সঙ্গীতব্যক্তিত্ব: আবদুল আহাদ।
আবদুল আহাদ কে ছিলেন? ঢাকা আর কলকাতায় এই প্রশ্নের দু’রকম উত্তর। রাজশাহীর উত্তরের সঙ্গে মিলবে না শান্তিনিকেতনের উত্তর। সাতচল্লিশের দেশভাগ যে বাঙালিকে দু’টুকরো করে দিল, তার দরুন যে ক’জন বাঙালি চেনা-অচেনার ফাঁকে পড়ে গেলেন, আবদুল আহাদ তাঁদেরই এক জন। গত বছর তাঁর জন্মের শতবর্ষ নিঃশব্দে পেরিয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারে তাঁর ঐতিহাসিক অবদানের স্থায়ী স্বীকৃতির দাবি করছে এই শতবার্ষিকী মুহূর্ত।
যে কারণে পঙ্কজকুমার মল্লিককে মাথায় করে রাখে কলকাতা, অনেকটা সেই কারণেই আবদুল আহাদকে বুকে রাখে ঢাকা। রেডিয়োর সঙ্গীত শিক্ষার আসরে অনেক রকমের বাংলা গানের তালিম পেয়েছে বাঙালি। দশকের পর দশক ধরে। পশ্চিমবঙ্গে এই শ্রবণসংস্কৃতির ভান্ডারি যদি পঙ্কজ মল্লিক হন, বাংলাদেশে তার কান্ডারি আবদুল আহাদ।
শুধু রেডিয়ো নয়, গ্রামোফোন রেকর্ডের কালো চাকতিতে পুরে, হিজ় মাস্টার্স ভয়েস বা কলম্বিয়ার মোহর লাগানো লেফাফায় মুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে প্রমিত রূপ অসংখ্য গৃহকোণে বেজে উঠল, তার পিছনেও আবদুল আহাদের সক্রিয় প্রশিক্ষকের ভূমিকা। ৭৮ আরপিএম স্পিডের রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড, যে রেকর্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিচয় রোমান হরফে লেখা ‘বেঙ্গলি টেগোর সং’, যার লেবেলে ‘কথা ও সুর: রবীন্দ্রনাথ’ ছাপা হত, এমন অসংখ্য রেকর্ডের লেবেলে রবীন্দ্রনাথের নামের পাশে একই মাপের হরফে লেখা আছে ‘পরিচালনা: আবদুল আহাদ’। বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির সহযোগে বেরনো এ সব রেকর্ডের শিল্পী তালিকায় সুধা মুখোপাধ্যায় আছেন। সন্তোষ সেনগুপ্ত, সত্য চৌধুরী আছেন। আছেন সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়। হ্যাঁ, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ছোট মেয়ে সুচিত্রার প্রথম রেকর্ড, যাতে ছিল ‘মরণ রে’ আর ‘হৃদয়ের একূল ওকূল’— তার প্রশিক্ষক ছিলেন আহাদ। তখনও সুচিত্রার, মিত্র হতে অনেক দেরি। ১৯৪৬ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাড়া জাগানো রেকর্ড, যার এক পিঠে ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায়’ আর অন্য পিঠে ‘হে নিরুপমা’— তাতেও সে আমলের দস্তুরমাফিক পরিচালকের নাম আবদুল আহাদ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক শান্তিদেব ঘোষের গলায় ‘কৃষ্ণকলি’র রেকর্ড খুঁজে পেলে দেখবেন, তাতেও দেখবেন পরিচালকের নাম আবদুল আহাদ। ওই সময় গ্রামোফোন কোম্পানির রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষকের পদে কাজ করছিলেন তিনি।
সেই সময় বহু অসাধ্য সাধন করেছেন আহাদ! পঙ্কজকুমার মল্লিককে দিয়ে ফের রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করানোটা তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পর বিশ্বভারতী মিউজ়িক বোর্ডের অনুমোদনের যে আমল শুরু হয়, তার গোড়ার দিকে সুরের উনিশ-বিশ নিয়ে গোল বাধার দরুন বেশ কয়েক বছর একটিও গান রেকর্ড করেননি পঙ্কজকুমার। এহেন শিল্পীকে গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তাদের মধ্যস্থতায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে তাঁর ঘরে দিনের পর দিন গিয়ে তাঁকে পুরোদস্তুর গান তুলিয়ে গান রেকর্ড করানোর কৃতিত্ব আহাদের। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। এক বার রেকর্ডিং হল। ক’দিন বাদে স্যাম্পল রেকর্ড বেরোলে দেখা গেল সুরের হেরফের হয়েছে। বিশ্বভারতী বেঁকে বসতে পারে। পঙ্কজবাবুকে বলেকয়ে আবার দমদমের গ্রামোফোন কোম্পানির স্টুডিয়োতে নিয়ে এলেন আহাদ। ক’দিন বাদে ফের স্যাম্পল রেকর্ড বেরোলে ফের খুঁত ধরা পড়ল। এ বার যান্ত্রিক ত্রুটি। তৃতীয় বারও পঙ্কজকে রেকর্ডিং স্টুডিয়োয় নিয়ে এসেছিলেন আহাদ। এ বারে আর ভুলচুক হয়নি। তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়। রেকর্ড তো পাশ করাতে হবে! শৈলজারঞ্জন মজুমদার তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্য। ক’দিনের জন্য কলকাতায় এসে উঠেছেন ১৭ নং বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে, অনাদিকুমার দস্তিদারের বাড়িতে। এ বারও উদ্ধারকর্তা আহাদ। ১৯৪৬-র এক দুপুরে পঙ্কজ ও হেমন্তর দুটো রেকর্ড নিয়ে অনাদির বাড়িতে গিয়ে শৈলজারঞ্জনকে শোনালেন আহাদ। মন দিয়ে শুনে খসখস করে কাগজের ওপর লিখে দিলেন শৈলজারঞ্জন। হেমন্তর গানদু’টির কথা তো আগেই বলা হয়েছে। পঙ্কজের গলায় ওই দুটো গান এখনও প্রবাদপ্রতিম— ‘সঘন গহন রাত্রি’ ও ‘তুমি কি কেবলই ছবি’।
অনেক পরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত আবদুল আহাদের আত্মজীবনী ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’-তে এ সব তথ্য মেলে।
যে আবদুল আহাদ বছরপাঁচেক ধরে কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবল সক্রিয়, যিনি একাধারে ‘গীতবিতান’-এর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গান শেখাচ্ছেন ও রেডিয়ো স্টেশনে গিয়ে দাপটে গান গাইছেন, যিনি আধুনিক গানে সুর দিয়ে বন্ধু সন্তোষ সেনগুপ্তকে দিয়ে গাওয়াচ্ছেন ‘আমি তুমি দুই তীর সুগভীর তটিনীর’ মতো জনপ্রিয় গান, এমনকি টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায় নাম লিখিয়ে ওবায়েদ-উল হক পরিচালিত ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ ছবিতে সুর দিচ্ছেন, ১৯৪৭-এর দেশভাগ তাঁকে কলকাতার পাট তুলতে বাধ্য করল। অন্তরঙ্গ বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই তাঁকে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল আহাদকে।
অথচ পূর্ববঙ্গেই জন্মেছিলেন আহাদ। ১৯২০ সালে, রাজশাহীতে। ডিস্ট্রিক্ট স্কুল ইনস্পেক্টরের ঘরে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর সঙ্গে যাঁরা গান গেয়ে বাজনা বাজিয়ে হইহই করে বড় হচ্ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জমিদারতনয়, পরবর্তী কালের প্রখ্যাত সরোদিয়া রাধিকামোহন মৈত্র। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতায় সিটি কলেজে ভর্তি হন আহাদ। নাড়া বেঁধে গান শেখেন মনজু খান সাহেবের কাছে। আই এ পাশ করার কয়েক বছরের মাথায় সরকারি জলপানি পেয়ে চলে যান শান্তিনিকেতনে। সেটা ১৯৩৮ সাল। সঙ্গীত ভবনের প্রথম মুসলমান ছাত্র আহাদ। থাকতেন কলাভবনের ছাত্রাবাসে। সুবিনয় রায় তাঁকে চোখে হারাতেন। সঙ্গীত ভবনের তাঁর সতীর্থদের মধ্যে দু’জন কালক্রমে স্বনামধন্য— রাজেশ্বরী বাসুদেব, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে আলাদা করে তালিম দিতেন শৈলজারঞ্জন ও শান্তিদেব। ‘উত্তরায়ণ’ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে যখন ‘শ্যামা’-র নির্মাণপর্ব চলছে, তার অঙ্গাঙ্গি ছিলেন আহাদ। ‘বর্ষামঙ্গল’ থেকে ‘চণ্ডালিকা’— রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের চমকপ্রদ সৃজনপর্বের ঘনিষ্ঠ প্রত্যক্ষদর্শী আহাদ। বাইশে শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণসংবাদ শান্তিনিকেতনে এলে শোকার্ত শৈলজারঞ্জন আহাদের হাতেই ‘সমুখে শান্তিপারাপার’ গানটির স্বরলিপি তুলে দিয়ে বৈতালিক পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন।
শান্তিনিকেতনের পালা সেরে কলকাতায় থিতু হয়ে শিক্ষক-শিল্পী-সঙ্গীত পরিচালকের বর্ণাঢ্য জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, এমন সময় তাতে পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছিল দেশভাগ।
ঢাকায় গিয়ে পায়ের তলার মাটি পেতে দেরি হয়নি আহাদের। গিয়েই ঢাকা বেতারে যোগ দিলেন সঙ্গীত বিভাগের প্রযোজক হিসেবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি শেখানো ও শোনানোর পাশাপাশি শত শত আধুনিক গানের সুরসৃষ্টি করে একেবারে চাঙ্গা করে দিলেন সেখানকার ম্রিয়মাণ সঙ্গীত জগৎকে।
দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালনা করেছিলেন সঙ্গীতশিক্ষার আসর। তৈরি করেছেন হাজার হাজার আধুনিক গান। সরকারি চাকুরে ছিলেন। ফলে সে সব গানের মধ্যে নাজির আহমদের লেখা বিখ্যাত গান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ও ছিল। সরকারি কাজ করতেন বলেই হয়তো আয়ুব খানের আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মুছে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিরুদ্ধে তাঁকে সরব হতে দেখা যায়নি। সনজীদা খাতুনের স্মৃতিকথায় আছে, “মনে আছে, আব্বাসউদ্দীন আহমেদ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আমাদের বাসায়, কাজী মোতাহার হোসেনের সংগ্রহে নজরুলের কী-কী গান রয়েছে খবর নিতে। আরও পরে দেখেছি নজরুলের গান যথাযথ গায়কী-সুদ্ধ শিল্পীদের কণ্ঠে তুলে দেবার জন্যে কত কষ্ট স্বীকার করেছেন আবদুল আহাদ।”
‘আমার সোনার বাংলা’ যে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠল, তার নেপথ্যনায়কদের এক জন তিনি। ১৯৬৯ সালে ঢাকায় গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ‘আমার সোনার বাংলা’ নামে একটি লং প্লেয়িং রেকর্ড বেরোয়, ৩৩ আরপিএমের। তার ব্যবস্থাপক ছিলেন একদা দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে গান শিখতে আসা কলিম শরাফী। সঙ্গীত পরিচালক আবদুল আহাদ। বস্তুত আজ সারা বাংলাদেশ যে ভাবে গানটি গায়, তার পিছনে সঙ্গীত শিক্ষক আবদুল আহাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
শিল্পী, শিক্ষক, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে প্রবাদপ্রতিম এই মানুষটি ঢাকা বেতার থেকে যথাসময়ে অবসর নেওয়ার পরও সাত বার এক্সটেনশন পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে জাতীয় শিল্পকলা আকাদেমির চত্বরে কালচারাল কমপ্লেক্স গড়ে তোলার লক্ষ্যে, বাংলাদেশ থেকে যে পাঁচ সদস্যের উচ্চস্তরের প্রতিনিধিদল মস্কো পাড়ি দিয়েছিল, তাতে সঙ্গীতের খেই ধরে ছিলেন আবদুল আহাদ। ওই সফরে তাঁর সহযাত্রী নাট্যবিদ রামেন্দু মজুমদারের মনে আছে, মিতবাক মানুষটি সব বৈঠকে সবার শেষে এসে হাজিরা দিতেন, যেতেনও সবার শেষে। ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১২৫তম বার্ষিকীতে রাজশাহীতে যে বিরাট আয়োজন হয়, তার উদ্বোধক ছিলেন তিনি। মঞ্চে তাঁর পাশে ছিলেন সুফিয়া কামাল, সনজীদা খাতুন, রামেন্দু মজুমদার ও লাইসা আহমেদ লিসা।
অকৃতদার ছিলেন। শোনা যায়, প্রথম যৌবনে শান্তিনিকেতনে যে কিন্নরীর সঙ্গে তাঁর মন বিনিময়ের পালা চলেছিল, স্থপতি বীরেন সেনের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে যাঁর সঙ্গে যুগলকণ্ঠে বুদ্ধদেব বসুকে গান শোনানো তাঁর জীবনের এক অক্ষয় সঞ্চয় ছিল, সেই প্রণয় অচরিতার্থ থাকায় আর বিয়ে করেননি তিনি।
আবদুল আহাদের জীবনাবসান ঢাকায়, ১৯৯৪ সালের ১৫ মে। কবিপক্ষের মধ্যলগ্নে। তাঁকে এখনও মনে রেখেছে ঢাকা। কলকাতা-শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার মূল স্রোত থেকে একেবারে ছিটকে যাওয়া এই মানুষটি আজও তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পাননি পশ্চিমবঙ্গে।
কৃতজ্ঞতা: রামেন্দু মজুমদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy