প্রতীকী ছবি।
বড়দিনের আগের ঝকঝকে রাত। মাটি থেকে ৩৬ হাজার ফুট উপরে ককপিটে পাশাপাশি বসে কম্যান্ডার ক্যাপ্টেন জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সহকারী পাইলট রাজীব কুমার। বিমানকে অটো-পাইলটে দিয়ে খানিকটা রিল্যাক্সড তাঁরা। কলকাতা থেকে চেন্নাইয়ের পথে বিমান তখন ভুবনেশ্বর ছাড়িয়ে বিশাখাপত্তনমের দিকে।
আচমকা ককপিটের দরজায় নক। দরজা খুলতেই প্রধান বিমানসেবিকা মুখ ঢুকিয়ে বললেন, “ক্যাপ্টেন, এক মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কোনও ডাক্তার যাত্রী আছেন কি না ঘোষণা করেছিলাম। এক সঙ্গে প্রায় ১৪ জন কার্ডিয়োলজিস্ট ভেলোরে সেমিনারে যাচ্ছিলেন। তাঁরা এসে মহিলাকে দেখছেন।”
দশ মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতির কথা তাঁকে জানাতে বললেন জয়দীপ। দশ মিনিটের মাথায় এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান তখন বিশাখাপত্তনমের উপরে। নিজেই ককপিট থেকে বেরিয়ে দেখলেন, সামনে বিজ়নেস ক্লাসে প্রায় বছর পঁয়ত্রিশের মহিলাকে ঘিরে তিন-চার জন ডাক্তার। এক জন তাঁর হার্ট পাম্প করছেন। জয়দীপ এক ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাদের হাতে কত ক্ষণ সময় আছে?” ডাক্তার বললেন, “হার্ট তো অলরেডি বন্ধ।”
ককপিটে ফিরে এসে কো-পাইলটকে নির্দেশ দিয়ে মুখ ঘোরালেন বিমানের। ২০০৯ সালে তখন বিশাখাপত্তনমে রাতে নামার সুবিধে ছিল না। জয়দীপদের পৌঁছতে হবে কাছের বিমানবন্দর ভুবনেশ্বরে। ওই উচ্চতায় বিমানের গতি থাকে সাধারণত ঘণ্টায় ৫৪০ কিলোমিটার। জরুরি অবস্থায় তা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৬১২ পর্যন্ত করা যায়। সেই সর্বোচ্চ গতিতে ভুবনেশ্বরের দিকে উড়ে চলল বিমান। ভুবনেশ্বরের এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-র সঙ্গে যোগাযোগ করে জয়দীপ জানালেন, মেডিক্যাল ইমারজেন্সি।
ভুবনেশ্বরের কাছে পৌঁছে মনে পড়ল রাতে ভুবনেশ্বরে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান নেই। ফলে মাটিতে নামলে মার্শালিং করে পার্কিং বে-তে নিয়ে যাওয়া, সিঁড়ি লাগানোর কাজ কে করবেন? জয়দীপের সঙ্গে ভুবনেশ্বরের এটিসি-র কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলেন অনেক নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়া কিংফিশারের পাইলট ক্যাপ্টেন অমিত চক্রবর্তী। তিনিও ভুবনেশ্বরে নামবেন এবং জয়দীপদের আগেই নামবেন। কাকতালীয় ভাবে তিনি জয়দীপের বন্ধুও। আকাশে আকাশে কথা হল বন্ধুর। অমিত জানালেন, “চিন্তা করিস না। আমি নেমে সব ব্যবস্থা করে রাখছি।”
সেই রাতে মুখ ঘুরিয়ে চলে আসা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ভুবনেশ্বরে নামতেই কিংফিশারের মার্শালার এগিয়ে এলেন। বিমানের গায়ে লাগানো হল কিংফিশারের সিঁড়ি। প্রস্তুত ছিল অ্যাম্বুল্যান্সও। জানা গেল, অসুস্থ মহিলা আদতে তাঁর স্বামীর হার্টের চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাচ্ছিলেন। মাঝপথে বিকল হল তাঁর নিজের হৃদ্যন্ত্র। মহিলাকে নামিয়ে দেওয়ার পরেও নাটক বাকি ছিল। তাঁদের দুটি ব্যাগ ছিল বিমানের পেটে কার্গো হোল্ড-এ। কপাল এতটাই ভাল ছিল যে, হোল্ড খুলতেই প্রথমেই বেরিয়ে আসে তাঁদের ব্যাগ দুটি। জয়দীপকে অন্য যাত্রীদের নিয়ে আর বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি ভুবনেশ্বরে।
ক্যাপ্টেন: জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
আবার টেক-অফ। আবার আকাশে ৩৬ হাজার ফুট উপরে উঠে গিয়ে জয়দীপদের বিমান যখন বিশাখাপত্তনম এটিসি-র আওতায় ঢুকছে, তখন শেষ কল এল ভুবনেশ্বরের এটিসি থেকে, “ক্যাপ্টেন, থ্যাঙ্ক ইউ। হসপিটাল কনফার্মড, লেডি প্যাসেঞ্জার ইজ় নাও আউট অব ডেঞ্জার।”
এমন কতশত প্রাণ নিত্যদিন বাঁচিয়ে চলেছেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে চলা পাইলটরা। কখনও মেডিক্যাল ইমারজেন্সি। কখনও আবার প্রতিকূল আবহাওয়া।
রাতের ফ্লাইট। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। সুমন মিত্র চোখ বন্ধ করে বসে নিজের আসনে। বেঙ্গালুরু থেকে ফিরছেন নিজের শহর কলকাতায়।
ড্রাইভারকে বলা আছে। বিমানবন্দর থেকে পিক-আপ করে নেবে। চিন্তা হচ্ছে, গাড়িতে উঠতে গিয়ে আবার ভিজে না যান। পাইলট ঘোষণা করে দিয়েছেন, ল্যান্ডিং শর্টলি। সিট বেল্ট লাগানো। বুঝতে পারছেন বাতাস কেটে হু হু করে বিমান নেমে আসছে বৃষ্টিভেজা শহরে। বাইরের জানলার দিকে চেয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না সুমন। বেশ কয়েকবার যেন দুলেও উঠল বিমানটা।
আশপাশে চেয়ে দেখলেন, সহযাত্রীদের চোখে-মুখে বেশ চিন্তার ছাপ। শেষে বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে রানওয়ে ছুঁল বিমান। পাশে বসা ভদ্রলোক বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, “এই সব অনভিজ্ঞ পাইলটদের মোটা টাকা দিয়ে রেখেছে। ভাল করে ল্যান্ডও করতে পারে না। আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।” টার্মিনাল থেকে ব্যাগেজ নিয়ে সুমন ও তাঁর সেই সহযাত্রী বাড়ির পথ ধরলেন। জানতেও পারলেন না, কত কাছাকাছি এসে ছুঁয়ে গেল শীতল মৃত্যুর স্পর্শ।
জানলেন শুধু ককপিটে বসে থাকা দুজন। পাইলট ও কো-পাইলট। ওই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বিরাটির দিক থেকে ল্যান্ড করতে এসে আচমকা বদলে যায় হাওয়ার গতি। দামাল হাওয়া মুখ ঘুরিয়ে ঝাপটা মারতে শুরু করে লেজের দিক থেকে। চোখের সামনে রানওয়ের আলো ঝাপসা হয়ে যায়। পাইলটরা জানেন এই অবস্থায় ল্যান্ড করতে গেলে বিপদ! কিন্তু, তত ক্ষণে এতটাই নীচে চলে এসেছে বিমান যে মুখ ঘুরিয়ে উপরে ওঠার উপায় নেই। দুর্দান্ত দক্ষতায় তাঁরা নেমে আসেন রানওয়েতে। ককপিটে বসে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে যায় কপালে।
ঝুঁকি তো শুধু যাত্রীদের নয়। নিজেদের জীবন নিয়েও প্রতি দিনের এই ছিনিমিনি খেলা চলে তাঁদের। বাইরে থেকে মনে হয়, দারুণ জীবন। অগাধ ঐশ্বর্য। সুবিধাভোগী, উচ্চবিত্ত শ্রেণির নাক-উঁচু নাগরিক। দামি ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, বিলাসবহুল জীবন, সুখী সংসার। কিন্তু, এর পিছনে জীবনের কতগুলো মুহূর্তের বলিদান রয়েছে, সেটা জনমানসে গোচর হয় না।
শুরু করা যাক জীবনের ঝুঁকি নিয়েই।
এই তো সে দিন দুবাই থেকে ফিরছিলেন এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের দুই পাইলট, ক্যাপ্টেন দীপক বসন্ত শাঠে এবং ক্যাপ্টেন অখিলেশ কুমার। সঙ্গে ১৮৪ জন যাত্রী। আকাশ পরিষ্কার। সুন্দর ভেসে আসছিলেন তাঁরা। মুম্বই ফিরে নিজের আবাসনের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল দীপকের। মন ফুরফুরে। অভিজ্ঞ পাইলট। সব কিছু নিয়ম মেনে চলছিল। কিন্তু, কেরলের কোঝিকোড় বিমানবন্দরের রানওয়ে টু এইট-এ এসে গুলিয়ে গেল সব হিসেব। সমুদ্র উপকূলবর্তী পাহাড়ের মাথা কেটে বানানো টেবলটপ রানওয়ে। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। নামতে গিয়েও বাধ্য হয়ে মুখ ঘুরিয়ে উপরে চলে গেলেন।
পাইলটদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-র সঙ্গে। বললেন, দশ হাজার ফুটে উঠতে চান। অনুমতি পেয়ে দশ হাজারে ওঠার আগেই কী মনে করে আবার জানালেন, রানওয়ের উল্টো দিক ওয়ান জ়িরো থেকে নামবেন। কে জানত সেই রানওয়ের শেষ প্রান্তে ঘাপটি মেরে মৃত্যু অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য? নিজেরাও কি জানতেন? জানলে কি সেখানে না নেমে অন্য বিমানবন্দরে চলে যেতেন না? কে যেচে মরতে চায়?
কিন্তু, শেষ মুহূর্তে পাইলটের ক্ষণিকের ভুল ডেকে আনে মৃত্যু। শুধু যাত্রীদেরই নয়, তাঁর নিজেরও। দীপক ও অখিলেশও জানতেন না এই ল্যান্ডিং তাঁদের জীবনের শেষ ল্যান্ডিং হতে চলেছে। রানওয়ের ওয়ান জ়িরো দিয়ে নেমে এসে যেখানে মাটি ছুঁলেন, সেখান থেকে পাহাড়ের কিনারা মাত্র পাঁচ হাজার ফুট। প্রচণ্ড গতিতে পিচ্ছিল রানওয়ে ধরে ছুটে চলা বিমানকে আপ্রাণ চেষ্টা করেও দাঁড় করাতে না পেরে শেষ বারের মতো উড়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। অন্তত প্রাথমিক তদন্ত সে রকমই বলছে। কিন্তু, সেটাও সম্ভব হয়নি। পাহাড়ের কিনারা দিয়ে গিয়ে ৩০ ফুট নীচে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বিমান। ককপিট থেকে বার করতে হয়েছিল দুই পাইলটের নিথর দেহ। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন যে সুস্থ সবল মানুষ, তিনি ফিরে গেলেন কফিনবন্দি হয়ে।
দীপক বা অখিলেশ প্রথম নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে ফেলে আসা দিনে এমন অনেক দীপক-অখিলেশের কথা জানা যাবে, যাঁরা কোনও আগাম খবর না দিয়েই টেক-অফ করে হারিয়ে গিয়েছেন।
কথা হচ্ছিল ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর সঙ্গে। ক্যাপ্টেন রায়চৌধুরী বঙ্গসন্তান। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের কম্যান্ডার পাইলট। ছোট থেকে সিঙ্গাপুরেই বড় হয়ে ওঠা। কয়েক হাজার ঘণ্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে আস্তিনের তলায়। এক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান এয়ারবাস ৩৮০-র কম্যান্ডার ছিলেন। বোয়িং এবং এয়ারবাস দু’ধরনের বিমান ওড়ানোয় তিনি সিদ্ধহস্ত।
ইন্দ্রনীল বলছেন, “কোনও প্রতিকূল মুহূর্তে প্রায় সব পেশার মানুষই একটু ভাবার সময় পান। মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগটুকু পান। আমাদের সে সুযোগ নেই। যখন ১০০ টন ওজন নিয়ে ঘণ্টায় আড়াইশো কিলোমিটার গতিতে মাধ্যাকর্ষণের প্রবল টানে মাটিতে নেমে আসে বিমান, তখন যদি খুব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র বিগড়ে যায়, ইঞ্জিন পুরোপুরি বন্ধও হয়ে যায়, সিদ্ধান্ত বদলের সুযোগটুকুও আপনার থাকে না। যা করতে হবে তখনই করতে হবে। এবং সেটা ঠিক না হলে মৃত্যু অনিবার্য।”
প্রতি দিন সারা ভারতে কয়েক হাজার উড়ান নামাওঠা করছে প্রায় দেড়শো বিমানবন্দর থেকে। সংখ্যাটা বিশ্বের নিরিখে সহজেই অনুমেয়। ভারতের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর দিল্লি ও মুম্বইয়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিমান ওঠানামা করে হিথরো, দুবাই, সিঙ্গাপুর, জেএফকে থেকে। মাসে ক’টা বিমান দুর্ঘটনার খবর আসে? একটাও নয়। কারণ, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ঠান্ডা মাথায় নিয়ম মেনে নিরাপদে যাত্রীদের নামিয়ে আনেন পাইলটরা। সব সময়েই যে আবহাওয়া ও পরিস্থিতি অনুকূল থাকে তা নয়। টেক-অফ করার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে তা পুরোপুরি অকেজো করে দেওয়ার ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনই যে কোনও মুহূর্তে যন্ত্র বিগড়ে যাওয়ার ঘটনাও তো ঘটে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু রানওয়ে ছোঁয় বিমান। বাড়ি ফেরার পথে যাত্রীরা জানতেও পারেন না, দুটো মানুষের দক্ষতার ফসল হিসেবে তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারলেন।
কী করে এটা সম্ভব?
ইন্দ্রনীল, জয়দীপের মতো অভিজ্ঞ পাইলটদের কথায়, নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে ফিট রাখতে হয় প্রতিটি মুহূর্তে। কাজটা শুনতে যতটা সহজ, করতে ততটা নয়। শারীরিক ভাবে ফিট রাখার জন্য নাহয় জিম রয়েছে। শরীরচর্চা রয়েছে। খাদ্যাভ্যাস রয়েছে। কিন্তু, মানসিক ভাবে ফিট রাখার সঠিক মন্ত্র সম্ভবত কারও জানা নেই। আত্মীয় বা প্রিয়জন বিয়োগ, স্ত্রী বা বান্ধবীর সঙ্গে মনোমালিন্য, ছেলেমেয়েদের শরীর খারাপ-সহ আরও হাজারও কারণ থাকে মনখারাপের। কিন্তু, সেই মনখারাপ নিয়ে ককপিটে বসলে তার প্রভাব পড়ে নিশ্চিন্ত নিরাপদ উড়ানে। তাই, যতই মনের কষ্ট থাক না কেন, প্রতিটি উড়ানের আগে বড় একটা শ্বাস নিয়ে তা ঝেড়ে ফেলতে হয়। নিজেকে বোঝাতে হয়, আমার হাতের মধ্যে এতগুলো মানুষের প্রাণ। যদিও বলা যতটা সহজ, করাটা কিন্তু নয়।
সামাজিক জীবন, ছেলেমেয়েদের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, এমন অন্য আরও অনেক সামাজিক অনুষ্ঠান এবং আরও বহু কিছুর বলিদানের পরিবর্তে মেলে এক পাইলটের জীবন। শীত-গরমের ছুটিতে আর দশটা মানুষ যখন পরিবার-বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পাহাড়ে বা সমুদ্রসৈকতে আনন্দে মশগুল, তখন দূরপাল্লার উড়ানে সামনে অনন্ত আকাশ নিয়ে বসে থাকেন পাইলট। সপ্তাহান্তে বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে দু’পাত্তর খেয়ে আমি-আপনি যখন আরামে বাড়ি ফিরে আসি, তখন পাইলটকে গুনতে হয় সময়। উড়ান ধরার ১২ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত ছোঁয়া যাবে না মদিরা। তারও আগে খাওয়ার সময়ে নিজেকে সংযত রাখতে হবে। উড়ানে ওঠার আগে বাধ্যতামূলক ব্রেথ অ্যানালিসিসে যদি ধরা পড়ে যাও, তা হলে প্রথম বারের জন্য তিন মাস সাসপেন্ড। দ্বিতীয় বারের জন্য তিন বছর।
কঠোর এক অনুশাসন চলে সারা জীবন ধরে। বদলে যায় দেহের ঘড়িও। ভোর পাঁচটার উড়ানের জন্য রিপোর্ট করতে হয় ভোর চারটের সময়ে। উঠতে হয় রাত দুটোয়। পর পর দু’রাত এই আর্লি মর্নিং ফ্লাইট করলে তৃতীয় দিন ছুটি থাকলেও রাতে ঘুম আসতে চায় না। শরীর তখন জবাব দিতে চায়। মরে যায় খিদে। আবার সতর্ক থাকতে হয় শরীর নিয়ে। দূরপাল্লার উড়ানে একের পর এক টাইম জ়োন বদলে যায়। দেহের উপরে তার প্রভাব পড়ে বিস্তর। বিদেশে পৌঁছে ভিন্ন টাইম জ়োনে ঢুকে হোটেলের নরম বিছানায় শুধু এ পাশ-ও পাশ করে কেটে যায় রাত। কিন্তু ফিরতি উড়ান শুরুর আগে ঝেড়ে ফেলতে হয় যাবতীয় ক্লান্তি।
শারীরিক ভাবে ফিট থাকতে নিয়মিত নিজের ব্লাড প্রেশার, ব্লাড শুগারও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ফলে অনুষ্ঠানবাড়িতে, পার্টিতে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তা হয়ে ওঠে না। সজাগ থাকতে হয় দৃষ্টিশক্তি নিয়ে। এ ছাড়াও রক্তে হিমোগ্লোবিন, কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক না থাকলে রক্ত পরীক্ষার পরে বসিয়ে দেওয়া হয় পাইলটদের। জয়দীপের কথায়, চল্লিশ পেরনোর পরে বহু পুরুষের কোলেস্টেরল এমনিতেই বেড়ে যায়। কিন্তু, পাইলটদের ক্ষেত্রে তা বাড়লে চলবে না। বাড়লেই বসিয়ে দেওয়া হবে। যত ক্ষণ না পর্যন্ত সেই হিমোগ্লোবিন বা কোলেস্টেরল আগের অবস্থায় ফিরবে, তত দিন উড়তে পারবেন না তিনি। আর না উড়লে বেতনের অর্ধেকটাই তো কাটা যাবে। কারণ, কত ক্ষণ উড়ছেন তার উপরে নির্ভর করে পাইলটদের বেতনের বড় অংশ।
বিমানসেবিকাদের সঙ্গে ‘মিষ্টি’ সম্পর্ক?
এ নিয়ে প্রচুর মুখরোচক গল্প চালু রয়েছে। স্মার্ট, সাদা ধবধবে পোশাক পরা, ছিপছিপে পাইলট। আর সুন্দরী, তন্বী বিমানসেবিকা। কথায় আছে, আগুনের কাছে বারুদ থাকলে তা জ্বলে উঠবেই। কিন্তু, বেশির ভাগ সময়েই এই ধরনের সম্পর্কের পিছনে ভয়ানক একাকিত্ব কাজ করে। বিশেষত দূরপাল্লার উড়ানে ১০-১২ ঘণ্টা ওড়ার পরে এক অজানা শহরে গিয়ে ২৪ ঘণ্টা বা কখনও তারও বেশি সময় একা কাটাতে হয় পাইলটদের।
ইন্দ্রনীল বলেন, “এমন হয়েছে, আমি আমস্টারডামে নেমেছি। হাতে ২৪ ঘণ্টা। কত ক্ষণ আর হোটেলের ঘরে নিজেকে বন্দি রাখা যায়! একা একা হাঁটতে বেরিয়ে গিয়েছি শহরে। কিছু কেনাকাটা করে ফিরে এসে পুলে একা কিছুটা সময় কাটিয়ে হয়তো ছোট একটা পেগ নিয়ে রেস্তরাঁয় বসে একা ডিনার করে ঘরে ফিরে এসেছি। এক বার নয়, বহু বার এমন হয়েছে। এই একা থাকার অভ্যেসটার সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছে।”
অনেক সময়ে এই একাকিত্ব থেকে সম্পর্কের সূচনা হয়। শুধু বিমানসেবিকা নয়, বিদেশের হোটেলে কর্মরত যুবতীর সঙ্গেও হয়। কিন্তু, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের সম্পর্ক স্বল্পস্থায়ী। যে একা পাইলট অন্য শহরে গিয়ে পাঁচতারা হোটেলে একা ঘরে রয়েছেন, সেই একই হোটেলের অন্য ঘরে রয়েছেন পছন্দের বিমানসেবিকা। একাকিত্ব কাটানোর জন্যই খানিকটা সময় তাঁরা এক সঙ্গে কাটাতে চান। সম্পর্কের সূচনা হয়। বিবাহিত পাইলট ও বিমানসেবিকার ক্ষেত্রেও হয়েছে। অজস্র উদাহরণ রয়েছে। এ নিয়ে পরে অশান্তি এবং তা থেকে মানসিক টানাপড়েনও হয়েছে। যা কখনও প্রভাবিত করেছে পেশাকেও। তখন সব কিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন করে মনোনিবেশ করতে হয়েছে কাজে, সংসারধর্মে। কোথাও অবশ্যম্ভাবী হয়ে গিয়েছে বিচ্ছেদ।
আবার পেশাগত জীবনের শুরুতে এ ধরনের সম্পর্ক থেকে দীর্ঘ সুখী দাম্পত্যজীবনের সূচনাও হয়েছে। তার উদাহরণও কম নয়। বিয়ে করার পরে সংসারের স্বার্থে অনেক বিমানসেবিকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। সে-ও এক নতুন উড়ান। তবে মাটির পৃথিবীতে। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy