সোল ইনভেক্টাস রোমানদের সূর্য দেবতা।
অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি রবিবার বাঙালির ঘরে ইতুপূজা হয়, আর মাসের শেষ দিনে অর্থাৎ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বড় আকারে এই পুজোর শেষ দিনের উদ্যাপন। ইতু অর্থাৎ সূর্য। মিত্র বা আদিত্য থেকে ‘ইতু’ শব্দটা এসেছে। বৈদিক যুগেও বছরের একই সময়ে সূর্যোপাসনার প্রচলন ছিল। মোটামুটি ২১-২২ ডিসেম্বর তারিখে হয় শীতকালীন অয়নান্ত, অর্থাৎ বছরের ক্ষুদ্রতম দিন। এই দিনই সূর্যের দক্ষিণতম অবস্থান, পরদিন থেকে উত্তরায়ণ বা সূর্যের উত্তর গোলার্ধের দিকে ফিরতি যাত্রা শুরুর দিন, দিনের দৈর্ঘ্য বড় হওয়ার সূচনাক্ষণ— তাই সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক সংস্কৃতিতেই এই দিনটাকে সূর্যের জন্মদিন বলে পালন করা হত।
সাংখ্যায়ন আরণ্যক, কৌষীতকি ব্রাহ্মণ উপনিষদ আর ঋগ্বেদের কুন্তাপ খিলসূক্তে গবাময়ন যজ্ঞ এবং মহাব্রত উৎসব পালনের উল্লেখ আছে। এক বর্ষব্যাপী হত গবাময়ন যজ্ঞ, আর যজ্ঞের শেষ চরণে, শীতকালীন অয়নান্তের দিন হত মহাব্রত উৎসব। গবাময়ন যজ্ঞকে বর্ষগণনার জন্য ব্যবহার করা হত, সেই বিচারে দেখলে এটা নববর্ষের দিন ছিল বলা যায়। মহাব্রত উৎসবে যজ্ঞাগ্নি জ্বালানো হত, বৃষ বা ছাগল বলি দিয়ে তাদের চামড়া ব্যবহার করে দুন্দুভি বানানো ও বাজানো হত, সারা দিন সোমরস পেষাই ও পান চলত— এক কথায় পূর্ণাঙ্গ নববর্ষের উদ্যাপন। এই দিন রথ প্রথমে দক্ষিণমুখী যাত্রা করে, একটি কাষ্ঠদণ্ডকে প্রদক্ষিণ করে উত্তরমুখী হয়ে ফিরে আসত, যা ছিল সূর্যের উত্তরায়ণের প্রতীক।
পাঁচ হাজার বছর আগে, ব্যাবিলন-মিশরের জ্যোতির্বিদ্যা ইংল্যান্ডে তখনও পৌঁছয়নি, স্টোনহেঞ্জে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ তৈরি করেছিল গ্রীষ্ম ও শীতকালীন অয়নান্ত মাপার ব্যবস্থা। এই দিন দুটোর হিসাব সহজ, পর পর তিন দিন একই জায়গা থেকে সূর্য ওঠে, একই আকাশপথ অনুসরণ করে একই জায়গায় নামে, অর্থাৎ এই সময় সূর্যের বার্ষিক গতি তিন দিনের জন্য এক জায়গায় থেমে যায়, তাই দিনটিকে ‘সলস্টিস’ বলা হয়। ‘সোল’ হলেন রোমান সূর্যদেবতা আর ‘স্টিস’ মানে স্থিরতা। স্টোনহেঞ্জের সুবিস্তৃত প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেকগুলি প্রস্তরস্তম্ভের এক সুবিন্যস্ত সংগ্রহ। একটি কেন্দ্রীয় প্রস্তরস্তম্ভের বলয়কে ঘিরে আর একটি বলয়, তাকে ঘিরে আর একটি, এই ভাবে একের পর এক সাজানো। প্রবেশপথে একটি বিশেষ প্রস্তরস্তম্ভ— তার পাশে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের দিকে তাকালে শীতকালীন অয়নান্তের সূর্যাস্ত দেখা যায়। সূর্যকে ডুবতে দেখা যায় সবচেয়ে পিছনের পাথরের দুই স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে। নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষের জ্যোতির্বিদ্যার এ এক আশ্চর্য নিদর্শন। অয়নান্তের দিন সেখানে মানুষ একত্র হত, আর দক্ষিণায়ন শেষের সূর্যাস্ত দেখে তারা নিশ্চিন্ত হত, সূর্য আবার ফিরবে। মিশরের কার্নাক মন্দির, আয়ারল্যান্ডে নিউগ্রাঞ্জ, স্কটল্যান্ডে মেজো, বহু প্রাচীন মন্দির এবং সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করা হয়েছিল অয়নান্তের দিনের সূর্যোদয়ের বা সূর্যাস্তের দিকে অভিমুখ রেখে।
সূর্যের জন্মদিনের ধারণাটা আবার আমরা দেখতে পাই পশ্চিম এশিয়ায়। ইসলাম-পূর্ব যুগের আরবদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দেবতাদের মধ্যে ছিলেন ‘দুশরা’। গ্রিক লেখক এপিফেনিয়াস-এর বর্ণনা থেকে জানা যায় জর্ডনের নাবাতিয়ান আরবরা বিশ্বাস করত, শীতকালীন অয়নান্তের দিন দুশরার পুনর্জন্ম হয়। কুমারী দেবী চাবু বা চামুর গর্ভে দুশরা নতুন করে জন্ম নেন। দুশরার পুনর্জন্ম মিলে যায় সূর্যের পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে।
বর্তমান ভারতে শীতকালীন অয়নান্তিক উৎসবগুলো অয়নান্তের দিন হয় না। কিছু ক্ষেত্রে তার এক সপ্তাহ আগে (যেমন ইতুপূজা) বা বেশির ভাগই তিন সপ্তাহ পরে মকর সংক্রান্তির দিন হয়। হিন্দু পরম্পরায় এখন মকর সংক্রান্তি অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষ দিনটি অয়নান্ত। দিনটিকে উত্তরায়ণ বলা হলেও এটি ভৌগোলিক উত্তরায়ণের শুরু নয়। হিন্দু সৌরবর্ষের দৈর্ঘ্য প্রকৃত সৌরবর্ষের চেয়ে প্রায় কুড়ি মিনিট বেশি, যার ফলে প্রতি সত্তর বছরে হিন্দু সৌরবর্ষে একটা বাড়তি দিন যোগ হয়। প্রায় সতেরোশো বছর আগে, যখন ভারতীয় জ্যোতিষের প্রামাণ্য বইপত্র লেখা হয়, তখন মকর সংক্রান্তি হত শীতকালীন অয়নান্তের দিন, আর এখন হয় জানুয়ারির মাঝামাঝি। বর্তমান ভারতে মকর সংক্রান্তির দিন তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, পঞ্জাবে লোহড়ি, গুজরাতে উত্তরায়ণ, কুড়মিদের টুসু পরব অর্থাৎ নববর্ষ, বাঙালির পৌষ সংক্রান্তি, আসামে ভোগালি বিহু— সবই উত্তরায়ণ উদ্যাপনের উৎসব।
চতুর্থ শতকে খ্রিস্টধর্ম কার্যত রোম সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠে, আর তার পর ধীরে ধীরে গ্রিক, রোমান, জার্মান, মিশরীয়দের সব ধর্ম একের পর এক নিষিদ্ধ ও বিলুপ্ত হয়। মিশরীয়দের রা, গ্রিকদের হেলিয়োস, সিরিয়ার এলাগাবাল আর রোমানদের সোল— সব সূর্যদেবতাই একে একে বিলুপ্ত হন। এঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন রোমের ‘সোল ইনভিক্টাস’— বাংলায় অজেয় সূর্য। রোমসম্রাট কনস্টান্টাইন প্রথম জীবনে সোল ইনভিক্টাস-এর ভক্ত ছিলেন এবং পরবর্তী জীবনে তিনি খ্রিস্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। কনস্টান্টাইন ৩১৩ অব্দে খ্রিস্টধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় সহনশীলতা ঘোষণা করেন। তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে ক্রিসমাসের প্রথম উদ্যাপন শুরু হয় ৩৩৬ অব্দে। ৩৫৪ অব্দে ‘ক্রোনোগ্রাফ অব ফিলোকালাস’ নামক পঞ্জিকায় প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় যে, জিশুর জন্ম হয় পঁচিশে ডিসেম্বর। এই বইতেই উল্লেখ আছে, দিনটি সোল ইনভিক্টাস-এরও আবির্ভাব দিবস। কনস্টান্টাইন সোল ইনভিক্টাস আর জিশুকে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন।
আরও এক শতক আগে সম্রাট অরেলিয়ান, ২৭৪ সালে সোল ইনভিক্টাস-এর মন্দিরের উদ্বোধন করেন ২৫ ডিসেম্বর। অরেলিয়ানের সময়ে ২৫ ডিসেম্বরকেই ধরা হত উত্তরায়ণের সূচনাক্ষণ, ২২ ডিসেম্বর নয়। এখানেও সেই সৌরবর্ষ হিসাবের গরমিল। রোমান সৌরবর্ষের দৈর্ঘ্য প্রকৃত সৌরবর্ষের চেয়ে এগারো মিনিট বেশি হত। ফলে প্রতি ১৩০ বছরে এক দিনের ব্যবধান তৈরি হত। যখন রোমানরা জুলিয়ান সৌরবর্ষ চালু করে (৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) তখন ২৫ ডিসেম্বরই উত্তরায়ণ শুরু হত। সম্রাট অরেলিয়ানের সময়ে প্রকৃত উত্তরায়ণ এগিয়ে ২২ ডিসেম্বর নাগাদ চলে আসে, কিন্তু প্রথাগত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তিনি ২৫ ডিসেম্বরকেই উত্তরায়ণ ও সূর্যের জন্মদিবস ধরেন। আরও পরে ষোড়শ শতকে উত্তরায়ণ যখন এগোতে এগোতে ১২ ডিসেম্বরে ঠেকে যায়, তখন পোপ গ্রেগরি ক্যালেন্ডারের সংস্কার করেন এবং এর ফলে উত্তরায়ণ ১২ থেকে আবার ২২ ডিসেম্বরে ফিরে আসে। এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই এই মুহূর্তে সবচেয়ে নিখুঁত সৌরবর্ষ, আর প্রায় সারা পৃথিবী জুড়ে ব্যবহৃত হয়।
চতুর্থ শতকের আগে জিশুর জন্মদিন নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। ইহুদিদের ‘পেসাহ্’ উৎসবের সময়ে বহু মানুষের উপস্থিতিতে জিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, তাই তাঁর মৃত্যুদিন নিয়ে সংশয় ছিল না। ২৫ মার্চ জিশুর মৃত্যুর তারিখ ধরা হত। কিন্তু তাঁর জন্মদিন অজানা ছিল। খ্রিস্টধর্মেমূলত মৃত্যুদিনই পালন হত। প্রথম যুগে খ্রিস্টানদের প্রধান উৎসব ছিল ইস্টার, যেখানে জিশুর প্রয়াণ এবং তাঁর মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উদ্যাপন হয়।
পশ্চিম এশিয়ার অনেক জায়গায় প্রচলিত কিংবদন্তি ছিল, মহামানবদের পৃথিবীতে আবির্ভাব আর মৃত্যু একই দিনে হয়, এ ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চারকেই আবির্ভাব ধরা হত। ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস নির্ধারিত হওয়ার পর তার ঠিক ন’মাস আগে, ২৫ মার্চ দাঁড়াল গর্ভসঞ্চারের দিন, অর্থাৎ ফেরেশতা গ্যাব্রিয়েলের দ্বারা কুমারী মেরিকে জিশুর জন্মবার্তা জানানোর দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy