দ
েহপট সনে নট সকলই হারায়’— এ কথা কে না জানে! মঞ্চে না এলে নাটকের ষোলো আনাই মাটি এমন কথাও শোনা যায়। অথচ শম্ভু মিত্রর নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নিয়ে আমাদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই কবে এই নাটককে ‘গত পঞ্চাশ বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা নাটক’ বলে আখ্যা দিয়ে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘অনেক অনেক দিন পরে এই একটি নাটক লেখা হয়েছে বাংলায়, প্রতিদিন থেকে বহুদিনের দিকে
এগিয়ে যায় যে-নাটক, যে-নাটক একই মুঠোয় ধরতে চায় ব্যক্তিকে আর সমাজকে, আমাদের অন্তর্জীবন আর বহির্জীবনকে।’
তার পর সাড়ে চার দশক অতিক্রান্ত। শঙ্খবাবু সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। শম্ভু মিত্রর প্রয়াণেরও পঁচিশ বছর হতে চলল। অথচ এ নাটক নিয়ে আমাদের বিস্ময় আজও অফুরান। তার লিখিত পাঠের মধ্যে আজও উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা খুঁজি আমরা। আজও তার মঞ্চায়নের অপেক্ষায় থাকি। ক’দিন আগে বইপাড়ায় এম সি সরকারের দোকানে গিয়ে দেখেছি স্তূপাকার ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র নতুন মুদ্রণ। পৌঁছে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের পাঠকের হাতে।
কেন এমন হয়?
মনসামঙ্গলের খেই ধরা যে নাটকে চাঁদ সদাগরের গুরু বল্লভাচার্যকে দিয়ে শম্ভু মিত্র বলিয়েছিলেন ‘জ্ঞানের সম্মান নাই, বিদ্যার মর্যাদা নাই, সুভদ্র আচার নাই, সুভাষণ নাই, মাংসসুখ ছাড়া কোনো সুখ-চিন্তা নাই— ভুল্যে যাও চন্দ্রধর, মহৎকার্য্যের কথা ভুল্যে যাও। শুধু কোনোমতে নিজেরে বাঁচেয়্যা রাখো। আদর্শের পাছে ছুট্যে কোনো লাভ নাই’। এই ভয়ঙ্কর বাস্তব তো আরও নিবিড় হয়েছে আমাদের সমকালে। যে সত্য-শিব-সুন্দরের খোঁজে এত আকুলতা চাঁদ সদাগরের, তা কবেই ক্লেদজ কুসুমে পরিণত। ১৯৬৪ সালে বহুরূপীর বার্ষিক নাট্যোৎসবে ‘অন্ধকারের নাটক’ করতে করতে যে নাটকের ছবি ভেসে উঠেছিল শম্ভু মিত্রর মনে, সে অন্ধকার কেটে বেরনোর কোনও পথ তো মিলছে না। তা হলে?
শুরুর শুরুতে নজর দিলে কি কোনও হদিস মিলবে? ১৯৭৩ সালে ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র প্রলম্বিত রচনাপর্ব যখন চলছে, শঙ্খ ঘোষের মুখোমুখি বসেছিলেন শম্ভু মিত্র। ‘এক-বক্তার বৈঠক’ নামে সেই সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, ওই ১৯৬৪-তে ‘রাজা’ নাটকের মহলা দিতে দিতে এক দিন কৌস্তুভ মুখোপাধ্যায়, অশোক সেন-সহ আরও অনেকের কাছে শম্ভু বলেছিলেন যে ‘চাঁদ বণিক নিয়ে একটা হয়। এর’ম হয়, ওর’ম হয়। সের’ম হয়। কেউ লিখে দিক্ না আমাকে একটা।’
‘চাঁদ বণিকের পালা’-র আত্মপ্রকাশ ১৯৬৫ সালে, বহুরূপী-র নাট্যপত্রের ত্রয়োবিংশ সংখ্যায়। অর্থাৎ ‘রাজা’ ও ‘রাজা অয়দিপাউস’-এর সাড়া-জাগানো সাফল্যের মধ্যেই শম্ভু মিত্র এ নাটকের খসড়া তৈরিতে হাত দিয়েছেন। কিস্তিতে কিস্তিতে সেটি ছাপা হবে বলে মনস্থ করেছেন। ছাপা হচ্ছে, তবে স্বনামে নয়, ছদ্মনাম ‘বটুক’-এর আড়ালে। দেবতোষ ঘোষ তখন বহুরূপী নাট্যপত্রের ঘরগেরস্থালি দেখেন। তাঁর হাতে নীল রঙের চিঠির কাগজে লেখা এই নাটকের প্রথম কিস্তি ধরিয়ে দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। বছর দশেক আগে দেশ পত্রিকায় (১৭ এপ্রিল, ২০১১) শম্ভু মিত্রর জীবনীগ্রন্থের সমালোচনা লিখতে গিয়ে দেবতোষ ঘোষ জানিয়েছেন, ছাপার পূর্বমুহূর্তে নিজের নামের বদলে শম্ভু খাড়া করলেন ‘বটুক’কে, মুখ টিপে বললেন, ‘দাও না, বেশ মজা হবে।’ মজা অবিশ্যি কম হয়নি। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে তাঁর সহযোগী তথা সঙ্গীতবিদ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ডাকনাম বটুক। তাঁকে খামোকা ব্যতিব্যস্ত করেছিলেন পাঠকদের কেউ কেউ। ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে বহুরূপী নাট্যপত্রের চতুর্বিংশ সংখ্যায় ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র দ্বিতীয় কিস্তি বেরনোর পর ‘বটুক’রহস্য ফাঁস হয়।
ছদ্মনামে লেখার অভ্যেস যাঁর আগেও ছিল, তাঁর পক্ষে আর একটি ছদ্মনাম নেওয়ার মধ্যে তেমন অভিনবত্ব না-ই থাকতে পারে। মনে হতে পারে যে ওই ত্রয়োবিংশ সংখ্যাতেই তো তাঁর আর একটি নাটক ‘ঘূর্ণি’ বেরোচ্ছে। তাই একই নামে আর একটি নাটক না-ই বা বেরোল।
১৯৫২-য় লেখা ‘ঘূর্ণি’-র নায়ক বিকাশের মধ্যে সন্তর্পণে ধরেছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর নান্দনিক বিচ্ছেদের যুক্তি। সেই বিষাদ সম্প্রসারিত হয়েছিল চাঁদ বণিকের সমুদ্রযাত্রায়। নাটকের শুরুতে ‘চম্পকনগরীর নিডরিয়া সদাগর ভাই’দের সামনে যে বক্তব্য রেখেছিলেন চাঁদ, যাতে ‘জ্ঞানেরেও পূজা
করো, ফির আবার, অজ্ঞানে ভজনা করো’-র পাটোয়ারি বুদ্ধিকে এক হাত নিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। তাতে ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠা স্বপ্নভঙ্গের ইশারা ছিল। এই নাটকে
নিহিত ছিল সেই বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ।
‘চাঁদ বণিকের পালা’-র তৃতীয় কিস্তি বেরোয় বহুরূপী নাট্যপত্রের পঞ্চবিংশ সংখ্যায়, ১৯৬৬ সালের পুজোয়। বছরটি স্মরণীয়। বছরের শুরুতেই ওয়েলিংটন স্কোয়ার আলো করে মঞ্চস্থ হচ্ছে ক্যালকাটা থিয়েটারের ‘দেবীগর্জন’। কবিপক্ষের আগে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে সাত মাস প্রেসিডেন্সি জেলে কাটিয়ে ছাড়া পাচ্ছেন উৎপল দত্ত। তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে শহিদ মিনারের পাদদেশে খাইবার জাহাজের আদলে তৈরি মঞ্চে কুশীলবদের পাশে এসে সংহতি জানাচ্ছেন ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, জ্যোতি বসু-সহ নবগঠিত মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার নেতৃবৃন্দ। এক দিকে কলকাতার পাবলিক থিয়েটার হাতিবাগান উপচে চলে আসছে মানিকতলা খালপাড়ে— কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে হইহই করে পালা পড়ছে ‘এন্টনী কবিয়াল’-এর। তাতে কেতকী দত্তর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন বহুরূপী-প্রাক্তনী সবিতাব্রত দত্ত। অন্য দিকে গ্রুপ থিয়েটারের ভরা জোয়ারে নাও ভাসাচ্ছেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়, পার্থসারথি চৌধুরী। এবং অবশ্যই বাদল সরকার। বহুরূপীর অন্দরমহলে তাঁর অবাধ গতি। তালেগোলে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ হাতছাড়া হলেও ‘বাকি ইতিহাস’ নিয়ে পাকা কথা হচ্ছে। বহুরূপীর পালে তখন জোর হাওয়া। ‘দশচক্র’, ‘রক্তকরবী’, ‘পুতুলখেলা’, ‘রাজা’, ‘রাজা অয়দিপাউস’ নিয়ে শাহি দিল্লির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত আইফ্যাক্স অডিটোরিয়ামে টানা পাঁচ দিনের উৎসব হচ্ছে বহুরূপীর। বহুরূপীর শো রেজিস্টার থেকে জেনেছিলাম, ১৯৬৬-তে সব মিলিয়ে ৪৫টি অভিনয় করেছিল বহুরূপী। তার মধ্যে ২৯টি কল শো! রাজধানী দিল্লিতে ১৪টি, ইলাহাবাদে দু’টি। উপরন্তু সে বছরই সদ্য অভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর হাত থেকে সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলোশিপ পাচ্ছেন শম্ভু মিত্র। সোনায় সোহাগা আর কাকে বলে!
এত রোশনাইয়ের মাঝে বসে তখন কী লিখছেন শম্ভু মিত্র? লিখছেন ভিন গতের এক খোয়াবনামা। এই খোয়াবনামার আদিতে চার-পাঁচশো বছর আগেকার বিপ্রদাস পিপীলাই, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বা বিজয়গুপ্ত থেকেও নেই। ১৯২৯-এ কলকাতায় মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের ‘চাঁদ সদাগর’ নেই। নেই কালিদাস রায়ের ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতাও। বিধ্বস্ত চাঁদ সদাগর তাঁর ছেলে লখিন্দরের মুখ দু’হাতে ধরে আবেগে বিহ্বল হয়ে বলেন, ‘হবি, বীর হবি, বল? সমুদ্দুরে পাড়ি দিবি? আমার সে সমুদ্দুরে? বল্, পাড়ি দিবি? দিবি?’ এর মধ্যে আলফ্রেড টেনিসনের ‘ইউলিসিস’কে খুঁজে পেয়েছেন কেউ। কেউ বা হেনরিক ইবসেনের নিঃসঙ্গ নায়ককে।
তবু মনে হয়, এর আসল সূত্র লুকনো আছে ১৯৬৫-৬৬’র সমাজ ও রাজনীতিতে, তখনকার বাঙালি সংস্কৃতিতে। না হলে জাতীয় স্তরে নট ও নির্দেশক হিসেবে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের পরও কোন অতৃপ্তি কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁকে? কোন অমৃতকুম্ভের সন্ধান করছিলেন শম্ভু মিত্র?
এর উত্তর মেলে ‘বাংলা থিয়েটার’ শিরোনামে তাঁর একটি লেখায়। লেখাটি বেরিয়েছিল ‘পরিচয়’ পত্রিকার চৈত্র-বৈশাখ (১৩৫৭-৫৮) সংখ্যায়, অর্থাৎ ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টের তিন বছরের মাথায়। সেখানে ‘সত্যিকার স্বদেশি জিনিস দিয়ে দেশের লোককে উদ্বুদ্ধ করতে গেলে’ কোন পথে থিয়েটারকে নিয়ে যেতে হবে তার দিশা খুঁজছেন শম্ভু মিত্র— “এমন একটা নাট্যশিল্প খুঁজে পেতে চাই যা একান্তভাবেই বাঙালির। কেউ যেন আমাদের অভিনয় দেখে না বলতে পারে যে ‘চতুর্থ শ্রেণির বিদেশি থিয়েটার’। আমাদের বাংলার ছবি, বাংলার নাচ, গান, বাংলার কাব্য যেন প্রাণ দেয় সেই নাট্যের। বাংলার নিগূঢ় প্রাণ যেন প্রকাশ পায় তাতে। সেই হবে আমাদের ‘যাত্রা’, আমাদের বাঙালি থিয়েটার।”
পাশাপাশি ন্যাশনাল থিয়েটারের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে তখন মগ্ন বাংলা থিয়েটারের তিন অভিভাবক— শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী। কলকাতা আর দিল্লিতে দরবার করছেন তাঁরা। একই সময় ‘নবযুগের নাটুকেদের উপর বিশ্বাস স্থাপন’ করার কথা বলছেন শচীন্দ্রনাথ। সেই ‘নাটুকেদের’ অবিসংবাদিত প্রধান শম্ভু মিত্র। তিনি আবহমান বাংলার ঘরের জিনিসকে নাগরিক নাট্যমণ্ডলে ফেরাতে চাইছেন, যুক্তি দিচ্ছেন— “বাংলার অভিনয়-পদ্ধতি হচ্ছে কথকতার বংশধর। কথা কইতে কইতে গান গেয়ে ওঠা যাত্রারও নিয়ম ছিল, থিয়েটারেরও নিয়ম, বাংলা সিনেমারও নিয়ম।” পাশাপাশি ওই একই বছরে সিনেমায় গানের ব্যবহার নিয়ে সওয়াল করছেন কমলকুমার মজুমদার।
‘চতুর্থ শ্রেণির বিদেশি থিয়েটার’-এর ছক ভেঙে বেরনোর কথা বলছেন শম্ভু মিত্র, কিন্তু কার্যকালে তা করতে পারছেন কি? না। ওই ১৯৫১-তেই তাঁর নেতৃত্বে ‘চার অধ্যায়’ প্রযোজনা করে যে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাচ্ছেন বহুরূপী, সেই যাত্রাপথে একে একে জুড়ে যাচ্ছেন হেনরিক ইবসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সোফোক্লেস। প্রাচী-প্রতীচির সে কাল আর এ কালকে চেনার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাটকের প্রয়োগরীতি প্রতিষ্ঠা করছেন তাঁরা। দু’দশক ব্যাপী এই জয়যাত্রায় তাঁদের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছেন তুলসী লাহিড়ী, বাদল সরকার, বিজয় তেন্ডুলকরের মতো আধুনিক নাটককার। এ সবের মধ্যে ‘বাংলার অভিনয়-পদ্ধতি’ তো নেই!
অথচ ষাটের দশক থেকেই ‘থিয়েটার অব রুটস’-এর পন্থাপ্রকরণ নিয়ে তোলপাড় চলছে দিল্লি-কেন্দ্রিক নাট্যবৃত্তে। ওই সময় বার বার আন্তর্জাতিক নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে পরিচয় ঘটছিল তাঁর। বিশেষ করে ইউরোপে গিয়ে। উত্তর-ঔপনিবেশিক নাট্যচর্চার দিক ও দিগন্তকে আরও নিবিড় মাত্রায় চিনতে বুঝি সুবিধে হয়েছিল তাঁর।
আজ বুঝতে পারি, ‘চাঁদ বণিকের পালা’ সেই আধুনিকতার সম্প্রসারণ প্রভাবিত। জাতীয়তাবাদী নাট্যপ্রকল্প থেকে সরে থাকতে পারেননি শম্ভু। লোকায়ত সাহিত্যসম্পদকে আধুনিক সাহিত্যবিচারের দাঁড়িপাল্লায় যাচাই করার রাস্তা এই দশকেই সুকুমার সেন, আশুতোষ ভট্টাচার্যর হাতে পড়ে আরও খুলে গেছিল। লোকসংস্কৃতি আর নাগরিক সংস্কৃতির আড়াআড়ি মুছতে শুরু করেছিল। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হওয়ার দায় নিজের ঘাড়ে নিতে সুবিধে হচ্ছিল শম্ভু মিত্রর।
তবু ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন তিনি। এ নাটকের তৃতীয় পর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৬৯-এর জুলাইতে, বাকিটা বেরিয়েছিল পাঁচ বছর পরে, ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বরে। এক দশক ধরে তিল তিল করে এই নাটক গড়েছিলেন শম্ভু।
এই সময় একটি সমবায়ী প্রয়াসের পুরোভাগে চলে এসেছিলেন তিনি, বাংলা নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতির পত্তন করে। জাতীয় নাট্যশালার যে দুরন্ত আশা হারিয়ে গিয়েছিল দিল্লি দরবারের ভুলভুলাইয়ায়, সেটি কুড়িয়ে এনে ধুলো ঝেড়ে কলকাতার বুকে খাড়া করার নেশায় মেতেছিলেন। তার ভিশন ডকুমেন্টে সই করেছিলেন উদয়শঙ্কর, বিষ্ণু দে, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রদোষ দাশগুপ্ত, ক্ষিতীশ রায়, আলি আকবর খান, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, শৈবাল গুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে এ উদ্যোগের মধ্যমণি শম্ভু মিত্র— তাতে সমবায়ী শিল্পের গরজকে সামনে রেখে আসলে সৎনাট্যের স্বপ্নকেই ফের বুনে দিয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন ‘একটা নির্লোভ জায়গা সেখানে আধুনিক শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় সমস্ত আন্তরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা উপস্থিত করা হবে এবং যোগাযোগ হবে দর্শকদের সঙ্গে, শ্রোতাদের সঙ্গে।’ ওই নাটমঞ্চ রূপায়িত হলে তার উপযোগী একটি নাট্যকলার বীজতলা যেন ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র মধ্য দিয়েই খুঁড়ে চলেছিলেন শম্ভু।
এই লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখেই কি ১৯৭৬ নাগাদ বহুরূপীর ৭ নং লোয়ার রেঞ্জের ঘরে এ নাটকের মহড়া শুরু করেছিলেন তিনি? চাঁদের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র স্বয়ং, সনকা— তৃপ্তি মিত্র, বল্লভাচার্য— কুমার রায়, বেণী নন্দন— দেবতোষ ঘোষ বা শঙ্করপ্রসাদ ঘোষ, ন্যাড়া— তারাপদ মুখোপাধ্যায়, লখিন্দর— সৌমিত্র বসু, বেহুলা— শাঁওলী মিত্র। বহুরূপীর মহড়ায় তখন দক্ষ অভিনেতার অভাব নেই। সবচেয়ে বড় কথা, বছর পাঁচেক নির্দেশনা না দিলেও দলে শম্ভুর নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ।
‘আমার বহুরূপী জীবন’-এ এ নিয়ে বিশদে লিখেছেন সৌমিত্র বসু। ‘শম্ভু মিত্র: ১৯১৫-১৯৯৭: বিচিত্র জীবন-পরিক্রমা’-য় শাঁওলী মিত্র লিখছেন, “তখনও, সেই সময়েও মহলা চলাকালীন শম্ভু মিত্র প্রচুর ধমক-ধামক দিয়ে যাচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝেই যথেষ্ট চেঁচামেচি করেছেন, রূঢ় কথা বলেছেন। তাতে সকলের ভালো লাগছিল না। ‘বড়ো অভিনেতা’দের মনে হচ্ছিল তাঁর এই বকুনি অপমানজনক এবং অযৌক্তিক। কিন্তু এ কথা তাঁরা কখনও নির্দেশককে সরাসরি বলেননি— সেই ঘটনাটাই সব চাইতে আপত্তিকর। তাঁরা মহলাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে পাশের ঘরে নিজেদের ক্ষোভ উদ্গার করেছেন। একদিন এ-লেখক ব্যক্তিগতভাবে একজনের কাছে এই ঘটনার প্রতিবাদও করেছিল। লাভ হয়নি। বরং তিনি কুপিত হয়ে উঠেছিলেন।” এ সব টের পাননি শম্ভু। শাঁওলী আরও লিখেছেন, “তবু কেন জানি না, একসময়ে এ-মহলা তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাতে আমরা ছোটোরা, সকলেই খুব, প্রায় ছেলেমানুষের মতো বায়না করেছিলাম যাতে তিনি মহলা বন্ধ করে না দেন। তিনি নিজস্ব রসিকতার ঢঙে কেবল বলেছিলেন, ‘নির্দেশক এবং নাটককার এই দু’টো রোল আমি একসঙ্গে প্লে করতে পারছি না।’”
এক দশক ধরে যে নাটক তিনি লিখলেন, যার নাট্যশরীর তাঁর চেতন-অবচেতন জুড়ে রইল, যার মঞ্চপ্রয়োগের কায়দাকানুন নিয়ে ভেবে চললেন অবিরাম— সেই সাধের মালাটি গাঁথতে গিয়ে থমকে পিছিয়ে আসার মধ্যে যে অবসাদ ছিল তার তল মেলে না। তবে নাটকের মহলা চলার সময় তাঁর অসহিষ্ণুতার বিবরণের মধ্যে তীব্র এক অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মঞ্চস্থ না হলেও ১৯৭৮-এর শুরুতেই বই হয়ে বেরিয়েছিল ‘চাঁদ বণিকের পালা’। বহুরূপী পত্রিকায় যে ভাবে নাটকের শেষ ছেপে বেরিয়েছিল, সেখান থেকে অনেক সরে এসে এক আধিভৌতিক কালীদহের সামনে চাঁদ ও তাঁর প্রেতবৎ সহনাবিকদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
‘পরিচয়’ পত্রিকা দফতরে শম্ভু মিত্রর মুখে এ নাটকের নির্বাচিত অংশের পাঠ শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, বলেছিলেন— ‘আমরা কাব্যনাট্যে ভাষা ও ছন্দের যে সমস্ত সমাধান করতে পারিনি শম্ভুবাবু তা অনায়াসে করেছেন।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’-র পাশে ‘চাঁদ বণিকের পালা’কে রেখে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘শম্ভু মিত্রের অক্ষয় কীর্তি হল মঙ্গলকাব্যের বহুল পঠিত কাহিনী আর চরিত্রকে আমাদের সাম্প্রতিক এবং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ফ্রেমে বাঁধতে পারা।’ শম্ভু মিত্রকে রবীন্দ্রনাথের একমাত্র উত্তরসাধক জ্ঞান করে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘...পশ্চিমের দিকে জানালা যার যটা ইচ্ছে খুলুন— জমিটুকু নিজের হওয়া চাই, ভিটেখানি তুলতে হবে নিজের হাতে— কেননা সেখানে বাস করব আমি এবং আমরা।’
যত দিন গেছে, সে কাল আর এ কালের বোঝাপড়া যত মজবুত হয়েছে, ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র মর্মে ঢুকতে পেরেছে বাঙালি। সেলিম আল দীন, সৈয়দ জামিল আহমেদ, সাইমন জাকারিয়াদের মতো নাট্যগবেষক আমাদের চিনিয়েছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যপরম্পরা। আমাদের চর্চাবৃত্তে ঢুকে পড়েছে বয়ানি গান, বিষহরির গান, ভাসানযাত্রা, মনসামঙ্গলের ঢপযাত্রা, বেহুলার নাচাড়ি, পদ্মার নাচনের মতো লোকায়ত অভিব্যক্তি। এ নাটকে যে শুধু কনটেন্ট নয়, ফর্মেরও ভাঙচুর চেয়েছিলেন স্রষ্টা, বাঙালিয়ানায় জারিত যে সহজিয়া চলনভঙ্গি রপ্ত করতে চেয়েছিলেন, তা আর নাগালের
বাইরে নেই।
‘চাঁদ বণিকের পালা’-র পাঠবিশ্লেষণেও অনেকে এগিয়ে এসেছেন। তার ছক-ভাঙা গদ্য সংলাপে অন্তর্বাহী কাব্যসুষমাকে চিনেছেন। পবিত্র সরকার লিখেছেন, ‘যেহেতু নাটককার চাঁদ বণিককে এবং তার সমূহ পরাজয়কে একটি রূপক বা অ্যালিগরি হিসেবে গড়ে তুলতে চান, হয়তো ষাট ও সত্তরের বছরগুলিতে ভারতের রাজনৈতিক বাতাবরণের একটা রূপকশরীর তৈরি করতে চান— তাই আখ্যান কল্পনায় নিজের মতো স্বাধীনতা নিয়েছেন। এ স্বাধীনতা তাঁর প্রাপ্য।’ শম্ভুর জন্মশতবর্ষে বহুরূপী পত্রিকার ১২২তম সংখ্যায় ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’-খ্যাত রামকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার এক নাটককার ষাটের দশকের এক অস্থির সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেন ‘নিডরিয়া’ শব্দাবলি, স্বপ্ন দেখান দক্ষিণ পাটনের, লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেন হরিকেল পার হয়ে, সুবর্ণভূমি ছেড়ে, অগ্নিকোণ ধরে সুদূর তাম্বপন্নির তীর।’
আমাদের মনে পড়েছে জীবনানন্দ দাশ কথিত সুবর্ণভূমির হদিস নিয়ে বেরনো দিশা-হারানো নাবিকের কথা। নাটকের তৃতীয় পর্বে বেহুলার হাহাকারকে মহাজাগতিক করে তোলে জুড়ির দল। গেয়ে ওঠে ‘ফিরাইয়া দে দে দে— মোদের প্রাণের লখিন্দরে’। সুরের দোলায় কথায় টানে উঠে আসেন বিনয় রায়, তাঁর ‘ফিরাইয়া দে দে দে— মোদের কায়ুর বন্ধুরে’। কৃষিবিপ্লবের আঁচ এসে লাগে মঙ্গলকাব্যের গাথায়।
চাঁদের মধ্যে আজকের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের এক প্রতিভূকেও কি রেখে যাননি শম্ভু মিত্র? তাঁকে দলে টানার জন্য, তাঁর আনুগত্য কেনার জন্য দুই যুযুধান শিবিরের লড়ালড়ি, আর কোনও দলেই যোগ না দিয়ে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে দৃঢ়সঙ্কল্প চাঁদের মধ্যে তো আমাদের চার পাশের অনেক লড়াকু মানুষের আদিকল্প বোনা আছে। এমন নাটক আধুনিক না হয়ে পারে?
মঞ্চস্থ করতে না পারলেও ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র পাঠ অভিনয় করতে অক্লান্ত ছিলেন শম্ভু। সেই সঙ্গে তাঁর কন্যা শাঁওলী। কারও মনে থাকতে পারে, ১৯৯৪ সালে এই নাটকের একটি শ্রুতিরূপ বেরিয়েছিল। ছ’টি ক্যাসেটের এ পিঠ-ও পিঠ জুড়ে ছিল ছ’ঘণ্টার সেই অবিস্মরণীয় পাঠ অভিনয়, শম্ভু মিত্র ও শাঁওলী মিত্রের গলায়। ক্যাসেট ছ’টিকে সুদৃশ্য লেফাফায় মুড়ে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ‘শ্রুতি টেপস অ্যান্ড রেকর্ডস’। লেফাফার মলাটে ছিল বিকাশ ভট্টাচার্যর আঁকা শম্ভু মিত্রের পোর্ট্রেট। কোন শম্ভু মিত্র? যাঁর গলায় দু বছর আগেই ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ‘দিনান্তের প্রণাম’ নামে ‘আধুনিকতম আবৃত্তির গ্রন্থন’ শুনেছি আমরা, সেই শম্ভু মিত্র। তাঁর পছন্দের ভঙ্গিতে বসে— ডান হাত মুঠো করে থুতনির নীচে রেখে অদূরে চোখ মেলে দেওয়া। কিন্তু বিকাশের হাতে পড়ে পুরু কাচের ভারী ফ্রেমের চশমার মধ্যে দিয়ে ঠিকরে বেরোলেন যে স্থিতধী মানুষটি, তিনি যেন বঙ্গ সংস্কৃতির রোজনামচা থেকে নিজের নাম তুলে নিয়েছেন কবে! উদাসীনতায় নিমগ্ন, নিঃসঙ্গ এই মানুষটি এই শ্রুতি-সংস্করণ ধরে রাখলেন কেন?
উত্তর মিলছে ষষ্ঠ ক্যাসেটের বি-পিঠে, নাটক শেষের পর। সেখানে স্রষ্টা বলছেন— “এই নাটকটা আমরা বেশ কয়েকবারই পড়েছি। প্রতিবারই সময়ের কারণে নানারকম ভাবে কাটাছেঁড়া করে পড়া হয়েছে। কিন্তু এবারে স্থায়ী শব্দবদ্ধ করবার সময়ে মনে হল যে পুরোটাই পড়া যাক। এই আশায় যে তাতে হয়তো নাটকের সম্পূর্ণ চলনভঙ্গিটা বোঝা যাবে। ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের মহলা দিতে দিতে হঠাৎ এ মঞ্চপ্রয়োগের ধারণাটা মাথায় এল। অর্থাৎ সামনে মঞ্চতল খানিকটা ছেড়ে একটা দেড় ফুট উঁচু পাটাতনে মঞ্চটা প্রায় সম্পূর্ণ ভরা। আর তার সামনে, মঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত একটি ন’ইঞ্চি উঁচু ধাপ। এইখানেই বলা যায় সমস্ত নাট্যক্রিয়া ঘটে। ফলে জুড়ি ও সূত্রধারেরা মঞ্চের উপরে থাকছে না। তাদের অবস্থান সম্পর্কে কৌতূহলী জনেরা নাটকটির আধুনিক সংস্করণের ভূমিকাটি পড়লে আন্দাজ পাবেন। এমনও তো হতে পারে যে কোনোদিন কোনো লোক নাটকটি ভালোবেসে মঞ্চে প্রয়োগ করতে চাইলেন। হয়তো তখন তাঁর সামান্য সাহায্য হতে পারে। সেই আশায় এই নাটক পাঠ করা।”
তাঁর এ নাটক কোনও দিন কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্য হবে বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জলপানি হাসিল করার উপায় হবে, এমন আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। নিজে এটিকে মঞ্চস্থ করতে পারেননি বলে আক্ষেপ ছিল। অনুরাগভরে পাঠ-অভিনয় করে অধরা সেই মাধুরীকে ছুঁতে চেয়েছেন। ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র শ্রুতিরূপটিকে কান থেকে কানে, মন থেকে মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র মঞ্চপ্রয়োগের সূত্রকে জনসমক্ষে নিবেদন করতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘কোনোদিন কোনো লোক নাটকটি ভালোবেসে মঞ্চে প্রয়োগ করতে’ চাইলে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর পিঠে একটি হাত রাখার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল।
আজ শম্ভু মিত্রর ১০৭তম জন্মদিন। তাঁর গড়া নাটকের দল বহুরূপীর দেখানো পথে পা দিয়েছেন হাজার হাজার উত্তরসূরি। তাঁরা থিয়েটারকে নিছক ফুর্তির আখড়া হিসেবে না দেখে কাজের মধ্য দিয়ে সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানের প্রকাশ ঘটাতে চান। আজকের ক্রমশ ক্ষীয়মাণ নাট্যচর্চার দিনেও কোনও তরুণ নাটুয়ার কানে কি শঙ্খধ্বনি হয়ে বেজে উঠবে সেই অমোঘ উচ্চারণ— ‘দিনে রেতে বুকে ভরসা রেখো, আমাদের জয় হবেই হবে’?
দ
েহপট সনে নট সকলই হারায়’— এ কথা কে না জানে! মঞ্চে না এলে নাটকের ষোলো আনাই মাটি এমন কথাও শোনা যায়। অথচ শম্ভু মিত্রর নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নিয়ে আমাদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেই কবে এই নাটককে ‘গত পঞ্চাশ বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা নাটক’ বলে আখ্যা দিয়ে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘অনেক অনেক দিন পরে এই একটি নাটক লেখা হয়েছে বাংলায়, প্রতিদিন থেকে বহুদিনের দিকে
এগিয়ে যায় যে-নাটক, যে-নাটক একই মুঠোয় ধরতে চায় ব্যক্তিকে আর সমাজকে, আমাদের অন্তর্জীবন আর বহির্জীবনকে।’
তার পর সাড়ে চার দশক অতিক্রান্ত। শঙ্খবাবু সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। শম্ভু মিত্রর প্রয়াণেরও পঁচিশ বছর হতে চলল। অথচ এ নাটক নিয়ে আমাদের বিস্ময় আজও অফুরান। তার লিখিত পাঠের মধ্যে আজও উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা খুঁজি আমরা। আজও তার মঞ্চায়নের অপেক্ষায় থাকি। ক’দিন আগে বইপাড়ায় এম সি সরকারের দোকানে গিয়ে দেখেছি স্তূপাকার ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র নতুন মুদ্রণ। পৌঁছে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের পাঠকের হাতে।
কেন এমন হয়?
মনসামঙ্গলের খেই ধরা যে নাটকে চাঁদ সদাগরের গুরু বল্লভাচার্যকে দিয়ে শম্ভু মিত্র বলিয়েছিলেন ‘জ্ঞানের সম্মান নাই, বিদ্যার মর্যাদা নাই, সুভদ্র আচার নাই, সুভাষণ নাই, মাংসসুখ ছাড়া কোনো সুখ-চিন্তা নাই— ভুল্যে যাও চন্দ্রধর, মহৎকার্য্যের কথা ভুল্যে যাও। শুধু কোনোমতে নিজেরে বাঁচেয়্যা রাখো। আদর্শের পাছে ছুট্যে কোনো লাভ নাই’। এই ভয়ঙ্কর বাস্তব তো আরও নিবিড় হয়েছে আমাদের সমকালে। যে সত্য-শিব-সুন্দরের খোঁজে এত আকুলতা চাঁদ সদাগরের, তা কবেই ক্লেদজ কুসুমে পরিণত। ১৯৬৪ সালে বহুরূপীর বার্ষিক নাট্যোৎসবে ‘অন্ধকারের নাটক’ করতে করতে যে নাটকের ছবি ভেসে উঠেছিল শম্ভু মিত্রর মনে, সে অন্ধকার কেটে বেরনোর কোনও পথ তো মিলছে না। তা হলে?
শুরুর শুরুতে নজর দিলে কি কোনও হদিস মিলবে? ১৯৭৩ সালে ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র প্রলম্বিত রচনাপর্ব যখন চলছে, শঙ্খ ঘোষের মুখোমুখি বসেছিলেন শম্ভু মিত্র। ‘এক-বক্তার বৈঠক’ নামে সেই সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, ওই ১৯৬৪-তে ‘রাজা’ নাটকের মহলা দিতে দিতে এক দিন কৌস্তুভ মুখোপাধ্যায়, অশোক সেন-সহ আরও অনেকের কাছে শম্ভু বলেছিলেন যে ‘চাঁদ বণিক নিয়ে একটা হয়। এর’ম হয়, ওর’ম হয়। সের’ম হয়। কেউ লিখে দিক্ না আমাকে একটা।’
‘চাঁদ বণিকের পালা’-র আত্মপ্রকাশ ১৯৬৫ সালে, বহুরূপী-র নাট্যপত্রের ত্রয়োবিংশ সংখ্যায়। অর্থাৎ ‘রাজা’ ও ‘রাজা অয়দিপাউস’-এর সাড়া-জাগানো সাফল্যের মধ্যেই শম্ভু মিত্র এ নাটকের খসড়া তৈরিতে হাত দিয়েছেন। কিস্তিতে কিস্তিতে সেটি ছাপা হবে বলে মনস্থ করেছেন। ছাপা হচ্ছে, তবে স্বনামে নয়, ছদ্মনাম ‘বটুক’-এর আড়ালে। দেবতোষ ঘোষ তখন বহুরূপী নাট্যপত্রের ঘরগেরস্থালি দেখেন। তাঁর হাতে নীল রঙের চিঠির কাগজে লেখা এই নাটকের প্রথম কিস্তি ধরিয়ে দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। বছর দশেক আগে দেশ পত্রিকায় (১৭ এপ্রিল, ২০১১) শম্ভু মিত্রর জীবনীগ্রন্থের সমালোচনা লিখতে গিয়ে দেবতোষ ঘোষ জানিয়েছেন, ছাপার পূর্বমুহূর্তে নিজের নামের বদলে শম্ভু খাড়া করলেন ‘বটুক’কে, মুখ টিপে বললেন, ‘দাও না, বেশ মজা হবে।’ মজা অবিশ্যি কম হয়নি। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে তাঁর সহযোগী তথা সঙ্গীতবিদ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ডাকনাম বটুক। তাঁকে খামোকা ব্যতিব্যস্ত করেছিলেন পাঠকদের কেউ কেউ। ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারিতে বহুরূপী নাট্যপত্রের চতুর্বিংশ সংখ্যায় ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র দ্বিতীয় কিস্তি বেরনোর পর ‘বটুক’রহস্য ফাঁস হয়।
ছদ্মনামে লেখার অভ্যেস যাঁর আগেও ছিল, তাঁর পক্ষে আর একটি ছদ্মনাম নেওয়ার মধ্যে তেমন অভিনবত্ব না-ই থাকতে পারে। মনে হতে পারে যে ওই ত্রয়োবিংশ সংখ্যাতেই তো তাঁর আর একটি নাটক ‘ঘূর্ণি’ বেরোচ্ছে। তাই একই নামে আর একটি নাটক না-ই বা বেরোল।
১৯৫২-য় লেখা ‘ঘূর্ণি’-র নায়ক বিকাশের মধ্যে সন্তর্পণে ধরেছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর নান্দনিক বিচ্ছেদের যুক্তি। সেই বিষাদ সম্প্রসারিত হয়েছিল চাঁদ বণিকের সমুদ্রযাত্রায়। নাটকের শুরুতে ‘চম্পকনগরীর নিডরিয়া সদাগর ভাই’দের সামনে যে বক্তব্য রেখেছিলেন চাঁদ, যাতে ‘জ্ঞানেরেও পূজা
করো, ফির আবার, অজ্ঞানে ভজনা করো’-র পাটোয়ারি বুদ্ধিকে এক হাত নিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। তাতে ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠা স্বপ্নভঙ্গের ইশারা ছিল। এই নাটকে
নিহিত ছিল সেই বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ।
‘চাঁদ বণিকের পালা’-র তৃতীয় কিস্তি বেরোয় বহুরূপী নাট্যপত্রের পঞ্চবিংশ সংখ্যায়, ১৯৬৬ সালের পুজোয়। বছরটি স্মরণীয়। বছরের শুরুতেই ওয়েলিংটন স্কোয়ার আলো করে মঞ্চস্থ হচ্ছে ক্যালকাটা থিয়েটারের ‘দেবীগর্জন’। কবিপক্ষের আগে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে সাত মাস প্রেসিডেন্সি জেলে কাটিয়ে ছাড়া পাচ্ছেন উৎপল দত্ত। তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে শহিদ মিনারের পাদদেশে খাইবার জাহাজের আদলে তৈরি মঞ্চে কুশীলবদের পাশে এসে সংহতি জানাচ্ছেন ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, জ্যোতি বসু-সহ নবগঠিত মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার নেতৃবৃন্দ। এক দিকে কলকাতার পাবলিক থিয়েটার হাতিবাগান উপচে চলে আসছে মানিকতলা খালপাড়ে— কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে হইহই করে পালা পড়ছে ‘এন্টনী কবিয়াল’-এর। তাতে কেতকী দত্তর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন বহুরূপী-প্রাক্তনী সবিতাব্রত দত্ত। অন্য দিকে গ্রুপ থিয়েটারের ভরা জোয়ারে নাও ভাসাচ্ছেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়, পার্থসারথি চৌধুরী। এবং অবশ্যই বাদল সরকার। বহুরূপীর অন্দরমহলে তাঁর অবাধ গতি। তালেগোলে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ হাতছাড়া হলেও ‘বাকি ইতিহাস’ নিয়ে পাকা কথা হচ্ছে। বহুরূপীর পালে তখন জোর হাওয়া। ‘দশচক্র’, ‘রক্তকরবী’, ‘পুতুলখেলা’, ‘রাজা’, ‘রাজা অয়দিপাউস’ নিয়ে শাহি দিল্লির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত আইফ্যাক্স অডিটোরিয়ামে টানা পাঁচ দিনের উৎসব হচ্ছে বহুরূপীর। বহুরূপীর শো রেজিস্টার থেকে জেনেছিলাম, ১৯৬৬-তে সব মিলিয়ে ৪৫টি অভিনয় করেছিল বহুরূপী। তার মধ্যে ২৯টি কল শো! রাজধানী দিল্লিতে ১৪টি, ইলাহাবাদে দু’টি। উপরন্তু সে বছরই সদ্য অভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর হাত থেকে সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলোশিপ পাচ্ছেন শম্ভু মিত্র। সোনায় সোহাগা আর কাকে বলে!
এত রোশনাইয়ের মাঝে বসে তখন কী লিখছেন শম্ভু মিত্র? লিখছেন ভিন গতের এক খোয়াবনামা। এই খোয়াবনামার আদিতে চার-পাঁচশো বছর আগেকার বিপ্রদাস পিপীলাই, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বা বিজয়গুপ্ত থেকেও নেই। ১৯২৯-এ কলকাতায় মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের ‘চাঁদ সদাগর’ নেই। নেই কালিদাস রায়ের ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতাও। বিধ্বস্ত চাঁদ সদাগর তাঁর ছেলে লখিন্দরের মুখ দু’হাতে ধরে আবেগে বিহ্বল হয়ে বলেন, ‘হবি, বীর হবি, বল? সমুদ্দুরে পাড়ি দিবি? আমার সে সমুদ্দুরে? বল্, পাড়ি দিবি? দিবি?’ এর মধ্যে আলফ্রেড টেনিসনের ‘ইউলিসিস’কে খুঁজে পেয়েছেন কেউ। কেউ বা হেনরিক ইবসেনের নিঃসঙ্গ নায়ককে।
তবু মনে হয়, এর আসল সূত্র লুকনো আছে ১৯৬৫-৬৬’র সমাজ ও রাজনীতিতে, তখনকার বাঙালি সংস্কৃতিতে। না হলে জাতীয় স্তরে নট ও নির্দেশক হিসেবে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের পরও কোন অতৃপ্তি কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁকে? কোন অমৃতকুম্ভের সন্ধান করছিলেন শম্ভু মিত্র?
এর উত্তর মেলে ‘বাংলা থিয়েটার’ শিরোনামে তাঁর একটি লেখায়। লেখাটি বেরিয়েছিল ‘পরিচয়’ পত্রিকার চৈত্র-বৈশাখ (১৩৫৭-৫৮) সংখ্যায়, অর্থাৎ ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টের তিন বছরের মাথায়। সেখানে ‘সত্যিকার স্বদেশি জিনিস দিয়ে দেশের লোককে উদ্বুদ্ধ করতে গেলে’ কোন পথে থিয়েটারকে নিয়ে যেতে হবে তার দিশা খুঁজছেন শম্ভু মিত্র— “এমন একটা নাট্যশিল্প খুঁজে পেতে চাই যা একান্তভাবেই বাঙালির। কেউ যেন আমাদের অভিনয় দেখে না বলতে পারে যে ‘চতুর্থ শ্রেণির বিদেশি থিয়েটার’। আমাদের বাংলার ছবি, বাংলার নাচ, গান, বাংলার কাব্য যেন প্রাণ দেয় সেই নাট্যের। বাংলার নিগূঢ় প্রাণ যেন প্রকাশ পায় তাতে। সেই হবে আমাদের ‘যাত্রা’, আমাদের বাঙালি থিয়েটার।”
পাশাপাশি ন্যাশনাল থিয়েটারের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে তখন মগ্ন বাংলা থিয়েটারের তিন অভিভাবক— শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী। কলকাতা আর দিল্লিতে দরবার করছেন তাঁরা। একই সময় ‘নবযুগের নাটুকেদের উপর বিশ্বাস স্থাপন’ করার কথা বলছেন শচীন্দ্রনাথ। সেই ‘নাটুকেদের’ অবিসংবাদিত প্রধান শম্ভু মিত্র। তিনি আবহমান বাংলার ঘরের জিনিসকে নাগরিক নাট্যমণ্ডলে ফেরাতে চাইছেন, যুক্তি দিচ্ছেন— “বাংলার অভিনয়-পদ্ধতি হচ্ছে কথকতার বংশধর। কথা কইতে কইতে গান গেয়ে ওঠা যাত্রারও নিয়ম ছিল, থিয়েটারেরও নিয়ম, বাংলা সিনেমারও নিয়ম।” পাশাপাশি ওই একই বছরে সিনেমায় গানের ব্যবহার নিয়ে সওয়াল করছেন কমলকুমার মজুমদার।
‘চতুর্থ শ্রেণির বিদেশি থিয়েটার’-এর ছক ভেঙে বেরনোর কথা বলছেন শম্ভু মিত্র, কিন্তু কার্যকালে তা করতে পারছেন কি? না। ওই ১৯৫১-তেই তাঁর নেতৃত্বে ‘চার অধ্যায়’ প্রযোজনা করে যে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাচ্ছেন বহুরূপী, সেই যাত্রাপথে একে একে জুড়ে যাচ্ছেন হেনরিক ইবসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সোফোক্লেস। প্রাচী-প্রতীচির সে কাল আর এ কালকে চেনার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাটকের প্রয়োগরীতি প্রতিষ্ঠা করছেন তাঁরা। দু’দশক ব্যাপী এই জয়যাত্রায় তাঁদের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছেন তুলসী লাহিড়ী, বাদল সরকার, বিজয় তেন্ডুলকরের মতো আধুনিক নাটককার। এ সবের মধ্যে ‘বাংলার অভিনয়-পদ্ধতি’ তো নেই!
অথচ ষাটের দশক থেকেই ‘থিয়েটার অব রুটস’-এর পন্থাপ্রকরণ নিয়ে তোলপাড় চলছে দিল্লি-কেন্দ্রিক নাট্যবৃত্তে। ওই সময় বার বার আন্তর্জাতিক নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে পরিচয় ঘটছিল তাঁর। বিশেষ করে ইউরোপে গিয়ে। উত্তর-ঔপনিবেশিক নাট্যচর্চার দিক ও দিগন্তকে আরও নিবিড় মাত্রায় চিনতে বুঝি সুবিধে হয়েছিল তাঁর।
আজ বুঝতে পারি, ‘চাঁদ বণিকের পালা’ সেই আধুনিকতার সম্প্রসারণ প্রভাবিত। জাতীয়তাবাদী নাট্যপ্রকল্প থেকে সরে থাকতে পারেননি শম্ভু। লোকায়ত সাহিত্যসম্পদকে আধুনিক সাহিত্যবিচারের দাঁড়িপাল্লায় যাচাই করার রাস্তা এই দশকেই সুকুমার সেন, আশুতোষ ভট্টাচার্যর হাতে পড়ে আরও খুলে গেছিল। লোকসংস্কৃতি আর নাগরিক সংস্কৃতির আড়াআড়ি মুছতে শুরু করেছিল। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হওয়ার দায় নিজের ঘাড়ে নিতে সুবিধে হচ্ছিল শম্ভু মিত্রর।
তবু ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন তিনি। এ নাটকের তৃতীয় পর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৬৯-এর জুলাইতে, বাকিটা বেরিয়েছিল পাঁচ বছর পরে, ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বরে। এক দশক ধরে তিল তিল করে এই নাটক গড়েছিলেন শম্ভু।
এই সময় একটি সমবায়ী প্রয়াসের পুরোভাগে চলে এসেছিলেন তিনি, বাংলা নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতির পত্তন করে। জাতীয় নাট্যশালার যে দুরন্ত আশা হারিয়ে গিয়েছিল দিল্লি দরবারের ভুলভুলাইয়ায়, সেটি কুড়িয়ে এনে ধুলো ঝেড়ে কলকাতার বুকে খাড়া করার নেশায় মেতেছিলেন। তার ভিশন ডকুমেন্টে সই করেছিলেন উদয়শঙ্কর, বিষ্ণু দে, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রদোষ দাশগুপ্ত, ক্ষিতীশ রায়, আলি আকবর খান, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়, শৈবাল গুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে এ উদ্যোগের মধ্যমণি শম্ভু মিত্র— তাতে সমবায়ী শিল্পের গরজকে সামনে রেখে আসলে সৎনাট্যের স্বপ্নকেই ফের বুনে দিয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন ‘একটা নির্লোভ জায়গা সেখানে আধুনিক শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় সমস্ত আন্তরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা উপস্থিত করা হবে এবং যোগাযোগ হবে দর্শকদের সঙ্গে, শ্রোতাদের সঙ্গে।’ ওই নাটমঞ্চ রূপায়িত হলে তার উপযোগী একটি নাট্যকলার বীজতলা যেন ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র মধ্য দিয়েই খুঁড়ে চলেছিলেন শম্ভু।
এই লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখেই কি ১৯৭৬ নাগাদ বহুরূপীর ৭ নং লোয়ার রেঞ্জের ঘরে এ নাটকের মহড়া শুরু করেছিলেন তিনি? চাঁদের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র স্বয়ং, সনকা— তৃপ্তি মিত্র, বল্লভাচার্য— কুমার রায়, বেণী নন্দন— দেবতোষ ঘোষ বা শঙ্করপ্রসাদ ঘোষ, ন্যাড়া— তারাপদ মুখোপাধ্যায়, লখিন্দর— সৌমিত্র বসু, বেহুলা— শাঁওলী মিত্র। বহুরূপীর মহড়ায় তখন দক্ষ অভিনেতার অভাব নেই। সবচেয়ে বড় কথা, বছর পাঁচেক নির্দেশনা না দিলেও দলে শম্ভুর নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ।
‘আমার বহুরূপী জীবন’-এ এ নিয়ে বিশদে লিখেছেন সৌমিত্র বসু। ‘শম্ভু মিত্র: ১৯১৫-১৯৯৭: বিচিত্র জীবন-পরিক্রমা’-য় শাঁওলী মিত্র লিখছেন, “তখনও, সেই সময়েও মহলা চলাকালীন শম্ভু মিত্র প্রচুর ধমক-ধামক দিয়ে যাচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝেই যথেষ্ট চেঁচামেচি করেছেন, রূঢ় কথা বলেছেন। তাতে সকলের ভালো লাগছিল না। ‘বড়ো অভিনেতা’দের মনে হচ্ছিল তাঁর এই বকুনি অপমানজনক এবং অযৌক্তিক। কিন্তু এ কথা তাঁরা কখনও নির্দেশককে সরাসরি বলেননি— সেই ঘটনাটাই সব চাইতে আপত্তিকর। তাঁরা মহলাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে পাশের ঘরে নিজেদের ক্ষোভ উদ্গার করেছেন। একদিন এ-লেখক ব্যক্তিগতভাবে একজনের কাছে এই ঘটনার প্রতিবাদও করেছিল। লাভ হয়নি। বরং তিনি কুপিত হয়ে উঠেছিলেন।” এ সব টের পাননি শম্ভু। শাঁওলী আরও লিখেছেন, “তবু কেন জানি না, একসময়ে এ-মহলা তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাতে আমরা ছোটোরা, সকলেই খুব, প্রায় ছেলেমানুষের মতো বায়না করেছিলাম যাতে তিনি মহলা বন্ধ করে না দেন। তিনি নিজস্ব রসিকতার ঢঙে কেবল বলেছিলেন, ‘নির্দেশক এবং নাটককার এই দু’টো রোল আমি একসঙ্গে প্লে করতে পারছি না।’”
এক দশক ধরে যে নাটক তিনি লিখলেন, যার নাট্যশরীর তাঁর চেতন-অবচেতন জুড়ে রইল, যার মঞ্চপ্রয়োগের কায়দাকানুন নিয়ে ভেবে চললেন অবিরাম— সেই সাধের মালাটি গাঁথতে গিয়ে থমকে পিছিয়ে আসার মধ্যে যে অবসাদ ছিল তার তল মেলে না। তবে নাটকের মহলা চলার সময় তাঁর অসহিষ্ণুতার বিবরণের মধ্যে তীব্র এক অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মঞ্চস্থ না হলেও ১৯৭৮-এর শুরুতেই বই হয়ে বেরিয়েছিল ‘চাঁদ বণিকের পালা’। বহুরূপী পত্রিকায় যে ভাবে নাটকের শেষ ছেপে বেরিয়েছিল, সেখান থেকে অনেক সরে এসে এক আধিভৌতিক কালীদহের সামনে চাঁদ ও তাঁর প্রেতবৎ সহনাবিকদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
‘পরিচয়’ পত্রিকা দফতরে শম্ভু মিত্রর মুখে এ নাটকের নির্বাচিত অংশের পাঠ শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, বলেছিলেন— ‘আমরা কাব্যনাট্যে ভাষা ও ছন্দের যে সমস্ত সমাধান করতে পারিনি শম্ভুবাবু তা অনায়াসে করেছেন।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’-র পাশে ‘চাঁদ বণিকের পালা’কে রেখে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘শম্ভু মিত্রের অক্ষয় কীর্তি হল মঙ্গলকাব্যের বহুল পঠিত কাহিনী আর চরিত্রকে আমাদের সাম্প্রতিক এবং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ফ্রেমে বাঁধতে পারা।’ শম্ভু মিত্রকে রবীন্দ্রনাথের একমাত্র উত্তরসাধক জ্ঞান করে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘...পশ্চিমের দিকে জানালা যার যটা ইচ্ছে খুলুন— জমিটুকু নিজের হওয়া চাই, ভিটেখানি তুলতে হবে নিজের হাতে— কেননা সেখানে বাস করব আমি এবং আমরা।’
যত দিন গেছে, সে কাল আর এ কালের বোঝাপড়া যত মজবুত হয়েছে, ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র মর্মে ঢুকতে পেরেছে বাঙালি। সেলিম আল দীন, সৈয়দ জামিল আহমেদ, সাইমন জাকারিয়াদের মতো নাট্যগবেষক আমাদের চিনিয়েছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যপরম্পরা। আমাদের চর্চাবৃত্তে ঢুকে পড়েছে বয়ানি গান, বিষহরির গান, ভাসানযাত্রা, মনসামঙ্গলের ঢপযাত্রা, বেহুলার নাচাড়ি, পদ্মার নাচনের মতো লোকায়ত অভিব্যক্তি। এ নাটকে যে শুধু কনটেন্ট নয়, ফর্মেরও ভাঙচুর চেয়েছিলেন স্রষ্টা, বাঙালিয়ানায় জারিত যে সহজিয়া চলনভঙ্গি রপ্ত করতে চেয়েছিলেন, তা আর নাগালের
বাইরে নেই।
‘চাঁদ বণিকের পালা’-র পাঠবিশ্লেষণেও অনেকে এগিয়ে এসেছেন। তার ছক-ভাঙা গদ্য সংলাপে অন্তর্বাহী কাব্যসুষমাকে চিনেছেন। পবিত্র সরকার লিখেছেন, ‘যেহেতু নাটককার চাঁদ বণিককে এবং তার সমূহ পরাজয়কে একটি রূপক বা অ্যালিগরি হিসেবে গড়ে তুলতে চান, হয়তো ষাট ও সত্তরের বছরগুলিতে ভারতের রাজনৈতিক বাতাবরণের একটা রূপকশরীর তৈরি করতে চান— তাই আখ্যান কল্পনায় নিজের মতো স্বাধীনতা নিয়েছেন। এ স্বাধীনতা তাঁর প্রাপ্য।’ শম্ভুর জন্মশতবর্ষে বহুরূপী পত্রিকার ১২২তম সংখ্যায় ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’-খ্যাত রামকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার এক নাটককার ষাটের দশকের এক অস্থির সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেন ‘নিডরিয়া’ শব্দাবলি, স্বপ্ন দেখান দক্ষিণ পাটনের, লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেন হরিকেল পার হয়ে, সুবর্ণভূমি ছেড়ে, অগ্নিকোণ ধরে সুদূর তাম্বপন্নির তীর।’
আমাদের মনে পড়েছে জীবনানন্দ দাশ কথিত সুবর্ণভূমির হদিস নিয়ে বেরনো দিশা-হারানো নাবিকের কথা। নাটকের তৃতীয় পর্বে বেহুলার হাহাকারকে মহাজাগতিক করে তোলে জুড়ির দল। গেয়ে ওঠে ‘ফিরাইয়া দে দে দে— মোদের প্রাণের লখিন্দরে’। সুরের দোলায় কথায় টানে উঠে আসেন বিনয় রায়, তাঁর ‘ফিরাইয়া দে দে দে— মোদের কায়ুর বন্ধুরে’। কৃষিবিপ্লবের আঁচ এসে লাগে মঙ্গলকাব্যের গাথায়।
চাঁদের মধ্যে আজকের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের এক প্রতিভূকেও কি রেখে যাননি শম্ভু মিত্র? তাঁকে দলে টানার জন্য, তাঁর আনুগত্য কেনার জন্য দুই যুযুধান শিবিরের লড়ালড়ি, আর কোনও দলেই যোগ না দিয়ে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে দৃঢ়সঙ্কল্প চাঁদের মধ্যে তো আমাদের চার পাশের অনেক লড়াকু মানুষের আদিকল্প বোনা আছে। এমন নাটক আধুনিক না হয়ে পারে?
মঞ্চস্থ করতে না পারলেও ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র পাঠ অভিনয় করতে অক্লান্ত ছিলেন শম্ভু। সেই সঙ্গে তাঁর কন্যা শাঁওলী। কারও মনে থাকতে পারে, ১৯৯৪ সালে এই নাটকের একটি শ্রুতিরূপ বেরিয়েছিল। ছ’টি ক্যাসেটের এ পিঠ-ও পিঠ জুড়ে ছিল ছ’ঘণ্টার সেই অবিস্মরণীয় পাঠ অভিনয়, শম্ভু মিত্র ও শাঁওলী মিত্রের গলায়। ক্যাসেট ছ’টিকে সুদৃশ্য লেফাফায় মুড়ে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ‘শ্রুতি টেপস অ্যান্ড রেকর্ডস’। লেফাফার মলাটে ছিল বিকাশ ভট্টাচার্যর আঁকা শম্ভু মিত্রের পোর্ট্রেট। কোন শম্ভু মিত্র? যাঁর গলায় দু বছর আগেই ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ‘দিনান্তের প্রণাম’ নামে ‘আধুনিকতম আবৃত্তির গ্রন্থন’ শুনেছি আমরা, সেই শম্ভু মিত্র। তাঁর পছন্দের ভঙ্গিতে বসে— ডান হাত মুঠো করে থুতনির নীচে রেখে অদূরে চোখ মেলে দেওয়া। কিন্তু বিকাশের হাতে পড়ে পুরু কাচের ভারী ফ্রেমের চশমার মধ্যে দিয়ে ঠিকরে বেরোলেন যে স্থিতধী মানুষটি, তিনি যেন বঙ্গ সংস্কৃতির রোজনামচা থেকে নিজের নাম তুলে নিয়েছেন কবে! উদাসীনতায় নিমগ্ন, নিঃসঙ্গ এই মানুষটি এই শ্রুতি-সংস্করণ ধরে রাখলেন কেন?
উত্তর মিলছে ষষ্ঠ ক্যাসেটের বি-পিঠে, নাটক শেষের পর। সেখানে স্রষ্টা বলছেন— “এই নাটকটা আমরা বেশ কয়েকবারই পড়েছি। প্রতিবারই সময়ের কারণে নানারকম ভাবে কাটাছেঁড়া করে পড়া হয়েছে। কিন্তু এবারে স্থায়ী শব্দবদ্ধ করবার সময়ে মনে হল যে পুরোটাই পড়া যাক। এই আশায় যে তাতে হয়তো নাটকের সম্পূর্ণ চলনভঙ্গিটা বোঝা যাবে। ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের মহলা দিতে দিতে হঠাৎ এ মঞ্চপ্রয়োগের ধারণাটা মাথায় এল। অর্থাৎ সামনে মঞ্চতল খানিকটা ছেড়ে একটা দেড় ফুট উঁচু পাটাতনে মঞ্চটা প্রায় সম্পূর্ণ ভরা। আর তার সামনে, মঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত একটি ন’ইঞ্চি উঁচু ধাপ। এইখানেই বলা যায় সমস্ত নাট্যক্রিয়া ঘটে। ফলে জুড়ি ও সূত্রধারেরা মঞ্চের উপরে থাকছে না। তাদের অবস্থান সম্পর্কে কৌতূহলী জনেরা নাটকটির আধুনিক সংস্করণের ভূমিকাটি পড়লে আন্দাজ পাবেন। এমনও তো হতে পারে যে কোনোদিন কোনো লোক নাটকটি ভালোবেসে মঞ্চে প্রয়োগ করতে চাইলেন। হয়তো তখন তাঁর সামান্য সাহায্য হতে পারে। সেই আশায় এই নাটক পাঠ করা।”
তাঁর এ নাটক কোনও দিন কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্য হবে বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জলপানি হাসিল করার উপায় হবে, এমন আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। নিজে এটিকে মঞ্চস্থ করতে পারেননি বলে আক্ষেপ ছিল। অনুরাগভরে পাঠ-অভিনয় করে অধরা সেই মাধুরীকে ছুঁতে চেয়েছেন। ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র শ্রুতিরূপটিকে কান থেকে কানে, মন থেকে মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র মঞ্চপ্রয়োগের সূত্রকে জনসমক্ষে নিবেদন করতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘কোনোদিন কোনো লোক নাটকটি ভালোবেসে মঞ্চে প্রয়োগ করতে’ চাইলে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর পিঠে একটি হাত রাখার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল।
আজ শম্ভু মিত্রর ১০৭তম জন্মদিন। তাঁর গড়া নাটকের দল বহুরূপীর দেখানো পথে পা দিয়েছেন হাজার হাজার উত্তরসূরি। তাঁরা থিয়েটারকে নিছক ফুর্তির আখড়া হিসেবে না দেখে কাজের মধ্য দিয়ে সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানের প্রকাশ ঘটাতে চান। আজকের ক্রমশ ক্ষীয়মাণ নাট্যচর্চার দিনেও কোনও তরুণ নাটুয়ার কানে কি শঙ্খধ্বনি হয়ে বেজে উঠবে সেই অমোঘ উচ্চারণ— ‘দিনে রেতে বুকে ভরসা রেখো, আমাদের জয় হবেই হবে’?
হয়তো শুনতে শুনতে সেই তরুণ নাটুয়ার মনে চন্দ্রধর আর শম্ভুর অভেদ রচনা হবে। আমাদের ছুতোনাতার অভ্যেস থেকে হয়তো এও মনে হবে যে চাঁদ বণিকের মধ্যে দিয়ে আসলে কি আত্মসমীক্ষার অছিলা তৈরি করছিলেন শম্ভু মিত্র? সমকালের মধ্যে মহাকালের ছায়া দেখতে দেখতে এক রূপকের আড়াল রচনা করে নিজেকেই ট্র্যাজিক হিরোর মহীয়ান উচ্চতায় বসাতে চেয়েছিলেন?
তা ছাড়া ‘এই দেশ যেন কতো ছোট হয়্যা গেছে, তাই নয়? শ্বাস নিতে যেন কষ্টবোধ হয়।’ এই হাহারবের মধ্যে কি ১৯৪৭ সালের পরবর্তী দু’-তিন দশকের ক্রমাগত স্বপ্নভঙ্গের আভাস ছিল না? ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সেই উজ্জ্বল দিনের রঙিন স্বপ্নকে ফিকে হতে হতে কি শেষটায় কালীদহে তলিয়ে যেতে দেখেছিলেন সেই বহুদর্শী? তবু চাঁদ বণিকের মুখে বসিয়েছিলেন ‘এ দেশের অন্তর মরে নাই’-এর মতো প্রাজ্ঞ প্রত্যয়। তাই কি গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ বুকে নিয়ে অর্ধনারীশ্বরের মতো শুয়ে থাকাই শ্রেয় বোধ করেছিলেন?
তাঁর ‘দিনান্তের প্রণাম’ সেই সঙ্কেতই পাঠায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy