Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Smaranjit Chakraborty

চুয়ান্ন

আমরা খাদের পাশের রাস্তায় হাঁটছিলাম সে দিন। বিকেলে খুব বৃষ্টির পরে আচমকা মেঘ সরে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেরিয়ে পড়েছিল। সোনালি রং করা তাঁবু যেন কেউ খাটিয়ে রেখেছিল আকাশের এক মাথা থেকে আর এক মাথা অবধি।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আমি নিয়ে যাব বাড়ি! বাবাকে! যেন বাবা আমার কথা কত শোনে! বাবা কারও কথা শোনে না। আমি দেখেছি সেলফ-মেড ম্যানরা স্বভাবে সামান্য রাগী আর একগুঁয়ে হয়। সেই জন্যই বোধহয় তারা সফল হয় জীবনে। আমার বাবাও তাই। ফলে অফিসে গিয়ে আমি আদৌ বাবাকে কনভিন্স করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব কি না, জানি না। তা ছাড়া আমার মার্কেটিং স্কিল শূন্য। কাউকে কনভিন্স করতে পারি না আমি।

লাইনের একদম প্রথম অটোটার সামনের সিটে বসলাম আমি। অটোচালক ছেলেটির বয়স আমার মতোই। মাথার দু’পাশে চুল প্রায় নেই। কিন্তু মাঝখানে পপলার গাছের মতো চুল। তাতে আবার লাল নীল রঙের স্ট্রিক। গালে দাড়িও আছে। ভাল করে ছাঁটা। মা বলে দাড়িতে বেড়া দেওয়া। ছেলেটার জামার বুক খোলা। বুকের ওপরের অংশে একটা ট্যাটু দেখা যাচ্ছে। বাঘের মুখ। আমার আবার বাবার সেই প্রাইজ়টার কথা মনে পড়ল। আর সেটার সূত্র ধরে আবার মনে পড়ে গেল এনাকে। কিন্তু এ বারও কোনও ফিলিং হল না। ওই যে আগে একটা বুকে পেটে খামচে ধরা ফিলিং হত, সেটা নেই। কেন নেই জানি না। কিন্তু নেই। বরং আজ সকাল থেকে কেন কে জানে আমি আমার মোবাইলের বিরহে একটু একটু করে কাতর হচ্ছি। কিন্তু তা বলে যে ব্যবহার করছি তা নয়।

শুধু সকালে অফিসে বেরোবার আগে ড্রয়ার টেনে এক বার দেখেছিলাম জিনিসটাকে। দামি ফোন। কেমন নিঃসঙ্গ ভাবে একা পড়ে আছে। কালো এক খণ্ড গ্র্যানাইট যেন। এক বার মনে হয়েছিল মোবাইলটা তুলে চার্জে বসাই। কিন্তু তার পরেই নিজেকে আটকেছি। এমন তরলমতি হওয়া তো ভাল নয়। আমাকে শক্ত হতে হবে।

সুদীপ্ত সেই পাহাড়ে বলেছিল, “কেন এমন করে আছ, দাদা! এমন করে কী লাভ!”

“লাভ ক্ষতি তো নয়! জীবনে আমি কোনও কিছুই লাভ ক্ষতি ভেবে করি না। শুধু ভাবি, আমার একটা স্ট্যান্ড থাকবে না!”

আমরা খাদের পাশের রাস্তায় হাঁটছিলাম সে দিন। বিকেলে খুব বৃষ্টির পরে আচমকা মেঘ সরে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেরিয়ে পড়েছিল। সোনালি রং করা তাঁবু যেন কেউ খাটিয়ে রেখেছিল আকাশের এক মাথা থেকে আর এক মাথা অবধি। আমার মনে পড়েছিল আগের বছর ছোটা মাঙওয়া নামক এক জায়গার কথা। সেখান থেকে এই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কী যে বড় দেখা যায়!

আগের দিন চন্দন সিংয়ের অমন কথাবার্তার পরে আমি অনেক ক্ষণ চুপ করে ছিলাম। সে দিন বিশেষ কথা হয়নি।

সুদীপ্তও চুপ করেছিল। তবে পরের দিন আমরা আবার আড্ডা মারছিলাম যথারীতি। নানা জায়গায় ঘুরেছিলাম পায়ে হেঁটে। তার পর দুপুরে ভাল করে লাঞ্চ করেছিলাম। শেষে বৃষ্টি কমলে আবার বেরিয়েছিলাম। আর তখনই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে থমকে গিয়েছিলাম একদম।

সুদীপ্ত বলেছিল, “জীবন কী অদ্ভুত রকম সুন্দর! সেখানে তুমি কেন এমন করে আছ দাদা! এমন করে কী লাভ!”

আমার উত্তর শুনে সুদীপ্ত বলেছিল, “প্রেমে আঘাত পেয়েছ, না? নিশ্চয়ই আগে মেয়েটা নিজে থেকে এসেছে, তার পর তুমি তাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করামাত্র ডিগবাজি খেয়েছে!”

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।

সুদীপ্ত বলেছিল, “জানো দাদা, এই প্রেমে কষ্ট পাওয়া হল মনের ক্যানসার! সারা ক্ষণ উচাটন, কী যেন হারাবার ভয়, টেনশন। এই বুঝি ও ভুল বুঝল! এই বুঝি ও আমায় সরিয়ে দিল! এই বুঝি অন্য কারও সঙ্গে চলে গেল! এ সব কষ্ট নিয়ে কত দিন থাকা যায় বলো! আর কাকে বিশ্বাস করবে! রিয়েলের বদলে এখন ভার্চুয়ালের দিকে সবার আগ্রহ! যাকে ভাল লাগে, মানুষ যার ঘনিষ্ঠ হয়, সে নানা ভাল-মন্দ কথাও তো বলবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে সব ভাল লাগে না কারও। তার জায়গায় ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে অচেনা, নানা ধান্দা নিয়ে ঘোরা লোকজন বদ মতলবে যে সারা ক্ষণ লাইক নামক গ্যাস খাইয়ে যাচ্ছে, সেটাই ভাল লাগে! যে সত্যি ভালবাসে তাকেই জুতো খেতে হয়, খেতে হচ্ছে! আজেবাজে মনোযোগ পাওয়ার লোভ অনেকেই সামলাতে পারে না। মানুষ সারা ক্ষণ নিজের বেঁচে থাকার ভ্যালিডেশন চায়। ম্যাক্সিমাম মানুষজনেরই তো কোনও ইন্টিগ্রিটি নেই। সবাই ইনস্ট্যান্ট ফেমের জন্য মরে যাচ্ছে। প্রেম খারাপ নয়। কিন্তু এক সঙ্গে চল্লিশ জনকে নাচানো আমার মতে খারাপ! ফলে এমন যারা করে তাদের থেকে দূরে থাকো দাদা। যে তোমার গুরুত্ব বোঝে না তাকে হাটাও।”

আমি তাকিয়ে ছিলাম সুদীপ্তর দিকে।

সুদীপ্ত চশমা ঠিক করে বলেছিল, “যা বলছি ভেবে দেখো দাদা। আমি তোমার ব্যাপার জানি না। কিন্তু আন্দাজ করতে পারি। এমন অনিশ্চয়তায় থাকার চেয়ে ব্রেক আপ অনেক ভাল। সেটা যদি তোমার হয়ে যায়, তুমি বেঁচে গেলে! ইউ হ্যাভ সার্ভাইভড! মনের কষ্ট তো অন্য লোকে বোঝে না। তাই আমলও দেয় না। তাই বলছি, বাক আপ। লিভ ইয়োর লাইফ। ধান্দাবাজ, অপরচুনিস্টদের জন্য কেন তুমি বেকার কষ্ট পাবে!”

ধান্দাবাজ! অপরচুনিস্ট! এনা! আমি জানি না এনা এমন কি না। তবে হ্যাঁ, কলেজ লাইফে ওর সব কাজ আমাকে দিয়ে করাত। আমি নিজেও অনেক কাজ যেচে করে দিয়েছি। কিন্তু কাউকে কেউ ভালবাসলে তো এমনই হয়। কাজ করে দেয়, গিফট দেয়, সেটা কি অপরচুনিজ়ম! আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, কষ্টের সময় তো এ সবও মনে পড়ে। মনে হয়, তা হলে কেন তখন অমন করল! অমন বলল!

সুদীপ্ত আরও নানা কথা বলছিল। ওর জীবন নিয়ে। বাড়ি নিয়ে। লেখাপড়া নিয়ে। এই যে মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়ায়, সে সব নিয়ে। আমি শুনছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার চন্দন সিং-এর কথাও মনে পড়ছিল। লোকটা জাত শয়তান! সন্দেহের মতো বিষ আর কিছু হয় না। চোখে যে বালি ফেলে গিয়েছিল লোকটা। থেকে থেকেই মনে পড়ছিল জেঠুর কথা, ছোটকার কথা! সবাই কি তবে সামনে এক, আর পিছনে আর-এক!

পাহাড় থেকে ফিরে আসায় সবচেয়ে খুশি হয়েছিল মা। বলেছিল, “যাক বাবা! সন্ন্যাসী হয়ে যাসনি এটাই অনেক।”

আমি কিছু বলিনি। আসলে বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না। নানা রকমের চিন্তায় পুরো ঘেঁটে ছিল মাথা।

সত্যি লোকটা এমন একটা বীজ পুঁতে দিয়েছে না! আমার কী করা উচিত! নিজের আখের গোছানো উচিত কি!

আজ বাগালের অফিসে গিয়েছিলাম আমি। সামনের সপ্তাহ অবধি প্রাইস সাবমিট করার ডেট এক্সটেন্ড করা হয়েছে।

বাগালে আজকেও বলেছিল, “দ্যাট চন্দন গাই ইজ় ফলোয়িং ইট লাইক আ হাউন্ড! তোমরা ঠিক করে কোট কোরো। ও একটা দালাল! বাজে প্রাইসে অন্যকে কাজ পাইয়ে দিয়ে সেখান থেকে নিজের কাট খেয়ে সরে পড়বে। আমি তো হেল্প করবই তোমাদের। পুশও করব। কিন্তু প্রাইসের বিশাল ফারাক হয়ে গেলে কিন্তু সবটা ম্যানেজমেন্টের কাছে চলে যাবে। প্লাস লাল তো আছেই! তখন আর আমার হাতে সে ভাবে কিছু থাকবে না। কেমন!”

আজ বাগালে আমায় উত্তরাখণ্ডে আরও দুটো কাজের ব্রিফ দিয়েছে। এগুলো নতুন প্রোজেক্ট। বলেছে এগুলো হতে কয়েক মাস টাইম লাগবে। কিন্তু আমরা যেন ডিটেল দেখে নিই। তেমন হলে কাউকে যেন পাঠিয়ে দিই এক বার সাইটে। দেখে এলে সিভিলের কাজ, লেবার রেট আর পাইপলাইন লেয়িং-এর কাজে সুবিধে হবে। আর বলেছিল এটা এই অফিসেও কেউ জানে না। একদম ওপর থেকে এসেছে। আমাদের অফিস থেকে যেন কিছুতেই এটা চন্দন সিং-এর কানে লিক না হয়।

“দাদা, একটু চেপে বসুন।” অটোচালক ছেলেটি আমার পাশে এসে একটু ধাক্কা দিয়েই বসল আমায়। তার পর একটা স্ট্র্যাপ লাগানো কাপড়ের ব্যাগ অটোর হ্যান্ডেলের সামনে মালা পরানোর মতো করে পরিয়ে বলল, “এস্‌সো পাস্‌সো টাকার নোট দেবেন না। খুচরো হাতে রাখুন। পরে বলবেন না যে নেই। ঝামেলা ভাল লাগে না আমার!”

আমি মেট্রো থেকে নেমেই অটোর ভাড়া বুকপকেটে নিয়ে রেখেছিলাম। আমি একটু সরে বসলাম। ছেলেটা কিছু একটা চিবোচ্ছে। কেমন একটা তাড়াহুড়ো ভাব। যেন একশো মিটার দৌড়ে নেমেছে।

হু-হু করে অটো ছুটছে। আমি মাথার ওপরের একটা রড ধরে কোনওমতে বসে রইলাম। ছেলেটা দু’বার থুতু ফেলল রাস্তায়। মনে হল কানের গোড়ায় দিই ঘুরিয়ে। কিন্তু দিলাম না। আমরা ভিতু খুব। আজকাল উচিত কথা বললে এত হেনস্থা হতে হয় যে, উচিতটাই অনুচিত হয়ে গিয়েছে।

আমাদের এখানে তো আসলে সিভিক সেন্স বলে অধিকাংশ লোকেরই কিছু নেই। সবাই ‘আমি কে জানিস!’ ধরনের মুখ করে ঘুরে বেড়ায়! আমি ভাবি এখনও যে রাস্তায় রোজ মারামারি হয় না সেটাই অনেক।

নানা সিগনালে ধাক্কা খেতে খেতে আমি ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে এসে যখন নামলাম, টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সবে। টাকা দিয়ে আমি পণ্ডিতিয়া রোডের দিকে হাঁটা দিলাম।

“আরে আরে... ইয়ে আরে... পুঁটি!”

আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গলাটা চেনা। পেছনে ঘুরে দেখলাম, লেবুদা। সর্বনাশ! এ এখানে কী করছে!

লেবুদা এগিয়ে এল।

লম্বা-চওড়া চেহারা। চোখগুলো বড় বড়, যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে। মাথায় ঘন চুল। দাড়ি-গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। একটা গোলাপি জামা আর কালো প্যান্ট পরা। জামাটা ভুঁড়ির ঠেলায় প্রায় ফাটো ফাটো অবস্থা।

আমি জানি লেবুদা খুব ভুলভাল বকে। কথার কোনও আগা-মাথা নেই। একে কাটাতেই হবে।

আমি কাষ্ঠ হেসে বললাম, “আরে লেবুদা, তুমি। আমি না আজ খুব ব্যস্ত! পরে কথা বলি?”

“তুই ব্যস্ত! তাতে আমার কী! আর নিজের গোপন কথা কেউ অন্যকে বলে!”

“গোপন কথা মানে!” আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।

“এই যে তুই ব্যস্ত। এটা গোপন কথা নয়! কিছুই তো ভগবান দেয়নি ঘটে!” লেবুদা এমন করে মাথা নাড়ল, যেন ভগবান তার কাজের রিভিউ-এর ভার দিয়েছে লেবুদাকে।

আমি বললাম, “কিছু বলবে?”

লেবুদা বলল, “আমরা বচ্চনের ফ্যানরা বলি না, ডায়ালগ দিই!”

আমি বললাম, “আচ্ছা, কোনও ডায়ালগ দেবে?”

“মুদ্দই লাখ বুরা চাহে কেয়া হোতা হ্যায়...” লেবুদা রাগী রাগী চোখে শুরু করল।

“আরে!” আমি বাধা দিলাম, বিরক্ত গলায় বললাম, “কিছু বলার হলে বলো।”

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjit Chakraborty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy