Advertisement
E-Paper

দশাননের হাতে তৈরি বাদ্যযন্ত্র হিসেবেই পরিচিত ‘রাবণহাত্তা’

কিংবদন্তি অনুযায়ী, এক বিপদে পড়ে শিবকে তুষ্ট করতেই এই বাজনা আবিষ্কার করেন লঙ্কাপতি। ছড় টেনে বাজাতে হয়, এমন প্রাচীনতম তারযন্ত্রগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। সম্ভবত এটিই পাশ্চাত্যের বেহালার পূর্বপুরুষ। প্রধানত চারণকবি এবং লোকগীতির শিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

পথশিল্পী: পর্যটকদের ‘রাবণহাত্তা’ শুনিয়েই উপার্জন করেন এঁরা।

পথশিল্পী: পর্যটকদের ‘রাবণহাত্তা’ শুনিয়েই উপার্জন করেন এঁরা। —ফাইল চিত্র।

সুব্রত মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৬:২৮
Share
Save

রাত তিনটের সময় ঘুটঘুটে অকল্পনীয় অন্ধকারে ট্রেনটা নামিয়ে দিল জয়সলমির স্টেশনে। এত অন্ধকার, নিজের হাতটা অবধি দেখতে পাচ্ছি না। কোনও মতে হাতড়ে হাতড়ে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। … তার পর শুরু হল এক অলৌকিক আওয়াজ। আমি চিনি। আমার ঠিক পাশ থেকে এক অতুলনীয়, অসাধারণ বাজনা সেই কালো কুচকুচে রাত্তিরে আমাকে প্লাবিত করতে লাগল।”

এক বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক স্কুলজীবনে একটি বাজনার টানে, বাড়ি থেকে না বলে পালিয়েছিলেন। জয়সলমের স্টেশনে অন্ধকার রাতে শিকল বাঁধা এক ডাকাত তাঁকে শুনিয়েছিল সে বাজনা। দিনের আলো ফুটলে তিনি দেখলেন, তাঁর সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে রয়েছেন সর্বাঙ্গে শিকল জড়ানো ডাকাত। জয়সলমির অঞ্চলের কুখ্যাত সেই ডাকাতকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তিহাড় জেলে।

‘ফেরারি মন’ বইটিতে সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র বর্ণনা করেছেন রাজস্থানের এক অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে বসে রাবণহাত্তা নামে সেই আশ্চর্য বাজনা শোনার অভিজ্ঞতা।

‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় মাঝরাতে ট্রেন ধরার দৃশ্যটা মনে আছে নিশ্চয়ই? রামদেওরা স্টেশনে আগুন ঘিরে দেহাতি জটলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে লোকগানের সে দৃশ্যটা। যেখানে হাতের আংটি দেখে ছদ্মবেশী মন্দার বোসকে চিনে ফেলেছিল ফেলুদা। ওই দৃশ্যে রাজস্থানি লোকগীতি ব্যবহার করে রাজস্থানের লোকসংস্কৃতিকে চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়।

রাজস্থানে যাঁরা ঘুরতে যান তাঁরা হয়তো লক্ষ করেছেন, বিভিন্ন কেল্লার সামনে বেহালার মতো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করা শিল্পীদের। দৃশ্যটা পরিচিত। তবে অনেকেই জানেন না এই বাদ্যযন্ত্রটির নাম। রাজস্থানে লোকগীতি গাওয়া হয় এই তারের বাদ্যযন্ত্রটির সঙ্গে। যার নাম রাবণহাত্তা। সুপ্রাচীন এই যন্ত্রসঙ্গত বহু যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছেন রাজস্থানি চারণকবি ও লোকশিল্পীরা। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টির উৎস। বলা হয়‚ প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো এই বাদ্যযন্ত্রটি আবিষ্কার করেছিলেন স্বয়ং লঙ্কাধীশ রাবণ!

লঙ্কাধিপতি রাক্ষসরাজ রাবণ মহাকাব্যের খলনায়ক। কিন্তু অন্য দিকে তিনি ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। শিবকে সন্তুষ্ট করার জন্য রাবণ এই বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ করেন। পৌরাণিক মতে, রাবণ এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করেছিলেন রাবণহাত্তা। রাবণের মা কৈকসী ছিলেন পরম শিবভক্ত। তিনি কৈলাস পর্বতে শিবের পায়ের কাছে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য রাবণ কৈলাস পর্বতকে লঙ্কায় নিয়ে আসার কথা ভাবেন। অহঙ্কারী রাক্ষসরাজ শিবের দুই অনুচর নন্দী-ভৃঙ্গীর বারণ না শুনে তাঁর দশ হাতে কৈলাস পর্বত উৎপাটিত করে লঙ্কায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কৈলাস আন্দোলিত হওয়ায় পার্বতী ভীত হন এবং পর্বতের কম্পন ঠেকাতে শিব তাঁর পায়ের একটি আঙুল দিয়ে পর্বতে চাপ দেন। তাতেই রাবণের একটি হাত কৈলাস পর্বতের নীচে চাপা পড়ে যায়। শিবের ক্রোধ থেকে মুক্তি পেতে, তাঁকে প্রসন্ন করার জন্য রাবণ রচনা করেন একটি মধুর শিবস্তোত্র। তার পর নিজের একটি হাত ও একটি মাথা কেটে, মাথার চুল দিয়ে নির্মাণ করেন একটি বাদ্যযন্ত্র। বাজনা ও স্তোত্র শুনে প্রসন্ন হয়ে শিব রাবণকে রক্ষা করেন। তৈরি হয় রাবণহাত্তা। শিবের আশীর্বাদে তাঁর বাদ্যযন্ত্র ‘রাবণের হাত’ বা ‘রাবণহাত্তা’ নামে পরিচিত হয়।

রাবণ-রাজত্বকালে শ্রীলঙ্কায় ‘হেলা’ সম্প্রদায়ের মধ্যে বাজনাটি প্রচলিত ছিল। কিন্তু তা সমুদ্র পেরিয়ে ভারতে কী ভাবে এল?

এর পিছনেও রয়েছে পৌরাণিক কিংবদন্তি। রাম-রাবণের যুদ্ধ শেষে, লঙ্কাজয়ের স্মারক হিসেবে রুদ্রাবতার হনুমানই রাবণহাত্তা নিয়ে আসেন উত্তর ভারতে। রাবণের মৃত্যুর পর লঙ্কার প্রাসাদে নতুন ধরনের বাদ্যযন্ত্রটি দেখে সেটি হনুমানের পছন্দ হয়। অন্য একটি লোককথা অনুসারে, লঙ্কাধিপতি রাবণের শ্বশুরবাড়ি, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী মন্দোদরীর বাপের বাড়ি ছিল এখনকার মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর জেলায়। রাবণ ছিলেন সেখানকার জামাই। সেই সূত্র ধরেই রাবণহাত্তার ভারতে আগমন।

গবেষক লেখক প্যাট্রিক জেরেড রাবণহাত্তার উৎপত্তি নিয়ে একটি বই লিখেছেন। সেখানে এর শ্রীলঙ্কা থেকে ভারত হয়ে কৈলাস পর্বত পেরিয়ে তিব্বতে পৌঁছনোর কাহিনি উল্লেখ করেছেন। ভায়োলিন বা বেহালার অগ্রজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে একে। রাবণহাত্তা এ দেশে প্রচলনের পর তা দ্রুত জনপ্রিয় হয় রাজপরিবার থেকে পশুপালকদের মধ্যেও। রাজস্থান ও গুজরাতের রাজপরিবারের মহিলারা, বিশেষ করে রাজকুমারীরা রাবণহাত্তা বাজাত। এটি ব্যাপক সাড়া ফেলে লোকশিল্পী এবং যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যে। উট, ভেড়া চরানোর সময় রাখালেরা সুর তোলে রাবণহাত্তায়। এদের মধ্যে অন্যতম ‘রাবারি’ সম্প্রদায়। তারা মনে করে, ভগবান শিব তাদের পাঠিয়েছে পার্বতীর উট চরানোর জন্য। এ রকমই নানা লোককথা, উপকথা প্রচলিত আছে রাবণহাত্তা নিয়ে।

গবেষকদের মতে, দ্বাদশ শতকে রাবণহাত্তা এ দেশে জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছয়। এ সময়ে ভারতে আসা আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে তা ছড়িয়ে পড়ে প্রাচ্যে। আরবি বাদ্যযন্ত্র রবাব নাকি রাবণহাত্তারই পরিবর্তিত রূপ। প্রাচ্যভূমির পর এর পরিবর্তিত রূপ পাশ্চাত্যে পৌঁছলে, তা জনপ্রিয় হয় ভায়োলিন বা বেহালার আকারে।

রাবণহাত্তা তারের বাদ্যযন্ত্র। দু’টি প্রধান তার ব্যবহৃত হয় এই বাদ্যযন্ত্রে। বাঁশ আর নারকোলের খোলার মতো অতি সাধারণ উপকরণে তৈরি হয় এটি। কিন্তু চমকে দেবে তার আওয়াজ। অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে বেহালা, সারেঙ্গির সঙ্গে। রাবণহাত্তার দু’টি অংশ। বাজনার ‘বেস’টি তৈরি হয় নারকেল খোল, তামা অথবা লাউ কিংবা কাঠের খোল দিয়ে। খোলটি ঢাকা থাকে ছাগল বা ভেড়ার চামড়ায়। অন্য অংশ হল লম্বা বাঁশের, যা খোলের সঙ্গে যুক্ত। খোল ও বাঁশের অংশে লাগানো থাকে অনেকগুলি তার। বাজানোর জন্য দু’টি তার থাকে। প্রধান তার তৈরি হয় ঘোড়ার লেজের চুল দিয়ে, অপরটি স্টিল দিয়ে। খোলের ছাউনিতে মোষের শিং দিয়ে তৈরি ব্রিজে আটকানো থাকে তারগুলি। ছড় দিয়ে বাজানো হয়। বাঁকানো লাঠিতে ঘোড়ার কেশরের তার দিয়ে তৈরি ছড়ে লাগানো থাকে ঘুঙুর। বেহালার মতো ছড় টেনে বাজানো হয়। এবং সেই সঙ্গে ছড়ের ঝাঁকুনিতে ঘুঙুরের বোল ওঠে।

রাজস্থান ও গুজরাতে আছে ‘নায়েক’ সম্প্রদায়। এঁদের মধ্যে যাঁরা চারণকবি, তাঁদের ভোপা-ও বলা হয়। মূলত ধর্মীয় গান এঁদের কণ্ঠে শোনা যায়। এ ছাড়াও আছে ত্রিশটিরও বেশি যাযাবর বা অর্ধ-যাযাবর জাতি। তাঁদের মধ্যে বহু আলাদা রীতি রেওয়াজ থাকলেও রাবণহাত্তা কমবেশি সবাই বাজিয়ে থাকে। তবে উপকথা বা কিংবদন্তি যাই হোক না কেন‚ এই যন্ত্র যে পৃথিবীর প্রাচীনতম ছড়ওয়ালা বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে একটি‚ তা নিয়ে নিঃসন্দেহ গবেষকরা। পাশ্চাত্যের গবেষকরাও এই কথা সমর্থন করেছেন। রাবণহাত্তাকে তাঁরাও আধুনিক বেহালা বা ভায়োলিনের আদি রূপ বলে মনে করেন।

পৃথিবীতে বাদ্যযন্ত্রে ছড় দিয়ে সুর তোলার প্রথম ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যায় দশম শতকে, তুরস্কের বাইজেন্টাইন ও পশ্চিম এশিয়ার আরবভূমিতে। আর নির্দিষ্ট করে ‘রাবণহাত্তা’ নামে বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় নান্যদেবের রচনায়। একাদশ-দ্বাদশ শতকের এই পণ্ডিত থাকতেন মিথিলায়। তিনি তাঁর ‘ভারতভাষ্য’ গ্রন্থে এই বাদ্যযন্ত্রের কথা বলেছেন। পরে সপ্তদশ শতকে তামিল কবি রমাভদ্রাম্ভা এর কথা লিখেছেন। তাঞ্জোর রাজসভায় এই যন্ত্র বাজাতেন কোনও এক মহিলা শিল্পী। অষ্টাদশ শতকে এই যন্ত্রকে মালাবারের মূল বাদ্যযন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন এক জার্মান মিশনারি।

ইউরোপের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতের অধ্যাপক জোপ বোর রাবণহাট্টার উপর বিশদে কাজ করেছেন। গবেষণাপত্রে বলেছেন, ভারতে এই যন্ত্র জনপ্রিয় হয় দ্বাদশ শতকে, কিন্তু তা তখন সমাজের উচ্চস্তরে জনপ্রিয় ছিল না। রাবণহাত্তা ছিল ভিক্ষাজীবীদের বাজনা। রাবণহাত্তার ব্যবহার এখন সীমাবদ্ধ রাজস্থান-গুজরাতের চারণকবিদের মধ্যেই। তাঁদের অনেকেই এখন রাজস্থানের বিভিন্ন কেল্লার সামনে বসে রাবণহাত্তায় সুর তোলেন। পর্যটনের অংশ হয়ে গিয়েছে এই দৃশ্য। পর্যটকদের দেওয়া পয়সাই এই শিল্পীদের রুটিরুজি।

রাজস্থানের মেহরানগড় ফোর্টের বাইরে বসে রাবণহাত্তা বাজানো জগদীশ ভোপার কাছে জানা গেল, নায়ক ভোপা সম্প্রদায়ের রাবণহাত্তার কথা। নায়ক ভোপার নাটক বা শিল্পকলায় চতুর্থ শতকের প্রাচীন কাব্যকথা ‘পাবু’ দেখানো হত নানা ঘটনার পর পর ছবি আঁকা কাপড় ধীরে ধীরে গোটানোর সঙ্গে সঙ্গে। বাংলার পটচিত্র-সহ কথকতার ঢঙে। সঙ্গে থাকতে রাবণহাত্তার সুর এবং দৃশ্যচিত্রের বিবরণ। টিভি-মোবাইল যুগের আগে যাত্রাগান চলত রাতভর। সে সব প্রথা এখন লুপ্ত। এখন টুরিস্ট স্পটের সামনে বাজিয়েই শুধু রোজগার। তাঁদের কাছেই রেডিমেড রাবণহাত্তা বিক্রি হয়। দেড় হাজার টাকা থেকে শুরু। মেহরানগড় দুর্গের জাদুঘরে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে রাখা আছে রাবণহাত্তাও।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে রাবণহাত্তার। প্রাচীনকালে তার হিসেবে ব্যবহৃত ঘোড়ার কেশরের বদলে এখন পুরোটাই স্টিলের তার। রাজা-মহারাজাদের যুগ শেষ হওয়ার পর রাবণহাত্তার ঠাঁই হয় জাদুঘরে। আর এখন এর ব্যবহার টিকে আছে কিছু শিল্পী আর বেশির ভাগ কেল্লার সামনে বসা গায়কদের মধ্যে। আওয়াজ বেহালা বা সারেঙ্গির মতো হলেও একটু চড়া। আর তাতেই অনায়াসে বেজে উঠছে ‘কেসরিয়া বালম পধারো মারো দেশ’-এর মতো জনপ্রিয় লোকগীতি বা বাজারচলতি নানা হিন্দি গানের সুর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lord Shiva Musical Instruments

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}