নামের সঙ্গে চরিত্র খুব কম ক্ষেত্রেই খাপে খাপ হয়। বাল্যবয়সের সবচেয়ে ডানপিটে বন্ধুটির নাম ছিল সুশান্ত। সদা-গাঁট্টা-মারনোন্মুখ সংস্কৃত স্যরের নাম ছিল দয়াময়। কিন্তু মাঝে মাঝে তো মিলেও যায়। আকাশবাণীর এক কালের আধুনিক গানের শিল্পী টফি দে রেকর্ডিং-এর দিন সত্যিই টফি বিলোতেন। নটেশ্বর, যাকে নোটেশ্বর ডাকত সবাই, সুদে টাকা ধার দিত। বাগবাজারের জ্ঞানচন্দ্র দাঁ-কে দেখলেই পালাতাম। সত্যিই জ্ঞান-দা ছিলেন, কেবল জ্ঞান দিতেন। আর আকাশবাণীর রসময় পাঠক।
লোকটি যেমন রসময়, তেমনই পাঠক। শোভন পাঠক হিসেবেও ওঁর আর একটা পরিচিতি আছে। কোনটা পিতৃদত্ত আর কোনটা পাবলিকদত্ত, জানি না। অনেকেই অশোভন নামেও ডাকেন, ওঁর মূলে ফিরে যাওয়ার প্রবণতার কারণে। মূল বলতে ‘আদি’ বোঝানো হচ্ছে। ভদ্রলোক যে কোনও ভাষ্যকে আদিরস প্রলেপনে সিদ্ধমুখ।
রস মাখানো আপাতনিরীহ শব্দক্ষেপণকে অশ্লীল বলা যাবে না মোটেই। কিন্তু এগুলো বলার সময়ে তাঁর উদ্দেশ্য থাকত একটাই, মেয়েদের কাছ থেকে ‘ধ্যাৎ, অসভ্য!’ কথাটা শোনা। কোনও তরুণী মহিলাকে চা খাওয়ানোর প্রস্তাব মোটেই দোষের হতে পারে না। বলা হল— চা খাবে? শুধু ‘চা’ এবং ‘খাবে?’-র মধ্যবর্তী শূন্যতাটা জোড়া লাগিয়ে দিলেন। ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ বলতে গিয়ে ‘স’ উচ্চারণে বলপ্রয়োগ। মোদীজির অনেক আগেই ব্ল্যাকমানির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। এ রকম অনেক। ওঁর নামের দ্বিতীয় ভাগে আছে পাঠক। উনি রীতিমত মুশকিলে ফেলার মতো পাঠক।
বড় মাপের এক জন প্রাবন্ধিক এসেছেন। পণ্ডিত লোক। এসেই চা খেতে চাইলেন। চা আনানো হল। সামান্য মুখকুঞ্চন করে তিনি বললেন, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা ‘চা’-ই না।’ পাঠকমশাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দারুণ বললেন স্যর! এক্ষুনি বানালেন? উনি মাথা নাড়লে, পাঠকমশাই বললেন, স্যর এটা তো দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের বচন। আকাশবাণীর চা নিয়েই অচলপত্র-তে লিখেছিলেন। কবিতা সিংহ-র ঘরে এটা ঘটেছিল। কবিতা সিংহ লিখেছিলেন, কবিতা সিংহের স্বামী বিমল রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘ইদানীং’ পত্রিকায়। সেই ভদ্রলোক তখন গলা নামিয়ে বলেছিলেন— তাই নাকি?
এক বার এক সিনিয়র দাদা কোনও তরুণতরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কচি দুব্বোঘাস দেখলে তোমার জিভটা কি লকলক করে ভাই?’ ছেলেটি ঘাবড়ে চুপ।
পরের প্রশ্ন, ‘কপালের দু’পাশে ব্যথা-ট্যাথা টের পাচ্ছ?’
ছেলেটা বলে, ‘কেন বলুন তো?’
সিনিয়র দাদা বললেন, ‘শিং গজাবার সময় মাথার দু’পাশটা চিন-চিন করে কিনা... সবাই বলছে, তোমার বউ তোমাকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে, তাই শুধোচ্ছিলাম।’
পাঠকমশাই আচমকাই সিনিয়র অফিসার দাদাকে বললেন— ‘শতদল গোস্বামীর লেখাটা কবে পড়লেন বলুন তো? ওঁর মামা জ্ঞানেন্দ্র বাগচীর রসিকতা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন...’
অফিসার দাদা বললেন— ‘ঠিকই, কালই তো পড়লাম।’
একটা গান রেকর্ডিং হচ্ছিল। গায়ক গাইছেন— কাবার জোয়ারেতে তুমি যাও মদিনায়...। নজরুলগীতি। পাঠকদা থামিয়ে দিলেন। ভুল গাইছেন, ভুল। কাবার জিয়ারতে হবে, জোয়ারে নয়।
এ ভাবেই ঝরঝর বাদলদিনে থামিয়ে বাদর, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা থামিয়ে ধনধান্যে পুষ্প ভরা...। এখনও অনেকেই ভুলটাই বলেন, গান করেন।
কী একটা পুরাতনী গানে ‘মোকব করিয়া রাখো ওগো প্রিয়ে’ কথাটা ছিল। মোকবের পরিবর্তে ‘মকুব’ হবে বলছিল কেউ। পাঠকদা বললেন, ওটা মোকব-ই হবে। নওয়াজিস খান গুল এ বকাবলি’র অনুবাদ করেছিলেন। ওখানে কন্যার সজ্জাবর্ণনায় আছে—
পায়েতে মোকব দিল চলিতে বাজন
কোমরে কিঙ্কিণী আছে খচিত রতন
রেশমী কঞ্চুল বক্ষে...
থাকগে ওটা। মোকব হল ঘুঙুর। চলিতে বাজন। হাঁটলে বাজবে...।
জানি না, কতটা গুল আর কতটা বকাবলি। তবে এই লোকটার জন্যই আমাকে সাদা কাক থামাতে হল।
পাঠকদা কিছু দিন আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘হিমানীশ গোস্বামী থেকে টেনে তোমার সাদা কাকে পালক গুঁজছ? লিখেছ, ছোটবেলায় তালিবান ছিলে? জামা-জুতোয় তালি থাকত? হিমানীশদা লিখেছেন কবেই। তারপর গত হপ্তার কাকটা যে তোমার অমুক গল্প থেকে উড়ে এল যে বড়...।’
তার পর কিছু দিন আগে— ‘ঠিকঠাক পাঠক ঠকতে পছন্দ করে না, বুঝলে? গত মাসের অনন্ত জানা তো তোমার অমুক গল্পের হরিপদ হালদারের ছদ্মবেশে ছিল, তাই না?’
এর পর আর সাদা কাক ওড়ানো চলে না।
swapnoc@rediffmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy