অভিনেতা: ‘মণিহারা’ ছবিতে কণিকা মজুমদারের সঙ্গে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই শব্দটি শোনা আছে? ‘ক্যালচিনশিয়ান’? এর হদিস পেতে বা অর্থ খুঁজতে যদি অভিধানের পৃষ্ঠা ওল্টান, তা হলে হতাশ হতে হবে। ক্যালকেশিয়ান আর চিনা— এই দু’টির মিশ্র শব্দ এটি। কলকাতায় চিনদেশীয় যারা থাকেন, তারা আর খাঁটি চিনেম্যান নেই, প্রায় কলকাত্তাইয়া বনে গিয়েছেন, এমনটাই মনে হয়েছিল অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মৃণাল সেনের পরিচালনায়, স্বাধীন ভারতে প্রথম সরকারি রোষানলে নিষিদ্ধ হওয়া চলচ্চিত্র ‘নীল আকাশের নীচে’-র শুটিং তখন চলছে। ‘ওয়াং লু’ চরিত্রাভিনেতা প্রায় রোজ চলে যেতেন চায়না টাউনে। চিনাদের জীবনযাপন দেখবেন, অভিনয়ের রসদ সংগ্রহ করবেন, এই জরুরি প্রয়োজনে তাঁর সেখানে নিত্যযাত্রা। তখনই কিছু কিছু কলকাতাবাসী ‘সাহেব’ বনে যাওয়া চিনাদের দেখে এই অদ্ভুত শব্দটি মাথায় এসেছিল তাঁর। ‘ওরা যতটা না চিনে, তার থেকে অনেক বেশি ক্যালকেশিয়ান, অর্থাৎ কলকাত্তাইয়া। ওদের দেখে চিনেম্যানের হাবভাব শিখতে গেলে শেষ পর্যন্ত বাঙালি হাবভাবও ভুলে যেতে হবে’— বলেছিলেন কালীবাবু।
চায়না টাউনে অবশ্য এক দিন গণধোলাইয়ের হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন এই দর্শনার্থী— ‘যেদিন শুটিং থাকত না, সেদিন আমি সকালবেলা একটা ট্যাক্সি করে চায়না টাউনে চলে যেতাম। তাদের চলা-ফেরা হাবভাব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করতাম। তবে ইয়াং ছেলেদের নয়, আমি লক্ষ করতাম বুড়ো-বুড়িদের চলাফেরা, কথাবার্তার ধরণ। চিনের প্রাচীন ব্যাপারটা এখনও তাদের মধ্যে থেকে গেছে।’ এ রকমই এক দিনে, হঠাৎ চার-পাঁচ জন ষণ্ডাগুন্ডা চিনে যুবক কালীবাবুকে চার পাশ থেকে ঘিরে ধরল। জায়গাটা তখন কোকেন স্মাগলিংয়ের স্বর্গরাজ্য। অভিনয়ে নৈপুণ্যপ্রার্থীকে তারা ভেবেছে পুলিশের স্পাই। প্রতিদিন অচেনা এক জনকে দেখলে স্থানীয়দের সন্দেহ উদ্রেক হবেই। এমন আশঙ্কা কালীবাবুর নিজেরও ছিল। সম্ভাব্য বিপদ থেকে পরিত্রাণের আশায় সঙ্গে রেখে দিয়েছিলেন তাঁর অভিনীত পুরনো ছায়াছবির স্থিরচিত্রের অ্যালবাম। সেগুলো দেখিয়ে চিনা-যুবাদের আপ্রাণ বোঝাচ্ছেন: ‘আমি স্পাই-ফাই কিছু নয়। সিনেমায় অ্যাকটিং করি। একটা ছবিতে চিনেম্যানের রোল করব। তাই তোমাদের দেখে আদব-কায়দা শিখতে এসেছি।’ এ সব কথা মাথাগরম খর্বাকার তরুণগুলিকে বিশ্বাস করানো শক্ত। তবে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করল। এক জন বৃদ্ধ চিনেম্যান, হ্যারিসন রোডে তার ডেন্টিস্টের দোকান, ‘পূরবী’ সিনেমা হলে সে কালীবাবুর ‘ডাকহরকরা’ ছবিটা দেখেছিল। সেই চিনে ভদ্রলোক চিনতে পেরেছিলেন বলে গণধোলাই থেকে একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন ‘ওয়াং লু’ কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘ডাকহরকরা’-ই এশিয়ার প্রথম ফিচার ছবি, যা মস্কো টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। এই ছবি দিয়ে ১৯৫৯-৬০ সালে স্টকহলম শান্তি সম্মেলনেরও উদ্বোধন হয়েছিল। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গীতরচনা, সুধীন দাশগুপ্তের সুর, মান্না দে-র অনন্য গায়কি, সেই সঙ্গে কালীবাবুর তুলনাহীন অভিনয়— পরিচালক সরোজ দে-র এই ছবিটি সে বছর জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও সরকারি ভাবে ছবিটি পাঠানো হয়েছিল। অভাবনীয় সাফল্যে আপ্লুত কালীবাবু বাড়িতে প্রীতিভোজের আয়োজন করেছিলেন ঘনিষ্ঠদের নিয়ে। সে দিন তাঁর বাড়িতে চাঁদের হাট— পরিচালক ছাড়াও ছবির প্রচার অধিকর্তা সুধীরেন্দ্র স্যান্যাল (ইনি ‘অচলপত্র’-সম্পাদক দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের পিতা), শোভা সেন, অজিত গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। বন্ধুদের পরানো ফুলের মালা গলায় নিয়ে কালীবাবু দৃশ্যত হাসিখুশি মুখে ফোটোগ্রাফারকে একের পর এক পোজ় দিয়ে গেছেন সেই সন্ধ্যায়।
অথচ এই ছবির আগে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলেন! ১৯৫১ সালে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কৌতুক গল্প ‘বরযাত্রী’ অবলম্বনে ছবি করেছিলেন পরিচালক সত্যেন বসু। তোতলা গণেশের চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় মিথের জন্ম দিয়েছে। এর পরেও তাঁর চাহিদা তৈরি হল না টালিগঞ্জে। ১৯৫৫ সালে সত্যেন বসুর ‘রিকশাওয়ালা’, পরের বছর তপন সিংহের ‘টনসিল’-এ অসম্ভব ভাল অভিনয় করলেও কাজের বাজারে ঢেউ এল না। ফলে সংসারের চাকা থমকে গেল। দারিদ্রের সেই চরমসীমায় পৌঁছে কালীবাবু আত্মহত্যার কথা ভাবছিলেন। বলেও ফেললেন সেই কথা কালুবাবুর কাছে। তিনি ধমক দিলেন: ‘এ সব কী কথা আপনার মুখে? আত্মহত্যা করতে যাবেন কেন! যারা দুর্বল চরিত্রের মানুষ তারা এ সব ভাবেন। আপনি তো তেমন মানুষ নন।’ পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন ‘কালুবাবু’ অর্থাৎ সরোজ দে। কয়েক মাসের মধ্যে বোঝা গেল, সেটা নিছক স্তোকবাক্য নয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডাকহরকরা’ নিয়ে ছবিটির পরিকল্পনা যখন বাস্তবায়িত হতে শুরু করল, সরোজ দে বলিষ্ঠ অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও নাম মনেও আনেননি নামভূমিকার জন্য। জোয়ার এল তাঁর কেরিয়ারে ‘ডাকহরকরা’-র ঝুলি-ভর্তি শিরোপা-সূত্রে।
বলা যেতে পারে, ১৯৫৮ সাল কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনে মাইলফলক। ‘ডাকহরকরা’ ছাড়াও সেই বছরে অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’, তপন সিংহের ‘লৌহকপাট’, সলিল সেনের ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ এবং ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ ছবিতে। বাস্তবিক, এর পরের এক দশক জুড়ে তিনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতে উত্তমকুমারের পাশাপাশি রাজত্ব করে গেছেন। এ ছাড়াও, সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’-র ‘মণিহারা’, তপন সিংহের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’, ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, অগ্রদূতের ‘বাদশা’, পঞ্চমিত্রের ‘ক্ষুধা’— সব এই সময়পর্বের বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র।
“…তিনি ছিলেন সেই সময়ে বাংলা ছবির টপ গ্ল্যামারদের অন্যতম। তাঁকে নায়ক করে ছবি তৈরি হচ্ছে, তাঁর কথা ভেবে ছবির গল্প নির্বাচন করা হচ্ছে।… উল্টোরথ পুরস্কার অনুষ্ঠান সেবার উত্তর কলকাতার রূপবাণী সিনেমায়। সস্ত্রীক কালী ব্যানার্জি এসে ট্যাক্সি থেকে নামছেন। সঙ্গে সঙ্গে উল্টোদিকের ফুটপাথ থেকে গগনিবদারী চিৎকার। সেই সঙ্গে ‘গুরু গুরু’ আওয়াজ।” লাঠিধারী পুলিশের কর্ডন ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছিল কালী-ভক্ত আকুল দর্শক।
এই সাফল্যের পর হঠাৎ করেই পারিশ্রমিক অনেকখানি বাড়িয়ে দিলেন কালীবাবু। এক-একটি ছবিপিছু ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা করে চাইতে শুরু করলেন। সে সময়ে সেই পারিশ্রমিক ছিল মহানায়ক উত্তমকুমারের চেয়েও বেশি! ফলে প্রযোজকরা মুখ ফিরিয়ে নিলেন তাঁর থেকে। সত্তর দশকের শেষ দিকে আবার দারিদ্র এসে করাঘাত করতে শুরু করল তাঁর অহংয়ের দরজায়। পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। ‘গুরুদক্ষিণা’ বা ‘ছোটবউ’-এর মতো বাণিজ্যিক ছবি কালীবাবুর অন্নসংস্থানের প্রধান সহায় হয়ে উঠেছিল তখন।
অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মতারিখ ১৯২১ সালের (অন্য মতে ১৯২০) ২০ নভেম্বর। এই বলিষ্ঠ অভিনেতা সারা জীবন কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। অসাধারণ ফুটবল খেলতেন। ক্রিকেট, লাঠিখেলা, বক্সিং-এও সুনাম ছড়িয়েছিল। বন্ডে সই করে মিলিটারিতেও যোগ দিয়েছিলেন! কবিতা লিখেছেন শখে, তবে সর্বদা সঙ্গী ছিল বই। প্রত্যন্ত বিদ্যুৎহীন গ্রামে শুটিং করতে গিয়ে রাতে অন্যদের সঙ্গে আড্ডা না জমিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় বই পড়ছেন— এটাই সকলের পরিচিত দৃশ্য হয়ে উঠেছিল।
অভিনয়ের টানে নাটক করেছেন ‘কেদার রায়’, ‘টিপু সুলতান’, ‘স্বর্গ হতে বিদায়’-এর মতো প্রযোজনায়। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও সলিল চৌধুরীর সান্নিধ্যে এসে গণনাট্য সঙ্ঘে যোগ দেন। সেই যোগাযোগে প্রেম ও পরিণয় প্রীতি লাহিড়ীর সঙ্গে, যিনি বামপন্থী নেতা অবনী লাহিড়ীর বোন শুধু নন, নিজেও ছিলেন সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মী। ‘প্রীতি বৌদির চেহারার মধ্যে একটা আপাত কাঠিন্য আছে। সেটা মনে হয় মাঠে-ময়দানে ঘুরে ঘুরে রাজনীতি করার জন্যই হয়েছে’— মেদিনীপুরের তেরপখিয়া গ্রামে প্রীতিকে প্রথম দেখে মনে হয়েছিল সাংবাদিক রবি বসুর। এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র-সাংবাদিকের সঙ্গে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুমুল তর্ক বেধে গিয়েছিল এক ছবির সেটে। শিশুর মতো সারল্য তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হলেও একগুঁয়ে রাগ তাঁর প্রভূত ক্ষতি করেছিল। সেই একগুঁয়েমি সম্বল করে তিনি কমিউনিজ়মে বিশ্বাস করতেন। ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিক রবিবাবুকে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় চিনের তিয়ান-আন-মেন স্কোয়্যারে ছাত্রদের ওপর কমিউনিস্ট সরকারের গুলি চালনার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন: “বেশ করেছে গুলি চালিয়েছে।… ওরা সব সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার হয়ে দালালি করছিল। …আমি কমিউনিস্ট। সাম্রাজ্যবাদীদের হয়ে যারা দালালি করে আমি তাদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করি।” ক্রুদ্ধ-সাম্যবাদী ‘কালী ব্যানার্জি’-র মুখ থেকে এটাই ছিল সেই তর্কের শেষ সংলাপ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy