ছবি: রৌদ্র মিত্র
অবসরের আগে চন্দনবাবু দফতরের পুরনো ফাইলগুলো ঘাঁটছিলেন। বয়সে ছোট সহকর্মী অরিক্তম বলছিল, “কী হবে চন্দনদা এ সব ঘেঁটে?” চন্দনবাবু বলেন, “৩৪ বছর ধরে এই অফিসটাই আমার ধ্যানজ্ঞান। বদলি হয়েছি বটে বারদুয়েক, আবার ফিরে এসেছি। আর তো ক’টা দিন! অবসরের পর কী করব! অনেক দিন ধরে ইচ্ছে একটু লেখালিখি করি। এ সব তো বাতিল কাগজ, বিশ-বাইশ বছর ধরে পড়ে আছে, ভাবলাম একটু নেড়েচেড়ে দেখি, যদি কিছু মেলে। ডি এম সাহেবকে বলে রেখেছিলাম। সাহেব অনুমতি দিয়েছেন। কপি করা যাবে না। এখানে বসেই দেখতে হবে।”
তাতেই রাজি চন্দনবাবু। সে দিন নীল রঙের একটা বড় প্যাকেটের দিকে চোখ আটকে গেল তাঁর। লাল কালিতে বড়-বড় করে লেখা ‘ইলেকশন বাতিল’। চন্দনবাবু খুললেন। যে দিন কনিষ্ঠ করণিক হয়ে এ অফিসে যোগ দিয়েছিলেন, সে দিন থেকেই এমন অজস্র প্যাকেট দেখে আসছেন তিনি। কী মনে হতে প্যাকেটটার ভেতর উঁকি দিলেন। ভর্তি ফাইল আর সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ চিঠি। কোনও চিঠির সঙ্গে দিস্তে খানেক মেডিক্যাল রিপোর্ট, কোথাও বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কার্ড, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর বিস্তারিত শারীরিক তথ্য, নিজের শুগার-প্রেশার-কিডনি-হার্ট সংক্রান্ত চরম অসুস্থতার বিনীত জ্ঞাপন। চন্দনবাবুর মনে পড়ে যখন সেকশন অফিসার হলেন, তখন তাঁর কাছেই জমা পড়ত এ সব চিঠি— ভোটের ডিউটি কাটানোর বহুমুখী আবেদন। তাঁর চোখ আটকে গেল একটি বিয়ের কার্ডে। লাল জমিনের ওপর সোনালি জরির কারুকার্যশোভিত কার্ড। সঙ্গে হবু বরের বিগলিত আবেদনপত্র। ‘মহামান্য’ সম্বোধনে তিনি জেলাশাসককে জানিয়েছেন, ভোটের আগের দিন তাঁর বিয়ে, ভোটের দিন কালরাত্রি আর ভোটের পরদিন বৌভাত। বৌভাতে সম্মাননীয় ডি এম, দু’জন এ ডি এম এবং দপ্তরের তিন বরিষ্ঠ কর্মীকেও নিমন্ত্রণ করে সেই সরকারি কর্মী পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনাও প্রার্থনা করেছেন। পাত্রের নাম আর ঠিকানা দেখে চমকে উঠলেন চন্দনবাবু— আরে এ তো গির্জাপাড়ার পার্থ রায়। সেচ দফতরের কর্মী। ১৯৯৬-এর নির্বাচনের সময় তো ওঁর বিয়ে ছিল না! বিয়ে হয়েছে ২০০০ সালে, নেমন্তন্নও খেয়েছেন তিনি। তবে? অরিক্তমকে বিষয়টি বলায় হোহো করে শেষে উঠল সে, “আরে বোঝেন না, এ সব ফন্দিফিকির, ডিউটি না করার। বুঝি রে বুঝি, তা বলে মিথ্যে বিয়ের কার্ড!”
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে চন্দনবাবুর।
ভোটকর্মীর ভোটের ডিউটি কাটানোর এমনতর রঙ্গ বঙ্গের ভোট-বাতাসকে নানা সময়ে কৌতুকময় করে তুলেছে। দীপকবাবুর কথাই ধরুন। চাকরিজীবনে শুরুর দিকে তিনি একাধিক বার ভোটের ডিউটি করেছেন। পোলিং অফিসার থেকে প্রিসাইডিং অফিসার— সামলেছেন একাধিক দায়িত্ব। সে সব ছিল সুখের দিন। পি মাইনাস ওয়ান অর্থাৎ ভোটের আগের দিন ডিসি (ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার) থেকে মালপত্র বুঝে নিয়ে পোলিং পার্টির সঙ্গে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যেতেন নির্ধারিত বুথে। পুরনো স্কুলবাড়ি। ছাদহীন বাথরুম। দূরে টিউবওয়েল। মালপত্র গুছিয়ে রেখে হাতমুখ ধুয়ে দলের চার জন চার পাশটা ঘুরে নিতেন। এলাকার হাওয়া বুঝতে। তখন এমন ঝক্কি ছিল না এ সবে। সবাই ভোটবাবু বলে একটু আলাদা সমীহ করত। সন্ধ্যা নামলে ফিরে আসতেন বুথে। তত ক্ষণে বারদুয়েক চা এসে গেছে, গত বারের জয়ী প্রার্থী আর তাঁর প্রতিপক্ষের তরফে। এদের দেওয়া চা খাবেন কি খাবেন না ভাবতে ভাবতে খেয়ে ফেলেছেন কথায় কথায়। পরের দিনের কাজ এগিয়ে রাখতে রাখতে রাত নামত মফস্সলের সেই স্কুলে। দরজায় টোকা আর দরাজ গলায় ডাক শুনে বাইরে এসে দেখবেন, দুই প্রার্থীই হাজির, জোড়হস্তে। ডিনারের ব্যবস্থা রেডি করে রেখেছেন তাঁরা। অনুগ্রহ করে গ্রহণের প্রার্থনা জানাবেন। সবিনয়ে তাঁদের প্রত্যাখ্যানের পরামর্শ দীপকবাবুরা আগেই পেয়েছেন অফিসের সিনিয়রদের থেকে। অতএব, নিজেদের উদ্যোগেই খাওয়ার আয়োজন। ফের দুই প্রার্থীর প্রতিনিধির আগমন— ‘দাদারা বলে দিয়েছেন, আপনারা আমাদের অতিথি। কোনও অসুবিধে হলে জানাবেন। এখানে অতিথিদের নিয়ে রাজনীতি করি না।’ তাঁদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় শেষে ফের বসতে হত শেষ পর্বের কিছু জরুরি কাজে। এক একটা বুথে তখন ৩০০-৪০০ ভোটার। এত চাপ ছিল না। দুপুরে সময় বার করে করে খেয়ে নেওয়া যেত। তার মধ্যেই এলাকার কেউ কেউ গাছের ডাব-কলা-পেয়ারা দিয়ে যেত। খুব আন্তরিক ছিল সে সব দিন। বিকেলের মধ্যে ভোটপর্ব চুকে যেত। নির্ধারিত সময়ে নিরাপত্তারক্ষীর পাহারায় ব্যালট বক্স দিয়ে সকলে মিলে ফের রিসিভিং সেকশন (আর সি), যেখানে ডি সি ছিল, সেখানে ফিরে আসা। আর সি-েত জিনিসপত্র জমা দিয়ে তার পর ছুটি। বাড়ি ফিরতে গভীর রাত। তখনও সচিত্র পরিচয়পত্রের যুগ আসেনি। টি এন শেষণের নাম জনপরিসরে আওয়াজ হয়ে ওঠেনি। ভোটারের নাম বা বাবার নামই ছিল পরিচয়। বুথে বসে থাকা এজেন্টরা লিস্ট মিলিয়ে চিনে নিতেন। নব্বইয়ের দশক থেকে বদলে যেতে শুরু করল ছবি। ক্রমে সচিত্র পরিচয়পত্র এল। ইভিএম এল। ভি ভি প্যাট এল। ভোটার বাড়ল। দীপকবাবুর বয়স বাড়ল আর এ সব ব্যবস্থা ‘ঝামেলা’ হয়ে চেপে বসতে লাগল তাঁর ভাবনায়। শেষ বার ভোট করতে গিয়ে দেখলেন বদলে গেছে মানুষও। এখন আর অতিথি নয়, সম্পর্ক বদলে গেছে। তাই ভোটের আগের বিকেল থেকে আসতে লাগল নানা রকম চাপ। প্রচ্ছন্ন প্রলোভন, এমনকি হুমকিও। রাতে এল দামি বিরিয়ানির প্যাকেট। খাওয়ার জন্য আর বিনীত অনুরোধ করেন না প্রার্থীরা। ‘দাদা’র ভাইয়েরা জোরালো শব্দের বাইক চালিয়ে এসে ছুড়ে দিয়ে যায় সেই মহার্ঘ খাবার। খাওয়ার প্রশ্ন আগেও ছিল না, এখনও নয়। কিন্তু কী অদ্ভুত বদলে গেল দেওয়ার ধরন!
চিরকালের ভিতু দীপকবাবু ভোটবাজারে বুকের পাটা দেখেছেন পাড়ার ব্যাঙ্ককর্মী নিমাইবাবুর। তাঁরও ভোটের ডিউটি আসত। তিনি নিরুত্তাপ। নির্ধারিত দু’টি দিনে দু’বার ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছেন। কাজকর্ম বুঝে নিয়েছেন। তার পর ভোটের দু’দিন আগে হঠাৎ হাতে প্লাস্টার। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে নিমাই সোজা ডি এম বা নির্বাচন আধিকারিকের অফিসে। নাম কাটা গেল ভোটের ডিউটি থেকে। দিনচারেক বাড়িতেই থাকলেন। তার পর কোথায় প্লাস্টার, কোথায় কী। দিব্যি সুস্থ। নিমাইবাবুর এমন ‘সাহসিকতা’য় মুগ্ধ দীপকবাবুর স্ত্রী দিনরাত স্বামীর ভীরুতাকে খোঁচা দিতেন। একে নিমাইবাবুর বেতন বেশি, তার ওপর এমন বুদ্ধি! দীপক মরমে মরে থাকতেন সংসারে। ছেলে সন্দীপন বড় হয়ে সরকারি চাকরি পেল। ফের পঞ্চবার্ষিকী ভোট উৎসব। ছেলের যথারীতি ভোটের ডিউটি। সে বছরদশেক আগের কথা। একটা সন্ধিক্ষণ তখন, পরিবর্তনের কাল। সন্দীপনরা গেল। ডিউটি করল। ওরা এ যুগের ছেলে। মক পোল, ব্যালট ইউনিট, ভোটিং ইউনিট, সে সব সিল করা ওদের কাছে মজার। কোনও চাপ না নিয়েই ওরা এ সব করতে পারে। তবু ভয় হয় দীপকের। বুথে বুথে আজকাল যা গন্ডগোল হয়! সে তো অন্য কথা। কিন্তু এ বারে সন্দীপনের চোখেমুখেও বিরক্তি। প্রথম পর্বের ভোটে ডিউটি ছিল ওর। এক বছর বন্ধ থাকার ফলে স্কুলবাড়িগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। যে ঘরে তাদের রাতযাপনের আয়োজন, তা ওপর-ওপর পরিষ্কার করা হলেও ভেতরে খুবই অপরিচ্ছন্ন। টয়লেটের অবস্থা আরও ভয়াবহ। একই অভিজ্ঞতা বেহালার অভি চক্রবর্তীর। তিনি তৃতীয় পর্বের ভোটে দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি বুথে ভোটকর্মী ছিলেন। এই সব ভোটকর্মীর অভিযোগ, ভোট চালাতে গিয়ে ন্যূনতম চাহিদাটুকুও মেলে না। কোভিড-পরিস্থিতিতে ভোট করতে গিয়ে তাই তাঁরা আতঙ্কিত, ক্ষুব্ধও।
আগের বার ভোটের আগে বারাসতের কৌশিক পাল বলেছিলেন, ওদের অফিসের বড়বাবুর কথা। তখন তাঁর বয়স ৫৯। শারীরিক ভাবে সুস্থও নন। সে বারে তাঁর ডিউটি এসেছিল। অসুস্থতা ও বয়সের কথা বলে ডি এম অফিসে গিয়ে একাধিক বার কথা বলেছেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার প্রমাণ দাখিল করেছেন। কিন্তু ডি এম অফিসে প্রবীণ মানুষটির সঙ্গে ভাল ব্যবহার তো করাই হয়নি, এমন অপমানিত হতে হয়েছে যে ডিউটি করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁকে নাকি বলা হয়েছে, অসুস্থ হয়ে চাকরি করছেন কী করে? ভি আর এস নিয়ে বাড়িতে থাকুন। সঙ্গে আরও কিছু অসম্মানজনক বাক্যবাণ। ঘটনাচক্রে তিনিও যে এক জন অফিসার তা বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন ডি এম অফিসের তরুণ সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার।
চাকরিজীবনের শেষ পর্বে এমন অপমানের মুখোমুখি যে অনেককেই হতে হয়েছে, সরকারি কর্মচারী মহলে কান পাতলেই তা শোনা যায়। ইলেকশন এসে গেলে সংশ্লিষ্ট জেলার ডি এম অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা নিজেদের ক্ষমতার পরাকাষ্ঠা বলে মনে করতে শুরু করেন। ভোট আসে, ভোট যায়। বদল হয় ক্ষমতারও। কিন্তু পাল্টায় না তাঁদের মানসিকতা! চৈতালি পাত্রের কথা ভাবুন। জটিল আর্থারাইটিসে আক্রান্ত এই স্কুলশিক্ষিকার ভোটের ডিউটি এসেছে। তাঁর অসুস্থতা এতটাই প্রবল যে, একটানা আধ ঘণ্টাও তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। সমস্ত প্রেসক্রিপশন-সহ তাঁর কলেজ-শিক্ষক স্বামী তিন দিন ধরে ছুটেছেন নানা প্রান্তে। তাচ্ছিল্য আর প্রচ্ছন্ন অপমান শুনতে শুনতে শেষ পর্যন্ত চৈতালিদেবীকে বসতে হয় মেডিক্যাল বোর্ডের সামনে। দীর্ঘ পরীক্ষার পর ছাড় মেলে বটে তাঁর, কিন্তু এর মধ্যেই ট্রেনিং না করার জন্য শোকজের চিঠি এসে যায়। তার জবাব দিতে ফের তাঁকে ছুটতে হয় ডি এম অফিস। চৈতালিদেবী বলছিলেন, কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালে মেডিক্যাল বোর্ডের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষার দিন তিনি দেখেছেন কত অসুস্থ অসহায় মানুষ এ বার ডিউটি পেয়েছেন ভোটে! এঁদের অনেকের সোজা হয়ে বসে থাকার শক্তিও নেই। তাঁরাও নানা অপমান সয়ে এখানে এসেছেন। নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁর বিনীত প্রার্থনা, একটু ভাল ব্যবহার কি আশা করতে পারেন না তাঁরা!
অন্য ছবিও আছে। কলকাতার পার্শ্ববর্তী এক জেলাশাসকের দফতরের কুশলী ব্যবহারের প্রশংসা করেছেন কলেজ-শিক্ষকদের একটি বড় অংশ। তাঁদের কথা যখন এসেই গেল তখন বলা থাক, খবরে প্রকাশ, এ বারে অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাই নির্বাচনকর্মী হিসেবে ডিউটির চিঠি পেয়েছেন। কোথাও কোথাও অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক, পরীক্ষা-নিয়ামকদেরও ভোটের ডিউটি এসেছে। এই প্রথম যে এমন হল তা নয়। কিন্তু এ বারে একচেটিয়া ডিউটি পড়েছে তাঁদের। গত দেড় মাস ধরে এ নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। একাধিক মামলা হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। অধ্যাপকদের বক্তব্য, ভোটের কাজে তাঁদের অনীহা নেই। অব্যাহতিও চান না। নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা রক্ষায় তাঁরা বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাঁরা চান পদমর্যাদা অনুযায়ী ডিউটি। বেতন কাঠামোর দিক থেকে অধ্যাপকদের পোলিং বুথে ডিউটি দেওয়ার বিরোধী তাঁরা। মামলা চলছে আদালতে। নানা মহল থেকে প্রতিবাদের জেরে নাকি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরদের ছাড় দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে খবর।
অধ্যাপকমহলে কান পাতলে শোনা যায়, একদা ভোটের ডিউটি কাটাতে অনেক খ্যাতিমান অধ্যাপকের হরেক কৌশলের কথা। এক অধ্যাপক নাকি সব ট্রেনিংগুলো যথাযথ করে পি মাইনাস ওয়ান ডে-তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন সরকারি হাসপাতালে। সঙ্গে এক বন্ধু। শেষ রাত থেকে পেট খারাপ। ডাক্তার দেখিয়ে, ও আর এস, ওষুধ, আর তিন দিন বিশ্রামের পরামর্শ-খচিত প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। নির্বাচন মিটতে শোকজ় পেলেন। সে দিনের প্রেসক্রিপশন-সহ জবাব দিলেন শোকজ়ের। তিনি রেহাই পেলেন বটে, কিন্তু শোনা যায়, একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে গিয়ে আর এক অধ্যাপকের নাকি ল্যাজেগোবরে অবস্থা হয়েছিল। এ সব সত্যি না মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া মিথ, তার হিসেব কেউ রাখেনি। প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পাওয়া এক ভোটকর্মী জানিয়েছেন, সকাল ছ’টা থেকে সন্ধে ছ’টা— ভোটের দিন এই ১২ ঘণ্টা তাঁরা মানুষ থাকেন না। ঠিক থাকে না খাওয়াদাওয়া, শোয়ার। যথাযথ টয়লেটও মেলে না সর্বত্র। মহিলা ভোটকর্মীদের দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। প্রতি মুহূর্তে রাখতে হয় নির্ধারিত ডায়েরি। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে টেক্সট করতে হয় প্রদত্ত ভোটের হার। সামলাতে হয় টেন্ডার ভোটের ঝক্কি। বিভিন্ন দলের এজেন্টরা কোনও অভিযোগ করলে, তা শুনে ব্যবস্থা নিতে হয় মাথা ঠান্ডা রেখে। ওই দিন বুথের সর্বময় কর্তা তিনি। সেই সূত্রেই তাঁর চাপও প্রবল। চার জনের টিম বটে। তবে দলনেতা যে তিনি। বুথে সুষ্ঠু ভোট পরিচালনার অন্যতম দায়িত্ব তাঁরই।
অবসরের দোরগোড়ায় চন্দনবাবু এ সব ভাবছিলেন। চোখ-কান তাঁর বরাবরই কিঞ্চিৎ বেশি খোলা। ভোটকর্মী হিসেবে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা, আগের কথা, পরের কথা, হালের কথা— সব একাকার হয়ে যাচ্ছিল তাঁর ভাবনাপথে। অনেক কাল আগে তাঁর বাবার কাছে শুনেছিলেন সে কালের ভোটের কথা। সে ছিল ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন। এলাকার বিশিষ্টজনেরা প্রার্থী হতেন। মারামারি নেই, মিছিল নেই, রোড শো নেই। ভোটের আগের দিন সকালে প্রার্থী এসে বলে যেতেন— কাল ভোট আছে, ভোটটা দিয়ে এসো। ধনাঢ্য জমিদার, লোকপ্রিয় চিকিৎসক বা এলাকার বিশিষ্টজন প্রার্থী হতেন। আপদে-বিপদে তাঁদের পাশে পাওয়া যেত। ছেলের ভবিষ্যৎ থেকে মেয়ের বিয়ে তাঁদের পরামর্শেই নির্ধারিত হত। সে কালের এই প্রার্থীরা এলাকার জনতাকে ভোটার মাত্র ভাবতেন না। ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই স্বজন ছিলেন এই জনতার। সে সব এখন অলীক—ভাবেন চন্দনবাবু।
নীল প্যাকেটটার ভেতরে থাকা অসংখ্য এক্স-রে প্লেট, প্রেসক্রিপশন আর দিস্তে দিস্তে আবেদন যেন তাঁকেই দেখছে। কত গভীর সত্যি, কত নির্মম মিথ্যে থিতিয়ে আছে এই আপাত-নিরীহ বাতিল কাগজগুলোর মধ্যে!
তিনি যত্ন করে তুলে রাখেন নীল প্যাকেটটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy