শিল্পী: ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে চরণদাসের চরিত্রে রবীন মজুমদার। ডান দিকে, তরুণ বয়সে
সালটা ১৯৪০। সে বারে স্কটিশ চার্চ-এ কলেজ সোশ্যালের ভার সদ্য পাশ-করা ছাত্রদের ওপর। তাদেরই এক জনের মাথায় খেলল, যদি প্রমথেশ বড়ুয়াকে নিয়ে আসা যায়!
বন্ধুরা হেসেই অস্থির। চলচ্চিত্র-তারকা, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা রাজকুমার আসবেন কিনা সোশ্যালে! ছেলেটাও নাছোড়বান্দা। একশো টাকা বাজি ধরল বন্ধুদের সঙ্গে। পর দিন সকালে বড়ুয়াসাহেবের বাড়ি গিয়ে এমন ধরে বসল, তিনি রাজি হলেন। কিন্তু বললেন, তিনি থাকবেন মাত্র দশ মিনিট। তাই সই। নির্দিষ্ট দিনে এলেন প্রমথেশ। বসলেন সামনের সারিতে। ছেলেটা সে দিন মঞ্চে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়েছিল ‘শাওন রাতে যদি...’। মঞ্চ থেকে নামতেই তাঁকে ডেকে প্রমথেশ বললেন, ‘‘বেশ ভাল গান গেয়েছ তুমি। গলাটি তোমার ভারী মিষ্টি। তুমি এক বার কাল সকালে বাড়িতে এস। তোমার সঙ্গে দরকার আছে।’’ পর দিন হাজির হতেই প্রমথেশ ছেলেটিকে অফার দিলেন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের। বললেন, ঠিক সময়ে খবর যাবে।
কলেজ-জীবন শেষ হল। যেখান থেকে কলকাতায় আসা, সেই কাটিহারে ফিরে গিয়েই আশায় আশায় প্রতীক্ষা। অবশেষে এক দিন ডাক এল কলকাতায় এসে যোগাযোগ করার। আসামাত্র খবর, প্রমথেশ বড়ুয়ার আগামী ছবিতে সে দিনের সেই ছেলেটিই নায়ক-গায়ক হতে যাচ্ছেন! এ বছর জন্মশতবর্ষে পা রাখা রবীন মজুমদারের শিল্পী-জীবনের আরম্ভটা এমনই চমকপ্রদ। সিনেমার খাতিরে যাঁর পিতৃদত্ত নাম ‘রবীন্দ্রনাথ’ কেটে ছোট করে দিয়েছিলেন বড়ুয়াসাহেব।
১৯১৯ সালের ডিসেম্বরে হুগলির চোপা গ্রামে জন্ম রবীন মজুমদারের। বাবা অমূল্যকুমারের চাকরির সুবাদে ছোট থেকেই তাঁর বেড়ে ওঠা কাটিহারে। শুরু থেকেই সঙ্গী ছিল গান। বারো-তেরো বছর বয়সে উত্তরবঙ্গ-রাজশাহী ডিভিশন মিউজ়িক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। বাবা কিনে দিলেন একটা হারমোনিয়াম। পণ্ডিত বীরেন নিয়োগীর কাছে গানের তালিমও শুরু হল। এ দিকে জোরকদমে চলছে পড়াশোনা। তিনটে বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে, কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন।
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪০-এ মুক্তি পেয়েছিল ‘শাপমুক্তি’। সেই নিয়েও চমক। মুক্তির আগের দিন গোটা ছবিটা দেখার সময় পরিচালক বড়ুয়াসাহেবের মনে হল, ৫ নম্বর রিলের একটা দৃশ্যে কিছু ত্রুটি থেকে গেছে। নতুন করে তুলতে হবে। পরের দিন সকাল আটটার মধ্যে সবাইকে স্টুডিয়োতে আসতে বললেন। সকলেই হতবাক! সেই দিনই তো ‘উত্তরা’ সিনেমায় ছবি মুক্তি পাবে! রবীনবাবু বলেই ফেললেন, ‘‘সে কী! কালই তো ছবি রিলিজ!’’ বড়ুয়াসাহেবের গম্ভীর উত্তর, ‘‘সেটা আমার ভাববার কথা, তোমার নয়।... জাস্ট অ্যাট এইট।’’ পরের দিন দৃশ্যটি তোলা হল, এর পর তা গেল ডেভেলপে। অবশেষে এডিটিং করে যখন প্রিন্ট হচ্ছে, তত ক্ষণে ‘উত্তরা’-য় ‘শাপমুক্তি’ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেখানে ছবি পাঠানো হয়েছিল ৫ নম্বর রিল বাদ দিয়েই। ফাইনাল প্রিন্ট রেডি হওয়ার পর, গাড়িতে রবীন মজুমদারকে তুলে হলের দিকে ছুটলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। যখন পৌঁছলেন, পর্দায় তখন চার নম্বর রিলের মাঝামাঝি অংশ চলছে। নতুন ৫ নম্বর রিল ঢুকে গেল যথাস্থানে!
প্রথম ছবিতেই নবীন নায়ক-গায়ককে বরণ করে নিলেন দর্শক। যেমন সৌম্যকান্তি চেহারা, তেমনই সাবলীল অভিনয়, সেই সঙ্গে মধুর কণ্ঠে গান। অনুপম ঘটকের সুরে রবীনের কণ্ঠে ‘বাংলার বধূ’, (সহশিল্পী: সুপ্রভা ঘোষ, শৈল দেবী), ‘এই ধরণীর ধূলির তলে’, ‘বনে নয় মনে রঙের আগুন’(সহশিল্পী: শৈল দেবী) গানগুলো শুরুতেই হিট হল। উত্তাল চল্লিশের দশকে এ ভাবেই উত্থান রোম্যান্টিক চিত্রতারকা রবীন মজুমদারের।
অবশ্য ‘শাপমুক্তি’-র গানের আগেই, ১৯৩৯ সালে মেগাফোন রেকর্ডে রবীন মজুমদার প্রথম বার গেয়েছিলেন নন-ফিল্ম গান ‘আজি এ বিদায়ক্ষণে’ আর ‘ওগো অনেক দিনের কথা’— এম সুলতানের কথায়, ভবানীচরণ দাসের সুরে। উদ্যোগটা ছিল সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর কাছেই তখন গান শিখছিলেন রবীন। তবে ‘শাপমুক্তি’-ই তাঁকে প্রথম এনেছিল সর্বসমক্ষে, পাদপ্রদীপের আলোয়। প্রমথেশ বড়ুয়াকে তাই চিরকাল তাঁর শিল্প-গুরু মানতেন রবীনবাবু।
সুরকার কমল দাশগুপ্ত-রবীন মজুমদার সংযোগও এক উজ্জ্বল ইতিহাস। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথায় ‘যোগাযোগ’ (১৯৪৩) ছবিতে ‘নাবিক আমার’, ‘এই জীবনের যত মধুর ভুলগুলি’, ‘নন্দিতা’ (১৯৪৪) ছবিতে প্রণব রায়ের কথায় ‘তুমি এসেছিলে জীবনে আমার’— আরও বহু গানের কথাই বলা যায়। ১৯৪২ সালে কমলেরই সুরে, প্রণব রায়ের কথায় ‘গরমিল’ ছবিতে নায়ক হয়ে গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’, আবার ওই বছরেই রবীনের কণ্ঠে রেকর্ডে শোনা গেল নন-ফিল্ম আধুনিক গান ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’ (কথা হীরেন বসু, সুর রবীন চট্টোপাধ্যায়)। শিল্পীর কালজয়ী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দুটো গানেরই অসীম অবদান।
১৯৪৯ সালের ৫ নভেম্বর মুক্তি পেল দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘কবি’। মূল কাহিনিকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ই ছিলেন এই ছবির গীতিকার। রবীন মজুমদার ‘নিতাই কবিয়াল’, সঙ্গে ‘ঠাকুরঝি’ ও ‘বসন’-এর চরিত্রে যথাক্রমে অনুভা গুপ্তা ও নীলিমা দাস। পুরো ছবি জুড়েই ভালবাসার আবেদনে ভরা সুরময় উপস্থাপন। অভিনয় ও গানে মাতিয়ে দিলেন রবীন মজুমদার। অনিল বাগচীর সুরে ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’, ‘ও আমার মনের মানুষ গো’ বা ‘ও হায় রূপের ছটা’ গানগুলিতে রবীনের কণ্ঠ সোনা ফলাল। তবে এই ছবির অন্য একটি গান প্রসঙ্গে দূরদর্শন-সাক্ষাৎকারে একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন রবীনবাবু। এক দিন ‘কবি’ ছবির শুটিং শেষে রবীনবাবু গুনগুন করে একটা গান গাইতে গাইতে দেবকী বসুকে বললেন, এখন যদি রেকর্ডিং হত, তা হলে এ গান তিনি প্রাণ দিয়ে গাইতে পারতেন। শুনে ওই রাতেই সুরকার অনিল বাগচী ও অন্যান্য যন্ত্রশিল্পীদের আনিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেললেন পরিচালক। রেকর্ডিং হল—‘এই খেদ মোর মনে’। শিল্পীর মনের টান ও কণ্ঠ একাকার হলে কী হয়, তার সাক্ষ্য এই গান।
বাংলা ছবির জগতে যে সমস্ত নায়ক-গায়ক এসেছেন, তাঁদের মধ্যে রবীন মজুমদার একটু ব্যতিক্রম। বাকি অসামান্য শিল্পীরা, পরবর্তী কালে হয় অভিনেতা নয় গায়ক হিসেবেই মূলত আসন পেতেছেন দর্শকমনে। কিন্তু রবীনবাবু বরাবর দুটি দিককেই সমান গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। বহু বাংলা ছবিতে তিনি নায়ক-গায়ক, আবার ‘মন্দির’ (১৯৪৭) ছবিতে শুধুই নেপথ্যশিল্পী। হিন্দিতেও তাই। ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ (১৯৪৬), ‘দুখিয়ারি’ (১৯৪৮) ছবিতে অভিনয়-সহ গান, আবার ‘হসপিটাল’ (১৯৪৩), ‘রাণী’ (১৯৪৩), ‘বিন্দিয়া’ (১৯৪৬) ছবিতে গাইছেন নেপথ্যে। কেরিয়ারের শেষ দিকে শুধু অভিনয়; মঞ্চাভিনয়ও করেছেন— ১৯৫২ সালে ‘সেই তিমিরে’ নাটক থেকে ১৯৮২ সালের ‘প্রজাপতি’ পর্যন্ত। সেখানেও সব ক্ষেত্রে গান নয়। এর মধ্যে ১৯৫৭ সালে মঞ্চেও ‘কবি’ নাটকে ‘নিতাই কবিয়াল’ হয়েছেন, অবশ্যই গান-সহ। এমনকি অরুণকুমার সরকারের পরিচালনায় ‘গ্রীণ অ্যামেচার গ্রুপ’-এর হয়ে অনেক নাটকে অপেশাদার মঞ্চেও অভিনয় করেছেন নির্দ্বিধায়। পাশাপাশি রেকর্ডে গেয়েছেন নন-ফিল্ম আধুনিক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছেন গায়কিও। ১৯৬০ সালে গাওয়া ‘এই যে এলাম শঙ্খনদীর তীরে’ ও ‘নানা রঙের দিনগুলি’-র মতো গানগুলো শুনলে বোঝা যায় তা।
১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়া রবীন মজুমদারকে দীর্ঘ দিন নিজের কাছে রেখে, উপযুক্ত চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন অনুজপ্রতিম সুরকার নচিকেতা ঘোষ। ১৯৭৬ সালে নচিকেতা ঘোষের অকালপ্রয়াণের পর ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭৬) সে কথা কৃতজ্ঞচিত্তে জানিয়েছিলেন রবীনবাবু। নচিকেতা তাঁকে বলতেন, ‘‘আমি তোমাকে আবার সুস্থ করে ইন্ডাস্ট্রির সামনে দাঁড় করাব, এ আমার প্রতিজ্ঞা।’’ সত্যিই সম্ভব করেছিলেন তা। রবীন মজুমদার সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। শেষের দিকে তাঁর গানের গলা স্তব্ধ হয়ে গেলেও, প্রয়াণের বছর অবধি (২৮ ডিসেম্বর, ১৯৮৩) অভিনয় করে গিয়েছিলেন। তাঁর শেষ ছবি ‘উৎসর্গ’ মুক্তি পায় এই বছরই।
সত্তর দশকের শেষে শেখর চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় দূরদর্শন-নাটক ‘আচার্য’-তে মুখ্য ভূমিকায় রবীনবাবুর অসামান্য অভিনয় দেখে ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) ছবিতে ‘চরণদাস’ চরিত্রে তাঁকে নির্বাচিত করেন সত্যজিৎ রায়। চরিত্রটির মুখে একটি গান ছিল। সত্যজিৎ রায় প্রথমে রবীনবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি নিজেই গানটি গাইবেন কি না। উত্তরে তিনি বলেন, অনেক দিন ‘প্রফেশনালি’ গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তখন সত্যজিৎ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, যদি তাঁর লিপে শিল্পী অমর পাল গানটি করেন, তাতে তাঁর কোনও আপত্তি আছে কি না। রবীন মজুমদারের শান্ত জবাব, ‘‘বিন্দুমাত্র না।’’ অতঃপর এক কালের বরেণ্য কণ্ঠশিল্পীর ঠোঁটে রূপ পেল অমর পালের গাওয়া অসামান্য সেই গান, ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’।
কলকাতা দূরদর্শনের শুরুর সময় রবীন মজুমদারের একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছোট বোন, প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী গৌরী ঘোষ। দাড়িগোঁফে ভরা মুখ, শীর্ণকায় রবীন মজুমদার একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে খেই ধরিয়ে দিচ্ছেন বোন। গাইতে পারছেন না, রেকর্ডে বাজানো হচ্ছে সেই সব চিরসবুজ গান। শিল্পী স্তব্ধ হয়ে শুনছেন, যেন ছুঁতে চাইছেন অতীতকে। টিভির পর্দায় তাঁর মুখটা যখন ক্লোজ আপে ধরা হচ্ছে, মনে হচ্ছিল তাঁর দুই চোখ যেন বলতে চাইছে, ‘ভালবেসে মিটিল না আশ, কুলাল না এ জীবনে, জীবন এত ছোট কেনে, এই খেদ মোর মনে...’
কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় সেনগুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy