Advertisement
E-Paper

ত্রাণের জলছবি

তখন নদীর জলে ভাসত লাশ, বাড়িতে খাওয়ার প্রস্তাব দিতেন বড় জোতদার। এখন সবাই মিলে কমিউনিটি কিচেন।

শ্যামল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২১ ০৭:১০
Share
Save

আর এক পা-ও বাঁ দিকে যাবেন না,” বলেই ফুটচারেক জলের ভেতর আমাকে ডান দিকে টেনে নিলেন অনন্ত জানা। ধামাখালি সেতু থেকে ডান দিকে নেমে বড়খোলা গ্রামের পথে মাঝরাস্তায় বাঁ দিকে গভীর পুকুর। রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে চলা জলে জোয়ারের তীব্র স্রোত। আর একটু হলেই তলিয়ে যেতাম পাঁকের অতলে। বিবশ মগজে ভেসে উঠছে আটাত্তরের বন্যা।

মেদিনীপুরের দাসপুর ব্লক, গ্রাম চাইপাট। চার দিন পর জল একটু নেমেছে। পায়ে হেঁটে কিছু ওষুধ নিয়ে আমরা হাঁটছি গ্রামের দিকে। সঙ্গে স্থানীয় তিন যুবক। দু’দিকে পুকুর, হাতের লাঠি মাটির আলে না ঠেকলে এগোনো বিপজ্জনক। আমি আর কল্লোল পেরিয়ে গেছি, পেছনের জলে হঠাৎ প্রবল ঘাই, হৃদয় তলিয়ে যাচ্ছে পুকুরের জলে। ঝাঁপ দিচ্ছেন দুই যুবক। একটু পরেই এক ত্রাতার চওড়া পিঠে উঠে এল আমাদের হৃদয়। পেট থেকে জল বার করতেই চোখ মেলল সে। “একটু সামলে চলুন, ভয় পেয়েছেন জানি, এই ইটের রাস্তাটা পেরোলেই যৌথ রান্নাঘর,” অনন্তর কথায় হুঁশ ফেরে। এ সবই আটাত্তরে ডাক্তারির ছাত্র হিসেবে ত্রাণকাজে যাওয়ার স্মৃতি।

গত সপ্তাহে আবার অন্য ছবি। ত্রাণশিবিরে মাঝে মাঝেই আমাদের আর জি কর হাসপাতালের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যেতে হয়। ওরা আটাত্তর দেখেনি, একুশ শতকে বন্যাধ্বস্ত গ্রামে চিকিৎসক হিসেবে ত্রাণের অ-আ-ক-খ শিখুক, অসহায় মানুষের জীবনে নিজেকে জুড়তে শিখুক। পৌছে দেখি, কাঁকড়া নিয়ে এসেছে বাউনিয়ার ছন্দা আর দীনু। ইয়াসের দাপটে বিদ্যাধরীর বাঁধে দুটো ফাটল দেখা দিতেই দুপুরে গোটা গ্রাম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঁধ বাঁচাতে। বাঁধ অটুট, কোটালের সর্বনাশা উত্তাল জলস্রোত হার মেনেছে মানুষের জোটবদ্ধ লড়াইয়ের কাছে।

“বাউনিয়া যাবেন না?” ছন্দার কথা শুনে মুহূর্তে মনে পড়ে গেল বাউনিয়ার কথা। কানমারির ঘাটে বিদ্যাধরী নদী পেরিয়ে গ্রামের দিকে তাকাতেই বুক ভেঙে যাচ্ছে। ইয়াসের তাণ্ডব বদলে দিয়েছে চেনা ছবি। চারপাশ জলমগ্ন, ফুটবল মাঠে ঢেউ। কিন্তু আবহবিজ্ঞান উন্নত, প্রশাসন সজাগ। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা আসতেই গ্রামের মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্টর্ম শেল্টারে।

ফুলেফেঁপে ওঠা নদীর ঘাটেই এ বার আমাদের মেডিক্যাল ক্যাম্প। ছোট আর বড় মামণি ওষুধ দিচ্ছে, প্রেশার মাপছে শঙ্কর, রোগী দেখছি তুহিনশুভ্র আর আমি। গত বার থেকে ১৪টা ক্যাম্প করলাম বাউনিয়ায়। এক দিন খেতে খেতে নন্দিনী বলে ওঠে, “কুচো চিংড়ি দিয়ে কুমড়োর তরকারি এত ভাল কী ভাবে রাঁধলে টগরী!” টগরী মুণ্ডার ঝকঝকে দাঁতে লাজের ঝিলিক! গত বার এখানে প্রায় দু’মাস যৌথ রান্নাঘর ছিল আমাদের।

টগরীদের রান্নাঘরের খিদে-বাড়ানো গন্ধে মনে ঝলসে ওঠে আটাত্তরের আর এক রসুইখানা। অসিত খাটুয়া মশাই হাইস্কুলের দোতলা থেকে তুলে নিয়েছেন নৌকোয়। নৌকো ছুটছে অচেনা পথে। ডাঙায় নেমে একের পর এক বাড়িতে ঢুকিয়ে ওষুধ, চিঁড়ে, মিল্ক পাউডারের প্যাকেট দিতে বলছেন খাটুয়া। কয়েকটা বাড়িতে দিয়েই আমার চোখ কল্লোলের চোখে।

“খুব খিদে পেয়েছে, আগে একটু খাবার পেলে...!”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, চলুন চলুন, আপনাদের খাওয়া আজ এই গরিবের বাড়িতে!”

একটু দূরেই অনেক উঁচুতে খাটুয়ার পাকা বাড়িতে পৌঁছেই চোখ ছানাবড়া! বিশাল বাড়ি, সার দিয়ে ধানভরা গোলা, খাওয়ার ব্যবস্থা, রসুইখানার বারান্দায় সুখাদ্যের খুশবুতে ভরে উঠেছে বাড়ির উঠোন।

তিন দিনের খিচুড়ি খাওয়া পেটের সামনে কাঁসার থালায় ফুলেল অন্ন, গরম ঘি, ঘন মুগের ডাল, ডিমের ডালনা, দু’পদের মাছ কাঁসার বাটিতে বাটিতে। নিরামিষাশী বনে গেলাম দু’জনেই! ভাত নামল না গলা দিয়ে, সামান্য খেয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে। পেছন পেছন ছুটছেন খাটুয়া।

বাংলা মাধ্যমের ছাত্র আমরা। গত পাঁচ দিন ধরে দেখছি, অনাহার-অর্ধাহারে কী যন্ত্রণায় বেঁচে আছেন মেদিনীপুরের বানভাসি মানুষ। আমাদের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে দাদাদের হাতে। অসিত খাটুয়া চোখ খুলে দিলেন। জোতদার চিনলাম সেই প্রথম। জানলাম, ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি মানে শুধু সুইডেন থেকে আসা নরম তুলতুলে কম্বল কেরানি বা অফিসারের বাড়িতে চলে যাওয়া নয়। নেতা চান, নিজের এলাকায় সব ত্রাণ ছলেবলে উপুড় করে দিয়ে ভোটের জমিতে সার দিতে।

ক্রান্তিকালে স্মৃতি ছোটে টর্নেডোর বেগে। মাটি খুঁড়ে তুলে আনে কতশত ছবি। সন্দেশখালি ব্লকের মণিপুর পঞ্চায়েতের গ্রাম আতাপুর পূর্ব আর পশ্চিম। আতাপুর এ বার ইয়াসের বৃষ্টিতে ডুবে গেছিল এক তলা বাড়ির মাথায় মাথায়। স্মৃতির জোয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে চার দশক আগের এক ঘূর্ণি। তিন ডাক্তারি ছাত্র, সঙ্গে ত্রাণ। নৌকো ছুটছে উথালপাথাল। জলের দিকে তাকালেই দুরন্ত ঘূর্ণি। তরী ডুবলেই পৌঁছে যাব স্লেট-কালো পাতালপুরী। কৌশিক হঠাৎ আঁকড়ে ধরছে আমার শীর্ণ বাহু— ওগুলো কী? দেখেই বুজে ফেলছি চোখ। ফুলে ঢোল দু’-দুটো মানুষের লাশ ভেসে যাচ্ছে, ডুবেই ভেসে উঠছে আবার। অ্যানাটমির মড়া কেটে অভ্যস্ত মনেও চোখের সামনে ভাসমান পচাগলা লাশ দেখা বড় বেদনার মতো। আটাত্তরে মেদিনীপুরের বন্যায় শুধু মানুষের লাশ নয়, ধ্বস্ত হতাম ফুলে ওঠা গবাদি পশুর লাশ দেখে।

তার চেয়েও বেদনা জেগেছিল গত বছর আমপানে মধ্য মোহনপুর গ্রামে ত্রাণের কাজে এসে। রোগী দেখা শেষ করে নদীর পাড় ধরে হাঁটছি, সঙ্গে সরবেরিয়ার গোটা দল। নবি হঠাৎ আপনমনে বলে উঠল, বছর বছর ঝড়, মিষ্টি জলের পুকুরে নোনাজল ঢুকে আমাদের ফসলের সর্বনাশ— এর শেষ কোথায়? বছর পেরিয়ে কোভিডের মাঝে ইয়াস এসে বুঝিয়ে ছাড়ছে, এই গ্রহে মানুষকে আর হয়তো চান না প্রকৃতি।

তার পরেও আট দিন আগে হাঁটুজল পেরিয়ে দেখে এলাম, সুন্দরবনের নিকাশি নালা আর খালগুলো চুরি হয়ে গেছে চুপিচুপি। সবটাই সিলভার টনিকের সেটিং-এ! সন্দেশখালি, গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, হিঙ্গলগঞ্জ... এ গল্পের শেষ নেই।

আয়লা, আমপান, ইয়াস আসে, আর মনের পর্দায় বার বার ভেসে ওঠে সেই জ্ঞানতাপসের মুখ। ইংরেজের পাতা রেললাইনে জল অবরুদ্ধ হয়ে অবিভক্ত বাংলায় বিধ্বংসী বন্যা আর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র সায়েন্স কলেজে বসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছাত্রদের বন্যাত্রাণে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। যত বার বানভাসি, ঝড়বিধ্বস্ত হয় বাংলা, তত বার ঝাঁপিয়ে পড়েছে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজগুলোর ছাত্ররা। পর পর ঝড়ে প্রাণ হাতে করে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছে ওরা। পৌঁছে যাচ্ছে বানভাসি মানুষের কাছে, দুর্গতদের হাতে তুলে দিচ্ছে বাচ্চাদের দুধের প্যাকেট, সার্জিকাল মাস্ক, জীবাণুরোধক।

রূপমারীর ক্যাম্পে তিনশো রোগী দেখছে ওবাইদুল্লা। শাশ্বতী খাতায় নাম, রোগ, ওষুধ লিখছে রোগীদের, কুশ আর দাদু মিটিং করছে পঞ্চায়েতের সঙ্গে। সরকারি জলের ট্যাঙ্ক থেকে পানীয় জল ভরে নিচ্ছেন আতাপুরের মানুষ। লণ্ঠনের আলোয় পরদিন সকালের কাজের হিসেব করছে সুশান। ভগ্নপ্রায় বাড়ির টালির চালে আকাশপানে চেয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ... নৌকো দেখেই চিৎকার, ‘সুই নিব নি, ভাগ, ভাগ!’... নৌকো থেকে চিঁড়ে আর গুঁড়ো দুধ ছুড়ে দিচ্ছে চিরন্তন, গোগ্রাসে গিলছেন। কেউ কলেরার ইনজেকশন নিচ্ছেন নৌকোয় উঠে, নিল্টু রোগীর পকেটে গুঁজে দিচ্ছে ওষুধ কেনার টাকা...

দিন যায়, মহামারি আসে, আসে দুর্যোগও— তবু আজও মানুষ, মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়।

Cyclone Yaas

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।