গণবিক্ষোভ: গত বছরে শ্রীলঙ্কার কলম্বোয়, প্রেসিডেন্সিয়াল সেক্রেটারিয়েট-এর প্রাঙ্গণে সমবেত বিদ্রোহী জনগণ। রাজাপক্ষে মলদ্বীপে পালিয়ে যাওয়ার পর।
১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের সময় আমার বয়স এক্কেবারে কম। ক্রিকেট তেমন বুঝতাম না, তবে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ইডেন গার্ডেনসে সে দিন আমিও ছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরার পথে সেই প্রথম শ্রীলঙ্কা দেশটাকে চেনা। অর্জুন রণতুঙ্গা, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনৎ জয়সূর্য, মুথাইয়া মুরলীধরনরা আস্তে আস্তে হয়ে উঠলেন গোটা কৈশোরের নায়ক। উপমহাদেশের ক্যারিবিয়ানস। ভারতের পায়ের কাছে সমুদ্রে ঘেরা রাবণের দেশ, বিভীষণেরও দেশ। ইডেনের সেই অভিশপ্ত সন্ধ্যার ছাব্বিশ বছর পর রাবণরাজার দেশে এমন আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানা ঘটে যাবে, তা আর কে জানত! অশোকবনে বন্দি গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে না পারলেও দ্বীপরাষ্ট্রের মানুষের প্রতিবাদের আগুন রীতিমতো টলিয়ে দিয়েছিল শাসকের গদি। মহাপরাক্রমশালী প্রেসিডেন্টকে পালাতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে। গোটা পৃথিবী অবাক হয়ে দেখেছিল শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক ‘আরাগালায়া’ আন্দোলন। ‘আরাগালায়া’র অর্থ ‘সংগ্রাম’। সংগ্রামই বটে! দক্ষিণ এশিয়া শেষ কবে দেখেছে জনতার এমন স্বতঃস্ফূর্ত অলৌকিক উত্থান! বিপুল তীব্রতায় সেই আন্দোলন আছড়ে পড়েছে শাসকের অলিন্দে, দেশছাড়া করেছে শাসককে, কিন্তু আন্দোলনের মূল সুরটি ছিল অহিংস।
শ্রীলঙ্কার বন্ধুরা বলছিলেন, তাঁদের লড়াই ছিল ‘প্রায় বিপ্লব’, অথবা অন্য ভাবে দেখলে ‘অসম্পূর্ণ বিপ্লব’। বহু বছরের স্বৈরাচারী শাসনের উচ্ছেদ ঘটানো গিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রোথিত সমস্যাগুলির সমাধান এখনও হয়নি। আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তার নেতৃত্ব কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল বা নেতার উপর নির্ভরশীল ছিল না। রেজিমেন্টেশনের নিগড়ে বাঁধা ছিল না কোনও কিছুই। হয়তো সেই কারণেই একটি পর্যায়ের পর আর সাফল্য আসেনি। থমকে গিয়েছে ‘আরাগালায়া’। রাজাপক্ষের সাম্রাজ্য উৎখাত হওয়ার পর তাঁদেরই দীর্ঘ ছায়ায় মসনদে বসেছেন রনিল বিক্রমসিংঘে। রাষ্ট্রীয় প্রত্যাঘাতের মুখে পিছু হটেছেন বিক্ষোভকারীরা। সেই লঙ্কাকাণ্ডের এক বছর পর শ্রীলঙ্কার গ্রাম-শহর-মফস্সল চষে বোঝা গেল, ‘আরাগালায়া’র পরের শ্রীলঙ্কা আর ঠিক আগের মতো নেই। এলটিটিই বনাম রাষ্ট্রের দীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাস যেমন স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে দেশটির শরীরে, ‘আরাগালায়া’ও ঠিক তেমন। এই অসম্পূর্ণ বিপ্লবের নৌকো হয়তো সাফল্যের তট ছুঁতে পারেনি। কিন্তু সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহসের পালে হাওয়া দিয়েছে দেদার। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই আন্দোলন চরিত্রগত ভাবেই আগেকার লড়াইগুলির চেয়ে আলাদা।
কলকাতা থেকে কলম্বো যাওয়ার ঝকমারি হল, হয় মাঝরাত্তিরে বেরোতে হবে, নয়তো পৌঁছতে মাঝরাত্তির হবে। চেন্নাই হয়ে যাওয়া। নতুন দেশ। রাস্তাঘাট চিনি না। বন্ধুবান্ধব আছে বটে, তবে তাদের আর কাঁহাতক বিরক্ত করা যায়। তার উপর শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় টাকা ভাঙানো মুশকিল। সঙ্গে ডলার ছিল বলে রক্ষে। এয়ারপোর্টের বাইরে যখন বেরোলাম, তখন দুপুর। আকাশের মুখ ভার। চট করে ট্যাক্সি নিতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে করল না। খানিকটা হাঁটলেই চোখে পড়ল প্রচুর অটো দাঁড়িয়ে আছে। ওঁর অবশ্য তাদের ‘টুক’ বলে ডাকেন। এয়ারপোর্ট থেকে আমার হোটেল অনেকখানি। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। শ্রীলঙ্কার টাকায় প্রায় হাজার চারেক খসল। তবে ভারতীয় টাকায় হিসেব করলে হাজার খানেক মতো। টুক-চালক ছেলেটির বয়স বছর পঁচিশ। দরাদরি করার সময় সে নিজেই বলল, “দেশটার কী হাল হয়েছে জানেনই তো! সব জেনেই তো এসেছেন! এখনও দর করতে ইচ্ছে করছে?”
এমন মুখঝামটা খেয়ে আর কী-ই বা বলা যায়! প্রায় সওয়া ঘণ্টার পথ। তুমুল বৃষ্টি নামল। চার দিক অন্ধকার। নজর চলে না। আস্তে আস্তে চলেছি, সঙ্গে তুমুল আড্ডা। কখনও ক্রিকেট, কখনও রাজনীতি, তবে প্রতি দিনের খাইখরচ নিয়ে আড়ষ্ট ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলে চলেছে ছেলেটি। বলছিল, “আমি কখনও রাজনীতি করিনি। তবে আরাগালায়ার দিনগুলিতে রাস্তায় ছিলাম। দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটত গল ফেস গ্রিনে, আরও হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম হয়তো একটা মির্যাকল হবে। গোতাবায়া রাজাপক্ষে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যাবে অনেক কিছু। কিন্তু সেটা হল না...”
বৃষ্টি থামার পরে দেখলাম, কলম্বো ভারী চমৎকার শহর। চার দিকে প্রচুর সবুজ। শহরের মধ্যে প্রচুর জলাশয়। খুব ছিমছাম, সাজানো গোছানো শহর। ক্যান্ডিও তাই। এই দু’টি শহরকে পশ্চিম ইউরোপের বড় শহরগুলির সঙ্গে তুলনা করাই যায়। মোড়ে মোড়ে, রাস্তা পেরোনোর জায়গায় ঠিক ইউরোপের মতোই পথচারীদের জন্য পৃথক সিগন্যালের ব্যবস্থা। পরে অবশ্য শুনলাম, কলম্বোর এই সৌন্দর্যায়ন রাজাপক্ষেদেরই অবদান। এক দিকে তাঁরা শহরকে সাজিয়েছেন, অন্য দিকে গরিবদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক এলাকায়। সে যাই হোক, ভারী চমৎকার লাগল শ্রীলঙ্কার মানুষজনকে। যে ক’দিন ও দেশে ছিলাম, গ্রাম শহর মফস্সলে টইটই করে ঘোরার ফাঁকে কাউকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে দেখলাম না।
কলম্বো শহরটা জুড়ে প্রচুর গির্জা আর মসজিদ। মোড়ে মোড়ে বৌদ্ধ মন্দির। বেশ কিছু হিন্দু মন্দিরও। আমি যেখানে ছিলাম, সেটা শহরের একেবারে কেন্দ্রে। সমুদ্রের তীরে যেখানে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল ‘আরাগালায়া’র দিনগুলিতে, সেই গল ফেস গ্রিন হাঁটাপথে মিনিট দশেক। কলম্বোর অলিগলিতে ঘুরছি, কথা বলছি সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করছি কেমন ছিল ‘আরাগালায়া’র দিনগুলি। এক জন বছর পঞ্চাশের ভদ্রমহিলা এক দিন পাকড়াও করলেন ইউনিয়ন প্লেসের এক কোণে। বললেন, “বিদেশ থেকে এসে তোমার মতো যে সব সাংবাদিক আরাগালায়াকে বুঝতে চাইছে, তাদের পক্ষে সবটা বুঝে ওঠা কঠিন। ‘আরাগালায়া’ তো আমরা করেছি। আমাদের মতো একদম সাধারণ মানুষই আরাগালায়ার স্রষ্টা। আমি কোনও দিন রাজনীতি করিনি। স্কুলে পড়াই। রাজাপক্ষেকে খারাপ লাগত না। গত বছরের শুরুর দিকে হঠাৎ দেখলাম জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দ্রুত অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। নাতনিটা আমার কাছে থাকে। ওর গুঁড়ো দুধ জোগাড় করতে পারছি না। রাতের পর রাত বিদ্যুৎ নেই। গাড়িতে ভরার পেট্রল-ডিজেল নেই। এলাকার ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে হইহই করছিল। আমিও এই বুড়ো বয়সে রাস্তায় নেমে এলাম। লোকে বলল গল ফেস গ্রিনে যেতে হবে। আমরা দল বেঁধে হাঁটতে শুরু করলাম। সবাই হাঁটছি। পাড়াসুদ্ধু লোক। এ ভাবেই শুরু হয়ে গেল আরাগালায়া...”
দিন কয়েক পরের সকালবেলা। কলম্বো থেকে খানিকটা দূরের ছোট্ট মফস্সল শহর। নাম কেলানিয়া। সকাল দশটা নাগাদ সেখানে নিয়ে গেলেন শ্রীলঙ্কার ইন্টার-ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস’ ফেডারেশন-এর কয়েক জন কর্মী। এই সংগঠনটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ছাত্র সংগঠন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতাবলম্বী পড়ুয়ারা এর সদস্য। তবে প্রভাব বেশি ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টি-র। কলম্বো ছাড়তেই চার পাশে গাঢ় সবুজ। মধ্যবিত্ত এলাকা, কিন্তু চমৎকার সব ছোট ছোট বাগানঘেরা বাড়ি। আমরা গেলাম একটি বাগানে ঘেরা দোতলা বাড়িতে। সেখানেই আমার দু’দিন থাকার কথা। আমি শ্রীলঙ্কায় গিয়েছি ‘আরাগালায়া’ আন্দোলনের এক বছর পর দ্বীপরাষ্ট্র কেমন আছে, তার খোঁজখবর নিতে। কেলানিয়ার ওই বাড়িতে সে দিন কলম্বো এবং তার আশপাশের অঞ্চলের আরাগালায়ার সঙ্গে যুক্ত এক ঝাঁক সমাজকর্মীর বৈঠক করার কথা। আমি সেই বৈঠকে আমন্ত্রিত।
জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই রকম বৈঠক ওঁরা প্রায়ই করে থাকেন। আন্দোলনের রূপরেখা কেমন হবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, এ সব তো আছেই। ওঁদের কাছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, আগামী দিনে বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান কী হবে, তা নির্ণয় করা। গত বছর যে ‘আরাগালায়া’ আন্দোলন গোটা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তার প্রধান দাবি ছিল রাজাপক্ষে সাম্রাজ্যের অবসান। এক বছর পেরিয়ে এসে আন্দোলনকারীরা অনুভব করছেন, এই কেন্দ্রীয় দাবিটি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশে সরিয়ে দিয়েছে। সংখ্যালঘুর (বিশেষত তামিল) অধিকারের প্রশ্ন, লিঙ্গসাম্যের প্রশ্ন, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের প্রশ্নগুলির যতখানি পরিসর পাওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। ফলে, আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে তাঁরা নিজেদের খামতিগুলো খুঁজে বার করতে চাইছেন। চাইছেন আন্দোলনটিকে যত বেশি সম্ভব ইনক্লুসিভ করে তুলতে। সেই জন্যই গোটা দেশ জুড়ে চলছে অসংখ্য ছোট-বড় আলোচনাসভা।
এই রকম আলোচনাসভা আমি আগে কখনও দেখিনি। একটি রাজনৈতিক আন্দোলন প্রকৃতপক্ষেই কতখানি বহুত্ববাদী হয়ে উঠতে চায়, তার প্রমাণ এই আলোচনা। একটি বড়সড় হলঘরে গোল করে সাজানো চেয়ার। শ’তিনেক মানুষ বসে আছেন৷ তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সব ধরনের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতি ও শ্রেণিগত পরিচয়ের মানুষ। কমিউনিস্ট নেতার পাশে বসে আছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু, তাঁর পাশেই এক জন তামিল। মুসলিম ধর্মগুরু আর খ্রিস্টান পাদ্রি পাশাপাশি বসে আলোচনা করছেন। আছেন শহুরে গরিব, বেকার যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, চলচ্চিত্র সমালোচক, নামজাদা সাংবাদিক। সে দিন তাঁদের আলোচনার বিষয় ‘জাতি প্রশ্ন’। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়গুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন তাঁরা। উপস্থিত আছেন প্রাক্তন এলটিটিই গেরিলা, গৃহযুদ্ধে সর্বস্ব হারানো মানুষ, প্রাক্তন সেনাকর্তা। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয়, কথাবার্তার মূল সুরটি আত্মসমালোচনার। বামপন্থী দল ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক বলতে উঠে সরাসরি সমালোচনা করলেন নিজেদের রাজনৈতিক ইতিহাসের। শ্রীলঙ্কার বড় অংশের বামপন্থীরা দশকের পর দশক যে ভাবে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের পক্ষে ওকালতি করেছেন, তার বিবরণ দিলেন নিজেই। একই রকম ভাবে, বিভিন্ন বৌদ্ধ সংগঠনের প্রতিনিধিরা তুলে ধরলেন সিংহলি বৌদ্ধ সমাজের ভিতরে বহমান সমস্যাজনক স্রোতগুলির কথা। আলোচনা হচ্ছে মূলত সিংহলি এবং তামিলে। আমার পাশে বসে এক জন তর্জমা করে দিচ্ছেন ইংরেজিতে।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, তীব্র তর্কাতর্কি চলছে, কিন্তু কেউ কাউকে কটাক্ষ বা ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন না। তামিলরা তুলে ধরছেন তাঁদের যন্ত্রণার কথা, বর্ণনা করছেন গৃহযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেও তাঁদের কেমন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হয়, তার অনুপুঙ্খ। প্রশ্ন করছেন ‘আরাগালায়া’কে নিয়েও। জানতে চাইছেন, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ওই আন্দোলনও তামিলদের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারল না! উপস্থিত বামপন্থী সংগঠকদের তীব্র সমালোচনা করছেন তাঁরা। দায়ী করছেন তাঁদের জাতিগত বৈষম্যের জন্য। অথচ বামপন্থীরা উত্তেজিত হচ্ছেন না, পাল্টা কটাক্ষ করছেন না, হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন ভুলত্রুটি, শান্ত ভাবে প্রত্যুত্তর করছেন। বৈঠকের মাঝে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। এক জায়গায় সাজিয়ে রাখা প্লেট, পাশেই খাবার। সকলেই নিজেদের খাবার বেড়ে নিলেন। খাওয়ার পরে নিজেরাই ধুয়ে রাখলেন নিজেদের প্লেট। রাতে শেষ হল বৈঠক। হলঘরটি সাফ করা হল হাতে হাত মিলিয়ে। মিটিং শেষে খেতে খেতে মনে পড়ল, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় বামপন্থী দল ‘জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা’ দু’বার সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিল, সত্তর দশকের শুরুতে এবং আশির দশকের শেষে। শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হয় সেই চেষ্টা। এর পর দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ। অসংখ্য প্রাণহানি। ‘আরাগালায়া’ বোধ হয় সচেতন বা অসচেতন ভাবে এই রক্তাক্ত অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে। সে স্থিত হয়েছে অহিংসায়, বহুত্বের আদর্শে। আন্দোলনের চরিত্র অনেকটা যেন বিয়াল্লিশের অগস্ট বিদ্রোহের মতো। বহু মত ও পথের মানুষ নেমে এসেছেন রাজপথে। তাঁরা হিংসা চান না, কিন্তু শাসকের আক্রমণের মুখে সক্রিয় প্রতিরোধ করতেও দ্বিধা করেন না।
শ্রীলঙ্কার এ মাথা-ও মাথা চষে মনে হল, এই ‘ইনক্লুসিভ’ হতে চাওয়া, ভিন্নমত শুনতে চাওয়া এবং ক্রমাগত নিজেদের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাওয়াই ‘আরাগালায়া’-র সবচেয়ে বড় জোরের জায়গা। আন্দোলনের কর্মীদের একটি বড় অংশ বহুত্ববাদে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের আলখাল্লায় গোটা আন্দোলনটিকে ঢেকে দিতে চাইছেন না তাঁরা। বরং গড়ে তুলতে চাইছেন বিভিন্ন ভাবনার মধ্যে কথোপকথনের একটি সজীব, প্রাণবন্ত পরিসর। ভারত এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় অভ্যস্ত আমার চোখে এই চেষ্টা খানিক নতুন ঠেকে বইকি!
কলম্বো বিমানবন্দরে নেমেছিলাম ৯ মে। নামতেই খবর পেলাম, এক মহিলা সে দিন সকালে জাতীয় পতাকা হাতে হাঁটছিলেন। গলায় ঝোলানো পোস্টারে এক বছর আগের সরকারি নিপীড়নের কথা লেখা ছিল। তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে সরকার। আমার সঙ্গী সাংবাদিক বলছিলেন, ঠিক এক বছর আগে, ২০২২ সালের ৯ মে ‘আরাগালায়া’ আন্দোলনকারীদের উপর রাজাপক্ষে সাম্রাজ্য নামিয়ে এনেছিল তীব্র অত্যাচার। কলম্বোর আশপাশের এলাকা থেকে দলে দলে সরকারপন্থী ক্যাডাররা জড়ো হয়েছিলেন কলম্বোয়। গায়ের জোরে সহিংস পদ্ধতিতে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বিক্ষোভকারীদের। ফল হয়েছিল উল্টো। হাজার হাজার জনতার প্রতিরোধের মুখে কার্যত পালিয়ে গিয়েছিলেন হামলাকারীরা। গোটা শ্রীলঙ্কা জুড়ে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন রাজাপক্ষের সমর্থকেরা। শেষ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে আসা শাসক শিবিরের একের পর এক নেতার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। সারা দেশ জুড়ে স্লোগান উঠেছিল, ‘গোতা গো হোম’।
কলম্বো, ক্যান্ডির রাস্তাঘাটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, শ্রমিক এলাকায় যাঁকেই প্রশ্ন করছি, গত বছর কী ভাবে শুরু হয়েছিল ‘আরাগালায়া’ আন্দোলন, অদ্ভুত উত্তর পাচ্ছি। ওঁরা বলছেন, কলম্বোর মতো বড় শহরগুলিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ‘কিউ’ (লাইন) থেকে। পেট্রল-ডিজ়েল নেই, খাবার নেই, বাচ্চাদের গুঁড়ো দুধ নেই। হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষারত। কখনও রোদে পুড়ছেন, কখনও বৃষ্টিতে ভিজছেন। অপেক্ষা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। খাবারের দাম আকাশছোঁয়া। বিদ্যুৎ নেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতের পর রাত। বাজার অগ্নিমূল্য। অসহায়, ক্ষুব্ধ মানুষ বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। মোড়ে মোড়ে জটলায় দাঁড়ানো মানুষ, দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়ানো মানুষ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাবে জর্জরিত মানুষ অবশেষে ফেটে পড়লেন বিক্ষোভে। একদম আচমকা। কোনও সংগঠিত রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়াই। খবর এল, রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা— প্রেসিডেন্টের কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির বাসভবনের সামনে শুরু হয়েছে জমায়েত। ভিড় বাড়ছে সমুদ্রতীর, গল ফেস গ্রিনে। এই খবর আসতেই খাবার, পেট্রল, মুদিখানার জন্য অপেক্ষারত লাইন থেকেই শুরু হল স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। একটা, দুটো, তিনটে, দশটা মিছিল। ছোট বড় মাঝারি, হাজার হাজার মিছিল। কোনও রাজনৈতিক দল নেই, গণসংগঠনের নেতৃত্ব নেই, কোনও পতাকা নেই, ব্যানার নেই, সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ। মানুষ মুখে মুখে স্লোগান তৈরি করছেন, গান গাইছেন, যে যেমন করে পারেন নেমে পড়েছেন রাস্তায়। আমার সঙ্গে ছিলেন নলিনী, নারী আন্দোলনের কর্মী। বলছিলেন, “সে এক অভূতপূর্ব, আশ্চর্য দৃশ্য! হাজার হাজার লোক রাস্তায়। দলে দলে মানুষ চলেছেন গল ফেস গ্রিনের দিকে। আক্ষরিক অর্থেই জনতার মহোৎসব! সব ধর্মের, ভাষার, জাতির মানুষ রাস্তায়। মুখে স্লোগান— গোতা গো হোম— পদত্যাগ করো, বাড়ি যাওগোতাবায়া রাজাপক্ষে।”
এই বিক্ষোভকারীরা অধিকাংশই শহুরে মধ্যবিত্ত। তাঁদের অনেকেই কিছু দিন আগেও ছিলেন গোতাবায়া রাজাপক্ষের সমর্থক। মনে রাখা দরকার, শেষ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে এসেছেন গোতাবায়া। জিতেছেন রাজাপক্ষে পরিবারের বাকিরাও। শ্রীলঙ্কার ৭৫ শতাংশ সিংহলিদের মধ্যে তখন বিপুল জনপ্রিয় গোতাবায়া। ‘অপর’ (অন্যান্য) তামিলদের বিরুদ্ধে বিজয়ের প্রতীক তিনি। ‘আরাগালায়া’ আন্দোলনে অংশ নেওয়া তামিল ছাত্রীরা বলছিলেন, তাঁরা রীতিমতো ভয় পেতেন রাজাপক্ষে শব্দটিকে। সিঁটিয়ে থাকতেন। শুনতে শুনতে অজান্তেই মনে পড়ে ভারতের কথা।
রাজাপক্ষেদের যে পদত্যাগ করতে হবে বা দেশ ছেড়ে পালাতে হবে, আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগেও এ সব ছিল কষ্টকল্পনা। এক দিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ, আর অন্য দিকে তামিল সংখ্যালঘুদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষে ভর করেই রাজাপক্ষের উত্থান।
এলটিটিই শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই জাতিবিদ্বেষের খানিকটা শিকার মুসলিমরাও। অঙ্কটা ছিল সহজ। ৭৫ শতাংশ সংখ্যাগুরুর অধিকাংশের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারলেই গদি সুনিশ্চিত। কিন্তু অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্র হতেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল সব। প্রতি দিনের বেঁচে থাকার লড়াই, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব বদলে দিল সমীকরণ। জীবনযাপনের জ্বলন্ত সঙ্কট রাজাপক্ষের সমর্থকদেরই দাঁড় করাল তাঁর বিরুদ্ধে। এক দল জড়ো হলেন সমুদ্রের ধারে। এক দল বসে পড়লেন রাষ্ট্রপতি ভবনের কাছে। ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন ছেলেমেয়েরা। অনলাইনে ঝড় তুললেন ব্লগাররা।
এর পরের ঘটনা গোটা পৃথিবী দেখেছে। টানা কয়েকটা মাস রাজপথে নতুন ইতিহাস লিখেছেন শ্রীলঙ্কার মানুষ। শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রনেতাদের প্রাসাদ দখল করে নিয়েছেন তাঁরা। জলকেলি করেছেন সুইমিং পুলে। মহার্ঘ সিংহাসনে বসে সেলফি তুলেছেন দেদার। তবে এই জাদুবাস্তবতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। প্রত্যাঘাত করেছে শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্র। রাজাপক্ষেদের অবর্তমানে তাঁদের দীর্ঘ ছায়া নিয়ে মসনদে বসেছেন রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। ব্যাপক দমন-পীড়নের মুখে পিছু হটেছেন আন্দোলনকারীরা। অসংখ্য অ্যাক্টিভিস্টকে জেলে পোরা হয়েছে। কড়া নজরদারি চলছে দেশের সর্বত্র। নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় স্থানীয় নির্বাচন পিছিয়েদিয়েছে সরকার।
খানিকটা থমকে থাকা এই সময়ে নিজেদের মধ্যেকার বোঝাপড়াগুলি ঝালিয়ে নিচ্ছেন ‘আরাগালায়া’র কর্মীরা। তাঁরা জোর দিচ্ছেন জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন নির্মাণে। ওঁরা একে বলছেন ‘পিপল’স কাউন্সিল’। অঞ্চল ধরে ধরে গড়ে উঠছে এই ধরনের সংগঠন। কোনও রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া, সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে এই কাউন্সিলগুলি। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যেমন থাকছেন, তেমনই থাকছেন শ্রমিক-নারী-কৃষক ও ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা। থাকছেন কোনও রাজনৈতিক দল না করা মানুষজন, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনও। তাঁরা কথা বলছেন এলাকার সমস্যা নিয়ে, আলোচনা করছেন কী ভাবে নিশ্চিত করা যায় অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র। কথায় কথায় উঠে আসছে সংসদ ও রাজনৈতিক দলনির্ভর গণতন্ত্রের বাইরের কোনও বিকল্প গণতন্ত্র নির্মাণের ভাবনাও।
মধ্য শ্রীলঙ্কার পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল এক দল তামিল ছাত্রীর সঙ্গে। হাপুথালে শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরে একটি ছোট্ট গ্রামের ‘আরাগালায়া’র সংগঠক তারা। প্রধানত তামিল চা-শ্রমিকরা থাকেন এই এলাকায়। অবর্ণনীয় দারিদ্র। ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা। তার সঙ্গে জাতিবিদ্বেষী অত্যাচার। ছবির মতো সুন্দর চার পাশ। কিন্তু চা-শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ। গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেখছিলাম পানীয় জলের অভাব। নর্দমার মতো জায়গা থেকে জল তুলে সংসারের কাজকর্ম হয়। কলম্বো বা ক্যান্ডির মতো ঝকঝকে শহরের সঙ্গে এই গ্রামগুলির ঠিক কতখানি পার্থক্য, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ভাঙাচোরা বাড়ি, অধিকাংশ বাসিন্দার জমির মালিকানা নেই। কোনও মতে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন মানুষগুলো। তার উপরে রয়েছে ‘তামিল’ পরিচিতির কারণে নানাবিধ হেনস্থা।
এই সব এলাকাতেও আছড়ে পড়েছিল গণআন্দোলন ‘আরাগালায়া’র ঢেউ। কলম্বো থেকে বহু দূরে, পাহাড়-নদী-চা বাগানে ঘেরা এই জনপদগুলিও উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোতাবায়া রাজাপক্ষে বিরোধী আন্দোলনে। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এক জন তামিল চা-শ্রমিকের বাড়িতে। তাঁর মেয়ের নাম শ্রী। বয়স বছর কুড়ি। তীব্র অভাব। অল্প বয়স থেকেই কাজ করতে হয়। ফলে লেখাপড়া বেশি দূর হয়নি। মেয়েটি কাজ করে চা-বাগানে। শ্রী বলছিল, “আরাগালায়া খুব গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। এই আন্দোলন দেখিয়ে দিল, আমরা, সাধারণ মানুষ চাইলে বিপুল শক্তিশালী শাসককেও তাড়াতে পারি। কিন্তু এই আন্দোলন মূলত কলম্বো শহরের বাসিন্দা বা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের লড়াই। গোতাবায়াকে তাড়ানোর দাবি আদায় হয়েছে ঠিকই। তবে আমাদের মতো শ্রমিক বা দরিদ্র জনতার দাবিগুলি অর্জিত হয়নি। পেট্রল, গুঁড়ো দুধ, বিদ্যুৎ ছিল না, তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রতিবাদ করেছিল। আমরা তাদের সমর্থন করেছিলাম৷ কিন্তু আমাদের কাছে তো এই সমস্যাগুলি নতুন নয়। দিনের পর দিন আমরা বিদ্যুৎ ছাড়াই থাকি। বছরের পর বছর এই এলাকার শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে। কলম্বো কেন্দ্রিক মানুষজন, এমনকি অধিকাংশ আন্দোলনকারী তার খবর রাখেন না। তাই আরাগালায়ার সময় আমরা বলেছিলাম চা-শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে। এটাই ছিল আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। কিন্তু সেই দাবি পূরণ হয়নি।”
প্রশ্ন করেছিলাম, এলটিটিই আন্দোলন এবং তামিল প্রশ্ন নিয়ে। এই এলাকায় অধিকাংশ মানুষই তামিল। উনিশ এবং বিশ শতকে ভারত থেকে তাঁদের নিয়ে আসা হয় চা-বাগানে কাজ করার জন্য। বছরের পর বছর তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে তীব্র জাতিবিদ্বেষী নিপীড়ন। এমনকি, তথাকথিত প্রগতিশীল শক্তির একাংশও তাঁদের দাগিয়ে দিয়েছেন ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির এজেন্ট’ হিসেবে। শ্রী এবং তাঁর বন্ধুরা বলছিলেন, ওঁদের মুখোমুখি হতে হয় এক দিনে জোড়া ফলার— হতদরিদ্র চা-শ্রমিক হওয়ার কারণে শ্রেণিগত নিপীড়ন, অন্য দিকে তামিল পরিচিতির কারণে জাতিগত নিপীড়ন। শ্রী বলছিলেন, “এলটিটিই যখন শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন আমরা খুবই ছোট। তাই কোনও স্মৃতিই প্রায় নেই। কিন্তু রাষ্ট্র কী ভয়াবহ অত্যাচার করেছিল, তার বহু গল্প শুনেছি। এলটিটিই-ও কিছু কম করেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক, দেশের বৃহৎ বামপন্থী দলও আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সেই বীভৎস নির্যাতনের পক্ষে ছিল।” শ্রী ওই এলাকায় ‘আরাগালায়া’র গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। বলছিলেন, “আরাগালায়ার বহু ইতিবাচক দিক রয়েছে। সে বহু সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। আমরা, শ্রমজীবী তামিলরা বহু দিন ধরে রাজাপক্ষেদের বিরোধী। তাঁদের গণহত্যার শিকার। স্বাভাবিক ভাবেই তামিলরাও আরাগালায়ায় অংশও নিয়েছিলেন। বিশেষ করে এই এলাকার তামিলরা। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির দাবিদাওয়া এবং তামিলদের কথা আন্দোলনে সে ভাবে উঠে আসেনি।”
সেই লঙ্কাকাণ্ডের এক বছর পর সারা শ্রীলঙ্কা জুড়ে ঘুরতে ঘুরতে বার বার মনে হচ্ছিল, কলম্বো শহরের ‘আরাগালায়া’র চরিত্রের সঙ্গে এই সব গ্রামীণ এলাকার আন্দোলনের খুব বেশি মিল নেই। এই অঞ্চলগুলি অনেক বেশি রাজনৈতিক, অনেক বেশি সচেতন। কলম্বোর যে সব মধ্যবিত্ত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে বেশ খানিকটা হতাশ। রাজাপক্ষের পরিবর্তে রনিল ক্ষমতায় এসে আন্দোলনের প্রভাব অনেকটাই মুছে দিতে পেরেছেন। সাময়িক হলেও ঠেকনা দিয়ে মধ্যবিত্তের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন বিদ্যুৎ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। ফলে ‘আরাগালায়া’র অভ্যন্তরে ‘ব্যবস্থা বদল’-এর যে দাবি উঠেছিল, তা এখন প্রায় কোণঠাসা বললেই চলে। কিন্তু গ্রামীণ শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এর চেয়ে খানিকটা আলাদা। ‘আরাগালায়া’-র প্রাথমিক সাফল্য (রাজাপক্ষে বিতাড়ন) যে-হেতু প্রান্তিক মানুষের সঙ্কটগুলি নিরসন করতে পারেনি, অথচ জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিয়েছে, তাই প্রান্তিক শ্রীলঙ্কা স্বপ্ন দেখছে আরও একটি আরাগালায়ার, যা হবে আগের তুলনায় অনেক বেশি ইনক্লুসিভ, কলম্বো-কেন্দ্রিকতার পরিবর্তে যার শিকড় প্রোথিত থাকবে দেশের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy