বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
লোহার ফটক খুলে ঢুকতেই বাঁ হাতে ছোট্ট একটি লন। সামনে একতলা সাদা বাংলোটিকে রেখে রাস্তা বাঁয়ে ঘুরতেই পর পর দুটি অফিস ঘর। দ্বিতীয়টি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের।
১৩ তালকাটোরা রোড-এ প্রণববাবুর দীর্ঘ দিনের এই বাসস্থান, লুটিয়ানস দিল্লির দর্পিত বাংলোগুলির তুলনায় যেন ছিল অনেকটাই সাদামাঠা। ২০০৪-এ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর বিরাট বাংলায় যাওয়ার কথাও ছিল। কিন্তু ১৩ একটি ‘লাকি’ সংখ্যা মুখোপাধ্যায় পরিবারের কাছে। স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় কিছুতেই রাজি হননি এই সংখ্যাটিকে ছাড়তে। এই বাড়িটি থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পুনরুত্থান ঘটেছে তাঁর স্বামীর। ১৩ জুলাই তাঁদের বিবাহ দিবস। পরে বাধ্য হয়ে বাড়িটি ছাড়তে হয়, যখন দেশের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হন প্রণববাবু!
গোটা লুটিয়ানস দিল্লি ঘুমিয়ে পড়ার পরেও দীর্ঘ ক্ষণ জেগে থাকত এই বাংলো। রাত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত শহরের তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সময় দেওয়া থাকত। তারই মাঝে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের অফিসারদের আনাগোনা। কংগ্রেসের বড় ও মাঝারি নেতারা হন্তদন্ত ভাবে আসতেন (জয়রাম রমেশ, আহমেদ পটেল, কপিল সিব্বল, প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিরা ছিলেন নিয়মিত)। ফাঁকে ফাঁকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ফাইলে সই, তাঁর প্রিয় শেফার্স কলমে।
নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের সঙ্গে।
এ রকমই কোনও এক রাতে এআইসিসি-র আসন্ন রাজনৈতিক প্রস্তাবের রূপরেখা বুঝতে রাত করে গিয়েছি। এমনিতেও রাত করেই যেতাম কারণ প্রথম অফিস ঘরটিতে ঠাসাঠাসি হয়ে বসে থাকা (ঘরটি ছোট তাই অনেকে বাইরে দাঁড়িয়েও অপেক্ষা করতেন) দেশের বিভিন্ন নেতা উকিল, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি-সহ সাক্ষাৎপর্ব শেষ হলে তার পর আপ্তসহায়ক প্রদ্যুৎ গুহ বলতেন, ‘‘এ বার যা, দাদা একটু আড্ডা মারবে!’’
এই ‘আড্ডা’ মানে এক আশ্চর্য কথ্য ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া। কখনও ইন্দিরা জমানার ভারত, জরুরি অবস্থা, অপারেশন ব্লু স্টার-এর খুঁটিনাটি। কখনও তাঁর শৈশবে তাঁর নিজের গ্রামে গাঁধীবাদী আন্দোলনের কথা। বর্ষাকালে হাতে চটি নিয়ে কর্দমাক্ত পথ পার হয়ে পাঠশালা যাওয়ার স্মৃতি। কখনও বাংলা কংগ্রেস গঠনের প্রেক্ষাপট, অথবা হালফিলের কোনও বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা। মোট কথা, যে কোনও সাংবাদিকের কাছে রাতের এই এক-দেড় ঘণ্টা, জাতীয় তথা বিশ্ব রাজনীতির একটি অমূল্য ক্র্যাশ কোর্স। মাঝেমধ্যেই প্রলুব্ধ হয়ে নোট নিতাম, আর উনি হাঁ হাঁ করে উঠতেন, ‘‘আরে আরে কী করছিস এ সব কিন্তু লিখবি না (সাধে কি ইন্দিরা গাঁধী বলেছিলেন প্রণবের পেটে খোঁচা দিলে শুধু পাইপের ধোঁয়া বেরোবে কোনও গোপন তথ্য বেরোবে না!)!’’ কী করে তাঁকে তখন বোঝাব যে এগুলি কাগজে লেখার বিষয়ই নয়, নিজের অর্জনের জন্য নোট করে রাখছি! পরের দিকে অবশ্য আস্থা বাড়ায় আর আঁতকে উঠতেন না এ সব ক্ষেত্রে।
যে রাতের কথা বলছি, সে দিন সন্ধে থেকেই আকাশে মেঘ। কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাব বোঝানোর মধ্যেই একটা ফোন এল, বুঝলাম কোনও গুরুত্বপূর্ণ ফোন কারণ, দ্রুত রিল্যাক্সড ভাবটা কাটিয়ে টানটান হয়ে বসলেন। ফোনটা কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী অথবা প্রধানমন্ত্রীর নয় সেটাও বুঝলাম, কারণ এই দুটিমাত্র ফোনে সাধারণত চোখের ইশারায় বলতেন, বাইরে অপেক্ষা করতে, আবার ডেকে নেবেন। এ ক্ষেত্রে অন্য কেউ। ‘ইয়োর এক্সেলেন্সি’ বলেই সম্বোধন করলেন ফোনকর্তাকে। কুশল বিনিময় করলেন। অদূর ভবিষ্যতে দেখা হওয়ার আশা প্রকাশ করলেন। আরও কিছু কথা বললেন, একতরফা শুনে বোঝা গেল না। ফোনটা রেখে বললেন, ‘‘নওয়াজ শরিফ, বুঝলি!’’ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে প্রাক্তন এই প্রধানমন্ত্রী তখন রাজনৈতিক অ্যাসাইলামে লন্ডনে। অবাক হলাম না, কারণ তত দিনে জেনে গিয়েছি এ রকম বহু হাই প্রোফাইল শীর্ষস্তরের রাষ্ট্র নেতা (বিশেষত রাশিয়া এবং প্রতিবেশী দেশগুলির) সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এখনকার পরিভাষায় যাকে কূটনৈতিক ‘ট্র্যাক টু’ বলা হয়ে থাকে সেটি তিনি বরাবরই করতেন, তা সে অর্থমন্ত্রিত্ব বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যার দায়িত্বেই থাকুন না কেন। এবং সেটি করতেন মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধীকে সম্পূর্ণ অবগত রেখেই।
লোকসংস্কৃতি ভবনের উদ্বোধনে।
আলোচনায় ইতি টেনে ওঠার তোড়জোড় করছি, প্রণববাবুর বহু দিনের অফিসকর্মী হীরালাল চা নিয়ে ঢুকে সংবাদ দিলেন, বাইরে খুব শিলাবৃষ্টি। ক্ষণিকের মধ্যেই যেন ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন প্রণববাবু। বললেন, ‘‘চল তো দেখি!’’ পায়ে পায়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালাম। সামনে গাড়িবারান্দার কোনায় একটা আমগাছ। নির্জন করিডরে হলুদ আলো পড়ে ঝলমল করছে বর্ষা। উনি গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছু ক্ষণ। তার পর কিছুটা নিজের মনেই বলতে থাকলেন, এই সময়ে (সম্ভবত মার্চ মাস ছিল) বর্ষায় আমের ফলন শিলাবৃষ্টিতে কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার বৃত্তান্ত। মুর্শিদাবাদের আমের কৌলীন্য-কথা। মুঘল দরবারের কথা। কাকে বলে বাম্পার ফলন। মাটিতে রসের অভাব হলে কী ভাবে মুকুল ঝরে যায়। তখন আমার মোবাইলে রেকর্ড করার বন্দোবস্ত ছিল না, আর থাকলেও করতাম না হয়তো। সব ম্যাজিক রেকর্ড করা যায় না! এই মানুষটিই মিনিট তিনেক আগে পাকিস্তানের তখনকার সরকারের পয়লা নম্বর শত্রুর সঙ্গে কৌশল রচনা করে উঠেছেন!
মনে আছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে লালুপ্রসাদের আনা মুজাফফরপুরের লিচু এবং ‘আম-বড়াই’ দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘লালুজি আপনি যা-ই বলুন, দেশের সেরা আম এবং লিচু কিন্তু পাওয়া যায় আমার এলাকা মুর্শিদাবাদে!’’ শুধু বলাই নয়, তাঁর তত্ত্বকে প্রমাণ করার জন্য সে বছর থেকে প্রতি মরশুমে, আম এবং লিচু তাঁর এলাকা থেকে এনে রাজধানীর নেতা-মন্ত্রীদের প্যাকেটে করে পাঠানো একটা প্রথার মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, উৎসাহের ক্ষেত্রগুলির পাশাপাশি তাঁর অনাগ্রহের ক্ষেত্রগুলিও ছিল প্রখর। যেমন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সফর করেছেন, কিন্তু পর্যটনে তাঁর মতি দেখিনি কোনও দিনই। কোথাও যেতে চাইছেন না, ততটা জরুরিও হয়তো নয়, অথচ কোনও জুনিয়র মন্ত্রী বা সাংবাদিক অবুঝের মতো জানতে চাইছেন, না যাওয়ার কারণ। এ সব সময়ে একটু ক্রুদ্ধ হয়ে (যে রাগ কমে যেতে সময় লাগত মিনিট তিনেক!) একটা পেটেন্ট উত্তর দিতেন, ‘‘আই অ্যাম নট আ টুরিস্ট!’’
মুহূর্তকথা: মিরিটির গ্রামের বাড়িতে দুর্গাপুজোয় চণ্ডীপাঠরত।
এহেন পর্যটনবিমুখ ব্যক্তিত্বকে উগান্ডার কাম্পালায় গিয়ে সফররত সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সম্মিলিত উসখুসানিতে বলেই ফেলেছিলাম, একটু বাড়তি সময় কি বার করা সম্ভব হবে? আফ্রিকায় যখন আসা হয়েছে, একটু সাফারিটা ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছা সবার। প্রায় আকাশ থেকে পড়ে খুবই বিস্মিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘‘এখানে আবার জঙ্গল দেখার কী আছে!’’ তুরস্ক বা চিন যেখানেই যেতেন, পর্যটনস্থলের থেকে অনেক বেশি আগ্রহ দেখেছি সঙ্গের ব্রিফ, ফাইল এবং দিনে অন্তত চার থেকে পাঁচটি বৈঠক, বক্তৃতা ও সম্মেলনে। তিনি চলে আসার পরেও তাঁর সফরসঙ্গী দুই সাংবাদিক লন্ডনে থেকে গিয়েছে কেন, কারণ জানতে চেয়েছিলেন। বলেছিলাম, ওরা শহরটা একটু ঘুরে দেখতে চায় আর কী। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে তাঁর মন্তব্য, ‘‘লন্ডনে ঘুরে দেখার কিছু আছে না কি!’’
অনাগ্রহের দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল সিনেমা। পরে অবশ্য রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে যা বদলে যায়। আগে সগর্বে বলতেন, ‘অপুর সংসার’ আর ‘রং দে বসন্তি’ ছাড়া কিছু দেখেননি! এই অদ্ভুত কম্বিনেশন কেন? কারণ ‘রং দে বসন্তি’ রিলিজ়ের আগে সেন্সর বোর্ডের তৎকালীন প্রধান শর্মিলা ঠাকুরের মনে হয়, ছবিতে দেখানো প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সংক্রান্ত বিতর্কিত বিষয়ে পরে সমস্যা না হয়, সে জন্য আগেই তাঁকে (তিনি তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী) দেখিয়ে নেওয়া ভাল। শোনা যায়, আমির খানের পাশে বসে ছবিটি অর্ধেক দেখেই মহাদেব রোডের অডিটোরিয়াম ত্যাগ করেছিলেন প্রণববাবু, শর্মিলাকে বিস্মিত করে। তাঁর সহাস্য মন্তব্য ছিল, ‘‘দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার, ফিল্মের সেন্সর সার্টিফিকেট দেওয়া নয়!’’
নিবিষ্ট: দেশদুনিয়ার রাজনৈতিক চিত্র ছিল তাঁর নখদর্পণে। তবে নিজস্ব ক্ষেত্রের বাইরের বিষয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না কখনই।
এক বার তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন বলে তাঁর সংসদীয় অফিস ঘরের সামনে অপেক্ষা করছেন বিনোদ খন্না। বাইরে থেকে ঘরে ঢোকার মুখে, দু’চোখে প্রশ্ন নিয়ে তিনি তাকালেন ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’-র প্রথম পুরুষের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে চিনতে পারছেন না! খন্নাও তখন সাংসদ হিসাবে নবাগত। তিনি নিজের নাম বললেন। তা-ও প্রণববাবুর ধোঁয়াশা কাটল না! বাধ্য হয়ে বিনোদ বলেন, ‘‘স্যর আই অ্যাম এম পি।’’ সঙ্গে সঙ্গে মুখচোখ বদলে সম্ভ্রমের ভাব। সংসদীয় গণতন্ত্রের আমৃত্যু পূজারি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে সসম্মানে নিয়ে গেলেন ঘরে!
তবে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ভবনের অডিটোরিয়ামে প্রায়ই ছবি দেখার বন্দোবস্ত হত। অভিনেতা, পরিচালকদের সঙ্গে বসে দেখতেন। লালকৃষ্ণ আডবাণীকে সঙ্গে নিয়ে দেখেছিলেন ‘পিকু’। যেটি সম্ভবত তাঁর দেখা শেষ হিন্দি ছবি। এক বৃদ্ধের জীবন তাঁর মেয়েকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ার সেই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন দুই প্রবীণ, ঘটনাচক্রে তাঁরা তখন পারিবারিক স্তরে তাঁদের মেয়েদেরই তত্ত্বাবধানে।
খাওয়াদাওয়া নিয়েও খুব বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহী দেখিনি তাঁকে। আলুপোস্ত, বিউলির ডাল, মাছের ঝোলে স্বচ্ছন্দ। বছরের একটি বিশেষ সময়ে মাছ খেতেন না। তবে এক বার রাষ্ট্রপতি হিসাবে বাংলাদেশ থেকে ফেরার সময় দৃশ্যতই উচ্ছ্বসিত দেখেছিলাম। আমরা আগে বিমানে চড়ে গিয়েছি। উনি আসবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি মধ্যাহ্নভোজ সেরে। ফিরে রীতিমতো উত্তেজিত। ‘‘আমি কি এই বয়সে এত খেতে পারি, কিন্তু হাসিনা ছাড়বে না! কই, চিতল, গলদা চিংড়ি, উফফ আমার অবস্থা দফারফা বুঝলি! বলছে ও নিজের হাতে সব রান্না করেছে, পাত খালি রাখলে চলবে না!’’
নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করতেও কুণ্ঠা দেখিনি। বোধহয় অগাধ আত্মবিশ্বাস থাকলেই এটা করা যায়। নিজের হিন্দি উচ্চারণ নিয়ে বহু মজার গল্প শুনেছি তাঁর মুখেই। পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সরকারে তখন নির্বাসন কাটিয়ে ফিরে আসা প্রণবের ক্ষমতা এবং গুরুত্ব রাজধানীতে ক্রমশ বাড়ছে। স্বাভাবিক ভাবেই শাহি দিল্লির অলিন্দে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। এক দল প্রণব-বিরোধী কংগ্রেস নেতা পি ভি-র কাছে গিয়ে বললেন, আমাদের উত্তরপ্রদেশে নতুন রাজ্যপাল নিয়োগ প্রয়োজন। প্রণববাবুকে রাজ্যপাল করে দেওয়া হোক। দিল্লি সামলানোর অনেক লোক আছে। অত্যন্ত বিচক্ষণ পি ভি বুঝে গেলেন যা বোঝার। একটু হেসে বললেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম আমাদের পঞ্চাশ শতাংশ ভোট নিয়ে চলে গিয়েছেন। এ বার প্রণবকে ওখানে রাজ্যপাল করলে ওর হিন্দি শুনে বাকি ৫০ শতাংশও চলে যাবে! দিল্লিতে ও যা দায়িত্ব পালন করছে তা-ই করতে দিন।’’
শুধু হিন্দিই নয়। ইন্দিরা গাঁধী এক বার নাকি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন উচ্চারণ বদলানোর জন্য স্পোকেন ইংলিশ টিচার রাখতে। প্রণব তাঁকে হেসে বলেছিলেন, ‘‘ম্যাডাম যা এক বার হয়ে গিয়েছে তাকে আর ফেরানো সম্ভব নয়। আপনি একটি বৃত্তকে চতুষ্কোণ বানাতে পারবেন না!’’
এমন কোনও গল্প প্রণববাবুর কাছে শুনিনি তাঁর অতীত ইতিহাসের যেখানে ইন্দিরা গাঁধীর নাম আসেনি। যখন যে অফিসে বসেছেন, দেওয়ালে ইন্দিরার ছবি থেকেছে, আর কারও থাক বা না থাক। সবচেয়ে প্রিয় ছিল তাঁর ১৯৮০ সালে লোকসভা ভোটে জেদ করে দাঁড়িয়ে হেরে যাওয়ার গল্প। ‘‘আমাকে দিল্লিতে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। আমি তো দুরুদুরু বক্ষে গিয়েছি। খাবার টেবিলে ডাকলেন। দেখি মানেকা বসে কিছু একটা সব্জি কাটছে ছুরি দিয়ে। থমথমে লাল হয়ে যাওয়া মুখে ইন্দিরাজি বললেন, সবাই জানত তুমি হারবে। এমনকি তোমার স্ত্রীও জানত। তাও তুমি কথা না শুনে ভোটে দাঁড়িয়ে আমায় বিপদে ফেললে!’’ দু’দিন পরেই তাঁর কাছে আসে সঞ্জয় গাঁধীর সেই বিখ্যাত ফোন। সঞ্জয় বলেন, ‘‘মামি তোমার উপর খুবই চটে আছেন! কিন্তু সেই সঙ্গে আমাকে এটাও বললেন, ওঁকে ছাড়া আমি মন্ত্রিসভা বানাতে পারব না! ওকে দিল্লি আসতে বলো। দেখা যাক রাজ্যসভা থেকে কী ভাবে জিতিয়ে আনা যায়।’’
২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার গঠনের সময় প্রণববাবুর অভিলাষ ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে কাজ করার। শোনা যায় জ্যোতি বসুও সে সময় এই পরামর্শ দিয়েছিলেন সনিয়াকেও। যে দিন মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা হবে, আমরা ওঁর সঙ্গে কথা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তাঁর সামনে কী চ্যালেঞ্জ এমন একটি খবর তৈরিও করে রেখেছিলাম। দরকার ছিল একটি অন-রেকর্ড কোট। বলেছিলেন, ‘‘একটু অপেক্ষা কর, সরকারি ঘোষণার পরেই দিচ্ছি।’’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট আনিয়ে পড়াশোনাও শুরু করেছিলেন। প্রদ্যুৎ গুহের কাছে শুনেছি, যখন দেখা গেল স্বরাষ্ট্র নয়, পেয়েছেন প্রতিরক্ষা— দৃশ্যতই হতাশ হয়ে এসে নিজের টেবিলে চুপ করে কিছু ক্ষণ বসেছিলেন। চারপাশে তাঁর ঘনিষ্ঠরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। একটু পরে উঠে ওয়াশরুম ঘুরে এসে এক গ্লাস জল খেলেন। তার পর ভিন্ন চেহারা। প্রদ্যুৎদাকে বলেছিলেন, ‘‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। তুই প্রতিরক্ষা সচিবকে ফোনটা মিলিয়ে দে। কাজ শুরু করি!’’ বাকিটা ইতিহাস। মন্ত্রিত্ব যা-ই থাক, অচিরেই সরকারের ‘নাম্বার টু’ হয়ে ওঠার। ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে পথ দুর্ঘটনার পর সনিয়া গাঁধী প্রণব-জায়াকে বলেছিলেন, ‘‘ও-ই তো আমাদের সরকারের মাথা। ওর মাথাতেই চোট লাগলে কী করে চলবে!’
রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার পর কিছুটা, পরে রাজাজি মার্গে অনেকটাই নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরেছিল। সর্ব ক্ষণ টিভি খোলা থাকত, কিন্তু শব্দহীন। বলতেন, ‘‘আগে সে ভাবে শোনা হয়নি, এখন রবীন্দ্রনাথের গান খুব শুনি। এমন একটা দিনও যায় না যে আমি একটি বা দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গুনগুন করি না।’’ এক সাংবাদিকের গলায় একটি গান শুনে আপ্লুত হতে দেখেছি। পরে নিজের অফিসকে বলে ওই গানটি ইচ্ছামতো শোনার ব্যবস্থা করেছিলেন সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে— ‘কোন্ খেলা যে খেলব কখন্ ভাবি বসে সেই কথাটাই…’ শেষ পর্যন্ত এই গানটি ঘুরেফিরে শুনতেন বলে জানি।
শেষ বার হাসপাতালে যাওয়ার তিন দিন আগে দেখা হওয়ায় বলেছিলেন, ‘‘এই করোনা নিয়েই হয়তো চলে যাব।’’ বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। উনি হয়তো তাঁর প্রখর মস্তিষ্ক দিয়ে টের পেয়েছিলেন সেই ‘নিঠুর খেলা’র দিন এসে গিয়েছে। শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর সুবিপুল খেলার মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার সেই ‘ভীষণ ভেরী’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy