজা দেখবে।’ এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল। দু’দিন পরে দেখি ছোট বৌদি, মানে টুকু, কলতলায় মিটিমিটি হাসছে। বুঝতে আমার বাকি রইল না। তার মানে, এরই কাজ। কিন্তু কেন? যাওয়ার সময় ইশারায় বলে গেল, রবিবার সন্ধেবেলা, বাগবাজার ঘাট।

আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না। তবু না গিয়ে পারলাম না। সন্ধের আগেই গেলাম। ঠিক অন্ধকার নামার পর টুকুবৌদি এল। হালকা সাজগোজ, গায়ে চড়া সুগন্ধি। কাছে এসে বলল, “চলো একটা নৌকোয় উঠি, এখানে কেউ দেখে ফেলতে পারে।”

কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা ছই-দেওয়া নৌকো ভাড়া করলাম। ঘণ্টাখানেক ঘুরলাম। বলল, “বাপের বাড়ির নাম করে বেরিয়েছি।”

সিকদার বাগানের মিত্তিরবাড়ির মেয়ে। গল্প করতে বেশ ভালই লাগছিল। নতুন অভিজ্ঞতা। যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, “আবার কবে দেখা হবে?”

আমি ইশারায় বললাম, “হবে।”

তার পর বেশ কয়েক বার এ দিক-ও দিক দেখা করেছি। গল্পের বিষয়ও অনেক গভীরে গিয়েছে। ঘটনাটা ঘটল শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন। আমি বিকেলের পর পড়াতে গেছি। বাড়িটা কী রকম নিস্তব্ধ লাগছে। দরজাটা আলতো করে ভেজানো। ঠেলে খুললাম। ঢুকে দেখি টুকুবৌদি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ইশারায় উপরে আসতে বলল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দেখলাম, মনমোহিনী খাটে গভীর ঘুমে। উপরে যাওয়ার পর
বৌদি বলল, “হাটখোলার বড় তরফের দত্তবাড়িতে গুরুদেব এসেছেন। হনুমানদাস বাবাজি। বাড়িসুদ্ধ সবাই গেছে। আমি যাইনি, সকাল থেকেই পেটের এই জায়গাটা খুব ব্যথা করছে।”

আমি বললাম, “ভুতো নেই, আমি উঠি।”

আমাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলল, “সকালে পূর্ণিমার পুজো হয়েছে, দুটো মিষ্টি খাও।”

প্লেটে দুটো প্যাঁড়া আর জল নিয়ে এল। মিষ্টি দুটো খাওয়ার পর মনে হল, মাথাটা কেমন চক্কর দিচ্ছে। গত বছর দোলে সিদ্ধি খাওয়ার পর যে রকম হয়েছিল। আমি বললাম, “বৃষ্টি আসছে, উঠি।”

“ভিজে যাবে তো, এক পশলা হয়ে যাক।”

ঝেঁপে বৃষ্টি এল। কান-ফাটানো বাজ পড়ল একটা। বৌদি ভয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরল। একটা ঘোরের মধ্যে, অবশ হয়ে যেতে লাগলাম। জানলার ঝাপসা কাচ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, গভীর মেঘের মধ্যে লিকলিক করে বিদ্যুৎ খেলা করছে। এর বেশি স্পষ্ট করে‌ আর কিছু
মনে নেই।

ইদানীং ছোটবৌদি আর বিকেলে কলতলায় গা ধোয় না। মাসছয়েক পর থেকে আর বৌদিকে দেখতে পেতাম না। ভুতোকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এখন বাপের বাড়ি থাকে। প্রায় ছ’মাস পর টুকু কোলে ছেলে নিয়ে ফিরল। হুলো বেড়ালটা আগেই মরে গেছিল। কেউ বলে, বিষ-খাওয়া ইঁদুর খেয়ে মরেছে, বা হয়তো কেউ ওর দুধে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। টুকুর ছেলের নাম ফেলু। কারণ সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, এ বাড়ির সব যেন তার অচেনা। মনমোহিনীর বিশ্বাস, হরিমাধবই ফেলু হয়ে এসেছেন। হুলো মরে ফেলু হয়েছে। যাক, তবু তো হরিমাধবের মনুষ্যজন্ম প্রাপ্তি ঘটল।

ফেলুর আদরও বাড়ল। বছর তিনেক হবার পর ফেলু টলমল পায়ে পড়ার ঘরে আসত। আমি লজেন্স দিতাম। ও আমার কোলে উঠে, বুকপকেট থেকে পেনটা নিয়ে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটত। লিখে কী যেন একটা বোঝাতে চাইত, আমি জানি না! তবে এ বাড়ির টিউশনি আমি আর ছাড়তে পারব না। ফেলুকে আমায় পড়াতে হবেই। ওর মাথাটা মনে হয় ভুতোর মতো হবে না। আমিও কি জড়িয়ে পড়লাম, ও বাড়ির সঙ্গে? দিনুর মতো! যতীন মাস্টার হয়েই অজানা বাঁধনে আটকে গেলাম!

অন্য বিষয়গুলি:

Short story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy