ছবি: কুণাল বর্মণ
একতলা কোয়ার্টারটার পিছন দিকে, ভিতর বারান্দাটার লাগোয়া এক চিলতে বাগান। বাগান না বলে এক ফালি জমি বললেই হয়। কোনও এক সময় গরম কালে এখানে বেলফুলের সুগন্ধে বাতাস ভরে উঠত, খেয়ার হাতের যত্নে, আদরে। ছোট ছোট ঝোপের মতো গাছ, কিন্তু সাদা সাদা ফুলে ভর্তি। সারা বাড়িটাই যেন সেই সুবাসে আচ্ছন্ন থাকত। ও পাশের দেয়ালটার গা ঘেঁষে তরতর করে মাথা তুলেছিল লতানে একটা গাছ, বেগুনি রঙের ফুল ধরত তাতে। নাম জানা নেই। লতাটা এখনও আছে, বাগানের এক মাত্র আমগাছটাকে জড়িয়ে। কিন্তু ফুল নেই।
মনোজবাবু আরামকেদারায় বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ওই আম গাছটার দিকে। এখন আমের দিন নয়। কচি কচি লালচে পাতা প্রতিটি ডালের মাথায় মাথায়। বসন্ত এসেছে। মুকুল ধরেছে অনেক। খুব মিষ্টি আম হয় এ গাছে। এ বছরও ফল হবে, তারই আভাস দেখা যাচ্ছে। আমগাছটার প্রতি অসম্ভব মায়া মনোজবাবুর।
ও দিকে জোর কদমে গোছগাছ চলছে। শেষ মুহূর্তের প্যাকিং। বড় বড় জিনিস সবই চলে গিয়েছে। খাট, আলমারি, আলনা, বিছানা, রান্নার সামগ্রী ইত্যাদি সব বাঁধাছাঁদা হয়ে বড় একটা ট্রাকে বোঝাই হয়ে রওনা হয়ে গিয়েছে আগেই। এ বার গাড়ি এলে উঠবে ছোট কিছু বাক্স আর এ বাড়ির মানুষগুলো। এ বাড়ির প্রায় পঁচিশ বছরের সংসার গুটিয়ে এখন নতুন বাসায় যেতে হবে। সবাইকেই যেতে হয়। কারণ, অফিস থেকে পাওয়া কোয়ার্টার নিজের বাড়ি মনে করলেও আসলে তো নিজের নয়।
মনোজবাবুর এ বাড়িতে আসার দিনটাও মনে আছে। খেয়ার কোলে ছোট্ট অতনু আর সামান্য কিছু আসবাব নিয়ে এ বাসায় ঢুকেছিলেন তাঁরা। আজ খেয়া নেই। অতনু আর তার ছোট বোন অতসীই সব গুছিয়েছে। অতসীর জন্ম এ বাড়িতে আসার পরে। সে এখন কলেজের পড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেছে। অতনুর অফিসটাও ওই কলেজ স্ট্রিটের কাছেই। এই বাড়ি বদলে যে ফ্ল্যাটটায় ওঁরা আজ যাবেন, সেটা ও দিকেই। ওঁদের যাতায়াতে সুবিধে হবে। কিন্তু, বড়ই ছোট্ট ফ্ল্যাট ওটা। দোতলায়। কোনও বাগান নেই। একেবারেই কংক্রিটের জঙ্গল। তবু, যেতে হয়, কাজ ফুরোলে, দায়িত্ব ফুরোলে, চাকরি শেষ হলে, সব অভ্যেসই প্রায় ছাড়তে হয়। বাড়িতে বাস করাটাও তো একটা অভ্যাস। ওই জায়গায় টুথব্রাশ, শেভিং সেট, ওই দেয়ালে তাঁর ও খেয়ার বিয়ের প্রথম দিকের বাঁধানো ছবিটা, দরজার পাশের ছোট কুলুঙ্গিতে কুলদেবতার আসন... সবই তো আসলে অভ্যেস।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে আজ। তাঁদের ছিল গ্রামের বাড়ি। মাটির দাওয়া, মস্ত ঘর, উঠোন জুড়ে ধান শুকোত, শীতকালে আচার, বড়ি। উঠোনে তুলসীমঞ্চ, দাওয়ার পাশে ডালিম আর শিউলি ফুলের গাছ। বাড়ির কাছেই ছিল নদী। যাতায়াতের মূল ব্যবস্থা ছিল নৌকায়। সে গ্রাম ছেড়ে এসেছিলেন মনোজবাবু মাত্র ছয় বছর বয়সে। পুব বাংলার সেই গ্রামের সবুজ নরম ছবিটা কোনও দিনই ভুলতে পারেননি তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন সে যুগের আইন পাশ করা মোক্তার। চাকরি নিয়েছিলেন বর্ধমান মহারাজের কাছে। কেননা, ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করবেন না তিনি। সে সময় দেশটা তো ছিল ব্রিটিশের শাসনে।
ছ’বছরের ছেলেকে বুকে চেপে মনোজবাবুর মা কাঁদতে কাঁদতে ভিটে ছেড়েছিলেন, নৌকায় নানা প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে। দেশ নাকি ভাগ হয়ে যাবে। তাঁদের গ্রামটা হয়ে যাবে অন্য দেশ। মা শেষ বারের মতো শ্বশুরের ভিটেয় ধূপ জ্বেলে গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করেছিলেন কাঁদতে কাঁদতে। আজও স্পষ্ট দেখতে পান মনোজবাবু। সেই যে দেশ ছেড়ে ভিটে ছেড়ে যাত্রা শুরু হল, তার যেন আর অন্ত নেই। মায়ের পোষা কালো দেশি কুকুরটা বহু দূর পর্যন্ত নদীতে সাঁতরে সাঁতরে নৌকার পিছন পিছন এসেছিল। এক সময়ে নদীর জল গভীর হতে শুরু করল, ওর দমও বোধহয় ফুরিয়ে আসছিল। মা চোখ মুছছিলেন আর বার বার চিৎকার করে বলছিলেন, ‘‘কাইল্যা কাইল্যা, চইলা যা, মানিক! চইলা যা!’’
নতুন শহর, নতুন দেশে এসে মনোজবাবুর নবজীবন শুরু হয়েছিল। বাঙাল বলে ছোট ছেলেরা খেলতে নিতে চাইত না তাকে। বাবা নতুন স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ভাল পড়ালিখা কইরা নিজের পায়ে খাড়াইতে হইব। বুজছ? আমাদের এইখানে ভিটা নাই, কিছু নাই, সব নিজের জোরে করতে হইব। বিদ্যা ছাড়া আমাদের আর কুনো সম্বল নাই, ভুলো না য্যান।’’
মনোজবাবু কথাটা ভোলেননি। স্কুলে বরাবর ভাল রেজ়াল্ট করতেন। সবার নজরে পড়েছিল তাঁর মেধা আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা। স্কুল পেরিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি পাওয়া, সবই নিয়ম করে ঘটে গিয়েছে। মা-বাবাও চলে গিয়েছেন চিরকালের মতো। কলকাতার ভাড়াবাড়িতে যখন মা-বাবাকে নিয়ে চলে আসেন মনোজবাবু, তখন মা
বার বার বলতেন, ‘‘বাবু, এক বার শ্বশুরের ভিটাখান দ্যাখতে সাধ যায়। নিয়া যাবি?’’
মাকে আশ্বস্ত করতেন তিনি এই বলে, ‘‘অবশ্যই নিয়ে যাব। দাঁড়াও, তোমাদের পাসপোর্ট করাতে হবে আগে। সে খুব হ্যাপার ব্যাপার। তার পর ভিসা করতে হবে, তবে না যেতে পারবে! চিন্তা কোরো না, সব করে ফেলব।’’ মা বলতেন, ‘‘নিজের দ্যাশে যামু, তাতে এত শাটোরের
কী আছে?’’
বাবা তখন বলতেন, ‘‘কেমন কইরা বুঝাই তোমায়, ওইটা অহন অইন্য দ্যাশ!’’
আসলে, মনোজবাবু বিষয়টাকে সে ভাবে গুরুত্বই দিতে পারেননি অফিসের কাজের চাপে। মা এক দিন টুক করে চলে গেলেন। তাঁর আর শ্বশুরের ভিটেয় যাওয়া হল না। কবে নাকি তেরো বছরের মেয়ে বৌ হয়ে এসেছিলেন সেই গ্রামে, সেই থেকে সেই গ্রামই যে ছিল তাঁর নিজের বাড়ি ঘর, ভিটে! মা চলে যাওয়ার পরে বাবা একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। বিকেলের দিকে গঙ্গার পাড়ে যেতেন। চুপ করে বসে থাকতেন। খেয়া এ বাড়ির বৌ হয়ে আসার পরে বাবা খেয়ার সঙ্গে টুকটাক কথা বলতেন। ভালবাসতেন খেয়াকে নিজের মেয়ের মতোই। খেয়া যা বলত, তাই মন দিয়ে শুনতেন বাবা। আর মাঝে মাঝে হেসে বলতেন, ‘‘খেয়া এক্কেরে আমার মা জননীর মতো। মনটা এক্কেরে সাদা!’’ কখনও হয়তো দুঃখ করে বলতেন, ‘‘বাবুটার জন্য কিছু রাইখ্যা যাইতে পারলাম না, না এক ফালি জমি, না বাড়ি।’’ খেয়া অমনি বলে উঠত, ‘‘আপনাদের বাঙালদের খালি বাড়ি বাড়ি বাতিক। বাড়ি করে হবেটা কী? ভাড়াবাড়িই ভাল!’’
বাবা চলে যাওয়ার পরে মনোজবাবুর কেমন যেন মনে হত, বাবা বোধহয় চেয়েছিলেন এক বার নিজেদের সাত পুরুষের ভিটেয় যেতে। মায়ের মতো বার বার বলতেন না ঠিকই। কিন্তু, একটা যেন টান ছিল, যেটা প্রকাশ করেননি ভাষায়। খেয়াকে সে কথা বলতেই খেয়া বলেছিল, ‘‘বেশ তো, এক বার তুমি একাই গিয়ে ঘুরে এস না! মনে শান্তি পাবে!’’ অতনু তখন খেয়ার পেটে। খেয়াই এক রকম জোর করে পাসপোর্ট ভিসা টিকিট, সব ব্যবস্থা করেছিল। মাত্র তিনটে দিনের জন্য মনোজবাবু পাড়ি দিয়েছিলেন নিজের সাত পুরুষের ভিটে দেখার জন্যে।
ঢাকা থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে মনোজবাবু গিয়েছিলেন সেই গ্রামে, যা ছেড়ে এসেছিলেন তিরিশ বছর আগে। সুন্দর রাস্তা, বদলে যাওয়া একটা দেশ দেখেছিলেন তিনি। গ্রামে পৌঁছে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন সেই হরিসভা, মন্দির, ঠাকুরানির ঝিল, নদীর পাড়, সব। তাঁদের ছেলেবেলার পাঠশালাটা এখন স্কুল হয়ে গিয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছেছিলেন সেই ভিটেয়। সেখানে এখন বড় পাকা বাড়ি। এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবার থাকেন সেই ভিটেয়। মনোজবাবু নিজের পরিচয় দিতে তাঁরা খাতির যত্নের ত্রুটি রাখেননি। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে নদীর সেই পাড়ে এসে বসে ছিলেন সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। দেখতে পাচ্ছিলেন, নৌকা চলেছে ঘর ছেড়ে যাওয়া এক পরিবার নিয়ে, পিছন পিছন সাঁতরে যাচ্ছে কালো একটা কুকুর। মায়ের আর্ত মিনতি, ‘‘কাইল্যা, চইলা যা মানিক!’’
ফিরে আসার সময় বাড়ির কর্তা বললেন, ‘‘এই জিনিসগুলা আপনারে নিতে হইব। এই ভিটা কিনবার পরে আমরা নতুন বাড়ি বানাইবার সময়, পুকুরের ঘাটের কাছ থাইক্যা এইগুলা পাইছিলাম। এই সব রুপা তামা পিতলের বাসন, পূজার বাসন সব। আমরা সব যত্ন কইরা রাইখ্যা দিছিলাম।’’
মনোজবাবুর চোখে জল এসে গিয়েছিল। এ সব তাঁর মায়ের হাতের যত্ন পাওয়া বাসন। বাড়িতে ব্যবহার হত এগুলো, পূজার সময়ে। তিনি শুধু এক বার হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, আমায় মাফ করবেন। এ সব তো নেওয়া যাবে না। আইনে আটকাবে। আমি যে খালি হাতে এসেছি!
গাড়িতে ওঠার আগে তাঁরই অনুরোধে বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি এক কোদাল মাটি একটা ব্যাগে ভরে দিয়েছিল, আর একটি আমগাছের চারা। সেই মাটি সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন মনোজবাবু একটা টবে, সেই আমের চারা সুদ্ধ। অতনু হওয়ার পর পর মনোজবাবু অফিস থেকে পেয়ে গিয়েছিলেন এই কোয়ার্টার। খেয়া বহু যত্নে সেই মাটি আর আমের চারা বসিয়ে দিয়েছিল বাসার পিছন দিকের এই এক ফালি জমিটায়। ক্রমে এখানে একটা বাগান তৈরি করে ফেলেছিল খেয়া। সেই চারা বড় হয়েছে, অনেক বড়। একটু একটু করে ফলও দিতে শুরু করেছে। আজ সব ছেড়ে চলে যেতে হবে মনোজবাবুকে। এই কোয়ার্টারের মেয়াদ শেষ, কিন্তু স্মৃতি তো কোনও মেয়াদ মানে না। এই আমগাছ, এই ছোট্ট বাগানের ছায়াটুকু মনোজবাবুর কাছে কতখানি, তা অতনু বা অতসী বুঝতে পারবে না।
অতসী এসে ডাক দেয়, ‘‘বাবা এস, গাড়ি এসে গিয়েছে!’’
মনোজবাবু বলেন, ‘‘ওই আমগাছটার তলা থেকে একটু মাটি নিয়ে নিস, মা। নতুন বাড়ির বাগানে মিশিয়ে দেব।’’
অতসী বলল, ‘‘ওখানে বাগান কোথায় বাবা? সব তো শান বাঁধানো! ঠিক আছে, টবে রেখে দেব!’’
অতসী বাগানটার দিকে যায়, মনোজবাবুও উঠে পড়েন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। গাড়িতে উঠতে উঠতে হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে, ছেলে অতনু যেন ফিরে এসেছে অনেক বছর বাদে এই কোয়ার্টারটায়, কোনও এক দিন। তখন সেখানে অন্য লোক, অন্য পরিবার, অন্য সাজসজ্জা। অতনু হয়ত বিনীত ভাবে বলছে, ‘‘একটু ও পাশের বাগানটায় যাওয়া যাবে? ওই আমগাছটার কাছে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy