Advertisement
৩০ ডিসেম্বর ২০২৪
Smaranjit Chakraborty

চুয়ান্ন

পূর্বানুবৃত্তি: মার্চেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ়ের অফিসে পুঁটি দেখতে পায় চন্দন সিংকে। লোকটি অসৎ এবং ধান্দাবাজ। ওকে এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল পুঁটির। কিন্তু চন্দন সিং নিজে এসে আলাপ করে পুঁটির সঙ্গে। ও দিকে, রাস্তায় পুঁটির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা সাবুকে বলে লামাদাদু। সাবু বলতে পারে না পুঁটির হৃদয়ঘটিত সমস্যার কথা। আগের দিনই বাড়িতে দিদির টি-শার্ট পরে ফেলায় দিদি চেঁচামেচি করে, ফলে মায়ের কাছে বকুনি খেতে হয় সাবুকে। ছোট থেকেই মায়ের মারধর খেয়ে বড় হয়েছে সাবু। দিদি চিরকাল ছিল বেস্ট গার্ল। সুন্দরী, বাধ্য, লেখাপড়ায় ভাল মেয়ে। আমি লেখাপড়ায় ভাল হলেও বাধ্য ছিলাম না।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

দিদি চিরকাল ছিল বেস্ট গার্ল। সুন্দরী, বাধ্য, লেখাপড়ায় ভাল মেয়ে। আমি লেখাপড়ায় ভাল হলেও বাধ্য ছিলাম না। বরং বাড়ির কথা না শুনে বাড়ির এটা-ওটা নিয়ে গিয়ে ভিখিরিদের দিয়ে আসতাম। এক বার মনে আছে, বাবা মায়ের জন্য পুজোয় চারটে শাড়ি কিনে দিয়েছিল। তার মধ্যে থেকে মভ রঙের একটা সিল্কের শাড়ি আমাদের পাড়ার শেষে একটা ভাঙা বাড়ির সিঁড়ির তলায় থাকা দিদিমাকে দিয়ে এসেছিলাম। মা যা মেরেছিল না! বেল্টের বাক্‌ল দিয়ে মেরেছিল আমায়। এখনও ডান পায়ে কাটা দাগ আছে আমার।

রাত্তিরে বাবা বলেছিল, ‘‘শুধু শুধু মার খেলি। আমায় বললেই আমি আর একটা শাড়ি কিনে এনে দিতাম তোকে। তুই ওই দিদিমাকে দিয়ে আসতিস!’’

বাবা-ই যা বোঝে আমায়। ভালও বাসে। কিন্তু বাড়িতে মা আর দিদির সামনে যেন গুটিয়ে থাকে বাবা। লেখার জগতে বাবার খুব নাম। কিন্তু তা বলে তো আর বিশাল রোজগার নয়। মা মাঝে মাঝেই দেখেছি— আমাদের কেন বড় সেডান গাড়ি নেই! কেন এখনও দশ বছরের পুরনো হ্যাচব্যাক— সেটা নিয়ে বাবাকে খোঁটা দেয়। দিদিও বলে। আমি ওদের বারণ করি। কিন্তু ওরা শোনে না। আর আমার নির্ঝঞ্ঝাট বাবা এ সব আক্রমণের সামনে পড়ে দিন দিন আরও কেমন যেন গুটিয়ে, একা হয়ে যাচ্ছে।
কাল রাতেও বাবা এসেছিল আমার ঘরে। সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট হল টিপিকাল নর্থের গলি। চার দিকে পুরনো বাড়ির মাঝে গ্রামের আঁকাবাঁকা ছোট নদীর মতো রাস্তা। আমার ঘরে একটা গোল ছোট ব্যালকনি আছে। বাড়ির দেওয়ালে চায়ের ছাঁকনির মতো ঝুলে থাকে।

আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে। বাবা এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল। নিঝুম রাতে কয়েকটা কুকুর ঘুরছিল নীচে। আকাশ লাল হয়ে ছিল মাথার উপর। আর সামান্য ফাঁকফোকর দিয়ে কত দিন পর ঠান্ডা একটা হাওয়া এসে ঘুরছিল আমাদের পলস্তারা খসা পাড়ায়। তার সঙ্গে নিয়ে আসছিল নানা বইয়ের গন্ধ, বট-অশ্বত্থের রিমঝিম আর পুরনো বাড়ির দেওয়ালের ঘ্রাণ। দূরে কলকাতা আরও শান্ত আর ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিল। কলকাতা উত্তরের এই সব পাড়া দেখলে কেমন একটা কষ্ট হয় আমার। মনে হয় একটা কুণ্ঠিত পল্লি যেন! এক সময়ের সব ঐশ্বর্য হারিয়ে আজ অবহেলার পাত্র হয়ে পড়ে আছে।

বাবা এসে আলতো করে হাত দিয়েছিল মাথায়। বলেছিল, ‘‘শুবি না? শুয়ে পড়।’’

‘‘তুমি কেন ওদের কিছু বলো না বাবা!’’

বাবা কী বলবে বুঝতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘‘আমি যে গলার জোর খাটাতে পারি না।’’

ঠিক। বাবা পারে না অমন চেঁচিয়ে কথা বলতে। অন্যকে অপমান করতে। কষ্ট দিতে। ছোট করতে। নিজেকে ‘আমি ঠিক’ বলে জাহির করতে। আজকাল এ সব না করতে পারলে কেউ কিছু নয়। আজকাল সারা ক্ষণ সবাইকে নিজের মত প্রকাশ করে যেতে হবে। ঝগড়া করে যেতে হবে। ‘আমি কে জানিস!’ ভাব দেখিয়ে যেতে হবে। ভদ্র, ভাল হয়েছ কি লোকজন এসে টুক করে বধ করে দিয়ে চলে যাবে।

বাবা বলেছিল, ‘‘মলির জিনিসে হাত দিস না। তোকে কাল টি-শার্ট এনে দেব। এখন শুয়ে পড়।’’

আমি বাবার দিয়ে তাকিয়েছিলাম। সেই ছোটবেলার মতো মনে হচ্ছিল আমার। মা মারলে, রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর বাবা এসে বসত আমার পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। চুল সরিয়ে দিত কপাল থেকে। গায়ের চাদর টেনে দিত। আমি জেগে থাকলেও চোখ বন্ধ করে থাকতাম। জানান দিতাম না যে জেগে আছি। মনে হত বাবা যেমন মানুষ, আমি জেগে আছি জানলেও গুটিয়ে যাবে।

গত রাতেও অবিকল তেমন লেগেছিল আমার। বাবার চোখেও কি সামান্য জল চিকচিক করছিল? স্ট্রিট লাইট থেকে ছিটকে আসা আলোয় সেই জলটা কেমন নীলচে লাগছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম এমন অবস্থায় চোখ থেকে নীল রঙের জলের ফোঁটা পড়ে! কান্নার রং যে কত রকমের হয়!

আমি লামাদাদুর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমায় এ বার লেক রোডে যেতে হবে। সেখানে একটা বড় কফি শপে আজ আমায় দেখা করতে বলেছে এনা। সেই যে ফোন করেছিল! তার সূত্র ধরে আমার সঙ্গে আজ কথা বলতে চেয়েছে ও। কেন চেয়েছে কে জানে!

আমি তো বেশ কয়েক বার কাটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা মেসেজের পর মেসেজ করে যাচ্ছে। দেখলেই গা-পিত্তি জ্বলে যায়। কলেজে তো পাত্তাই দিত না! র‌্যাম্পে হাঁটা মডেলদের মতো নাক আকাশের মেঘে বেঁধে ঘুরে বেড়াত! ওকে যদি কোনও দিন আমি শূর্পণখা না করেছি তা হলে আমার নামও সর্বোত্তমা নয়!

নরেন্দ্রপুর থেকে লেক রোড আসতে আমার চল্লিশ মিনিট মতো লাগল। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার অবশ্য রেনকোট আছে। তাও পিনের মাথার মতো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি এসে হেলমেটের সামনের কাচে লাগছিল। অসুবিধে হচ্ছিল স্কুটি চালাতে। বার বার সিগনালে দাঁড়ালেই সামনের কাচটা মুছতে হচ্ছিল।

লেক রোডের দোকানটা সবে খুলেছে এখন। তেমন ভিড় নেই। আমি স্কুটিটাকে একটা পাশে রেখে রেনকোটটা খুলে গুটিয়ে স্কুটির সিটের তলায় ঢোকালাম। আর ঠিক তখনই একটা ফোন এল।

এখন আবার কে রে বাবা! আমি জিন্‌সের পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলাম। আরে, দীপ্যদা! আমায় তো দীপ্যদা খুব একটা ফোন করে না! তা হলে এখন কেন করল!

আমি কাফেতে ঢোকার সামনের চওড়া সিঁড়ির এক পাশে সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে লাগালাম, ‘‘বলো দীপ্যদা।’’

‘‘সাবু!’’ দীপ্যদার গলায় কেমন একটা টেনশন।

আবার কী হল! আমি ভাবলাম, লোকটা তো সারা ক্ষণ ‘কুল’ থাকে। কোনও বিপদ হল কি?

‘‘কী হয়েছে? সব ঠিক আছে?’’

দীপ্যদা বলল, ‘‘আমার তোমার সঙ্গে খুব জরুরি দরকার আছে। আমি আসলে গোয়ায় এসেছি। পরশু ফিরব। তার পর দেখা করব। প্লিজ়।’’

‘‘বাড়িতে এসো। তুমি তো আসো। সেখানেই কথা হবে!’’

দীপ্যদা বলল, ‘‘না। তোমার সঙ্গেই দরকার। আমি চাই না আর কারও সামনে কথাগুলো বলতে। আমি এসে তোমায় ফোন করব। তুমি প্লিজ় একটু সময় কোরো।’’

‘‘সব ঠিক আছে তো দীপ্যদা?’’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

দীপ্যদা একটু যেন সময় নিল। তার পর বলল, ‘‘সব ঠিক করব বলেই দেখা করে তোমার সঙ্গে কথা বলা দরকার। বুঝলে? আচ্ছা রাখি। ভাল থেকো।’’

দীপ্যদা ফোন কাটতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি এল আবার। আমি দ্রুত কাফের সামনের সিঁড়িতে উঠে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

ঢুকেই একটা কাচের দেওয়াল। পাশে অর্কিড সাজিয়ে রাখা। কাফেটা পুরো ফাঁকা। না, পুরো ফাঁকা নয়। ওই দূরে একটা থামের আড়ালে বসে আছে এনা আর সঙ্গে... ওরে বাবা, অন্য একটা ছেলে! কে ছেলেটা?

আমি আরও দু’পা এগোলাম। দেখলাম ছেলেটা এনার চুল হাতে পাকাতে পাকাতে কথা বলছে। আর তার পর আচমকা এনার পিঠে হাত দিয়ে ওকে আলতো করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। এনাও ছেলেটার কলারটা মুঠো করে ধরল! ছেলেটা কে? ওর নতুন প্রেমিক! এর জন্যই কি পুঁটিকে তাড়িয়েছে নিজের জীবন থেকে?

দেখলাম, দুজনে একেবারে বিভোর! বিশ্বসংসার ভুলে গিয়েছে। আমি দ্রুত পকেট থেকে মোবাইলটা বার করলাম। তার পর ক্যামেরা অন করে ওদের দিকে তাক করে জ়ুম করলাম। এ বার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার পর খচ খচ করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম ওদের চুম্বন মুহূর্তের!

এটা কি অন্যায় করলাম? ভুল করলাম? এ ভাবে অন্যের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি তোলা তো ভুল, তাই না?
কিন্তু করলে, করেছি। বেশ করেছি! সারা ক্ষণ এ ভাবে এক ডাল থেকে আর এক ডালে ঘুরে বেড়ানো, অন্যদের কষ্ট দেওয়া, সে সব খুব ঠিক কাজ না কি? আর শুনুন, সারা ক্ষণ অত ব্যাকরণ মেনে চলতে পারব না আমি, বুঝেছেন?

পুঁটি (দিন : তেরো)
আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার খুব ভক্ত। সেই ছোটবেলা থেকে। বড়দের হোক বা ছোটদের, ওঁর প্রায় সব লেখা আমার পড়া। কোনও ম্যাগাজ়িনে ওঁর লেখা থাকলে সেটা আমি কিনবই। পুজো সংখ্যায় বেরনো ওঁর উপন্যাস যখন বই হয়ে বেরয়, সেগুলো পড়া হয়ে গেলেও আমি প্রতিটি বই কিনে রাখি।

খবর নিয়ে জেনেছি যে, জোধপুর পার্কের কোথায় যেন থাকেন উনি। নিজে এখনও দোকান বাজার করেন। অনেক দিন আগে এক বার মেট্রোয় আমি ওঁকে দূর থেকে দেখেছিলাম। সবাই ওঁকে বসার জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিল। কিন্তু উনি কিছুতেই বসছিলেন না। বরং সামান্য হেসে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন ওই বসার অনুরোধ।

আমি দূর থেকে দেখে ভাবছিলাম, যাব সামনে একটু? কথা বলব? তার পর আর সাহস করে উঠতে পারিনি। আমার সঙ্গে সে দিন এনা ছিল। ও বলছিল, ‘‘যা না, কথা বল।’’

কিন্তু আমি জানি, সামনে গেলে কোনও আওয়াজই বেরবে না মুখ দিয়ে! তা ছাড়া আমি সামান্য মানুষ, এমন মুগ্ধ পাঠক তো ওঁর কত্ত আছে! শুধু শুধু ওঁকে বিরক্ত করতে মন চায়নি।

কিন্তু সত্যি বলছি, আমার আজকাল প্রায়ই মনে হয়, উনি আমাকে, মানে লোহিতাশ্ব মুখোপাধ্যায়কে নিশ্চয়ই চেনেন। না হলে কী করে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ লিখলেন! ওটা তো অনেকটা আমাদের বাড়ির মতোই!

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjit Chakraborty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy