ছবি: কুনাল বর্মণ।
সূর্য গলে যায় আকাশের পশ্চিমে, টাঙ্গানিকা হ্রদের জল রক্ত হয়ে ওঠে। তার পরই, দিগন্তবিস্তৃত সাভানায় পাগলের মতো দৌড়োয় জ়েব্রার দল। একটা ভারী শরীরের নির্লিপ্ত পদচারণায় কাঁপে নরম মাটি। পরগাছা ঝোলানো বড় গাছগুলো পর্যন্ত অজানা আশঙ্কায় স্থির। এমনই আদিম প্রেক্ষাপটে, ভয়াল সিংহদের মানুষ শিকারের হাড়হিম কাহিনি দিয়ে শুরু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ (১৯৩৭)। উগান্ডায় রেলের কাজে যোগ দিয়েছিল শঙ্কর। সেখানে হানা দিল হিংসুটে সিংহ। কুলিদের নিয়ে যেতে লাগল, মাদ্রাজি তরুণ থিরুমল
আপ্পার রক্তাক্ত জামা রেখে গেল ভাঙা ডালে। এক রাতে শমনকে দেখল শঙ্কর। কুঁড়ের ওপরে উঠে খড়ের চালা থাবা দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। পরে শঙ্কর একটা পাণ্ডববর্জিত ছোট্ট স্টেশনে আসে। সেখানেও হাজির এক মক্কেল। কাচের ও পারে নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে। শঙ্করের বাহ্যচেতনা লুপ্তপ্রায়। আর সিংহ তার চোখের আগুনে সময়কে থামিয়ে রেখেছে।
প্লট লেখকের কল্পনাপ্রসূত। তবে, আফ্রিকার ভূগোল ও প্রকৃতিকে নিখুঁত করতে কয়েকটি বেড়ানোর বইয়ের সাহায্য নিয়েছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন হেনরি প্যাটারসনের লোম খাড়া করা শিকারকাহিনির একটি কপিও বিভূতিভূষণের সংগ্রহে ছিল। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর সিংহপর্বে বইটির অনেকখানি অবদান।
সালটা ১৮৯৮। ব্রিটিশরা ভারত মহাসাগর থেকে লেক ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত রেলপথ বসাচ্ছিল। সেখানে নদীতে সেতু বাঁধছিলেন জন। খামচা খামচা কাঁটাঝোপ, মানুষ-সমান ঘাস, ছাড়া ছাড়া গাছ, দুর্ভেদ্য জঙ্গল। পাশ কাটিয়ে রেল এগোচ্ছে। আসছে হাজারও ভারতীয় কুলি। লাইনের ধারে তাদের ক্যাম্প। কুমির-ভর্তি নদীটার নামেই জায়গাটার নাম। সাভো। রেলকর্তারা জানতেন না স্থানীয় এই শব্দ কতখানি মিলে যায় অদূরে অপেক্ষারত নিয়তির সঙ্গে। কাম্বা ভাষায় সাভো মানে, কসাইখানা।
চাকার ঘড়ঘড়, হাতুড়ির আওয়াজ, ড্রিলারে কাঠ ছ্যাঁদা করার শব্দ, মানুষের কলতান। শিগগিরই তাল কাটল। দু’-এক জন কুলি নিখোঁজ। সোয়াহিলিরা বল্লম ঠুকে ঠুকে ভূতে পাওয়ার মতো করে মাথা নাড়তে লাগল। ‘সিম্বা, সিম্বা!’ তারা সিংহের গর্জন শুনেছে। মানুষ মারলে এ ভাবেই ডাকে পাজি জানোয়ারটা। পরের রাতেই ক্যাম্পে তুলকালাম। কুলিরা কাঁপতে কাঁপতে বলল, শিখ সর্দার উঙ্গন সিংহ তাঁবুর খোলা দিকটায় শুয়ে ছিল। একটা বিরাট সিংহ মাথা গলিয়ে তার ঘাড় কামড়ে বার করে নিল। সর্দারও তার বলিষ্ঠ দু’হাতে সিংহটাকে সরানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু ‘ছোড়ো, ছোড়ো’ চিৎকারই সার।
বালিতে থাবার গর্ত, ওজনদার কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ। একটু দূরেই পড়ে আছে হতভাগ্যের কিছু মাংসের টুকরো আর হাড়। মানুষখেকো সিংহরা প্রথমেই চামড়াটা ছিঁড়ে তাজা রক্ত চেটে নেয়।
শুকনো মাংস তখন রক্তশূন্য। খুঁটিয়ে দেখে সাহেবের বুকে ঢাকের গুমগুম। সিংহ একটা নয়, দুটো! সিংহে-সিংহে ঝাপটাঝাপটির শব্দই কুলিরা শুনেছিল। একটু দূরে পড়ে বিস্ফারিত চোখে সবটা দেখছিল উঙ্গন সিংহের ছেঁড়া মাথা। সিংহরা সেটা ছোঁয়নি।
রাতেই একটা কাকার হরিণকে টোপ বেঁধে, .৩০৩ রাইফেল, ১২ বোরের শটগান নিয়ে, গাছে উঠলেন কর্নেল। কেউ বাইরে শুতে সাহস পেল না। তাঁবুগুলোর বাইরে জ্বলল গনগনে ধুনি। একটু পরেই, দূর থেকে ভেসে এল বজ্রনির্ঘোষ। আবার দীর্ঘক্ষণ সব নিস্তব্ধ। সিংহরা এই ভাবেই নিঃসাড়ে শিকারকে অনুসরণ করে। হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল খানিক দূরের রেলক্যাম্প থেকে। এমন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সিংহের তল্লাট পেরিয়ে অন্য ক্যাম্পে খবর নিতে যাওয়া আর আত্মহত্যা একই কথা।
প্রতি রাতে টেক্কা দেয় সিংহ! রোজই টোপ সাজান, আর অন্য তাঁবুতে হামলা করে সিংহ। জন অস্থির হয়ে উঠলেন। ৩০ মাইল জুড়ে দু’-তিন হাজার কুলি দলে দলে ছড়িয়ে। কোন তাঁবুর কাছে তিনি ঘাপটি মেরে, কী করে আঁচ করছে বনের পশু?
স্থল-জল-অন্তরীক্ষে এমন কোনও বান্দা নেই যে তাদের আটকায়। উঁচু কাঁটাজাল, আগুনের লকলকে জিভ, পালায় পালায় প্রহরা, ক্যানেস্তারার ঝনঝন— নিষ্ফল।
এক রাতে, জনের ঘুম ভাঙল তাঁবুর ওপর খড়মড় শব্দে। কোমরে লণ্ঠন ঝুলিয়ে বন্দুক হাতে বাইরে এলেন। ভাঙা চাঁদের ঠিক নীচে হায়েনা হ্যা-হ্যা করে হাসল। সকালে দেখলেন, তাঁবুর ধারে, কাঁটাতার ঘিরে থাবার ছাপ। ঘুরে ঘুরে অতি সন্তর্পণে একটা পাতলা খোঁচ বার করেছে শয়তানগুলো! সেখান দিয়ে ঢুকছে।
রেলের কাজ এগোচ্ছিল। মজুর কমছিল। যে কয়েকশো অভাগাকে থাকতে হল, তারা রাত কাটায় গাছে। মুশকিল হল, আগের ক্যাম্পেই রয়ে গেল হাসপাতাল। কালাজ্বরে কাবু, জানোয়ারের নখে-থাবায় আহতরা আছে সেখানে। পুঁজ-রক্তের গন্ধ। সিংহ কি দূরে থাকতে পারে! একটা কটু গন্ধ পেয়ে কম্পাউন্ডার তাঁবুর ফাঁক দিয়ে দেখল, যমদূত! প্লাস্টার-ব্যান্ডেজ বাঁধা রুগিদের মাড়িয়ে, ওষুধের বোতল ভেঙে রক্তারক্তি করে, তিন-চার জনকে থাবা মেরে, এক অসহায়কে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে কাঁটাতার টপকে চলে গেল।
সকালের ট্রেন সাভো স্টেশনে আসার সময় গার্ড সভয়ে দেখলেন, প্ল্যাটফর্মে বসে আছে একটা সিংহ। আর একটা স্টেশনের চালে। ওরা যে দিকে তাকিয়ে গজরাচ্ছে, সে দিকে এক জন স্থানীয় ওয়াইকিকু গাছের মগডালে বসে পা ছুড়ছে। একটু পরই দু’জন কুলি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জনকে ডেকে নিয়ে গেল। তারা দেখে এসেছে বিকেলের পড়ন্ত রোদে ডাক্তার ব্রক হাসপাতালে ফিরছেন। ঝোপঝাড়ের আড়ালে তাঁর পিছু নিয়েছে অতিকায় এক সিংহ। কুলিরা বলল, ‘দুটোই সিংহ, অথচ ন্যাড়া! ফির এতনা ভুখ! এ শ্যের না আছে। ইয়ে জরুর আত্মা হ্যায় সাহিব।’
শিকার-শিকারিতে প্রথম দেখা। হাসপাতালের কাছে এক পরিত্যক্ত মালগাড়ির কামরায় গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন ডা. ব্রক আর জন। দীর্ঘ নীরবতার পর কামরাটা হেলে গেল! ঢুকতে চেষ্টা করছে জোড়া শত্রু! দু’-দুটো বন্দুকের শব্দ কামরার ধাতব দেওয়ালে ঠিকরে তুলকালাম তুলল। চমক খেয়ে পালাল ওরা। বারুদের ফুলকিতে এক ঝলক দেখেই, জনের চৈতন্য টলছে। কেশর নেই। মুখ ভর্তি কাঁটাঝোপের ফুটিফাটা। কী কুৎসিত! অস্বাভাবিক! সাক্ষাৎ দুর্বৃত্ত।
সার্চ পার্টি এল। জঙ্গল যেন ওদের লুকিয়ে ফেলল। তারা ফিরতেই রুদ্রমূর্তিতে বেরিয়ে এল ওরা। ডিস্ট্রিক্ট অফিসার তাঁর খাস সৈন্য আবদুল্লাকে নিয়ে আসছিলেন। রাস্তাতেই ঝাঁপাল বদরাগী সিংহ। বেড়াল যে ভাবে ইঁদুর নিয়ে পালায়, সে ভাবে বিশালদেহী কাফ্রিটাকে মুখে করে চলে গেল। মাসাই গাঁওবুড়ো বলল, ‘ধরা যাবে না। মানুষের রক্তের সঙ্গে বদগুণগুলোও সিংহদের মধ্যে ঢোকে। ওরা তখন মানুষের মতো ভাবে। ধূর্ত হয়ে যায়।’ জনও কিনারা পান না! দুটো অত ভারী জানোয়ার এতটুকু শব্দ না করে কী ভাবে কাঁটাতার টপকাচ্ছে? মড়িতে বিষ মাখিয়েও চেষ্টা করেছেন। খায় না। মাসের পর মাস রাত জেগে তাঁর যুক্তিবুদ্ধি পরিশ্রান্ত। কানে আসে এলাকায় দুই ভাইয়ের নাম হয়েছে দ্য গোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেস। ওয়ানিকা-মাসাই-সোয়াহিলিরা বলছে, বনের কোনও রাজাই সিংহ হয়ে গেছেন। জঙ্গলের ওপর ব্রিটিশদের লাগাম পরাতে দেবেন না তিনি।
জন ফাঁদ পাতলেন। ইঁদুরকলের মতো, সিংহদমন যন্ত্র। কিন্তু সেই কলে সেপাইরা সিংহকে এক ফুটের মধ্যে পেয়েও মারতে পারল না! সে উন্মাদের মতো মানুষ আর তার মধ্যের গরাদ ঝঁাকাচ্ছিল। স্ক্রু, পেরেক খুলে পড়ছিল আস্ফালনে-আক্রমণে। সেপাইরা এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে, মশাল উল্টে আগুন লাগিয়ে ফেলে। তার পর ‘ভাইয়ো! খবরদার! শয়তান আতা!’ চেঁচাতে চেঁচাতে পালায়।
রেলের কাজ থেমে গেল। ক্রিসমাস এল, পরিত্রাণ এল না। খবর এল, কাছেই এক ভাই বসে, একটা গাধাকে গলাধঃকরণ করছে। কর্নেল ঝাঁপান ডাকারও লোক পান না। অবশিষ্ট কুলিরা ক্যানেস্তারা বাজাতে বাজাতে অর্ধচন্দ্রাকারে জঙ্গলটা ঘিরে ফেলল। আওয়াজে অতিষ্ঠ জানোয়ারটা শুঁড়িপথ দিয়ে বেরিয়ে, সাহেবের ঠিক পনেরো গজ সামনে এসেই অবাক হয়ে তাকাল। জনের চোখ রাইফেলের মাছিতে। অথচ, হায় ভগবান! গুলিই বেরল না! বন্দুকটা নতুন, সাহেব তাতে অভ্যস্ত নন। খেসারত হিসেবে তাঁর চার পাশের দুনিয়াটা দুলে উঠল। তাঁর আয়ু এখন ওই দুটো মার্জারমণির মালিকের খিদে আর মর্জির গোলাম। পশু মুখ ঘুরিয়ে, জঙ্গলের পথ নিল।
এর পরই প্রথম যে ট্রেন এল, গুটিকয় অসমসাহসী বাদে, সক্কলে তাতে চেপে সাভো ছেড়ে চলে গেল। বলে গেল, ‘ওরা প্রেতাত্মা, অস্ত্রে মরবে না।’ সাহেব স্বপ্ন দেখলেন, একটা বিরাট অবয়ব হাঁটছে। শরীরটা সিংহের। মাথাটা মুকুটপরা পিশাচের।
আধখাওয়া গাধাটার দশ ফুট দূরে মাটিতে বাঁশ পুঁতে বারো ফুট উঁচু মাচা বাঁধলেন জন। মাচার পাটাতনে তিনি হিসেব করছিলেন, বারো ফুট উচ্চতা সিংহর পক্ষে টপকানো স্বাভাবিক কি না। চকিত করল তাঁর অভিজ্ঞ কান। একটা খিদে-খিদে হাই, তার পর চাপা গররর। সাহেব ঘামছেন। মড়ি ছেড়ে, মাচার দিকে এগিয়ে আসছে শমন! ক্রুদ্ধ পশু পলকা মাচা ঘিরে চক্কর কাটছে। ঘণ্টাখানেক সাহেব মূর্তির মতো স্থির, ঘাড়-হাত টনটনাচ্ছে। এমন সময় একটা পেঁচা এসে, গাছের ডাল ভেবে, সাহেবের বন্দুক-ধরা হাতে বসতে গেল! প্রায় সিংহের হাঁয়ে পড়ে যান আর কী! ঝটপট শুনেই নীচ থেকে সিংহটা হিংস্র ঘ্যাঁক করল। ওটুকুই যথেষ্ট। চোখের তারায় জোর এনে, লক্ষ্য আন্দাজ করে ট্রিগার চাপলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিংহনাদ। মোক্ষম লক্ষভেদ। বিকট গোঙানি সরতে সরতে থেমে গেল এক সময়। ঘোর নির্জনতা ভেঙে আকাশে দুটো টোটা ছুড়লেন সাহেব।
সিংহটাকে পাওয়া গেল সকালে। লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে আধবসা। মরে কাঠ, তবু ভয় দেখানোর ভঙ্গি। ওকে তক্ষুনি কেটে খেতে চাইছিল আসকারিরা। সাহেব তাদের শান্ত করলেন। এর দোসর শোধ নিতে চাইলে কপালে আরও দুঃখ আছে।
ঠিক এক সপ্তাহ। আলো মরতেই, মেঘগর্জনের মতো সিংহনাদ। হাহাকার আর জিঘাংসা ঝরছে সেই চিৎকারে। সকাল হতে, লাশ মিলল ইন্সপেকশন বাংলোর ছাগলগুলোর। একটাকে খেয়েছে। একটাকে নিয়েছে। বাকিদের খামোখাই মেরেছে। দাগ ধরে কিছুটা যেতেই, ঝোপের ভেতরে জেগে উঠল প্রকাণ্ড মাথাটা। সবাইকে ছেড়ে, উল্কাবেগে ছুটে এল জনের দিকে। বন্দুক গর্জে উঠতেই, বিপদ থমকাল মাঝরাস্তায়। উল্টোবাগে দৌড়ল ক্ষিপ্ত সিংহ।
মড়িটার কাছের ইউকা গাছে ঠায় বসে জন। রাত দুটো নাগাদ, নীচের ঝোপে পাশাপাশি দুটো জোনাকি জ্বলল। নরখাদক এসেছে। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। সব ভুলে দেখছেন, কী মসৃণ দক্ষতায় সে আড়ালের সুযোগ নিয়ে দূরত্ব কমিয়ে আনছে। ঘন চাঁদোয়ার মতো আঁধার, গায়ের রঙে মানিয়ে যাওয়া ঝাপড়া খাগড়া, আর অফুরন্ত ইন্দ্রিয়শক্তি! কুড়ি গজ দূরে এসে একটু দাঁড়াল। সোজা বুকে গিয়ে ঢুকল গুলি। পড়ল না। দু’লাফে নাগালের বাইরে চলে গেল। পর পর গুলিও ছুটল তাকে অন্তিমচুম্বন দিতে।
পাঁচটা লৌহবুলেট খেয়েও যদি সে না মরে, তবে সোয়াহিলিরাই জিতবে। আকাশের কালো হালকা হতেই সাহেব নামলেন। পিছনে অনুচর, তার কাঁধে সাহেবের মার্টিনি কারবাইন রাইফেল। রক্তের ছোপ ধরে সওয়া মাইল যেতেই, তীব্র জান্তব হুঙ্কার রুখে দিল তাঁদের। ঝোপ থেকে এক লাফে বেরিয়ে, সে তেড়ে এল জনের দিকে। দুটো গুলিতেও তাকে থামানো গেল না, চমকে রাইফেলটাই পড়ে গেল। নিরস্ত্র সাহেব তখন ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে প্রাণভয়ে
ছুটছেন। একটা ডাল ধরে ঝুলে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় ডিগবাজি খেয়ে গাছে চড়ে বসলেন। শিউরে উঠে দেখলেন সিংহটা প্রাণপণে সেই গাছেই ওঠার তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছে। তার পিছনের পা গুলিতে
জখম। নইলে এত ক্ষণে সাহেবের ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার কথা। পঙ্গু সিংহটা একটু একটু করে পিছু হটল। কিছুটা গিয়েই এক রাশ ধুলো উড়িয়ে পড়ে গেল পাথরে।
একশো অবধি গুনে, নীচে নেমে, রাইফেল তুলে সাহেব এগোলেন। সিংহটা ভান করছিল! উঠেই ঝাঁপাতে এল ঠিক আগের মতো। সজাগ মার্টিনি কারবাইন ফুঁড়ে দিল তার মাথা আর বুক। মাত্র ক’ইঞ্চি দূরে, শুয়ে রইল দুর্ধর্ষ দুশমন। নিস্পন্দ।
এ বার উচ্ছ্বাস বিশ্ব জুড়ে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বললেন, গোস্ট আর ডার্কনেস, দুই জন্তু থামিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জয়রথ। আগুন উগরোতে উগরোতে তা আবার চলেছে। তাই কি? সন্ত্রাসের শাসন শেষে, জন মানুষখেকোদের আস্তানাটা পেলেন। প্রাগৈতিহাসিক গুহা। গায়ে জলের ধারা, মোটা লতা। অন্ধকারে একটু এগোতেই, পায়ে ঠেকল মানুষের করোটি। স্তূপাকার হাড়গোড়, মেয়েদের বালা, পুরুষের কান-মাকড়ি! এ ভাবে হাড় জমায় যে, সে কেমনতর পশু? কে আছে ভেতরে? সিংহী? শাবক? না কি...? চোয়াল শক্ত করে, অন্ধকারের চোখে চোখ রেখে পায়ে পায়ে পিছিয়ে এলেন তাঁরা। যেন একটা গরম হলকা খুব কাছে এসেও হতাশ হয়ে ফের গুহায় ঢুকে গেল।
বহু পশু মেরেছেন কর্নেল প্যাটারসন। হিপো, গন্ডার, চিতা, নেকড়ে। প্রচুর মানুষখেকো সিংহও! কেনিয়া যে থিকথিকে নরখাদকে। বুনোরা নাকি মুখে খড়কুটো জ্বালিয়ে মরা মানুষকে ছুড়ে ফেলে জলপ্রপাতের নীচে। আরবরা সাভোর ওপর দিয়েই ক্রীতদাস বোঝাই ক্যারাভান নিয়ে বেসাতি করতে যেত। দাসেরা অসুখে অনাহারে মরলে ফেলে যেত রাস্তাতেই। সে সব দেহ খেয়ে খেয়ে সিংহদের মুখে মানুষের সোয়াদ লেগেছে। জিম করবেটের সেই রুদ্রপ্রয়াগের চিতা, ১৯১৮ থেকে ’২৬— আট বছরে ১২৫ জনকে মেরেছিল। এরা সেখানে, ১৮৯৮-র এপ্রিল-ডিসেম্বর, ন’মাসেই ১৩৫ জনকে খতম করেছে। পরে, হাড়-মাংস-কোলাজেন ঘেঁটে গবেষকরা বলেছেন, প্রথম সিংহ ২৪, দ্বিতীয় জন ১১। সবসুদ্ধ জনা ৩৫কে খেয়েছিল। সরকারি হিসেবে নিহত ২৮। সংখ্যাটা কি বাড়িয়ে বলেছেন শিকারি?
তিনি লিখেছেন, শুধু যারা পেটে গেল, তাদের হিসেব নিলে চলবে? যাদের থাবা মেরেছে, হাত ছিঁড়েছে, দাঁত বসিয়ে ফুটো করেছে মাংস— প্রায় সকলে একে একে মুছে গেছে পৃথিবী থেকে। কত গ্রাম আছে সিংহদের ডেরার মাঝখানে, যেখানে কে জন্মাল আর কে মরল, কেউ খবর রাখে না। সাভোর ঊষর জমিতে এক ফোঁটা জল, একটু জল বলে কাতরে কাতরে কত জন মুখ থুবড়ে স্থির হয়ে গেছে, শকুন আর সরুঠোঁট ছাড়া কোন পোস্টমর্টেম জেনেছে? আফ্রিকা কি অতই জলভাত?
বর্তমানে শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়ামে, সিংহ দুটোর চামড়া স্টাফ্ড অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। কুঁকড়ে ছোট হয়ে গিয়েছে ন্যুব্জ বৃদ্ধ দুই দানব। কিন্তু এখনও মরেনি আক্রোশ। কারণ, আজও ওদের বংশধররা মানুষ মারছে তানজানিয়া, সেরেঙ্গেটি আর সাভো নদীর চরে। ওদের নকল চোখে এখনও আসল ম্যাজিকের ক্রূর প্রত্যয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy