ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
পাড়ায় এসডিও বাংলোর সামনের রাস্তাটি নির্জন। অভ্র ওটার নাম দিয়েছে প্রেমসরণি। আজও আধো-আলো আধো-অন্ধকারে একজোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটি মুখ কাছাকাছি, নিচু গলায় কথা চলছে, মেয়েটি উন্মুক্ত ফুলের মতো মুখ তুলেছে, ছেলেটি যেন ঝমঝমে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসবে ঠোঁটের কাছে। ছেলেটার জন্য কেমন যেন করুণা হল তার। হয়তো সন্ধে গভীর হলে মেয়েটিকে বাড়ির কাছে ছেড়ে দিয়ে আসবে, বিগলিত গলায় বলবে, ‘আজ সারারাত স্বপ্নে তোমাকেই দেখব। কতকাল তুমি এ ভাবে কাছে থেকেও দূরে থাকবে?’ যেমন সে নিজে রুমকিকে বলত।
চিকেন পক্সের মতো সবারই জীবনে এক বার প্রেম আসে। সাধারণত এক বার হলে দ্বিতীয় বার আর হয় না। তাই তার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
টিউশন পড়িয়ে ঘরে ফিরে বই নিয়ে বসল অভ্র। আজ হরপ্পা সভ্যতা নিয়ে লেখা একটা বইতে ডুবে গেল সে। হরপ্পার অধিবাসীদের মধ্যে নাকি দাঁতের রোগ, অস্থিরোগ বেশি ছিল। কয়েকটি কঙ্কালের নমুনার উপর পরীক্ষা চালিয়ে পারিবারিক হিংসার নমুনাও পাওয়া গিয়েছে।
অভ্রর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটল। টুং করে মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ ঢুকল।
রুমকি মেসেজ পাঠিয়েছে। লিখেছে, “আমার উপর রাগ করেছিস?”
অভ্র উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। ন’বছর আগে রুমকির উপর প্রবল রাগ হয়েছিল, সময়ের পলি জমতে জমতে এখন কোনও অনুভূতিই আসে না। রাগ-ক্ষোভ-মোহ কিছুই আর নেই। সে শুনেছে, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে সারা পৃথিবীতে প্রেমের চেয়ে ঘৃণার মেসেজ-ভরা কার্ড বেশি বিক্রি হয়। কিন্তু সে আজও রুমকিকে ঘৃণা করতে পারে না।
রুমকি ইনবক্সে লিখল, “লটারির নেশা খুব সাংঘাতিক। লটারির টিকিট প্লিজ় কিনিস না। আমি চাই না তুই লটারির নেশায় পড়ে সর্বস্বান্ত হোস।”
“কিছু থাকলে তো সর্বস্বান্ত হওয়ার কথা আসে!” বিরক্ত হয়ে টাইপ করল অভ্র।
রুমকির বড়সড় মেসেজ এল এ বার, “সব গেলেও ডায়ালগ আগের মতোই আছে দেখছি। কথার ভাঁজে খেলাস না। প্লিজ়, আমার এই অনুরোধ তুই রাখিস। এখন তোর ভালমন্দ বোঝার
আমি কে— এ রকম কথা বলতে পারিস। আই ডোন’ট মাইন্ড।”
অভ্র লিখল, “চেষ্টা করব। এটুকু বলতে পারি। কোনও কিছুরই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না।”
“তোর মোবাইল নম্বরটা পাঠা।”
“কেন?’’
রুমকি অসহিষ্ণু হল, “সামান্য ফোন নম্বর দিতেও কারণ জানতে চাইছিস? তুই কোথাকার কোন সেলেব্রিটি?”
“আমার মোবাইল নম্বর ন’বছর পরেও বদলায়নি। নতুন করে নেওয়ার কী আছে?”
রুমকি মেসেঞ্জারে লিখল, “নম্বরটা বিয়ের পরই ডিলিট করে দিয়েছিলাম।”
“বেশ করেছিস। তা হলে আবার নম্বর নিয়ে ঝামেলা করবি কেন?’’
“দূর! একটা নম্বর দিতে এত ধানাইপানাই করিস কেন?” রুমকি লিখল, “তখন তো বুঝতাম না। পরে বুঝেছি যে নীলের অত সন্দেহবাতিক নয়। আমার প্রাইভেসিতে নাক গলায় না। বুঝেছিস?”
“বুঝলাম,” নম্বরটা পাঠিয়ে দিল অভ্র।
রাত সোয়া দশটা বেজেছে। এ বার রাতের খাওয়াটা সেরে নিতে হবে। মা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, তাকে জাগিয়ে রাখা ঠিক হবে না। বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে, এমন সময় তার মোবাইল সুরেলা শব্দে জেগে উঠল।
“রুমকি বলছি।”
অভ্র চুপ করে থাকল। কত কাল পরে, যেন বহু যুগের ও পার হতে কারও কণ্ঠ ভেসে আসছে।
“তুই কি জুয়া খেলিস?” রুমকি জিজ্ঞেস করল।
অভ্র রেগে জবাব বলল, “কেন? এত খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছে কেন?”
রুমকি বোধহয় তার রুক্ষ কথায় কিছু মনে করল না, বলল, “খেলিস জুয়া?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক ধরেছি। যাদের লটারি কেনার নেশা আছে তারা জুয়া খেলতেও পারে। জুয়াটা কোথায় খেলিস? অনলাইনে খেলিস না তো?”
“অত হাইফাই হতে পারিনি। গরিবের জন্য অনলাইন জুয়া নয়।”
“সেলেব্রিটিরা টাকার লোভে আজকাল অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। অনলাইন জুয়ার খুব রমরমা বাজার এখন। ধনী-গরিব সবাই ফাঁদে পড়ছে। তুই তা হলে কী খেলিস?”
“উদয়পল্লিতে সপ্তাহে দু’দিন, শনি এবং রবি খেলাটা হয়। খেলাটার নাম হাব্বাডাব্বা।”
“অমন নাম তো শুনিনি।”
“রসিক জানে রসের সন্ধান। হাব্বাডাব্বা হল পপুলার জুয়া। ছত্তীসগড়, ঝাড়খণ্ডে খুব চলে। একই খেলা, নাম ভিন্ন। ওই সমস্ত রাজ্যে খেলাটার নাম ঝান্ডামুন্ডি। আমাদের রাজ্যেও খেলাটার খুব চল আছে। খুব সহজ খেলা, নিয়মের মারপ্যাঁচ নেই। আচ্ছা, জুয়া নিয়ে তোর এত কৌতূহল কিসের?”
রুমকি বলল, “কৌতূহল নয়, ভয়। তোর ব্যাপার, আমার বলা সাজে না। তবে পুরনো রিলেশনের কথা ভেবে অনুরোধটা রাখিস।”
“সারা জীবন পুরনো রিলেশন বয়ে নিয়ে যেতে হবে নাকি?”
“তুই বড্ড ক্যাটকেটে কথা বলিস। আগে কী সুন্দর কথা বলতিস, তোর মধ্যে মোলায়েম একটা ব্যাপার ছিল। তোর কাছে একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই। সুযোগ দিবি?”
“আমি একটা অপদার্থ ছেলে। আমাকে কনফেশন বক্স বানিয়ে লাভ নেই।”
রুমকি ভেজা গলায় বলল, “ও রকম বলিস না। আমি যে তোর সঙ্গে কিছু শেয়ার করতে চাই।”
“বলে ফেল।”
ইতস্তত করে রুমকি বলল, “নাগপুরে নীল যে চাকরিটা করত, কোভিড সিচুয়েশনের জন্য সেটা আর ছিল না। ও এত দিন কলকাতায় ছিল না, গুয়াহাটিতে ছিল। জুন মাসে ও একটা কোম্পানিতে জয়েন করতে চলেছে।”
“এ সব আমাকে বলছিস কেন?”
“বলছি এই জন্য সে সবার জীবনেই ব্যাড ফেজ় আসে। সেটা কাটিয়ে উঠতে হয়।”
“জ্ঞান শোনার মতো সময় এবং ইচ্ছে কোনওটাই আমার নেই। কাউকে কাউকে সারা জীবনই খারাপ সময়ের মধ্যে যেতে হবে। যেমন অভ্রনীল পাইন নামের এই হতভাগা,” অভ্র চোয়াল কঠিন করল।
“ঠিক আছে। জ্ঞান দেব না। ওটা আমার বিশ্বাস। জীবনে সবারই সুসময় আসে। তাই বলছিলাম। শুধু একটা রিকোয়েস্ট রাখিস। প্লিজ়, তুই লটারি, জুয়া ইত্যাদিতে নিজেকে বরবাদ করিস না।”
অভ্র হাসে, “নতুন করে আর কী বরবাদ হব? তা ছাড়া তিরিশ, একশো টাকা অবধি আমার দৌড়। লেগে গেলে কিছুটা হিল্লে হয়। ওই লোভে
পড়েই যাই।”
“ওই টাকাটা শুনতে সামান্য হলেও কি
কষ্টের নয়?”
“হ্যাঁ, দশ টাকারও অনেক মূল্য আছে, অন্তত আমার কাছে।”
“ছেড়ে দে। প্রথমে টাকার অঙ্কটা অল্পই থাকে, পরে নেশা ধরে গেলে লাফিয়ে বাড়ে। ধরে নে, তোর ওয়েলউইশার কেউ রিকোয়েস্ট করছে। তুই তার কথা রাখার চেষ্টা করবি। কেন এ রকম বার বার বলছি জানিস? আমার নিজের দাদা অনলাইন জুয়ার নেশায় প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছিল। বৌদি সময়মতো ধমকে-চমকে ফিরিয়ে না আনলে ওদের পথে বসতে হত। স্টেশনারি স্টোর্স থেকে যা
আয় হত পুরোটাই ঢেলে দিত জুয়ায়। এখন পথে এসেছে। তাও আগের সচ্ছলতা ফিরে আসেনি, কষ্টেসৃষ্টে চলে।”
অভ্রর ঠোঁট কাঁপল, “তেমন মনের জোর নেই যে! তবে চেষ্টা করব।”
“আচ্ছা, শুনে ভাল লাগল। সময় পেলে, ইচ্ছে হলে ফোন করব। ধরিস অ্যাট লিস্ট।”
রুমকি ফোন রেখে দিল।
অভ্র কিছু ক্ষণ আনমনা অবস্থায় বসে রইল। এক কালে কথা বলতে বলতে সময়জ্ঞান থাকত না, ক্লান্তি আসত না, মনে হত সময় কেন এত তাড়াতাড়ি দৌড়য়! গত দশ দিনে তিন বার দেখা হলেও কেউ কারও ফোন নম্বর চায়নি, ফেসবুকের প্রসঙ্গ আসেনি। ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের ডাকে আজ অবধি সাড়া দেয়নি রুমকি। ন’বছর আগেই দু’জনের দু’টি পথ দু’দিকে বেঁকে গিয়েছে।
আজ ঘুম তার কথা শুনল, ডাকামাত্রই চলে এল। ঘুমের উপত্যকায় পার্কের সবুজ গালিচায় পা ফেলে সে হেঁটেই চলে। হলুদ কুর্তি ও নীল জিনসের এক মহিলা দু’হাত মেলে এগিয়ে আসে তার দিকে। অস্পষ্ট তার মুখ, কিছু বোঝার আগেই তার নরম হাতের বন্ধনে আটকে পড়ে অভ্র, মুখে ল্যাম্পপোস্টের উদ্ভাসিত আলো পড়ে। মহিলার মুখ দেখে চমকে যায় সে। এক মুখ হাসি নিয়ে রুমকি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে! তাকে ডালপালা মেলে আচ্ছন্ন করে দিতে চাইছে।
তখনই ঘুম ভেঙে গেল তার। কী বিড়ম্বনা, রুমকির বুকের সাদা জ্যোৎস্নায় সে মুখ রেখেছিল সবেমাত্র! বেডরুমের আলো নিভিয়ে ছাদে উঠে আসে অভ্র। হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে কিছু ক্ষণ বসে থাকার পরে সে মুখ তোলে। রাস্তা আর বাড়িগুলো গাঢ় অন্ধকারে আবছা, দূরের বহুতলগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে, ঘুমে আচ্ছন্ন গাছগাছালি, নিঝুম নিশুতি রাত।
সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে শূন্যে বুদবুদ হয়ে ফেটে পড়ছে, আর তার দিকে তাকিয়ে যেন বিদ্রুপে ফেটে যাচ্ছে। বলছে, ‘এখনও? শ্রীমান অভ্র, অবচেতনে ইচ্ছে তা হলে মরেনি? জেনে রাখো, এই জন্মে কামিনী কাঞ্চন কিছুই জুটবে না তোমার। তুমিও এক দিন ‘টেকনো’-র মতো এই শহরের এক সর্বহারা ভবঘুরে হয়ে যাবে।’
নির্মলের দোকানে এসে সে দেখল, টেকনো পাগল বকবক করেই যাচ্ছে। এক মানুষের শরীরে অন্য মানুষের মাথা কী ভাবে ঢুকে যাচ্ছে, এই তত্ত্ব সে বুঝিয়েই ছাড়বে। শ্রোতা কেউ নেই, সবাই চা খেয়ে সরে পড়ছে। কান গরম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “আপনার শরীরে কার মাথা ঢুকেছে বলুন তো?”
টেকনো থতমত হয়ে বলল, “আ-আমার শরীরে কারও মাথা ঢুকবে না।”
“ফেঁসে যাওয়া টায়ারের মাথা। বুঝেছেন? হয় চুপ করুন না-হয় কেটে পড়ুন। মাথায় গরম জল ঢেলে দেব,” রেগে তাকাল অভ্র।
ধমকে কাজ হল। টেকনো পয়সা মিটিয়ে চলে গেল। নির্মল হাসল, “বাঁচালে অভ্রদা। কানের পোকা ঝেড়ে দিচ্ছিল। আজ কী হয়েছে কে জানে! এই নিয়ে আট জন পাগল আমার দোকান ভিজ়িট করল।
তবে চট করে কেউ ‘টেকনো’কে দেখে পাগল ঠাওরাবে না।”
“তা ঠিক।”
“দশ চাকা, কুড়ি চাকার গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে ওর লাইফ কেটে গেল। তার পর যা হয়। বিয়ে-থা করেনি, দু’ভাই বাড়ি নিজেদের নামে লিখিয়ে নিল, খেতে-পরতে দেয় না। কখনও-সখনও দশ-বিশ টাকা ধরিয়ে দেয়। ওকে রাতে খোলা বারান্দায় শুতে দেয় শুধু।”
টেকনো-র সঙ্গে কর্কশ ব্যবহার করার জন্য আফসোস হল অভ্রর। মানুষের শরীরে অন্য মানুষের মাথা না ঢুকলেও শয়তানের মাথা সম্ভবত ঢুকে পড়ে। অর্থসম্পত্তির জন্য দুনিয়ার প্রায় সবাই পাগল হয়ে যাবে। বড়সড় রাজনৈতিক নেতাদের দোষ দিয়েই বা কী লাভ? সাধারণ মানুষও সুযোগ পেলে দু’হাতে আমদানি করতে চায়।
কিন্তু মল্লারটার হল কী? গত দশ দিনে এক বার দেখাও হয়নি, ফোনও করেনি। গত পরশু রাতে ফোন করেও সাড়া পায়নি। রিং হয়েই চলল, ধরল না। এই সকালে ওকে ফোনে পাওয়া অসম্ভব। তবু রিং করে দেখা যেতেই পারে।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy