জ্ঞানতপস্বী: রঘুমণি বিদ্যাভূষণ ভট্টাচার্যের তৈলচিত্র। ডান দিকে, বহিরগাছির ভট্টাচার্যপাড়ায় তাঁর টোলবাটী, যা বর্তমানে স্থানীয় পূজামণ্ডপ
সালটা ১৮০৫। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখনও জন্মগ্রহণ করেননি। রামমোহন রায়ের বয়স মাত্র তিরিশ বছর। বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ হেনরি টমাস কোলব্রুককে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দু আইন এবং সংস্কৃত বিষয়ের সাম্মানিক অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করলেন লর্ড ওয়েলেসলি। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ আধিকারিকদের ভারতীয় ভাষা শেখানো, বিশেষ করে সংস্কৃত, হিন্দি এবং বাংলা ভাষা। কোলব্রুক সংস্কৃত বিষয়ের দায়িত্ব নিয়ে দেখলেন, ব্রিটিশদের সংস্কৃত শেখার সবচেয়ে বড় সমস্যা ভাল সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং অভিধানের অভাব। তিনি নিজে সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনার দায়িত্ব নিলেন এবং অভিধান রচনার দায়িত্ব দিলেন ওই কলেজের প্রখ্যাত পণ্ডিত মুনিরাম তারাকে। কিন্তু মুনিরাম তারা অচিরেই অসুস্থ হয়ে পড়লে কোলব্রুক সাহেব রঘুমণি বিদ্যাভূষণকে ওই অভিধান রচনার কাজ শেষ করতে অনুরোধ করেন। রঘুমণি বিদ্যাভূষণ আনন্দের সঙ্গে এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে মাত্র দু’বছরের মধ্যে এই বিরাট কাজ সম্পন্ন করেন। ১৮০৭ সালে প্রকাশিত হয় সুবৃহৎ সংস্কৃত অভিধান ‘শব্দমুক্তামহার্ণব’। ১৮১৯ সালে প্রকাশিত হোরেস হেম্যান উইলসনের প্রথম সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান, রঘুমণি বিদ্যাভূষণের ‘শব্দমুক্তামহার্ণব’ অনুসরণ করেই রচিত হয়। হোরেস সাহেব তার কাজের জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন অথচ রঘুমণি বিদ্যাভূষণকে ইতিহাস বেমালুম ভুলে গিয়েছে। কান্তিচন্দ্র রাঢ়ীর ‘নবদ্বীপ মহিমা’, ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ ইত্যাদি কয়েকটি বইয়ের বাইরে সমকালীন ইতিহাসে প্রায় কোথাও তার নাম খুঁজে পাওয়া যায় না।
অসাধারণ মাপের পণ্ডিত ছিলেন রঘুমণি বিদ্যাভূষণ। কৃষ্ণনগর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বহিরগাছি গ্রামে তাঁদের পারিবারিক টোল ছিল। তা ছাড়াও তিনি কলকাতার চিৎপুরে একটি টোল স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের এবং টোলের খ্যাতি বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮১৮ সালের ২১ নভেম্বরের ‘সমাচার দর্পণ’-এ তাঁর কাশীযাত্রার সংবাদে তাঁকে ‘অনন্যসাধারণ পাণ্ডিত্যাশ্রয় মহামহোপাধ্যায় মহারাজগুরু শ্রীযুত রঘুমণি বিদ্যাভূষণ ভট্টাচার্য্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৩৫১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত সাহিত্য পরিষৎ-পত্রিকার ১ম-২য় সংখ্যায় দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ‘নবদ্বীপ রাজগুরু রঘুমণি বিদ্যাভূষণ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ওই প্রবন্ধে রঘুমণির কুলপরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর পিতামহ রামভদ্র ন্যায়ালঙ্কার ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত। রামভদ্রের পিতা রামচন্দ্র তর্কালঙ্কারের বাড়ি ছিল চব্বিশ পরগনার কুশদহ গ্রামে। রামভদ্রের অসাধারণ পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে গুরু পদে বরণ করে প্রচুর ভূ-সম্পত্তি দান করেন। মহারাজ কৃষ্ণচদ্র বার বার গুরুদেব রামভদ্রকে জমি দান করেছেন। প্রথম জমি দানের যে তারিখ পাওয়া গিয়েছে, তা হল ২৩ কার্তিক ১১৩৬ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরেজি ১৭২৯ সাল। সুতরাং সহজেই বোঝা যায় যে ১৭২৮ সালে সিংহাসনে আরোহণের ঠিক পরের বছরেই কৃষ্ণচন্দ্র রামভদ্রকে গুরু পদে বরণ করেন। রামভদ্র কৃষ্ণনগর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বহিরগাছি গ্রামে বসবাস শুরু করেন এবং নিজের বাড়িতে টোল স্থাপন করেন। দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা সেই টোলে পড়তে আসত। রামভদ্র ন্যায়ালঙ্কারের আট পুত্র ছিল। দুই পুত্র শৈশবে মারা যান। জীবিত ছয় পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠতম রামানন্দ বিদ্যালঙ্কার, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রই ছিলেন রঘুমণি বিদ্যাভূষণ ভট্টাচার্য।
রঘুমণির জন্মসাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর বাল্যকাল এবং শিক্ষা সম্পর্কেও তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর লেখা কয়েকটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ‘শব্দমুক্তামহার্ণব’-এর কথা আগেই বলা হয়েছে। তাঁর লেখা অন্য যে গ্রন্থগুলির কথা জানা গিয়েছে, সেগুলি হল— ‘দত্তকচন্দ্রিকা’, ‘আগমসার’, ‘প্রাণকৃষ্ণীয় শব্দাব্ধি’ ইত্যাদি। ‘প্রাণকৃষ্ণীয় শব্দাব্ধি’ সংস্কৃত পদ্যে রচিত অভিধান। ‘আগমসার’ গ্রন্থে তন্ত্রশাস্ত্র বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘দত্তকচন্দ্রিকা’-র আলোচ্য বিষয় দত্তক গ্রহণের নিয়মকানুন এবং বিধিনিষেধ। তবে ‘দত্তকচন্দ্রিকা’ বইটি তিনি নিজের নামে লেখেননি, ‘কুবের’ ছদ্মনামে লেখেন। বহু দিন পর্যন্ত ‘দত্তকচন্দ্রিকা’-র কুবের এবং প্রাচীন পণ্ডিত কুবেরকে অভিন্ন বলে মনে করা হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘দত্তকচন্দ্রিকা’-র একটি শ্লোক থেকে কুবেরের প্রকৃত নাম যে রঘুমণি, তা নির্ধারণ করেন।
পিতামহ রামভদ্রের মতো রঘুমণিও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। মহারাজ পণ্ডিত রঘুমণির প্রতিও যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাঁকেও অনেক ভূ-সম্পত্তি দান করেন। ১৭৮০ সালে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রঘুমণিকে পলাশি পরগনার শিবচন্দ্রপুর গ্রামে ৬০০ বিঘা জমি দান করেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রঘুমণি বিদ্যাভূষণের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের আবাসস্থল ছিল কাশী। রঘুমণি কাশী গেলে সেখানকার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতেরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং বিভিন্ন শাস্ত্র আলোচনা করে সন্তুষ্ট হন। ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রকাশিত সংবাদ থেকে এ কথা জানা যায়।
বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিই ছাত্রাবস্থায় তাঁর কাছে বিদ্যাশিক্ষা করেছেন। যাঁদের নাম নিশ্চিত ভাবে জানা গিয়েছে তাঁরা হলেন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক এবং ঔপন্যাসিক ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পিতা বিশ্বনাথ তর্কভূষণ, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের পুত্র রামজয় তর্কালঙ্কার, রঘুরাম শিরোমণি প্রমুখ। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার নিজে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর পুত্রকে রঘুমণির টোলে পড়তে দেওয়া রঘুমণির খ্যাতির সপক্ষে একটি বড় প্রমাণ। রামজয় তর্কালঙ্কার পরবর্তী কালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দ্বিতীয় পণ্ডিত নিযুক্ত হন। রঘুরাম শিরোমণির ‘দায়ভাগার্থদীপিকা’ ১৮২২ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইতে তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে নিজেকে ‘বিদ্যাভূষণরূপে খ্যাত সর্ব্বদেশে বিদিত সর্ব্বশাস্ত্রবেত্তা যে রঘুমণি পণ্ডিত তাঁর ছাত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অষ্টাদশ শতকের প্রারম্ভে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ শুরু হয়। সেই সময় বিশিষ্ট পণ্ডিতদের অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। টুলো পণ্ডিত হলেও রঘুমণি রক্ষণশীল ছিলেন না, তিনি ছিলেন উদারপন্থী। তিনি এ দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের আশু প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করেছিলেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন। ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি ডেভিড হেয়ার, রাজা রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, রানি রাসমণি প্রমুখের উদ্যোগে এ দেশের মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে হিন্দু কলেজের উদ্বোধন করা হয়। ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কয়েক জন সংস্কৃত পণ্ডিতের সঙ্গে রঘুমণি বিদ্যাভূষণও উপস্থিত ছিলেন।
১৮১৮ সালের ২১ নভেম্বরের ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে জানা যায়, জীবনের শেষ দিনগুলো কাশীধামে অতিবাহিত করবার ইচ্ছে নিয়ে ওই বছরের নভেম্বর মাসে তিনি কাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁর সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি। পথিমধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে জানা যায়, ১৮১৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই তাঁর মৃত্যু হয়। সেই হিসেবে ২০১৯ সালে তাঁর মৃত্যুর ২০০ বছর পূর্ণ হল। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের মতে সেই সময়ে বাংলার দুজন অগ্রগণ্য সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ভট্টাচার্য এবং নদিয়ার বহিরগাছির রঘুমণি বিদ্যাভূষণ ভট্টাচার্য। মূলত রাজগুরু রামভদ্র এবং তাঁর পৌত্র রঘুমণির প্রচেষ্টায় ত্রিবেণী এবং নবদ্বীপের পাশাপাশি বহিরগাছিও সে কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কৃত শিক্ষার পীঠস্থান হিসেবে গড়ে উঠেছিল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কথা ইতিহাস মনে রেখেছে, মনে রেখেছে সংস্কৃত শিক্ষায় ত্রিবেণী
এবং নবদ্বীপের অবদানের কথাও। কিন্তু রামভদ্র, রঘুমণি এবং বহিরগাছির কথা ইতিহাসের পাতা থেকে যেন একেবারেই মুছে গিয়েছে। দু’-একটি বইতে সামান্য উল্লেখ ছাড়া কোথাও তাঁর বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। তাঁর মতো এক জন পণ্ডিতকে বিস্মৃত হওয়ার লজ্জা একান্ত ভাবেই আমাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy