ছবি: পিয়ালী বালা
পূর্বানুবৃত্তি: ইনস্পেক্টর ঘোষালের কথা শুনে আদৌ ঘাবড়াল না আকিঞ্চন। কিন্তু হাওয়া ক্রমশ খারাপ দিকে ঘুরল। দীর্ঘ ক্ষণ থানায় বসে থাকার পর খবর পাওয়া গেল যে, রাধিয়া শ্রীবাস্তব আত্মহত্যা করেছে। লকআপে ঢোকা ছাড়া উপায়ান্তর রইল না আকিঞ্চনের। অন্য দিকে মিশুকের জন্য মন খারাপ হতে ফোনে ঠিকানা জেনে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল কস্তুরী। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে বেশ অবাক হল সে। অভিনেত্রীর বাড়ি হিসেবে সে যা যা কল্পনা করেছিল, বাস্তবে মিশুকের বাড়ি তার ধারে কাছেও এল না।
এক জন অপরিচিতের কাছে এত বেত্তান্তের দরকার ছিল না। কস্তুরী জিজ্ঞেস করল, “চাকরি করেন আপনার উনি?”
“না। আগে বিজ়নেস করত। লস-টস খেয়ে এখন বাড়িতেই থাকে। যাকগে, আমার নাম আরতি। আপনি যোধপুর পার্ক থাকেন না? বাবা! এই রোদে এতটা এলেন! মিশু আপনার কথা অনেক বার বলেছে আমাকে। যে দিন প্রথম বার বলে সে দিন আমি আর উনি তো অবাক! আমার ছোটটি সারা দিন পাড়া টইটই করে বেড়াচ্ছে। বড় মেয়েটা আবার একেবারেই মিশতে পারে না। একমাত্র বন্ধু হিয়ান্তিকা। তাই এত দিন বাদে যখন শুনলাম আপনার সঙ্গে চেনাজানা হয়েছে, আমরা তো অবাক! একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না তো ভাই?”
“না, মনে করার কী আছে। কী ব্যাপার?”
“আসলে প্রথম প্রথম আপনাকে আমরা সন্দেহ করতাম। বুঝতেই পারছেন, মিডল-ক্লাস মেন্টালিটি আমাদের। ভাবতাম ও খারাপ সঙ্গে পড়েছে। আসলে আপনার বয়সটা তো ঠিক... মানে ওর বন্ধু হওয়ার পক্ষে... বুঝতেই পারছেন...” ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলেন আরতি।
“ও আমার মেয়ের মতো।”
“ও মা! তাই? আপনার ছেলেমেয়ে নেই বুঝি?”
“আছে। এক মেয়ে। তবুও... আসলে সম্পর্ক জিনিসটাই তো অদ্ভুত।”
“তা ঠিক, তা ঠিক। এই তো মিশু এসে পড়েছে।”
মিশুক ঘরে ঢুকেই কস্তুরীকে দেখে প্রায় লাফিয়ে উঠল, তার পর “বিবি-ই-ই-ই!” বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে কস্তুরীর কোলে বসে পড়ল। কস্তুরী একেবারে অপ্রস্তুত! দৃশ্য দেখে আরতিদেবীর হাতের কাপ হাতেই রয়ে গেল। তিনি এতটা আশা করেননি। হাতকাটা গেঞ্জি আর ছোট্ট হাফপ্যান্টে এখন মিশুককে দেখলে কে বলবে, এই মেয়ে পর্দায় দাপিয়ে অভিনয় করে! ক্লাস টেনে পড়া মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। আরতিদেবী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “করছিস কী মিশু? ওঁকে বসতে দে, চা-টা খেতে দে।”
“আরে দূর। এ তো আমার বিবি।”
“বিবি আবার কী নাম? আন্টি বল, মাসি বল।”
“ধ্যাত। বিবিকে আমি মাসিমা, কাকিমা এ সব বলতে পারব না। বিবি মানে কী জানো মা? বিবি মানে ভীষণ ভাল।”
“বুঝুন! আপনি চা-বিস্কুট খান ভাই। চা-টা জুড়িয়ে যাচ্ছে।”
মিশুক কোল থেকে উঠে পড়ে বলল, “এই গরমে আর চা খেতে হবে না। বিবি তুমি আমার ঘরে এস। তোমাকে কোল্ড ড্রিংক্স খাওয়াচ্ছি।”
আরতিদেবী বললেন, “খুব জেদি মেয়েটা। এক বার হ্যাঁ করলে না করায় কার সাধ্যি। আপনি যান ওর সঙ্গে। দুপুরে কিন্তু খেয়ে যেতে হবে ভাই। অবেলায় আপনাকে ছাড়ব না।”
কস্তুরী মৃদু আপত্তি করলেন, “আরে না না। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। এখান থেকে বেরিয়ে এক বার টেলিফোন অফিসে যেতে হবে। আর এক দিন আসব না-হয়।”
মিশুক হাত ধরে টান দিল, “ও সব দেখা যাবে। আগে আমার সঙ্গে এস।”
অগত্যা মিশুকের সঙ্গে সঙ্গে লাগোয়া একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল কস্তুরী। এটাও বহরে বেশি বড় নয়। আসবাবও সামান্য। একটা লন্ডভন্ড খাট, একটা বুক-শেলফ, একটা কাঠের আলমারি, তার উপরে কুরুশের কাজের ঢাকনি, একটা টেবিল। ব্যস। খাটের হাল দেখে পলকে মেহুলির কথা মনে এল। বিছানায় বসে কস্তুরী বলল, “কী হাল করে রেখেছিস বিছানাটার তিতি? এ তো পাগলের কাণ্ড।”
“এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। আমি গুছিয়ে নেব। দাঁড়াও।”
তিতি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং ফিরে এল দুটো ঠান্ডা পানীয়ের গ্লাস নিয়ে। ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে কস্তুরী বলল, “বেশি হাঁটাহাঁটি করিস না।”
“ভাঙেনি। মলম লাগিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ করতে হবে। আর একটা এক্স-রে।”
“কই মলম কোথায়? ব্যান্ডেজ কই?”
“ওই তো টেবিলে। আমি লাগিয়ে নেব বিবি। এখন তোমার সঙ্গে গল্প করি একটু? প্লিজ়?”
পাশের টেবিল থেকে ক্রেপ ব্যান্ডেজ আর মলমের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে কস্তুরী বলল, “তিতি, আমি কিন্তু বকব এ বার। দেখি পা।”
মিশুক প্রথমে একটু আঃ-উঃ করলেও পরে চুপ করে গেল। ব্যান্ডেজ জড়াতে জড়াতে কস্তুরী মুখ তুলে দেখল, তাকে একদৃষ্টে দেখছে মিশুক। কস্তুরী বলল, “কী দেখছিস? আমি কিন্তু খুব কড়া মা।”
“মেয়েকে বকো এই ভাবে?”
কস্তুরী জবাব দিতে গিয়ে চুপ করে গেল। কী বলবে মিশুককে? মেহুলি আর বকার জায়গায় নেই। অনেক আগে বকাবকি করত। মেয়ে চুপ করে থাকত, কিন্তু আকিঞ্চন চেঁচামেচি করত। মেয়ের কোনও দোষ নেই, বাপই মেয়ের সর্বনাশটা করল। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে দিল কস্তুরী। প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলল, “তোর কলটাইম নেই? এই পায়ে হাঁটাহাঁটি করবি কী করে?”
ফিক করে হেসে দিল মিশুক। বলল, “তুমি আমাদের টার্মগুলো শিখে নিয়েছ? আর কলটাইম! আর কোনও দিন ফ্লোরের মুখ দেখতে পাব কি না কে জানে!”
“মানে? এই সামান্য চোটে?”
“তা নয়। ঝামেলা লেগেছে।”
“কিসের ঝামেলা?”
গুছিয়ে বসে হাতের গ্লাসের একটা চুমুক দিয়ে মিশুক বলল, “বলছি শোনো। লাস্ট কয়েক মাস হয়ে গেল আমরা রেগুলারলি পেমেন্ট পাচ্ছি না।”
“সে কি রে? কাজ করিয়ে টাকা দেয় না?”
“আগে দিত। আগের মাসের টাকা এই মাসের শুরুতেই। চেকে। টিডিএস-ফিডিএস কেটেকুটে সব হিসেব পরিষ্কার। মাস সাতেক হল এই কাণ্ড শুরু হয়েছে। এখনও আমি জুন মাসের টাকা পাইনি।”
“সে কী!”
“হ্যাঁ। এই নিয়ে গন্ডগোল।”
“তা হলে সিরিয়ালগুলো বন্ধ হয়ে যাবে?”
“এখন যা দেখছ সব ব্যাঙ্কিং। অর্থাৎ আগে থেকে শুট করে রাখা স্টক। এই সপ্তাহের মধ্যে ঝামেলা না মিটলে রিপিট টেলিকাস্ট দেখানো হবে।”
“যাহ।”
“কিন্তু টাকা দিচ্ছে না কেন?”
“ওরা বলেছে এটা টেম্পোরারি ক্রাইসিস। আর মাস চারেকের মধ্যেই পেমেন্ট রেগুলার হয়ে যাবে। কিন্তু রিটন কিছু দেবে না এখনই। সেই কারণেই কাজ বন্ধ।”
“এই কাজ বন্ধের সময়ের টাকা দেবে?”
“নাঃ। আমি তো স্যালারি-পেড নই। যত দিন কাজ তত দিন টাকা। এখানে দু’ধরনের আর্টিস্ট আছে। যাদের মাসিক স্যালারিতে কাজ, তাদের চ্যানেলের অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। আর আমি সে রকম নই। কাজ অনুযায়ী টাকা। তাই আমি অন্য চ্যানেলেও কাজ করতে পারি। তবে লিড পাব না। বিবি, ভাল কথা মনে করালে। একটা গুড নিউজ় আছে।”
“কী রে?”
“বড় চ্যানেল থেকে ডাক এসেছে। রেড উইন্ডোজ় প্রোডাকশন হাউস থেকে ফোন এসেছিল কাল সকালে। তোমাকে প্রিন্সেপ ঘাটে বলব-বলব করেও ভুলে গেছি। এই সেরেছে! তুমি আবার মা-র সামনে সব্যসাচীর নাম করোনি তো?”
“আরে না।”
“এখনই বোলো না। ঝামেলা করবে। আসলে মা খুব পেটপাতলা, জানলেই বাবাকে বলে দেবে। বাবা চেঁচামেচি শুরু করে দেবে। বাবা খুব ধর্ম-টর্ম মানে আর কী। ওরা তো ব্রাহ্মণ নয়।”
“মাই গড! এখনও এ সব কেউ মানে-টানে না কি? তা হলে? বিয়ে?”
“ও সব পরে ভাবব। আগে চুটিয়ে প্রেম তো করে নিই। হি হি হি! জানো, সব্য খুব ভাল। একদম তোমার মতো। ভাল চাকরিও করে। রাজারহাটে। ওই যে আইটি সেক্টর আছে না? সেইখানে।”
“বুঝলাম। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“বলো না। হেজ়িটেট করছ কেন?”
“তুই পুজোয় কী নিবি?”
“কিচ্ছু না। সিরিয়াসলি কিচ্ছু না। আমি পছন্দ করি না বিবি। তোমাকে ফার্স্ট ডে বলেছিলাম না? এই দেখো, ও ভাবে মুখ গোমড়া করতে হবে না। আসলে পুজোর জন্য আট পিস জামাকাপড় হয়ে গেছে। আগের তিন সেট চুড়িদার রয়েছে। আলমারি উপচে পড়ছে। প্লিজ়। আচ্ছা, দিলে আমাকে অন্য কিছু দিয়ো। ড্রেস মেটিরিয়াল ছাড়া।”
কস্তুরী নিচু স্বরে বলল, “সব্য কিছু দেয়নি?”
মিশুক আরও নিচু গলায় বলল, “দিতে চেয়েছিল। নিইনি। তোমাকে বললাম না রিজ়নটা?”
“আজ আসি রে। টেলিফোনের অফিসে যেতে হবে এক বার।”
“পরে যেয়ো। অন্য কোনও দিন যেয়ো।”
“না রে তিতি। তোর মা না হলে আমাকে ঠিক পাকড়ে ফেলবে।”
বলতে বলতে আরতি দেবী ঘরে ঢুকলেন হাতে একটা প্লেট নিয়ে। বললেন, “পাকড়ে তো ফেলবই। খালি গপ্পগুজব করলে হবে? মাছভাজা খেতে হবে।”
“এ সব আবার কী? আপনি বসুন না। সবাই মিলে গল্প করি।”
“তার কি জো আছে ভাই? মায়ের স্নানের সময় হল। স্নান মানে ভিজে গামছা দিয়ে গা মোছানো। তার পর খাইয়ে দেওয়া। তার পর এখনই মিশুর বাবা এসে বলবে, ‘স্নানে যাচ্ছি, ভাত দাও।’ আর স্নান করে এসে এক মিনিট দাঁড়াবে না। দু’মিনিট দেরি হলেই বেরিয়ে যাবে। বড্ড বদরাগী।”
“কিন্তু...”
“কোনও কিন্তু নয়। ইলিশ মাছ।”
“এটা তো সিজ়ন নয়। পেলেন কোথায়?”
“আমার মামাবাড়ি বাংলাদেশে। মামাতো ভাই এসেছিল। এই তো কাল ফিরে গেল। এটা পদ্মার ইলিশ। খেয়ে দেখুন।”
“আচ্ছা, আমরা দু’জনে খাচ্ছি।”
মিশুক হাঁ-হাঁ করে উঠল, “আমি ওর মধ্যে নেই। বাব্বা! কী তেল! আমি স্পাইসি আর অয়েলি ফুড অ্যাভয়েড করি। তুমি খাও।”
কস্তুরী কোনও কথা না বলে খুব ছোট্ট এক টুকরো ভেঙে মিশুকের মুখে তুলে দিল। প্রথমে মুখ সরিয়ে নিলেও পরমুহূর্তে কপ করে মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল, “চলো বেড়িয়ে আসি।”
“কোথায় রে?”
গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে মিশুক বলল, “চল হাইল্যান্ড পার্ক যাই।”
“তোর পায়ের এই অবস্থায়? মাথা খারাপ?”
“পা ঠিক আছে। বেশি আতুপুতু কোরো না তো। যাব তো গাড়িতে। আর হাঁটাহাঁটি না করলে ব্যথা বাড়বে। ডাক্তারকাকু বলেছে।”
“ডাক্তার বলেছে হাঁটাহাঁটি না করলে ব্যথা বাড়বে? ওরে বদমাশ মেয়ে!”
মিশুক হাসিতে গড়িয়ে পড়ল। হাসি থামলে বলল, “তবে একটু দাঁড়াও। আর এক জন মেম্বারের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।”
“কে? বোন?”
“আরে না। তার কথা তো তুমি জানো। আমি যার কথা বলছি সে এখন বোনের সঙ্গে পাড়া বেড়াতে গেছে। আর আমি আওয়াজ পাচ্ছি, ওরা ফিরে এসেছে।”
বলতে বলতে একটি মেয়ে ঘরে এসে ঢুকল। বয়সে মেহুলির চেয়ে ছোটই হবে। মুখের আদলে কস্তুরী বুঝল, এ মিহিরা। কিন্তু সঙ্গের প্রাণীটি ঘরে ঢুকেই কস্তুরীকে দেখে থমকে গেল, আর তাকে দেখে কস্তুরীও সিঁটিয়ে গেল। তার কুকুরে খুব ভয়। কোনও বাড়িতে কুকুর আছে শুনলে সে সেই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোয় না। মিশুক বলল, “ভয় পেয়ো না বিবি। ও মাফিন। খুব ভাল জাতের। বিগল।”
তার পর নিচুস্বরে বলল, “সব্যর গিফট। নামটাও ওর দেওয়া।”
কস্তুরী ভয়ে বিছানার উপরে পা তুলে নিলেও দেখল অন্য কুকুরের মতো বিশ্রী শব্দে ডেকে উঠল না। বরং শান্ত ভাবে কাছে এসে কস্তুরীকে নিরীক্ষণ করতে লাগল, কখনও ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে। কস্তুরী ভাল করে লক্ষ করল, কুকুরটার চোখের উপরের চামড়া খানিকটা ঝুলে আসার কারনে মনে হচ্ছে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মিশুক দু’-এক বার ‘মাফিন’ ‘মাফিন’ বলে ডাকলেও মাফিন কিন্তু কস্তুরীর সামনে থেকে নড়ল না। বরং কস্তুরীর মনে হল কুকুরটা খুব ধীরে ধীরে মাটিতে পেট ঘষে ঘষে তার কাছে এগিয়ে আসছে। মিহিরা এ বার হেসে উঠে বলল, “ও কিন্তু খুব লোভী আন্টি। আপনি মাছ খাচ্ছেন, তাই ও আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছে না।”
কস্তুরী ভয়ে ভয়ে বলল, “ও কী খায়?”
মিহিরা বলল, “সব। পাউরুটি থেকে পিৎজ়া, সন্দেশ থেকে গোলাপজাম, পেঁয়াজি থেকে...”
মিশুক ধমকের সুরে বলল, “তুই ভাগ তো। খালি গুল দেয়।”
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy