সময়ান্তর: ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির দৃশ্য। ডান দিকে, তিতাস নদীর বর্তমান অবস্থা। নীচে, বাবা আলাউদ্দিন খাঁ-র বাসভবনে তৈরি সঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা
তিতাস নদীকে বাঙালি দেখেছে দুজন মানুষের চোখ দিয়ে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ যে ভাবে ‘কূলজোড়া জল বুক ভরা ঢেউ’ দেখিয়েছেন, সেই ভাবে। আর দেখেছে ঋত্বিক ঘটকের ক্যামেরায়— এ-পার ও-পার জুড়ে থইথই জল, নদীর বুক চিরে বয়ে চলা পাল তোলা নৌকোর সারি, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ। সময় বয়ে গিয়েছে তার মতো করে। তিতাসও বয়ে চলেছে। গত বছরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছিলাম। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মস্থান আর ঋত্বিকের প্যাশন তিতাস সে দিন এই ভাবনাগুলোকেই উসকে দিয়েছিল। মনের ভিতর তিতাসকে সামনে থেকে দেখতে পাওয়ার ইচ্ছেটাই শুধু জেগে উঠেছিল। সেই তিতাস, যাকে আমরা ভাবনায় লালন করেছি আর ক্যামেরার চোখ দিয়ে আকণ্ঠ পান করেছি। কিন্তু তিতাস আর সে তিতাস নেই।
কাজের সূত্রে বছরে দু’-তিন বার বাংলাদেশে যাওয়া হয়েই যায়, কিন্তু এ বার পথটা অন্য। এই প্রথম ত্রিপুরা দিয়ে যাওয়া। ছোট শহরের সেই ছোট এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চেকপোস্টে নিজেদের ভারতীয়ত্বের প্রমাণাদি দাখিল করে বাংলাদেশে যখন প্রবেশ করলাম, তখন বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। সন্ধে হল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সার্কিট হাউস পৌঁছতে পৌঁছতে। যত কাছাকাছি পৌঁছচ্ছি ততই উত্তেজনা বাডছে আর মনে মনে গুনগুন করে উঠছি, ‘আমের তলায় ঝামুর ঝুমুর কলা তলায় বিয়া/ সুন্দরীর ও বর আসবে টোপর মাথায় দিয়া।’
যে নদীর ‘ভোরের হাওয়ায় তন্দ্রা ভাঙে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না’— সে নদী দেখার বিস্ময় অপার। সার্কিট হাউস থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতেই পৌঁছলাম। উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে, মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে সাদা কালো টুকটাক ইমেজে। গাড়ি থামল, চালক বললেন, “ম্যাডাম, এ বার একটু হাঁটতে হবে।”
যে গলিটার ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে হল, তার মাঝেই শুরু হয়ে গিয়েছে মালোপাড়া। হঠাৎ সামনে পড়ল কালো পাথরে তৈরি একটি আবক্ষ মূর্তি। মূর্তিটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের। পিছনেই মালোদের ঘরদোর। একটা গলির মধ্যে ঢুকে গিয়ে আমাকে বলা হল, এখানেই উনি জন্মেছিলেন। আমার কাছে যেন উপন্যাস সিনেমার সব ইমেজ ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ফিরে ফিরে আসছিল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা অগোছালো ঘরবাড়ি। সামনে দালান। সেখানে বসে মেয়ে-বৌরা ঘরের কাজ করছে। সময়কে রিওয়াইন্ড করে দিচ্ছে সব কিছু। মালোপাড়ার মানুষজনের সার্বিক উন্নতি যে খুব হয়নি, তা বোঝা যাচ্ছে ঘরবাড়ি বা পোশাকআশাক দেখে। সেই ঢেউ খেলানো টিনের ঘরগুলো অদ্বৈতর অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দর মতো চরিত্ররা যেন থমকে যাওয়া সময়ের মুখে দাঁড়িয়ে। তাদের মতো কিছু মানুষ বসে আছে। কোনও কাজই করছে না। মাছ ধরার জালগুলো পাশে রেখে দেওয়া। সেগুলো দীর্ঘ ব্যবহারহীনতায় ধূলিমলিন। সব মিলিয়ে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মালোপাড়া ২০১৯-এও থমকে দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে স্টুডিয়োপাড়ার সেট পেতে রাখা। সেই সেটে ওই আবক্ষ মূর্তি ছাড়া অদ্বৈতর উপস্থিতি আর কোথাও নেই।
ওই গলিগুলো পেরিয়ে গোকর্ণ ঘাট। তিতাসের ধারে। মনে হচ্ছিল, ছোটবেলার মতো চোখ বেঁধে হাঁটি। তার পর হঠাৎ দেখতে পাব তিতাসকে। এ তো সেই নদী— ‘‘মেঘনা পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই... তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হইতে পারে না। আবার ছোটো নৌকায় ছোটো বউ নিয়ে মাঝি কোনোদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না। তিতাস শাহী মেজাজে চলে।’’ সেই শাহি মেজাজ তার আজ আর নেই। চোখ মেলে খুঁজে চলেছি সেই কূলজোড়া জল আর বুকভরা ঢেউ। না, কোথাও নেই। নদীতে জলই নেই তত। হয়তো বর্ষা নামলে খানিকটা বাড়বে। দু’দিকের পাড় জুড়ে ঘন বসতি। এ-পারে দাঁড়িয়ে ও-পারের ঘরবাড়ি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খুবই দূষণ জলে। জলের কোথাও কোথাও কচুরিপানা ও বর্জ্য পদার্থ জমে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, নদী সংস্কারের কাজ তেমন একটা হয় না। যে ভাবে গঙ্গা, যমুনা আর অন্যান্য নদী অবহেলিত, এ-ও তাই। তিতাসকেও যেমন দূষণমুক্ত করা যায়নি, তেমনই মালোপাড়ারও উন্নতি হয়নি। সংরক্ষিত করা যায়নি অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাড়িটিকেও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভূখণ্ডের দেশগুলোর কলোনিয়াল হ্যাংওভারের কথা বিশ্ববিদিত, কিন্তু সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা তারা আজও আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি। তাই অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাড়িটিকে মিউজ়িয়াম করে তোলা সম্ভব হয়নি, আরও অনেক কিছুই, যা সংরক্ষণযোগ্য ছিল, ক্রমশ হারিয়ে গিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি থেকে।
তিতাসের ধারে গড়ে ওঠা এই মফস্সলেরই সন্তান বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। বোঝাই যাচ্ছে এক সময় এই শহর, সাংস্কৃতিক পীঠস্থান হিসেবে পিছিয়ে ছিল না মোটেই। আসলে বড় বড় শহর তার প্রগল্ভতার গরিমায় ছোট শহরকে গিলে ফেলে। সে জন্যই ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপেক্ষিত, এত গুণিজনের স্পর্শ পাওয়ার পরও। তিতাসকে দেখে সত্যি মনে হয়েছিল, না দেখতে এলেই ভাল হত। কোনও কোনও জিনিস আমাদের মনে যে ছবি তৈরি করে, তা ধরে রাখা উচিত। সেই ইমেজগুলো নষ্ট হলে কষ্ট পেতে হয়। স্মৃতিটাও যেন হারিয়ে যায় তার সঙ্গে সঙ্গে। এখনও তিতাসের বুকে নৌকো চলে। মানুষ এ-পার ও-পার হয়। তবে সেই আতিশয্য নেই, সৌন্দর্যও নেই। কারণ নদীটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। ক্লান্ত নদী যেন বহু যুগের ক্লেদ নিয়ে বয়ে চলেছে। সে নিজেকে মালিন্যমুক্ত করে আগেকার সর্পিল রূপ ফিরে পেতে চায়। তার ইচ্ছে মানুষের মনের কান অবধি পৌঁছয় না।
তিতাসের পার থেকে এক রাশ মন খারাপ নিয়ে ফিরলাম বাবা আলাউদ্দিনের বাড়ি দেখতে। সেই বাড়িটি এখন ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’। তাও এখানে গানবাজনার চর্চা হয়। এই বাড়িটি খানিকটা যত্নে রাখা হয়েছে। ভিতরে বাবা আলাউদ্দিনের কিছু ছবি। একটু ভিতরে ঢুকে বোঝা গেল পুরনো বাড়িটি আর নেই। বর্তমান ভবনটি নতুন করে সংস্কার করে তৈরি। বাড়িটায় ঢুকে একটা খুব বড় পোস্টার চোখে পড়ল। সেখানে বাড়িটিকে ভেঙে ফেলার কিছু ছবি, আর তার নীচে লেখা ‘সন্ত্রাসী হামলায় ধ্বংসকৃত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘরের পুনঃসংস্কার ও পুর্নগঠনশেষে শুভ উদ্বোধন করেন জনাব মো. আব্দুল মান্নান, বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) চট্টগ্রাম, ২৩ মে, ২০১৮’। বাড়ির বাইরের গেটটা দেখে বোঝা গিয়েছিল যে, পুরনো বাড়িটি নষ্ট হয়েছে। সন্ত্রাসবাদী হামলায় বাড়িটি পুরোটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাকে পুনরুদ্ধার করে একটি সঙ্গীতাঙ্গন ও সংগ্রহশালা হিসেবে চালানো হয়। মিউজ়িয়াম যেমন হয়, তেমন কিছু তথ্য বা স্মারক নেই। বাবা আলাউদ্দিনের কিছু ছবি আর কিছু বাদ্যযন্ত্র রাখা আছে। যত্ন করে আমরা ধরে রাখতে পারি না, বরং নষ্ট করে ফেলি। আলাউদ্দিন খাঁ-র বাড়ির সামনে দাঁডিয়ে সে দিন বেনারসের বিসমিল্লা খাঁ-র বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। গলিঘুঁজি পেরিয়ে সে বাড়িতে যখন পৌঁছলাম, দেখলাম নিতান্ত হতশ্রী দশা। পোস্টবক্সে ওঁর নাম লেখা ছিল আর বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখা গেল ওঁর ছবি। বেনারস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাইহার, তিতাস, মালোপাড়া যেন সেই মুহূর্তে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল মনের গভীরে সরোদ, বাঁশি, সেতার, সানাইয়ের কনসার্ট বেজে উঠবে এক্ষুনি।
আরও দুজন মানুষের নাম উল্লেখ করতেই হয় এই অঞ্চলে এসে। প্রথম জন কবি আর দ্বিতীয় জন গায়ক। কবি আল মাহমুদ। আমার মতো অনেকেরই প্রিয় কবি তিনি। তাঁর শেষ জীবনের লেখালিখি বেশ বিতর্কিত। তবে ‘সোনালী কাবিন’-এর খোঁজ করতে যাওয়ার সময় পাইনি।
সেই গায়ক, যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন অমর পাল। যাঁর লোকসঙ্গীতের খ্যাতি দু’দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এত গুণিজন সমাগম নিয়েও আজ নিতান্ত মলিন তিতাসপারের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ঘুরে ফিরে তিতাসের কথাতেই ফিরতে হয়। নদীকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবিকা, জনপদ তৈরি হয়, সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তেমনই তিতাসকে কেন্দ্র করেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেই মালোপাড়ার ছেলে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘মোহম্মদী’ নামক মাসিক পত্রিকায় চাকরি করার সূত্রে সাতটি সংখ্যায় ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলেন এই উপন্যাসের প্রথম খসড়া। মাঝপথে পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দেন অদ্বৈত, তাই আর শেষ হয়নি। পরবর্তী কালে যখন কলকাতায় চলে আসেন, তখন এই উপন্যাসের শেষের অংশটি লিখেছিলেন এবং প্রথম খসড়াটিকেও যথাযথ ভাবে সম্পাদনা করেছিলেন। উনি বেঁচে থাকাকালীন উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর এটি উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়। তিতাস পারের মৎস্যজীবী মানুষরাই ‘মল্ল’ বা ‘মালো’ সম্প্রদায়ের। তাঁদের নিয়েই আখ্যান। বর্ণহিন্দু সমাজের চোখে এঁরা ব্রাত্যজন। সেই মালো সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছিলেন অদ্বৈত, তাঁদের মুক্তি দিতে। কিন্তু সত্যিই কি মুক্ত করতে পেরেছেন তিতাসকে, মালোদের? এটি আজ বড় জ্বলন্ত প্রশ্ন। এই উপন্যাস নিয়েই ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় তৈরি করলেন তাঁর ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সাদা-কালোর মূর্ছনায় উজাড় করে দেখালেন নিজস্ব উদ্বাস্তু চেতনার ভাবাবেগ। তার সেই ন্যারেটিভ তিতাসের পার বেয়ে বাঙালি হৃদয়ে তৈরি করল এক চিরন্তন দৃশ্যপট।
তিতাসের পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন এ সব কথা মনে পড়ছে, তখন বৈশাখী বিকেলের সূর্য পাটে বসেছে। আমারও ফেরার সময় হল। সমস্ত মালিন্য নিয়ে তিতাস বয়ে চলবে অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে। বাঙালির মণিকোঠায় তুলে রাখা দৃশ্যাবলি আর ছায়া ফেলবে না তার জলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy