শার্দূল: সরিস্কায় বাঘের গলায় রেডিয়ো কলার। ছবি: মনোজ ধওয়ান
হুডখোলা জিপ যতই ভিতরে ঢুকছিল, ঠান্ডাটা বাড়ছিল। গেট থেকে একটু এগিয়েই একটা ওয়াচ টাওয়ার। সেখানে ক্যামেরা বসানো। জিপে থাকা গাইড বললেন, ‘‘স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতে হয় সব সময়। না হলে টাওয়ারে কে কী ঢিল ছুড়ে দিল, কী ভাবে জানবেন!’’
স্থানীয় বাসিন্দা! অবাকই হতে হল শুনে। এটা তো ব্যাঘ্র প্রকল্প! জিপ-যাত্রা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই বড়-বড় করে লেখা ছিল, ‘রাজস্থান সরকার, বাঘ পরিযোজনা সরিস্কা’। বাঘের ডেরায় মানুষ থাকে!
উত্তরটা পাওয়া গেল কিছু ক্ষণ পরে। সরিস্কা অভয়ারণ্যের ডেপুটি ডিরেক্টর হেমন্ত শেখাওয়াত বললেন, এই অভয়ারণ্যের ভিতরে ২৯টি গ্রাম রয়েছে! এখানেই শেষ নয়। অরণ্যের ভিতরেই একটি মন্দির রয়েছে। সেখানে প্রতি মঙ্গল ও শনিবার পুজো-পার্বণের জন্য অভয়ারণ্যের গেট খুলে দেওয়া হয়। তার ফলে অবাধে ওই দু’দিন গড়ে ৯০০টি গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়। ফলে সরিস্কার বাঘ ভীষণ ভাবে উপদ্রুত! অবশ্য শুধু সরিস্কা কেন, অন্য অনেক অভয়ারণ্যেই তো মানুষের দাপট! এমনকী, খোদ প্রধানমন্ত্রীর তথ্যচিত্রেরও শুটিং হয় সেই অভয়ারণ্যেই!
কেমন ভাবে বাঘেদের জীবনযাত্রা পাল্টে যাচ্ছে, বলতে গিয়ে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেন হেমন্ত। জানালেন, অতীতে রাজস্থানের আলওয়ারের সরিস্কায় ও মধ্যপ্রদেশের পান্না অভয়ারণ্যে চোরাশিকারিদের দাপটে বাঘ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তার পরেই বাঘ সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ‘টাইগার টাস্ক ফোর্স’ তৈরি করে। ২০০৮ সাল নাগাদ রণথম্ভোর থেকে একটি বাঘ ও একটি বাঘিনি আনা হয়েছিল সরিস্কায়। যদিও কিছু দিনের মধ্যে সেই পুরুষ বাঘটিকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছিল কেউ। সেই সব ঝড়ঝাপটা সামলে বাঘেদের বংশবিস্তার শুরু হয়। বর্তমানে সরিস্কায় বাঘেদের সংখ্যা ১৯। আছে ১১টি পূর্ণবয়স্ক বাঘ এবং আটটি শাবক। কিন্তু ওই একই সময়ে
পান্নায় যে বাঘেদের প্রকল্প চালু হয়েছিল, সেখানে বাঘের সংখ্যা চল্লিশের মতো।
সরিস্কায় বাঘের সংখ্যা কম কেন? বাঘ বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, এখানকার বাঘেদের বংশবিস্তারে অনীহা রয়েছে। অনেকে তো এমনও বলেছেন যে, সরিস্কার বাঘের নাকি প্রজনন ক্ষমতাই হারাতে বসেছে। তারা এতটাই ‘স্ট্রেসড’! হেমন্তের কথায়, ‘‘আসলে এখানে তো সব রকমের উৎপাতই রয়েছে।’’
এমনিতে এই মুহূর্তে সরিস্কা অভয়ারণ্যে আলাদা ব্যস্ততা চলছে। অন্য অভয়ারণ্যের মতোই। কারণ, গত বছর থেকে সারা দেশে এই বাঘ-গণনার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী মে-জুন মাসে এই গণনার কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে বাঘ-গণনার তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মোট ১৮টি রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার ১১৮ বর্গ কিলোমিটার অরণ্যে বাঘের সংখ্যা ছিল ২,২২৬টি। এ বারও সারা দেশে প্রায় চার লক্ষ বর্গকিলোমিটার অরণ্য জুড়ে বাঘের খোঁজ শুরু হয়েছে। সারা দেশে বাঘ-গণনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘টাইগার সেল’-এর বিজ্ঞানী যাদবেন্দ্র ঝালা জানালেন, ক্যামেরা-ট্র্যাপ থেকে শুরু করে মোবাইল, সমস্ত কিছুই ব্যবহার করা হচ্ছে এই গণনায়।
সরিস্কায় যে পথ দিয়ে বাঘ নিয়মিত চলাচল করে, সেখানে গাছের গুঁড়িতে লাগানো দুটি ক্যামেরা দেখিয়ে যাদবেন্দ্র বোঝাচ্ছিলেন, বাঘ-গণনার ক্ষেত্রে কী পদ্ধতিতে এই ক্যামেরা-ট্র্যাপ ব্যবহার করা হয়। মাটি থেকে আড়াই ফুট উঁচুতে বসানো ক্যামেরাগুলি সামনে থেকে যা কিছু যায়, তারই ঝপাঝপ ছবি তুলে নেয়। আট জিবি মেমরিওয়ালা ক্যামেরাগুলোয় তোলা ছবি দেখে বাঘেদের গায়ের কালো দাগ বিশ্লেষণ করা হয়। বাঘেদের কালো দাগ হল মানুষের ফিংগারপ্রিন্ট-এর মতো। প্রতিটা দাগ আলাদা, নিজস্ব।
যাদবেন্দ্র বলছিলেন, ‘‘আগে শুধুমাত্র পাগমার্ক দেখে বাঘ চিহ্নিত করা হত। কিন্তু এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। শুধু প্রযুক্তি অবশ্য নয়, মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় বাঘের গতিবিধি জানতে জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষকেও যুক্ত করা হয়েছে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে।’’ তথ্য বলছে, শেষ বার (অর্থাৎ ২০১৪ সালে) যখন বাঘ-গণনা হয়েছিল, ৯,৭৩৫টি ক্যামেরা-ট্র্যাপ ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখানে ২০১৮ সাল থেকে যে বাঘ-গণনা শুরু হয়েছে, তাতে ১৬,৩১৫টি ক্যামেরা-ট্র্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে।
গতিবিধি জানার জন্য সরিস্কায় সম্প্রতি পাঁচটি বাঘকে রেডিয়ো কলার পরানো হয়েছে। এমনিতে ওই রেডিয়ো কলারের সঙ্গে স্যাটেলাইট সংযোগ রয়েছে। প্রতিটি কলারের আবার ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা। সেই ফ্রিকোয়েন্সি ‘রিসিভ’ করার জন্য একটা অ্যান্টেনা ও একটা রিসিভার থাকে। জার্মানিতে তৈরি, এক কেজিরও বেশি ওজনের রেডিয়ো কলারগুলির প্রতিটির দাম প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা!
কলারের ব্যাটারির আয়ুর কথাও মাথায় রাখতে হয়, জানালেন হেমন্ত। কারণ ইচ্ছে করলেই বাঘের হদিশ পাওয়া যায় না। তাই নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট বাঘ সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য যাতে সংগ্রহ করা যায়, সে দিকে খেয়াল রাখা হয়। কলারে এমন সময় অন্তর সিগন্যাল ঠিক করা হয় যাতে সেটি অন্ততপক্ষে দু’বছর চলবে। ১৫ মিনিট বা এক ঘণ্টা অন্তর সিগন্যাল ঠিক করলে হয়তো গতিবিধি সম্পর্কে নিয়মিত খবর পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে ব্যাটারি দ্রুত খরচ হয়। তাই সরিস্কার ক্ষেত্রে পাঁচ ঘণ্টা অন্তর সিগন্যাল
ঠিক করা হয়েছে। সে কারণে অসুবিধাও হয় অবশ্য। কারণ, পাঁচ ঘণ্টা আগে বাঘ যেখানে ছিল, সিগন্যাল ধরে সেখানে গেলে বাঘের দেখা পাওয়া যায় না! হেমন্ত বলছিলেন, ‘‘পর্যটকেরা এসে আমাদের গাড়ির পিছু ধরেন। ভাবেন এঁরা যখন যাচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই সেখানে বাঘ আছে। কিন্তু তাঁরা অনেকেই এটা বুঝতে পারেন না যে, আমাদের যে দূরত্বটা গাড়ি করে যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে, সেই দূরত্ব বাঘ দশ মিনিটে পার করে দেয়! ফলে বাঘের দেখা মিলবে কী করে!’’
তা হলে চোরাশিকারিরাই বা বাঘের খোঁজ পায় কী ভাবে?
উত্তর দিলেন যাদবেন্দ্র। একটু হেসে বললেন, ‘‘গত তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতাতে জঙ্গলকে পুরোপুরি চিনতে পেরেছি বলব না। সেখানে চোরাশিকারিরা জঙ্গলকে চেনে নিজেদের হাতের তালুর মতো। ’’
ফলে লড়াই তুমুল। এক দিকে চোরাশিকারির দল। অন্য দিকে— রেডিয়ো কলার, ক্যামেরা-ট্র্যাপ, মোবাইল ইত্যাদি আধুনিক সব প্রযুক্তি সঙ্গী করে চলা, বাঘ-গণনায়
যুক্ত কর্মীরা।
কারা জিতল, বাঘের সংখ্যা সারা দেশে বাড়ল না কি কমল, উত্তর পাওয়া যাবে আগামী মে-জুন মাসে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy