Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

শওকতকে সঙ্গে নিয়ে খেতে যেতেন বিধুশেখর শাস্ত্রী

অথচ সেই শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়েই গোড়ার দিকে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের খেতে বসার সারি ছিল আলাদা। ছিল ব্রাহ্মণ পরিবেশকও। নানান ধর্মের মানুষের একত্রবাসে ক্রমে ভেঙে গেল জাতপাত, উঁচু-নিচুর সংস্কার।রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এমনিতে খাওয়াতে ভালবাসতেন। সুকুমার সেন তাঁর স্মৃতিকথায় সে কথা লিখেছিলেন।

একত্র: ‘প্রাক্‌কুটীর’-এর সামনে খেতে বসেছেন সে কালের আশ্রমিকেরা। ছবি সৌজন্য: রবীন্দ্র ভবন, বিশ্বভারতী।

একত্র: ‘প্রাক্‌কুটীর’-এর সামনে খেতে বসেছেন সে কালের আশ্রমিকেরা। ছবি সৌজন্য: রবীন্দ্র ভবন, বিশ্বভারতী।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৯ ০০:২১
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে খাওয়া-দাওয়ার স্বাচ্ছন্দ্য তেমন ছিল না। চেয়েচিন্তে টাকা সংগ্রহ করে কষ্টেসৃষ্টে চালাতে হত শান্তিনিকেতনের ইস্কুল। তাঁর নিজের পকেট থেকেও টাকা যেত। মোটা ভাত-রুটির অভাব না থাকলেও, তার চেয়ে বেশি কিছু আশ্রমিকদের দেওয়ার সাধ্য প্রথম দিকে হয়নি। কবিপুত্র, আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্র, সকলের জন্য একই ব্যবস্থা। মুগ কলাই, ছোলা— এই সব সস্তা কিন্তু পুষ্টিকর খাবার পড়ুয়াদের দেওয়া হত। পড়ুয়ারা যাতে মাটি কোপায়, বাগান করে সে দিকে নজর দিতে বলেছিলেন কবি— শ্রম করলে পাতে যা জুটবে ছেলেরা সোনামুখ করে তাই খাবে। ক্রমে ইস্কুলের খাওয়া-দাওয়া একটু ভাল হয়।

রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এমনিতে খাওয়াতে ভালবাসতেন। সুকুমার সেন তাঁর স্মৃতিকথায় সে কথা লিখেছিলেন। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফিরবেন তাঁরা, ট্রেনে খাওয়ার জন্য পুঁটলি বেঁধে দিতে বললেন কবি। রবি-জীবনের শেষের দিকে তরুণ কবি বুদ্ধদেব বসু গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে, আতিথ্যের ত্রুটি হয়নি সেই সব-পেয়েছির দেশে। গুরুদেবের খাদ্য-বাৎসল্যের নানা গল্প ফাঁদতেন মুজতবা আলি। মুজতবার সপাট স্বীকারোক্তি, ‘আমার বলতে ইচ্ছে করে সেই জিনিস, ইংরেজিতে যাকে বলে লাইটার সাইড।’ আপাত ‘লাইটার সাইড’-এর তাৎপর্য কিন্তু গভীর। জার্মানির মারবুর্গে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, বক্তৃতা দেবেন। তখন জার্মানিতেই আছেন মুজতবা। ডাক পড়ল, হাজির হলেন। বক্তৃতা শেষে রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি। মুজতবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এত রোগা হয়ে গিয়েছিস কেন?’’ আলি চুপ। কবির নির্দেশ: ‘‘অমিয়, একে ভাল করে খাইয়ে দাও।’’ অমিয় চক্রবর্তী জার্মানির হোটেলে মুজতবাকে পেটপূর্তি খাইয়ে দিলেন। মুজতবা তো খেতে পেলে আর কিছু চান না। খাওয়ার পাতেই তাঁর সর্বধর্মসমন্বয়। তাঁর ‘চাচাকাহিনী’ নামের আড্ডা-ভরা রচনার কেন্দ্র একটি খাদ্যাগার। জার্মানির ‘হিন্দুস্থান হৌস’ তাঁর আড্ডাস্থল, পাঠকের জ্ঞানপীঠ। সেই আড্ডার গোসাঁই ছিলেন চাচা, বরিশালের খাজা বাঙাল মুসলমান। মুখুজ্জে, সরকার, রায়, চ্যাংড়া গোলাম মৌলা চাচার চ্যালা। সেই হৌসে খাওয়া নিয়ে পঙ্‌ক্তি বিচার চলে না। রায় চুকচুক করে বিয়ার খায় আর তাঁর গ্রাম সম্পর্কের ভাগ্নে গোলাম মৌলা ভয়ে মিটমিট করে তাকায়। পাছে বেচারি খাওয়ার দোষে বানচাল হয়ে যায়। হিন্দুস্থান হৌসে কেউ বানচাল হয়নি, যেমন বানচাল হয়নি মুজতবার গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে।

প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে খাওয়াদাওয়া নিয়ে বেশ বাছবিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে প্রচলিত সংস্কারে তিনি হাত দিতে চাননি। চিঠিপত্রে তার প্রমাণ ইতিউতি ছড়িয়ে আছে। ‘রন্ধনশালায় বা আহারস্থানে হিন্দুআচারবিরুদ্ধ কোন অনিয়মের’ তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। ‘ব্রাহ্মণ পরিবেষক না হইলে আপত্তিজনক হইতে পারে’ এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। (কুঞ্জলাল ঘোষকে লেখা চিঠি, ১৩ নভেম্বর ১৯০২) এমন আশঙ্কা সহজে যায়নি। ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে পাঁচ বছর পরে ১৯০৭ সালে লিখেছেন, ‘বাঙালী ব্রাহ্মণ হিন্দুস্থানীর রান্না খাবে না’। ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে এক বার খুবই বিশ্রী কাণ্ড ঘটেছিল সে কথা জানা যাচ্ছে বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র-কথা’য়। ‘অস্পৃশ্য জাতির বালক’ ইস্কুলের রান্নাঘরের ভাত ছুঁয়ে ফেলেছিল। কাজেই সেই ছোঁয়াচ-লাগা ভাত উচ্চবর্ণের অভুক্ত আশ্রমিকেরা খেলেন না, ফলাহার করলেন। ভাত ফেলে দিতে হল। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথকে খুবই বিচলিত করে, বিরক্ত হয়েছিলেন। তবে সারকথা লিখেছেন মুজতবা, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপনা করেন তখন এটাকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা ব্রহ্মবিদ্যালয় বলা হত। ছেলেরা জুতো পরতো না, নিরামিষ খেত, ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণেতরের জন্য পৃথক পৃথক পঙক্তি ছিল; ... সেই শান্তিনিকেতনেই, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ই, পৃথক পৃথক পঙ্‌ক্তি উঠে গেল, আমিষ প্রচলিত হল ...’ আমিষ নিয়ে মজাদার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। বিধুশেখর এমনিতে মাছ-মাংস খেতেন না, ছাত্রাবস্থায় কাশীতেই তাঁর মাছ-মাংসের পাট উঠে গিয়েছিল। শান্তিনিকেতনে আসার পর কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর পেটের অসুখ হল। রবীন্দ্রনাথ মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। শাস্ত্রীমশাই রাজি, তবে একটাই শর্ত। এক মাস তিনি মাছ খাবেন, কিন্তু তাতে যদি শরীরের উন্নতি না হয় তা হলে পুনশ্চ নিরামিষ। বিধুশেখর এক মাসে ষাটটি মাগুর মাছের জীবন হানি করলেন, শরীরের তেমন কিছু সুবিধে হল না। তাই আবার নিরামিষমার্গে ফিরে গেলেন।

বিধুশেখর আপরুচি খানায় বিশ্বাসী হলেও সঙ্কীর্ণমনা হিন্দু ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের আশ্রম বিদ্যালয়কে যাঁরা উদারতার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন তাঁরা দুজনেই শাস্ত্রজ্ঞ—এক জন বিধুশেখর শাস্ত্রী, অন্য জন ক্ষিতিমোহন সেন। রবীন্দ্রনাথ সচেতন ভাবেই চাইতেন তাঁর আশ্রমে শাস্ত্রজ্ঞ অথচ উদার হিন্দুরা আসুন। এতে হিন্দু লোকাচার মেনে চলা কূপমণ্ডূকদের মন ও মতি সম্প্রসারিত হবে। বিধুশেখর পরে যখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলেন তখন তাঁর সম্বন্ধে বলা হত, ‘By dress he is a Brahmin, by religion a Bramho, by education a European, and by culture a Buddhist.’ শাস্ত্রীমশাই নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেও ছিলেন উদার। তাঁর প্রিয় সখা ছিলেন খ্রিস্টান যাজক দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ়। ব্রহ্মমন্দিরে আচার্যের আসনে বসে বিধুশেখর মুগ্ধকণ্ঠে ইমাম গজ্জালীর ‘কিমিয়া সাদৎ’ আবৃত্তি করতেন। মৌলানা শওকত আলিকে বাহুপাশে আবদ্ধ করে তিনি আশ্রমের খাবারঘরে নিয়ে যাচ্ছেন, এ ছিল শান্তিনিকেতনের সুপরিচিত দৃশ্য।

শান্তিনিকেতনের আর এক শাস্ত্রজ্ঞ ক্ষিতিমোহন সেন ভারতীয় মধ্যযুগের ইতিহাসকে নতুন করে পড়েছিলেন। কবীর, দাদূর ভারতবর্ষ আলোকিত ভারতবর্ষ। দাদূকে মঠস্থাপনের অনুরোধ করলে তিনি বলেন, বাণী আর উপলব্ধি প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা যায় না। মশালের আগুন ধরা পড়ে না প্রতিষ্ঠানে, থাকে শুধু নিভে যাওয়া পোড়া কাঠ আর সলতে। ঘর নয়, পথই যে মুক্তি দেয়, সংস্কার থেকে তা মানতেন ক্ষিতিমোহন। আশ্রমের পড়ুয়াদের নিয়ে যেতেন পিকনিকে, শিক্ষামূলক ভ্রমণে। পথে নামলে খাওয়ার পঙ্‌ক্তি সহজে ভেঙে যায়। ১৯১০ সালে তিনি আশ্রমের বড় ছেলেদের নিয়ে গেলেন মুর্শিদাবাদ-বহরমপুর। সঙ্গী ছিলেন সত্যেশ্বর নাগ, বঙ্কিমচন্দ্র সেন। ট্রেন-স্টিমারের পথটুকু বাদ দিলে পায়ে হাঁটা। সঙ্গে কম্বল আর সামান্য কিছু জামা-কাপড়। কখনও পথে রাত কাটে কখনও মেলে ভাগ্যগুণে রাজ আতিথ্য। আলিবর্দি খাঁ-সিরাজদৌল্লার সমাধি ফারসি লেখা পড়ে আলাদা করে চিনিয়ে দেন। যে ভাবে নিজে পথে পথে ঘুরে অপ্রাতিষ্ঠানিক সন্তদের জীবনকথা সংগ্রহ করেন তিনি, দেশ চেনার সেই রীতিই শেখাতে চান পড়ুয়াদের। কেবল দূরে নয়, নিকট ভ্রমণেও তিনিই দলপতি। ছেলেদের নিয়ে গেছেন অজয়ের ধারে। শুকনো অজয়ের চরে বসে দল বেঁধে সবাই খেল নারকেল-চিঁড়ে।

এই যে ক্রমে শান্তিনিকেতনের ভরা সংসারে ধীরে ধীরে মুছে গেল খাদ্য-পঙ্‌ক্তির দূরত্ব, খাদ্যাখাদ্য বিচারের সংস্কার তা দেখার মতো। আবার আপরুচি নিরামিষে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরা বিশ্বাসে অটল থেকেও উদার এও মনে রাখা চাই। বিদ্যালয় তো কেবল বই পড়ায় না, আচার-আচরণেও নানা কথা শেখায়। সেই শিক্ষার ইতিহাস মনে রাখা চাই। খাওয়া নিয়ে বাছ-বিচারের, পঙ্‌ক্তি-রক্ষার, রান্নাঘর গড়ার কথা হালে আলটপকা তাই না বলাই ভালো। অনেকটা পথ সামনে এগোনো গিয়েছে, পিছন দিকে আর নাই বা এগোলেন।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Santiniketan Religious Harmony Education Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy