জলজীবন: নৌকো চালানো কিংবা স্নান, পান অথবা কৃষি, প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যবহৃত হত জলসম্পদ।
আমাদের ভারত নদীমাতৃক দেশ। গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, নর্মদার মতো নদী তাদের বয়ে আনা পলি সঞ্চয় করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে দিয়ে এই দেশের শরীর। হিমালয়ের ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এই দেশের শরীরের গঠন নির্মাণে বড় ভূমিকা নিয়েছে। ভারতের ভূপ্রকৃতি, ভারতের জলবায়ু এই দেশের মানুষের মধ্যে বৈচিত্র যেমন ঢেলে দিয়েছে, তেমন বেঁধেছে এক ঐক্যে। এই দেশটার কোথাও জলের প্রাচুর্য, কোথাও রুখাশুখা। কোথাও আবার জল বরফ হয়ে থাকে। বেঁচে থাকতে যে জল ছাড়া উপায় নেই।
“নদীর প্রাচুর্য যেখানে রয়েছে, সেখানে মানুষজন নদীর ও আশপাশের বাস্তুতন্ত্রকে ব্যবহার করতে শিখেছিল, তাদের জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে। আর যেখানে নদী নেই, ভারতের সেই শুখা এলাকায় মানুষ শিখেছিল বৃষ্টির জল ধরে রেখে, সূর্যের হাত থেকে তাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা। জল সঞ্চয়ের এই নানা শিক্ষা নিয়ে গড়ে উঠেছিল জলের পাঠশালা। পরম্পরাগত ভাবে সেই শিক্ষা প্রবাহিত হয়েছে পূর্বসূরিদের হাত থেকে উত্তরসূরিদের মধ্যে। এমন ভাবে গড়ে উঠেছিল একটা জল সমাজ। সেই সমাজে ছিল জলের জন্য অভিভাবক। যে পালন করত জলশিক্ষকের ভূমিকা। ভারতের মতো বিপুল দেশে এমন উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র...” এত দূর বলে একটু থামলেন রামদাস গজধর। বয়স সত্তর। রামদাস থাকেন জয়সলমিরের আডকিয়া তহসিলে বা গ্রামে।
রামদাসের পদবি গজধর নয়। এটা তাঁর উপাধি। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া এই উপাধি আজও তিনি বহন করে চলেছেন। রাজস্থানে মেঘ বড় কৃপণ। কারণ তার বুক থেকে সে জল দেয় কম। এখানকার মানুষের কাছে সূর্য হল ‘অম্বুতস্কর’। অম্বু বা জলকে বাষ্পে রূপান্তরিত করে চুরি করে নেয় সূর্য। তবু সূর্যের প্রতি ছিল তাঁদের অগাধ বিশ্বাস। তাঁরা জানতেন সূর্য যতটা জল চুরি করে, আবার তা ফিরিয়ে দেয়। সূর্যই যে জলচক্রের কেন্দ্র। তাই সূর্যের প্রতি তাঁদের অভিমান থাকলেও ভালবাসার কমতি ছিল না। তলাও বা পুকুরের জল একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় নেমে গেলে তার জল যথেচ্ছ ব্যবহার করা যেত না। গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা এক সঙ্গে বসে সেই সব বিধিনিষেধ তৈরি করতেন। সেই প্রবীণ মানুষদের দলের মধ্যে এক জন থাকতেন ‘পানি বুজুর্গ’ বা ‘জল প্রবীণ’। গজধরেরাই মূলত ‘পানি বুজুর্গ’ হয়ে উঠতেন। একটা লাঠি বা ‘গজ’ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁরা বুঝতেন মাটির অন্তরে লুকনো জলের কথা। মাটির উপরে গজ ফেলে তাঁরা বলে দিতেন কোথায় পুকুর বা তলাও কাটলে বৃষ্টির জলে ভরে উঠবে পুকুর। অভিজ্ঞতা আস্তে আস্তে পরিণত হয়ে উঠলে, এক বার কোনও ফাঁকা মাঠের দিকে তাকালেই বলে দিতে পারতেন কোথায় কত বড় তলাও কাটলে কত দূর থেকে কতটা জল ছুটে যাবে, একেবারে ঠিক আন্দাজ করতে পারতেন তাঁরা। তাঁরা লোভ করেননি। বেঁচে থাকার গভীর অধ্যবসায়ে আয়ত্ত করেছেন প্রকৃতির নানা রহস্য। প্রকৃতিও হতাশ করেনি তাঁদের।
ভারতের উত্তর প্রান্তে আছে লাদাখ। সেখানকার খোঁজখবর নেওয়া যাক। এখানে সূর্য চোরের দায়ে দাগি হয়ে ওঠেনি। সূর্যের তেজ এখানে জল দান করে। লাদাখে বরফ জমে থাকে পাহাড়ের চুড়োগুলোয়। পানযোগ্য জল দরকার হয় জীবনধারণের জন্য। গ্রামের মানুষেরা দেখলেন সূর্যের তাপে অল্প অল্প বরফ গলে। সেই বরফগলা জলকে ধরার জন্য ছোট ছোট নালা তৈরি করে রাখা হয়। সেগুলো বেয়ে বরফগলা জল নামে। জল ধরার জন্য একটা পাথরের চৌবাচ্চা তৈরি করা হয়। গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষ এই কাজে যথেষ্ট দক্ষ। গ্রামের সবাই তাঁদের বলেন ‘ডিজাগো আপা’ বা ‘বন্ধু পিতা’। আর জল ধরার চৌবাচ্চাকে বলা হত ‘জিং’। সারা দিন একটু একটু করে বরফগলা জল এসে ভরিয়ে তুলত জিং। বিকেলের দিকে জল ভর্তি হয়ে গেলে ডিজাগো আপা ‘চিরপান’ বলে হাঁক দিয়ে গ্রামের মানুষকে জানিয়ে দেন সবুজ সঙ্কেত। গ্রামের মানুষেরা সকলেই বুঝে যান, জল ব্যবহারের জন্য তৈরি। সহমতের ভিত্তিতে সবাই মিলে গ্রামের মানুষেরা জল ভাগ করে নেয়।
দক্ষিণ ভারতেও ছিল এক আত্মনির্ভর জল সমাজ। সারা বছর ধরে নানা কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে সেই সমাজ জলের প্রতি মানুষের ভালবাসা তৈরির কাজ করত। জলের প্রতি ভালবাসা তৈরির কাজকে তামিলনাড়ুতে বলা হত ‘তান্নিরাভি ভীরাম্পম মাক্কাই’ অর্থাৎ ‘জলপ্রেমী মানুষ’। আর যিনি দলপতি হয়ে জল সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, তাকে তামিলনাডুর মানুষরা বলতেন ‘নীর অর্চন’ বা ‘জল রাজা’। ‘নীর অর্চন’রা নানা রকম ছড়া কেটে জল ধরার কথা বলতেন। তামিল ভাষায় এমনই এক ছড়ার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়, ‘জীবন মানে জল যেন/ জলের প্রাণ তোমার হাতে/ জল রাজা দিচ্ছে ডাক/ জল বাঁচাতে ভালবাসা বাজি রাখ।’
তামিলনাড়ুর ‘কোভিল কুলম’ বা মন্দিরের অন্তর্গত পুকুরগুলো দেখাশোনার জন্য থাকতেন এক দল মানুষ। যাঁরা পুকুরগুলোয় নোংরা ফেলতে দিতেন না। পুকুরের চার পাশ সব সময় তাঁরা পরিষ্কার করে রাখতেন। পুকুরগুলোয় বৃষ্টির জল কম জমলে, কেন জলের পরিমাণ কম হল, তার খোঁজ রাখতেন। যে এলাকা থেকে পুকুরের জল গড়িয়ে আসত, সেই এলাকাকে ‘জল রাজা’র সদস্যরা চিনতেন হাতের পাতার মতো। ‘জল রাজা’র সদস্যদের বলা হত ‘নীর সিপ্পাই’ বা ‘জল সৈনিক’। এঁরাই দেখাশোনা করতেন পুকুরের আশপাশের এলাকা।
কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরু শহর। স্থানীয় মানুষজন দেখতেন বৃষ্টির সব জল গড়িয়ে সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। শুখা মরসুমে জলের খুব সঙ্কট দেখা দিত। সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রামের মানুষেরা এক সঙ্গে দল বেঁধে বসে ঠিক করলেন, জলের ঢাল বরাবর তৈরি করা হবে ছোট ছোট পুকুর। পুকুরগুলোকে এক সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল ছোট ছোট খাল কেটে। এই ব্যবস্থাটাকে স্থানীয় মানুষরা নাম দিলেন ‘কেরে’। এর ফলে জল যেমন এক বিন্দু নষ্ট হল না, ঠিক তেমনই মাটিও জলের সঙ্গে ধুয়ে গেল না। বছরের একটা দিন দেখে স্থানীয় মানুষরা ‘কেরে’গুলোর মাটি তুলে আবার গভীর করে তোলেন। স্থানীয় ভাবে এই কাজকে ‘সাপাস্তা কিলাসা’ বলে। ‘কেরে’গুলোকে চোখে চোখে রাখতেন গ্রামের মানুষেরা। এই কাজকে গ্রামের মানুষেরা বলতেন ‘কান্নালী নীরু’। গ্রামের সব থেকে প্রবীণ ও নবীনরা এই কাজের দায়িত্ব পেতেন।
প্রবীণদের সঙ্গে নবীনদের হাতে হাত ধরে জল সমাজ তৈরির কাজ দেখা যায় গোয়া রাজ্যের পিরোল গ্রামে। মাডগাঁও থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় পিরোলে। সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের কোলে গ্রামটা পুরো শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছিল। কাজের অভাবে সমস্ত তরুণরা পাড়ি জমাচ্ছিল পানাজির হোটেলগুলোয়, না হলে বিদেশে। এমন এক পরিস্থিতিতে গ্রামের প্রবীণ মানুষেরা এগিয়ে এলেন। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটা টিনের চাল দিয়ে ঘর তৈরি হল। সেখানে ডাকা হল গ্রামের সবাইকে। গ্রামের সবাই মত দিলেন তরুণরা গ্রাম থেকে চলে গেলে গ্রাম মরে যায়। তাই ঠিক হল এক জন তরুণকে ‘গাবাচা নেতা’ বা ‘গ্রাম দলপতি’ বানিয়ে সবাই তাঁর অধীনে কাজ করবেন। রোজ সন্ধ্যায় তাঁরা সবাই মিলে গ্রামের চালাঘরের নীচে বসেন। তাঁরা জানেন মাটির বন্ধু গাছ। গাছের বন্ধু মেঘ। মেঘের বন্ধু বৃষ্টি। সৃষ্টিকে বাঁচায় বৃষ্টি।
কাজেই প্রথম কাজ হল, মাটি ধরে রাখতে হবে পাহাড়ে। তার জন্য গাছ লাগাতে হবে। ওঁরা পুরো পাহাড় জুড়ে লাগালেন কাজুবাদাম গাছ। পাহাড়ের গর্তে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট ঝরনাগুলোকে যত্ন করে বাঁধিয়ে দিলেন। তার পর ছোট ছোট খাল বা ট্রেঞ্চ তৈরি করলেন পাহাড় জুড়ে। পাহাড়ের গায়ে কাজুবাদাম সিদ্ধ করে ‘ফেনি’ (বড় বাতাসার মতো এক ধরনের মিষ্টি) তৈরির জন্য ছোট ছোট কড়াইওয়ালা উনুন বা ‘ডুংলি’ তৈরি হল। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ন্যাড়া পাহাড় ভরে উঠল কাজুবাদামের গাছে। বৃষ্টির জল জমল খালে। কাজুবাদাম ও ফেনি বিক্রি করে গ্রামের তরুণেরা স্বনির্ভর হয়ে উঠল।
এমন এক জল সমাজ আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও ছিল। উত্তরবঙ্গের মানুষজন বৃষ্টির জলকে হেলায় হারাতেন না। মরা ঝোরা বৃষ্টির সময় জীবন পেত। তার পর বৃষ্টির জল বয়ে গেলে ঝরনার মন বিষণ্ণ হয়ে যেত। ঝোরা থেকে ছোট ছোট নালা কেটে নিয়ে যাওয়া হত চাষের জমিতে। এই ছোট ছোট নালাগুলোকে বলা হত ‘দং’। এই ‘দং’ নির্মাণে যাঁরা পারদর্শী, তাঁদের বলা হত ‘ডগলি’। ‘ডগলি’রা মরা ঝোরাটাকেও সারা বছর যত্ন করে আগল দিয়ে রাখতেন। তাঁরা বছরে এক বার একত্র হয়ে নিজেদের মধ্যে সারা বছরের অভিজ্ঞতা আলোচনা করে নিতেন। এক সঙ্গে জড়ো হওয়াকে বলা হত ‘মাঠ মিলন’। মাঠ মিলনের দিন সবাই এক মুঠো করে চাল, ডাল ও একটা করে আনাজ নিয়ে আসতেন। মাঠের পাশে উনুন কেটে আগুন জ্বালিয়ে সব ডাল চাল আনাজপাতি দিয়ে তৈরি হত ‘ভূত খিচুড়ি’। এই ‘ভূত খিচুড়ি’ প্রথমে খানিকটা তুলে পাতায় করে মরা ঝোরার পাশে রেখে আসা হত। তার পর এক সঙ্গে সবাই মিলে খাওয়া হত।
‘ডগলি’দের মধ্যে ছোট নদীগুলোকে যারা দেখাশোনা করতেন, তাঁদের বলা হতো ‘নুদয়’। এই ‘নুদয়’রা সমাজে খুব মর্যাদা পেতেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের কথা মতো নদীর জল কোনও ভাবে নষ্ট করতেন না। জলের প্রতি সব মানুষের ভালবাসা তৈরি করতেন ‘নুদয়’রা।
বর্ষার জল পলি বয়ে আনে। সেই জলের সঙ্গেই পুকুর ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে ওঠে। কিছু বছর অন্তর পুকুর সংস্কারের দরকার হয়। পুকুর শুকিয়ে গেলে পুকুর থেকে পাঁক তুলতে হয়। উত্তর ভারতে এই কাজটা করা হত চৈত্র ও বৈশাখ মাসে, পশ্চিম ভারতে করা হয় দীপাবলির পর আর বাংলায় বর্ষা আসার ঠিক আগে। রাজারাজড়াদের গড় ও দিঘি কাটার জন্য ছিলেন গড়খাই সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এঁরা জল ধরার কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বংশ পরম্পরায়। সেই কারণেই এঁরাও ছিলেন জল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায়, তিনি জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য অনেক কথা ভেবেছিলেন। বিনা কারণে গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। বনাঞ্চলের কোনও ক্ষতি করলে অর্থদণ্ড দিতে হত। হাতি ঘোড়া গরু পালন করা হত যথোচিত বিধিনিষেধ মেনে। বন্যার সময় বিপন্ন মানুষের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছিল।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রকৃতি ও জল সমাজের দেশজ ধারাটি নষ্ট হয়ে গেল ঔপনিবেশিক আমলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নদীর জীবনে সব থেকে বেশি সর্বনাশ ডেকে আনে। নদী শাসনের পরম্পরা শুরু হয়। কাজেই জল সমাজের দেশীয় ধারাটি ক্রমশ বিনষ্ট হয়ে পড়ে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বন্যার জল ব্যবহার করে সেচের কাজে ব্যবহার করতেন। যাকে বলা হত ‘প্লাবন সেচ’। যে দিন থেকে আমরা নদীকে শাসন করা শুরু করলাম, বিনষ্ট হয়ে গেল সেচ দেওয়ার দেশীয় পদ্ধতি। ইংরেজরা কখনও চায়নি দেশের নিজস্ব পদ্ধতিগুলো বেঁচে থাকুক। সেই কারণেই ক্রমশ হারিয়ে গেছে জলের জন্য তৈরি হওয়া ‘জল সমাজ’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy