বিস্ময়কর: মণিপুরের নিঙ্গেল গ্রামে নোনা জলের কুয়ো।
মণিপুরে সমুদ্র নেই। সবুজ পাহাড়, জঙ্গল আর উপত্যকার দেশ মণিপুর। নদী আছে বটে, তবে তার জল মিষ্টি, সুন্দরবনের মতো নোনা নয় মোটেই।
তবু আশ্চর্যের কথা— মণিপুরে নুন তৈরি হয়। স্থানীয় মানুষজন রান্নার কাজে তো সেই নুন ব্যবহার করেনই, বিশেষ বিশেষ সময়ে, পুজো-পার্বণেও খাবারে ব্যবহার করেন। যেমন আমরা উপবাস-ব্রতে সৈন্ধব লবণ ব্যবহার করি।
রাজধানী শহর ইম্ফল থেকে ৩৫ কিমি দক্ষিণে লাইমাটন পর্বতমালার পাদদেশে নিঙ্গেল বলে একটি ছোট জনপদ আছে। সেখানেই এই নুন তৈরি হয় সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে। হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এখনও মণিপুরের সুপ্রাচীন এই নুন তৈরির পদ্ধতিকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে।
দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি এই নুন ঘিরে আছে বেশ কিছু শুভ বিশ্বাস। বিশেষত মণিপুরে এখনও নারীদের গর্ভাবস্থায় ও সন্তান প্রসবের পর সুস্থ শরীর রক্ষা এবং পুষ্টির জন্য নুন খাওয়ানো হয়। গ্রামের দিকে এই সময়ে এই নুন ধন্বন্তরির মতো বলে মণিপুরিরা বিশ্বাস করেন।
বিয়ে-থা, পুজো-পার্বণের মতো পবিত্র কাজে এই নুন এখনও সমাজের সব স্তরের মানুষ সমান ভাবে ব্যবহার করেন। পুরাকালে মণিপুরের মহারাজ সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ এই লবণ পারিতোষিক দিতেন।
পুজো বা বিয়ের মরসুমে নুন তৈরির ধুম লেগে যায় নিঙ্গেল গ্রামে। নুন উৎপাদনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের ব্যস্ততা ওঠে চরমে। ইম্ফলের ইমা মার্কেট (মণিপুরি ভাষায় ‘ইমা’ মানে মা। এখানকার সব দোকান চালান মহিলারা, তাই এই নাম), থঙ্গল মার্কেট, থোবাল বাজারে নুনের চাহিদা বেড়ে যায় দ্বিগুণ।
জানতে কৌতূহল হয়, পাহাড়ও নয়, সমুদ্রও নয়, তা হলে এই নুনের উৎস কী! নিঙ্গেল গ্রামে তিনটে কুয়ো বা ইঁদারা আছে। সেই কুয়োর জল সম্পূর্ণ লবণাক্ত। কুয়োগুলি চারশো বছরেরও বেশি পুরনো। সবচেয়ে প্রাচীন কুয়োটি কাঠের, অন্য দু’টি পরবর্তী কালে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। প্রাচীন কুয়োটি মোটা গাছের গুঁড়ির ভিতরটা ফাঁকা করে তৈরি করা হয়েছে। কালের দাপট প্রতিহত করে কুয়োটি আজও একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ছ’ফুট ব্যাসার্ধের কুয়োটি প্রায় পঞ্চাশ ফুট গভীর। সারা বছরই কুয়োগুলি জলে ভর্তি থাকে।
নিঙ্গেল থেকে দেড়-দু’কিমি দূরে আরও দু’টি নোনা জলের কুয়ো ছিল উখোংসং এবং সিখং-এ। আগে এখানেও নুন তৈরি হত। কিন্তু এখন সে দু’টি শুকিয়ে গেছে। ফলে সেখান থেকে আর নুনও তৈরি হয় না।
নোনা জলের কুয়ো থেকে জল এনে টিনের বড় পাত্রে কাঠকুটো জ্বালিয়ে জ্বাল দিয়ে দিয়ে ঘন করে একটু তরল অবস্থায় মাটির সরা করে কলাপাতায় ঢেলে দেওয়া হয়। জমে গিয়ে তা বড় হাতে-গড়া মোটা রুটির মতো সরার আকার নেয়। এক-একটির দাম পড়ে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা। নিঙ্গেলকে মণিপুরি ভাষায় বলে— থুং খং। ‘থুং’ মানে লবণ আর ‘খং’ মানে কুয়ো।
নিঙ্গেল এখন ‘নুনের গ্রাম’ বলে পরিচিতি লাভ করে মণিপুরের পর্যটন তালিকায় বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। মণিপুরে যাঁরাই নতুন যান, এক বার নিঙ্গেলে ঢুঁ মেরে আসেন।
প্রাকৃতিক ভাবেও নিঙ্গেল জায়গাটি যেন ছবির মতো। পাহাড়ের পাদদেশে সবুজে মোড়া ছোট্ট জনপদ। মেরেকেটে হাজারখানেক লোকের বাস। বাঁধানো রাস্তা। বেশ কিছু ঘরবাড়ি। কয়েকটি দোকানপাট আর সুন্দর একটি মন্দির। মন্দিরে অধিষ্ঠিত প্রাচীন মণিপুরি দেবদেবী— নঙ্গপক, নিংথাও এবং প্যান্থাইবি। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস— এই দেবদেবীরা কুয়োগুলি রক্ষা করছেন।
অনেক আগে নিঙ্গেলের অধিকাংশই নুন তৈরির কাজ করতেন। কালের নিয়মে তা বদলেছে। নতুন প্রজন্ম এ কাজে আগ্রহী নয়। পঁচাত্তর বছর বয়সি কুঞ্জরানী, যিনি গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই নুন তৈরি করছেন, বললেন, এই কাজে সব চেয়ে বড় সমস্যা জ্বালানির। প্রচুর জ্বালানি দরকার হয় নোনা জলকে ঘন করতে। পাহাড়-জঙ্গল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করা বর্ষাকালে খুবই দুরূহ।
কুঞ্জরানীর কাছে যাওয়ায় উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। অর্নগল মণিপুরিতে অনেক কথা বলছিলেন। জানালেন, “এই কুয়োকে এ গ্রামের লোকেরা দেবতা বলে মানেন। শুক্রবার এই কুয়োকে আমরা ছুঁই না। অতীতে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেছে শুক্রবারে। আর এখন শুধু ওই কাঠের বাঁধানো কুয়ো থেকেই জল নেওয়া হয়।
নিঙ্গেলের প্রাক্তন প্রধান ইঙ্গোচা সিং জানালেন, এখন দশটি পরিবার নুন তৈরির কাজে যুক্ত। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না হলে ঐতিহ্যবাহী এই দেশীয় গৌরব ধরে রাখা এক দিন সত্যিই দায় হয়ে উঠবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy