Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গাওয়ার সুযোগ পেয়ে দ্বিধায় ছিলেন, ঠিকমতো গাইতে পারবেন তো! তার পরেও বহু ছায়াছবিতে গান গেয়েছেন।
Amar Pal

এক বারেই রেকর্ড করেছিলেন ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’

তিনি অমর পাল। আগামী বুধবার তাঁর জন্মশতবর্ষের সূচনা।

সহজিয়া: পল্লিগানের মাটির সুর ছিল অমর পালের সবচেয়ে প্রিয়। ডান দিকে, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তাঁর গানে লিপ দিচ্ছেন রবীন মজুমদার।

সহজিয়া: পল্লিগানের মাটির সুর ছিল অমর পালের সবচেয়ে প্রিয়। ডান দিকে, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তাঁর গানে লিপ দিচ্ছেন রবীন মজুমদার।

দীপঙ্কর ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২১ ০৮:১১
Share: Save:

গানের মাঝেই সংলাপ ঢুকিয়ে সত্যজিৎ রায় গানটিকে আরও অর্থবহ করে তুললেন— ‘বাঃ খাসা! কী ভাষা!’ হালকা কথার মাঝে গানের গভীর তাৎপর্য নিয়ে এল ‘হীরক রাজার দেশে’। সেখানকার রাজনীতি আর রাজা-প্রজার কথা যেন সব সময়ই প্রাসঙ্গিক। এই অস্বাভাবিক বাস্তবতা মজার মোড়কে তুলে ধরতে ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ গাওয়ালেন অমর পালকে দিয়ে। অমর পাল নিজেই তো অবাক, দ্বিধাও ছিল। ঠিক ঠিক পারবেন তো? সংলাপের পর আবার গাইছেন, ‘দেখো ভাল জনে রইল ভাঙা ঘরে/ মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে।’ পরিচালক ও গায়ক দু’জনেরই বয়স তখন ষাটের আশপাশে। এ বছরই সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল আর অমর পালের জন্মশতবর্ষের সূচনা। সিনেমায় গান অমর পাল এর আগেও অনেক গেয়েছেন, কিন্তু সত্যজিতের এই সিনেমার প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর গর্ববোধ বোঝা যেত। এ এক দিক। আবার, লোকসুরের বিস্তার আর হরেক বিষয় তাঁর গলায় মোহিনী মায়ায় জড়িয়ে পড়ত।

‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই...’— গুনগুন করে গাইতে লাগলেন কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে। নানা কথার মাঝে বলছেন, লোকায়ত সুর থেকেই তো আমাদের সঙ্গীতের সৃষ্টি। লোকসঙ্গীত যে সঙ্গীতের শিকড় তা বলতেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে, কিন্তু উদ্ভাসিত হয়ে উঠত চোখমুখ। কথা আর সুরে অনাবিল আবেগে আত্মস্থ হয়ে যেতেন তখন, বয়স বা বার্ধক্যের কোনও ছাপ পড়ত না অভিব্যক্তিতে। অমর পালের আতিশয্যহীন সাবলীল স্মৃতিচারণাও লোকগানের মতো মাটির গন্ধমাখা সতেজতারই সন্ধানী। ২০১৯-এর ২০ এপ্রিল তাঁর প্রয়াণের কিছু ক্ষণ আগেও ছিলেন নিত্যকাজে উদ্বেগহীন। তবু শতায়ু জীবনের বছর দুয়েক কাছাকাছি সময়েও তিনি গানের কথায় উদ্বেল হতেন, কথার ভিড়ে হারিয়ে যেতেন। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার ছিল বিস্তৃত ও স্বচ্ছ। অনুচ্চ তারে বাঁধা হলেও তাঁর জীবন-পরিক্রমা ছিল পল্লিগানের গরিমায় মশগুল।

কথায় কথায় দুই বাংলারই স্মৃতি জড়িয়ে থাকত তাঁর। ওপার বাংলার তিতাস নদীর পাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শৈশব থেকে যৌবনের প্রথম ভাগ কেটেছে। কলকাতায় এসে থিতু হলেন ছাব্বিশ বছর বয়সে। তখনকার কুমিল্লা জেলার ওই ছোট জনপদের পথ-মাঠ-ঘাটের গানের সুর তাঁর মনকে দখল করে নিয়েছিল। ছোটবেলায় লেখাপড়ায় একেবারেই মন ছিল না, স্কুলে যেতেও ইচ্ছে হত না। স্কুলে যাওয়ার পথে ছিল কলের গানের দোকান। সেখানে গান বাজত। ওখানেই বই হাতে গান শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে থাকতেন ছোট অমর। বাড়ির কাছেই বেতের গাছ ছিল, সেই বেত দিয়ে মাস্টারমশাইরা তাঁকে বহু মেরেছেন!

জন্ম ১৯২২-এর ১৯ মে। ন’বছর বয়সেই বাবা প্রয়াত। তবে ওই যেখানে গান হচ্ছে— কোথাও কবিগান, কোথাও কৃষ্ণলীলা, কোথাও যাত্রা—সেখানে পালিয়ে যেতেন। এ দিকে আবার বাড়িতে জ্যাঠামশাইয়ের আখড়া ছিল, সেখানে তিনি বাউল গানের আসর বসাতেন। বাবা গাইতে পারতেন না তবে সমঝদার ছিলেন। কালীকীর্তন, মালসি গান শুনতে ভালবাসতেন। ঝোঁক ছিল বছর বছর বাড়িতে জারি গানের আসর বসানো। মা দুর্গাসুন্দরী কিন্তু ভাল গাইতেন। বিয়ের গান, পুজোপার্বণ অনুষ্ঠানে মেয়েলি গান কত সব। গানের সুরের সঙ্গে অমরের সখ্য আশৈশব।

তিনি বলতেন, ‘কেন আমার গানটা প্রাণ পেয়েছে জানো? আমি নিজে চোখে দেখেছি।’ বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী শীতের সময় গাইতেন, ‘জাগো হে এই নগরবাসী’, ‘প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনার মাঝে গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে’ বা ‘রাই জাগো গো’। তাঁর গানের জীবন ১৯৪২ থেকে শুরু হলেও, ১৯৫১ সালে প্রথম আকাশবাণীতে গেয়েছিলেন শচীন ভট্টাচার্যের লেখা ভাটিয়ালি সুর ‘কোন গ্রামের কন্যা ওগো/ যাইবা কোন গ্রামে গো/ ওই দেখো গো দিনের সুরজ গাছের মাথায় নামে’। যখন তাঁর বয়স কুড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই এই শচীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ হয় পাশের বাড়ির ঝুলনের অনুষ্ঠানে। সে বাড়িরই সুরেন্দ্র সূত্রধর শচীনবাবুকে বললেন, ‘এর গলাটা খুব ভাল। ও গান করতে পারে।’ একাধারে বড় কবিরাজ আবার গীতিকার শচীন ভট্টাচার্যের অবদান তাঁর প্রতিভার স্ফুরণে সবচেয়ে বেশি। শচীনবাবু গান শুনে অমরকে নিয়ে গেলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ছোট ভাই উস্তাদ আয়াত আলি খাঁর কাছে। তার পর দেশ স্বাধীন ও ভাগ হয়ে গেলে শচীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে চলে এলেন কলকাতায়। তার পর স্থায়ী বসবাস টালিগঞ্জ এলাকায়। এখানে এসে আবার শচীনবাবু অমর পালকে নিয়ে গেলেন ওপার বাংলারই তাঁদের এলাকায় বসতি ছিল, এমন সঙ্গীতশিল্পী দুই ভাই— মণি চক্রবর্তী ও সুরেন চক্রবর্তীর কাছে। সুরেন চক্রবর্তী ছিলেন লোকসঙ্গীতের অসামান্য প্রাজ্ঞ শিল্পী। তাঁর গভীর প্রভাব পড়ে অমর পালের সঙ্গীতজীবনে।

আধুনিক বাংলা গানের উজ্জ্বল সেই সময়পর্বে শচীন দেব বর্মণের গান, আব্বাসউদ্দিন আহমেদের গান সব সময়ই তাঁর মনকে টানতে লাগল। আবার ‘নিমাই দাঁড়ারে নিমাই দেখিরে তোমারে’— অনন্তবালা বৈষ্ণবীর এমন গানের মুগ্ধতা তেমনই সারা জীবন বয়ে চলেছিলেন। গ্রামীণ জীবন আর সুরেই ছিল তাঁর আকুলতা। কথাপ্রসঙ্গে বলেছেন, “এক জন মুসলমান ভিখিরি, সে অন্ধ, সে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন থেকে টাউনে ঢুকতে একটা খাল পড়ে— খালটা মেঘনায় পড়েছে, তা ওই খালের ওপর একটা ব্রিজ ছিল লোহার— ওই ব্রিজের পাশে বসে তাঁর পাশে ওঁর মেয়েটা বসে থাকত। গান গাইত, ‘আরে মুসলমান বলে আল্লা, হিন্দু বলে হরি/ দয়ানি করিবা আল্লা দয়ানি করিবাও।’ এইটা আমার ভগবানের আশীর্বাদ, সুরটা টেনে নিল।” মাটির গন্ধমেশা সেই সব গানের সুরে সুরে সিদ্ধান্ত নিলেন— ‘গাই তো পল্লিগীতি গেয়েই মরব আর বাঁচব তো পল্লিগীতি গেয়েই বাঁচব।’ সে কথা সারা জীবন বলেওছেন গর্বের সঙ্গে। সঙ্গীতজীবনে প্রভাতি গান, ভাটিয়ালি গান আর শ্যামাসঙ্গীতও গাইতেন রেডিয়োতে। এক বার বিশেষ প্রয়োজনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের তত্ত্বাবধানে রেডিয়ো স্টেশনে খালি গলায় ভাটিয়ালি গান গাইলেন, ‘এ ভবসাগরে কেমনে দিব পাড়ি রে / দিবানিশি কান্দি রে নদীর কূলে কূলে।’ এমন কত অভিজ্ঞতার ঝুলি তাঁর। সিনেমায় এর পর গেয়েছেন অপরেশ লাহিড়ীর সুরে ‘ও আমার দেশের মাটি’ ছবিতে, তার পর দেবকীকুমার বসুর ছবি ‘সাগরসঙ্গমে’। এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। পরে তপন সিংহের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, অরুন্ধতী দেবীর ‘মেঘ ও রৌদ্র’, পীযূষ বসুর ‘শিউলিবাড়ি’ ইত্যাদি বহু সিনেমায় নেপথ্যশিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন। আত্মতৃপ্তি নিয়ে স্মরণ করতেন, বম্বেতে এক বার অনুষ্ঠানের শেষে রাজ কপূর বলেছিলেন যে, ‘আপনি ভাগ্যবান, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে আপনি কাজ করেছেন।’ সেই ‘হীরক রাজার দেশে’-র গানে অমর পালের এক বারের গাওয়াতেই ঠিকঠাক রেকর্ড হয়ে গেল। তাঁর অজস্র গানের রেকর্ড, ক্যাসেট ও সিডি হয়েছে। জনপ্রিয় এই গায়ক দেশের নানা জায়গা ছাড়াও আমেরিকা ও জাপানের মানুষদের তাঁর লোকগানের সুরে মুগ্ধ করেছেন।

পিতৃকুল ছিলেন ব্যবসায়ী। মা ভাবলেন ছেলে বখাটে হয়ে যাবে। তাই এক আত্মীয়কে তাঁর ব্যবসার কাজে অমরকে সঙ্গে নিতে বললেন। চট্টগ্রাম, কলকাতা দু’-এক বার ঘুরেও এসেছেন কিশোর অমর। কিন্তু তখনই তো তাঁর মন গানের সুরে ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টাউন ক্লাবে একটা রেডিয়ো ছিল। যখন গান হত বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে শুনতেন। পালিয়ে এক বার যখন কলকাতায় এসেছিলেন, এক জনের সঙ্গে ঘটনাচক্রে যোগাযোগে বড়বাজারে এসে একাই কিছু দিন ছিলেন ষোলো বছরের অমর। ইডেন গার্ডেনে গিয়ে বসে থাকতেন। আর রবীন্দ্রকাননে যেতেন। কারণ, ধারণা ছিল সেখানে গেলেই বোধহয় কে এল সায়গল, প্রমথেশ বড়ুয়া, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কানন দেবীকে দেখা যাবে। আবার ফিরলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মায়ের এক মামা রংপুরে ব্যবসা করতেন। তিনি রংপুর থেকে অমরকে লালমনিরহাট নিয়ে গেলেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেখানে দু’দিন কাজ আর বাকি সময় ফাঁকা। একটা চায়ের দোকান দিলেন। সেই সময় শুনলেন শচীন দেব বর্মণ আর রবীন মজুমদার আসছেন রংপুর কলেজে গান গাইতে। কিন্তু ঢোকার উপায় নেই। বাইরে থেকে শুনলেন শচীনকর্তা গাইছেন, ‘চোখ গেল চোখ গেল চোখ গেল পাখিরে’, ‘পদ্মার ঢেউ রে’-র মতো সব গান। বাংলার মাটি ও গানই তাঁকে বিভোর করে রাখত।

লোকগানের প্রতি এই টান তাঁর কখনও কমেনি। এই আকুতি আর সঙ্গীতধারাকে লোকসুরের মায়াজালে ধরেছেন তিনি। তাঁর গায়নে প্রভাতি আর ভাটিয়ালির সুরবৈভব অন্য মাত্রা দিয়েছে। তাঁর অননুকরণীয় মোহাচ্ছন্ন গায়কি অনন্য রূপ পেয়েছিল তাঁর জীবনযাপনের মতো সরল স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে। অমর পালের স্বীকৃতি ও সম্মাননা ভারত সরকারের সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডি লিট, রাজ্যের সঙ্গীত মহাসম্মান বা লালন পুরস্কারের মধ্যে আটকে থাকেনি, তাঁর জীবন পরিক্রমা ছিল সুরের খোঁজে বহমান। মায়া জড়ানো মুখচ্ছবি, প্রকৃতির নিস্তরঙ্গ বহমানতা, গ্রামজীবনের আলো-আঁধারির স্পন্দন ছিল তাঁর স্বরে ও সুরে। বাঙালিকে প্রাণের আরাম দিয়েছেন তিনি। সাত দশকের বেশি এই লোকগানেই আত্মস্থ ছিলেন। পূর্ববঙ্গের লোকগানের সুরেলা মেজাজ আর গায়কির সহজিয়া ঘরানার স্মরণীয় ও অবিসংবাদী বাহক অমর পাল।

অন্য বিষয়গুলি:

Amar Pal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy