Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৬
Smaranjit Chakraborty

চুয়ান্ন

জিনাদি কিছু বলল না। শুধু হুম্ শব্দ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেয়ে যেতে লাগল। আর আমি আবার ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:০০
Share: Save:

জিনাদি হাসল। তার পর আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, “প্রেমে পড়েছিস না কি রে?”

সেই এক মান্ধাতার আমলের কথা। কেউ চুপ করে একা একা থাকলেই যেন প্রেমে পড়তে হবে! আর যেন তার চুপ করে থাকার অন্য কারণ থাকতে পারে না!

কিন্তু জিনাদি আমার বস। তাকে তো আর আমি বিরক্তি দেখাতে পারি না!

বললাম, “জিনাদি, আমায় কবে নর্থ বেঙ্গলে ট্রান্সফার করবে গো?”

“কেন? এত তাড়া কিসের তোর?”

আমি বললাম, “বলো না! নতুন টেরিটরি। আমি এক্সপ্লোর করতে চাই। প্লাস পাহাড় আমার ভাল লাগে খুব। চেঞ্জ অব প্লেস হলে কাজে উদ্যম পাব!”

“পালাতে চাইছিস? কেন রে? ছেলেটার সামনে বিয়ে না কি?”

আবার এক কথা! শালা, সবাই এমন কেন কে জানে! আমার যে কী জ্বালা জীবনে, সেটা যদি বুঝত!

আমি বললাম, “ও রকম কিছুই নয় জিনাদি। তুমি তো আমায় জানো।”

“না রে, জানি না। কী করে জানব! আমরা কেউ কি কাউকে জানি! এই না জানা থেকেই তো

যত গোলমাল।” জিনাদি সামনে বসা ড্রাইভারকে এসিটা বন্ধ করতে বলে জানলার কাচ নামাল। সিগারেট খাবে।

আমি অন্য দিকে মুখ ঘোরালাম। জিনাদির আজ মিটিং ছিল একটা। ফুড ব্যান্ডিটের একটা অ্যাপ লঞ্চ হবে। সেটা নিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ আলোচনা হয়েছে। এটা হলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে। লোকজন অনেক সহজে আমাদের কন্ট্যাক্ট করতে পারবে।

তা ছাড়া আর এক জন ইনভেস্টর আমাদের কাজে ইনভেস্ট করতে চায়। তারা চায় আমরা যেন খাবারের সঙ্গে ওষুধও এ রকম করে তোলার ব্যবস্থা করি। বহু মানুষ আছে যাদের বাড়িতে ওষুধ পড়ে পড়ে নষ্ট হয়। সে সবও যদি আমরা তুলতে পারি, তা হলেও মানুষের উপকারে লাগবে। কিন্তু এতে বাড়তি ওয়ার্ক ফোর্স লাগবে। বিদেশি ফান্ডিং যা পাই, তাতে সেটা করা যাবে না। কিন্তু লোকাল ফান্ডিং যদি পেয়ে যাই, তা হলে অসুবিধে হবে না। কিন্তু সব কিছুতেই তো একটা ক্যাচ থাকে। এখানে ক্যাচটা হল, নতুন ইনভেস্টর কোম্পানিটি তাদের নাম আমাদের সঙ্গে ঢোকাতে চায়। ওদের মূল ব্যবসা হল লিকার বা মদ-এর। তাই ওরা একটা সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও নিজেদের যুক্ত করতে চায়। এতে নাকি ওদের ব্র্যান্ডিং ভাল হবে, সঙ্গে নাকি প্রফিট মার্জিন ম্যানেজমেন্টটাও ঠিক হবে।

এই শেষের ব্যাপারটাই গোলমেলে। তা ছাড়া আমাদের এত দিনের কাজে আমরাই বা কেন অন্যদের নামের ভাগ দেব! আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি নাক গলালে খবরদারিও করবে নিশ্চিত। ওদের কথা শুনে মনে হয়েছে যে, সব কিছুতেই ওরা মাইক্রো-ম্যানেজ করতে চায়!

যাই হোক। জিনাদি সব শুনেছে। এ বার দিল্লিতে গিয়ে আরও উপরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলবে। দেখা যাক তারা কী বলে।

জিনাদি সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তোর কী মনে হয়, আমাদের কি এই লিকার কোম্পানির টাকা নেওয়া উচিত?”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমি জানি আমার কথায় কিছুই হবে না।

“কী রে বল! আই ওয়ান্ট ইয়োর ওপিনিয়ন।”

আমি বললাম, “আমার মনে হয় উচিত। যদিও সাধারণ লোকজনের মদ নিয়ে একটা আদিখ্যেতা আছে। মানে নিজে খাবে, কিন্তু প্রকাশ্যে একটা ভুরু কোঁচকানো ভাব দেখাবে। তাও, টাকার গায়ে তো কিছু লেখা থাকে না। তা ছাড়া, আমরা যদি এক্সপ্যান্ড করতে পারি, আরও বেশি মানুষকে সার্ভ করতে পারব। শুধু দেখা দরকার, যেন ওরা ইনভেস্ট করছে বলে যেন বেশি নাক না গলায়।”

জিনাদি কিছু বলল না। শুধু হুম্ শব্দ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেয়ে যেতে লাগল। আর আমি আবার ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা!

সে দিন কী ভাবে যে আমি পালিয়ে এসেছিলাম দীপ্যদার বাড়ি থেকে, সেটা আমিই জানি। আমার যে কী শরীর খারাপ করছিল! মনে হচ্ছিল যেন আমি কোনও ক্রাইম করে ফেলেছি!

এটা কেন হল, সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। আমি কি এমন কিছু করেছি, যাতে দীপ্যদার মনে হয়েছে আমি দীপ্যদার ব্যাপারে আগ্রহী! কিন্তু আমি তো সামনেই যেতাম না। বাড়িতে দীপ্যদা এলে ভদ্রতা করতে যেটুকু কথা বলতে হয়, সেটুকুই বলতাম! তা হলে এমনটা হল কেন!

আমি যে খুব অপ্রস্তুত হয়েছি, সেটা দীপ্যদা বুঝতে পেরেছিল। তাই আমি চলে আসার আগে বলেছিল, “আমি জানি তুমি আনকমফর্টেবল ফিল করছ। কিন্তু ট্রুথটা তো আমায় বলতেই হবে। আমার যাকে ভাল লাগে, তাকে বলব না যে তাকে চাই আমি! তবে সব কিছু ম্যানেজ করার আগে প্লিজ় এটা কাউকে বোলো না। এটাই আমার রিকোয়েস্ট।”

বাড়ি ফিরে আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না। মাকে শুধু কোনও মতে বলেছিলাম যে, দীপ্যদা ঠিক আছে। দিদি অবশ্য কোনও আগ্রহ দেখায়নি। আর কেন দেখায়নি সেটা আজ সকালে জানা গিয়েছে।

“তুই নামবি কোথাও?” জিনাদি সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল, “আজ আর অফিস যাব না। এক বার বঙ্কুর বাড়িতে যাব। অনেক দিন যাওয়া হয়নি।”

বঙ্কুদা জিনাদির প্রাক্তন স্বামী। সল্টলেকে থাকে। বছর দশেক হল ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ আছে এখনও। কলকাতায় এলে জিনাদি এক বার হলেও বঙ্কুদার বাড়িতে যায়। বঙ্কুদার মাকে এখনও বেশ ভালবাসে জিনাদি।

ডিভোর্সের সময় নাকি বঙ্কুদার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। জিনাদি চলে যাবে, এটা মেনে নিতে পারেনি।

জিনাদি আমায় বলেছিল, “বঙ্কুটা অপদার্থ। কিন্তু ওর মা খুব ভাল মানুষ। আমি ওঁকে খুব মিস করি! অমন তিলের নাড়ু, পালং শাক আর চিতল মাছের মুইঠ্যা আর কেউ রাঁধতে পারে না!”

আমি ঘড়ি দেখলাম। বিকেল চারটে বাজে। এখন বাড়ি তো যাব না। কারণ বাড়ির পরিস্থিতি সকাল থেকে খুব খারাপ হয়ে আছে। তবে কি লামাদাদুর কাছে যাব? কিন্তু তার পরেই মনে পড়ল লামাদাদু আজ নৈহাটি গিয়েছে কোন এক বন্ধুর বাড়িতে। তা হলে?

পণ্ডিতিয়া রোড আমায় খুব টানছে। বেশ কিছু দিন হয়ে গেল পুঁটিকে দেখিনি। মনখারাপ করে ওকে বেশি দিন না দেখলে। তাই ভাবলাম পার্ক স্ট্রিট মোড়ে নেমে যাই। মেট্রো ধরে কালীঘাট চলে যাব। সেখান থেকে অটো করে ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক। কাছেই পণ্ডিতিয়া। পুঁটি।

জিনাদিকে বললাম, “পার্ক স্ট্রিট মোড়ে নামিয়ে দাও। আমি চলে যাব।”

জিনাদি ড্রাইভারকে তেমনই নির্দেশ দিল। তার পর বলল, “নর্থ বেঙ্গল সত্যি যেতে চাস? সিরিয়াসলি বল। আমি তা হলে পরশু ফিরে গিয়েই এই নিয়ে কথা বলব।”

আমি তাকালাম জিনাদির দিকে। জোড়া ভুরু সামান্য কুঁচকে আছে। বড় বড় দু’টো

চোখ সার্চলাইটের মতো ফোকাস ফেলছে আমার মুখের উপর।

আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম। তার পর বললাম, “হ্যাঁ জিনাদি। প্লিজ়। আর ওই কচিদার সঙ্গেও পারলে একটু দেখা কোরো।”

মাথা নেড়ে জিনাদি আর একটা সিগারেট বার করল। তার পর ছোট্ট নীল লাইটারটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, “ছেলেটা কে রে? খুব দাগা দিয়েছে?”

আজ তেরছামতো একটু রোদ এসে পড়েছে পার্ক স্ট্রিট মোড়ে। বড় সাদা বাড়িটার গায়ে কেউ যেন সোনালি রাংতা আটকে দিয়েছে। এই ব্যস্ত বিকেল, সাঁজোয়া গাড়ি, মানুষের মিছিলের মধ্যে কী অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য! কিন্তু কারও কি চোখে পড়ছে! আচ্ছা, আমাদের জীবনও কি এমন ছোট ছোট সৌন্দর্য দিয়ে বোনা থাকে? আমরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হয়ে থাকি বলে দেখতে পাই না?

“কী রে, দেওয়াল বেয়ে উঠবি না কি?” পাশ থেকে একটা গলা পেয়ে আমি ঘুরলাম।

রিজু দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।

“আরে তুই!” আমি একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। আশপাশেও তাকালাম। পুঁটি কি আছে ওর সঙ্গে!

“না পুঁটি নেই। আসেনি। অফিসে আছে।” রিজু হাসল বড় করে।

আমি ভুরু কুঁচকে বিরক্ত হয়েছি এমন ভাব করে বললাম, “আমি জানতে চেয়েছি!”

রিজু বলল, “সব কি মানুষ মুখে বলে জানতে চায়? তা এখানে কী করছিস?”

আমি বললাম, “কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ। তুই?”

“আমি আর কী! ওই বাগালের অফিসে যাচ্ছি। প্রোজেক্ট চলছে না? সেই কারণে ওদের প্রসেস ডিজ়াইনের লোকের কাছ থেকে কিছু পয়েন্ট বুঝে আসতে হবে। কয়েক দিন পরেই তো প্রাইস সাবমিশন। তার আগে টেকনিক্যাল ব্যাপারটায় সব কোম্পানিকে একটা প্ল্যাটফর্মে আনতে হবে। মানে সবার টেকনিক্যাল ডেটা যেন এক থাকে।”

“বুঝেছি, বুঝেছি!” আমি হাত তুললাম, “কী বোরিং!”

“বাট ইট পেজ়।” রিজু হাসল, তার পর আচমকা প্রসঙ্গ বদলে বলল, “রোল খাওয়াবি? ওই দেখ না সামনে রোলের দোকান। চিকেন-ফিকেন না, এগ রোল খাওয়ালেই হবে! খাওয়াবি?”

“এত হ্যাংলা কেন রে তুই? আর তোর না মিটিং আছে!” আমি চোখ পাকালাম, “বলে দেব কাকুকে?”

“আচ্ছা, আচ্ছা,” রিজু রাগের ভঙ্গি করল, “এত কিপটে কেন রে?”

“আমি কিপটে? আর তুই! সেই কলেজ থেকে আজ পর্যন্ত তো কাউকে একটা লজেন্সও খাওয়াসনি! শুধু অন্যেরটা মেরে খাওয়ার ধান্দা! বেহায়া কোথাকার! লজ্জা নেই তোর? ‘খাওয়া’ বলতে লজ্জা করে না!”

আমার কথায় রিজু ঘাবড়ে গেল বেশ। আমিও নিজেও অবাক হলাম। আমি এ সব কী বলছি! হ্যাঁ, যা বলছি সেটা সত্যি। কিন্তু সত্যি কথাগুলোও তো এ ভাবে বলতে নেই। আমাদের জীবনে এমন লোক তো থাকেই যে, ছোঁচার মতো সবাইকে ‘খাওয়া খাওয়া’ বলে বেড়ায়, কিন্তু তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে কখনও জলও গলে না। তা বলে কি বেহায়াদের মুখের উপর বলতে হয় যে, তুমি একটা দু’কান কাটা নির্লজ্জ, বেহায়া!

রিজু, “আমি আজ আসি রে,” বলে কোনও মতে চলে গেল। আমার যে কী হয়েছে! কী সব করছি আমি! আর কিছু না ভেবে মেট্রোর সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লাম আমি।

আজ মেট্রোয় বেশ ভিড়। শুনলাম একটা অল্পবয়সি স্কুলে-পড়া ছেলে সুইসাইড করেছিল নেতাজি ভবনে।

স্কুলের ছেলে! সুইসাইড! কী হচ্ছে সব আজকাল! এত অল্প বয়স থেকে কিসের এমন ফ্রাস্ট্রেশন সবার! কিসের এত কষ্ট যে, আত্মহত্যা করতে হবে! আসলে আমার মনে হয়, আজকাল প্রায় প্রত্যেকের দুটো করে জীবন হয়ে গিয়েছে। একটা নিজের চারপাশের, অন্যটা ভার্চুয়াল। এই দুটোয় নিজেকে খাপ খাওয়াতে আর সামাল দিতে গিয়েই সবাই ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলছে। লোকের সামনে নিজেকে ভার্চুয়ালি বড় করে প্রোজেক্ট করছে, আর সত্যিকারের জীবনে সেই লেভেলে নিজেকে তুলে আনতে গিয়েই নানা সমস্যা হচ্ছে। জটিলতা বাড়ছে। সবাই আজকাল খুব ক্ষণস্থায়ী বাঁচায় বিশ্বাসী। সবটাই যেন থার্টি সেকেন্ডস অব ফেম! কেউ কারও কথা ভাবছে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjit Chakraborty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy