দরজাটা খোলাই ছিল। কমপ্লেক্সটায় পাহারা মজবুজ। অনুপও নাম ঠিকানা সব কিছু লেখার পরে ভিতরে ঢুকতে পেল। যদিও অনুপ অনেক বারই এই ফ্ল্যাটটাতে এসেছে। এখানেই দীপকদার বাড়ি, অনুপের নিজের পিসির ছেলে। তবে আজকের এ ভাবে আসাটাকে মন থেকে খুব একটা মেনে নিতে পারছে না। দীপকদাদের থার্ড ফ্লোর। ফ্ল্যাটের দরজাতে এখনও গাপ্তুর নাম জ্বলজ্বল করছে। হাল্কা একটু খুলে ভিতরটা দেখে নিল অনুপ। না ড্রয়িংরুমটাতে কেউ নেই। ঘরের একদিকটাতে একটা সাদা চাদর, তার উপর একটা টুল। টুলের সাদা কভারের উপর রাখা আছে ছবিটা। ছবির সামনে ফুলদানি। ছবিতে মালা দেওয়া। অনুপ চটিজোড়া ঘরের ভিতরেই দরজার একটা কোণে খুলে সাদা চাদরটাতে পা রেখে কিছু ক্ষণ এ দিক-ও দিক তাকিয়ে একটু জোরেই বলে উঠল, ‘‘দাদা, কোথায় গেলে?’’
এক জন মাঝবয়সি ভদ্রলোক ঘরের ভিতর থেকে ড্রয়িংরুমে এসে অনুপকে দেখতে পেয়েই একটু স্বস্তির স্বরেই উত্তর দিল, ‘‘ও, তুই চলে এসেছিস, আমি এই ভাবছিলাম। আয় ভিতরে আয়। ছেলেমেয়েরা এল না, স্বপ্না এল না?’’
‘‘দরজাটা খোলাই থাকবে?’’
‘‘হ্যাঁ খোলাই থাক। স্বপ্না আসেনি?’’
‘‘না গো দাদা, ছুটি পেল না।
তা ছাড়া এ রকম একটা ঘটনাতে এসেও বা কী করবে বলো তো? আমার নিজেরই কেমন কেমন লাগছে! বৌদি কই?’’
দীপক একটা একটা লম্বা শ্বাস ফেলে কিছু ক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তার পর নিজের মনেই বলে উঠল, ‘‘‘আর কী করবি বল, সব তো হাতের বাইরে চলে গেল। ’’
‘‘বৌদি কেমন আছে?’’
‘‘আর কেমন। এই যে এই ঘরে শুয়ে আছে। মাঝে তো ডাক্তার দেখাতে হল। বড় শ্যালিকা গত পরশু এসেছে। গাপ্তুর খবর পাওয়া থেকে তো ভাল করে খাওয়াদাওয়াও করেনি। মাঝে কয়েকটা দিন একটু উঠেছিল, আজ সকাল থেকে খালি কাঁদছে। সুগার ডাউন, লো প্রেশার। আমি তো ভয় পাচ্ছি ওকে না হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।’’
অনুপ ঠিক কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। চুপ থেকে বলে উঠল, ‘‘তোমার নিজের শরীর কেমন?’’
‘‘আমি! আমি খুব ভাল আছি। আমাকে তো ভাল থাকতেই হবে।’’
‘‘বিশ্বাস করো আমি প্রথমে ভাবতেই পারিনি।’’
‘‘আমরাও তো বিশ্বাস করিনি। সন্ধে থেকেই বলে রেখেছিল, ‘রাতে ঠাকুর দেখতে যাব।’ প্রতি বছরেই যায়। কয়েক জন বন্ধু মিলে এই এ দিক-সে দিক ঘোরে। একটু মজা করে। সবাই বাইরে বাইরে পড়ে। এই কয়েকটা দিনই যা একসঙ্গে থাকে। আমরাও তাই বাধা দিই না। ডিনারটা বাইরে করবে বলল, আমি হাজার টাকাও দিলাম।’’
‘‘ক’টা নাগাদ খবর পেলে?’’
‘‘আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে। ওর মায়ের ফোনে পুলিশ খবর দিল।’’
‘‘স্পট?’’
‘‘না। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরেই। দু’জনেই সঙ্গে সঙ্গে গেলাম।’’
‘‘বৌদি এ ঘরে?’’
‘‘হ্যাঁ... হ্যাঁ। যা, শুয়ে আছে।’’
অনুপ এ বার ভিতরের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বৌদিকে ভিতরে শুয়ে থাকতে দেখল। বিছানার চার দিকে আরও কয়েক জন মহিলা বসে আছেন দেখে অনুপ দরজার কাছে কিছু সময় দাঁড়িয়ে অন্য আর একটা ঘরের দিকে পা বাড়াল। তিন কামরার এই ফ্ল্যাটটায় এর আগেও বেশ কয়েক বার এসেছে। দিল্লি থেকে কলকাতা এলে দীপকদার কাছে কিছু ক্ষণের জন্য হলেও আসে। বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়েও অনেক বার এসেছে। স্বপ্নাও শুনে ফোন করে খুব কান্নাকাটি করেছে। আসার কথাও ভেবেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ছুটি পেল না। ছেলেমেয়েদেরও ছুটি নেই।
পাশের ঘরটা গাপ্তুর। এখানে এলে এই ঘরটাতেই থাকত অনুপ। এখনও এ দিক-ও দিক ছড়ানো আছে জামাকাপড়, বই, পেন, হেডফোন। কম্পিউটার টেবিলের ড্রয়ারটাও বেশ কিছুটা খোলা। ভাইপোর বিছানাতে বসতেই সামনের দেওয়ালে সচিন আর সৌরভের একটা ছবি, আর তার পাশে একটা বিদেশি বাইকের ছবির দিকে চোখ পড়ল। ঘরটা যেমন ছিল তেমনই করে রাখা আছে বুঝল অনুপ।
অনুপ কোনও বিদেশি বাইক চেনে না। নিজের একটা পুরনো বাইক আছে। এখানে এলে ওটা নিয়ে মাঝে মাঝে এ দিক-ও দিক ঘোরে। দিল্লিতে অফিসের গাড়ি আছে। দীপকদার গাপ্তুকে অত দামি বাইক কিনে দেওয়ার কথায় প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিল। কিন্তু কিছু বলেনি। কী দরকার। শুধু গাপ্তুকে এক দিন ফোনে বলেছিল, ‘‘সাবধানে চালাবি বাবু।’’
‘‘ওর ঘরটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। প্রতিটা জায়গায় গাপ্তুর স্মৃতি, কী ভাবে ভুলে থাকব? এড়িয়ে যত ক্ষণ থাকা যায়।’’
কথাগুলো বলতে বলতে দীপকদা বিছানার চাদরে হাত বোলাতে লাগল। পাশে বসে থাকা অনুপের সব দেখে বুকটা কেমন যেন চাপ হয়ে আসছিল। কিছু ক্ষণ দু’জনেই চুপ, তার পর দীপকদাই বলল, ‘‘কিছু খাবি? একটু চা করতে বলি?’’
অনুপ এয়ারপোর্ট থেকে সোজা দীপকদার বাড়িতে চলে এসেছে। মাঝে রাস্তায় একটু টিফিন করেছে। চা’ও খেয়েছে। জানে এ বাড়িতে খাবারের কথা কাউকে বলা যাবে না। দীপকদার কথার উত্তরে বাইকের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘‘বাইকে খুব প্যাশন ছিল?’’
‘‘হ্যাঁ। আমাকে বলে বলে একটা হাই সিসির বাইক কেনা করাল। এক লাখ সত্তর হাজার টাকা দাম। ওর মা তখন বারণ করেছিল। আমি ভাবলাম, যাক আর তো কিছু চায় না। তা ছাড়া পড়াশোনাটাও করে। মাসে এক বার বা দু’বার আসত। তখনই একটু-আধটু যা বাইকটা নিয়ে বেরোত। তাও দূরে কোথাও যেত না।’’
‘‘আজ কি শ্রাদ্ধের কাজ হবে?’’
‘‘না রে, সে সব তিন দিনের দিন মিটিয়ে দিয়েছি।’’
শেষের শব্দগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকল একটা লম্বা শ্বাস। কিছু ক্ষণ চুপ থেকে দীপকদা বলে উঠল, ‘‘ফ্ল্যাটের কেউই খাবে না। যে দিন বলতে গিয়েছিলাম, সে দিনই সবাই বলে দিয়েছিল। তবে সবাই আসবে বলেছে। তাও ব্যবস্থা আছে, পঞ্চাশ জনের মতো খাবে।’’
‘‘আবার খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা করলে?’’
‘‘ওর মা বলল। আজ তো গাপ্তুর জন্মদিন। গাপ্তু তো আজও কয়েক জনের মধ্যে বেঁচে। তারা আসবে, তাদের বাড়ির লোক আসবে।’’
‘‘মানে?’’
দীপকদা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় ঘরের দরজার কাছে এক মহিলা এসে বললেন, ‘‘জামাইবাবু, দিদির কোনও ওষুধ আছে?’’ দীপকদা সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরে গেল। কিছু ক্ষণ পরে আবার এই ঘরে ফিরে এসে বলল, ‘‘তোর বৌদির শরীরটাই সবচেয়ে খারাপ হয়ে গেছে, প্রথম পাঁচ-ছয় দিন তো কিছুই খায়নি, কাঁদেওনি। শুধু ওই বিছানায় শুয়ে ছিল। ডাক্তারকে ঘুমের ইনজেকশন দিতে হয়েছিল।’’
‘‘বললে যে শ্রাদ্ধ হয়ে গিয়েছে, তবে তোমরা আজ এত লোক...ওর জন্মদিন বলে?’’
‘‘সেটা একটা কারণ। তবে আরও একটা কারণ আছে,’’ দীপকদা কথা বলতে বলতে চোখ দুটো মুছল।
ডোরবেলটা বেজে উঠতেই দীপকদা আবার বাইরে গেল। কিছু সময় পরেই অনুপের কাছে এসে বলে, ‘‘তুই একটু হেল্প করতে পারবি? কেটারিংয়ের ছেলেগুলো এসেছে, খাবারগুলো একটু ধরে ধরে নামিয়ে নিতে হবে।’’
অনুপ উঠে গিয়ে কেটারিংয়ের তিনটে ছেলের সঙ্গে হাত লাগিয়ে সব খাবার দীপকদার ফ্ল্যাটে নিয়ে এল। পাড়া-প্রতিবেশী, ফ্ল্যাটের সবাই এক এক করে এসে ফোটোতে মালা বা ফুল দিয়ে প্রণাম করে যাচ্ছে। কেউ কেউ দীপকদার দুটো হাত ধরে কেঁদে উঠছে। কেউ কেউ বৌদির ঘরে যাচ্ছে, বসে থাকছে। চোখে শাড়ির আঁচল, রুমাল বা চুড়িদারের ওড়না নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছে। বাইরের ঘরের একটা কোণে দাঁড়িয়ে অনুপের সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। বুক ফেটে জল এল, শুধু দুটো চোখ শুকনো খটখটে। কী করবে বুঝতে পারল না। দীপকদার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘‘খুব অস্বস্তি লাগছে দাদা, একটু ঘুরে আসি। বসে থাকতে পারছি না।’’ দীপকদা তখন ফ্ল্যাটে আসা সকলের সঙ্গে কথা বলছে। অনুপের কথা শুনে উত্তর দিল, ‘‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি আসবি। তুই আজ থাকবি তো?’’
‘‘না গো দাদা, কাল বাইরে থেকে কয়েক জন আসবেন, তাঁদের সঙ্গে মিটিং আছে। রাতের ফ্লাইটেই চলে যেতে হবে।’’
‘‘ঠিক আছে, এখন তো আছিস। তাড়াতাড়ি আসবি। ওঁরাও আসবেন তো।’’
‘‘ওঁরা মানে?’’
‘‘ওই যে গাপ্তুর তিন জন।’’
কথাগুলো শুনে আবার একটা খটকা লাগল। এ দিকে শরীরটাও ভাল লাগছে না। কমপ্লেক্সের বাইরে বেরিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখল, প্রায় জনা পঁয়ত্রিশ কমপ্লেক্সের ভিতর ঢুকছে। এঁরাই কি দীপকদার আমন্ত্রিত? নাও হতে পারে। এত বড় কমপ্লেক্স, এত লোক, অন্য কারও ফ্ল্যাটেও যেতে পারে। এ দিক-ও দিক ঘুরে কিছু ক্ষণ পর দীপকদার ফ্ল্যাটে যেতেই দেখল, ড্রয়িংরুমে সেই চাদর পাতা জায়গাটাতেই একসঙ্গে অনেকে খেতে বসেছেন। দরজার কাছে দাঁড়াতেই দীপকদা বলে উঠল, ‘‘ও, তুই এসে গেছিস। এঁদের হয়ে যাক, তার পরে আমরা খেতে বসব।’’
‘‘ঠিক আছে।’’
অনুপ চারদিকটা দেখে নিল। মাংস, ফ্রায়েড রাইস, আইসক্রিম, মালাই চমচম। সব কিছু বেশ অদ্ভুত লাগল। সব থেকে আরও অদ্ভুত লাগল, বৌদি পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে এ ঘরে চলে এসেছে। গাপ্তুর ছবির কাছে বসে এঁদের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে বলে উঠছে, ‘‘তুমি একটু মাংস নাও, তুমি একটু ফ্রায়েড রাইস।’’কেউ ‘না’ বললেই বলে উঠছে, ‘‘সে কী! না খেলে গাপ্তুটাও তো খেতে পারবে না।’’
অনুপ আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে থার্ড ফ্লোরের লনে এসে দাঁড়াল। সেখান থেকে শহরের অনেকটা দেখা যায়। ওখানে গিয়ে দাঁড়াতেই আর এক জন ভদ্রলোক এসে পরিচয় করলেন অনুপের সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে অনুপ খাওয়াদাওয়ার কথাটা তুলতেই ভদ্রলোক একটু অবাক হয়েই বললেন, ‘‘এ মা আপনি কিছু জানেন না?’’
অনুপ খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল, ‘‘কীসের বলুন তো?’’
‘‘এই গাপ্তুর মারা যাওয়ার পরের সব ঘটনা?’’
‘‘না তো। কিছু হয়েছে? দীপকদা তো কিছু বলেনি আমায়।’’
‘‘বলবার মতো ঘটনা, আবার নয়ও। আপনি খেয়াল করেননি, গাপ্তুর ফোটোর বাঁ-পাশেই তিন জন বসে আছে। এক জন একটু বয়স্ক, বাকি দু’জন মাঝবয়সি। গাপ্তু আজও তাঁদের মধ্যে বেঁচে।’’
‘‘মানে?’’
‘‘এক জনের শরীরে আছে গাপ্তুর হার্ট। বাকি দু’জনের শরীরে দুটো কিডনি। চোখের কর্নিয়া দুটোও দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের নাম জানা যায়নি। এখানে গাপ্তুর মারা যাওয়ার কয়েক দিন পরে তো কাগজে এ সব নিয়ে খুব লিখল। দীপকবাবু, বৌদিকে টিভিতেও দেখাল। তাঁদেরই সব বাড়ির লোকজন আজ এসেছেন। গাপ্তুর পছন্দের সব কিছুই রান্না হয়েছে। আজ তো গাপ্তুর জন্মদিন। আপনি এ সবের কিছুই জানেন না?’’
অনুপের দুটো চোখ ভিজে গেল। ভদ্রলোকের কাছ থেকে আস্তে আস্তে আবার দীপকদার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গাপ্তুর ফোটোর পাশে বসে থাকা তিন জনের দিকে একভাবে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ঘরের ভিতর খাওয়াদাওয়া চলছে। দীপকদা দেখাশোনা করছে, বৌদি একভাবে গাপ্তুর ছবির কাছে বসে আছে। চোখেমুখে কেমন যেন একটা তৃপ্তির ভাব। গাপ্তুর শরীরের প্রতিটা অংশই তো বৌদির লালনে আর দীপকদার পালনে তৈরি। গাপ্তুর শরীরটা শুধু গাপ্তুর একার নয়। আজও নয়। বৌদি যত্ন করে সেই তো গাপ্তুকেই খাওয়াচ্ছে। এখানে আসার পর থেকে বৌদির সঙ্গে এক বার কথা বলার সুযোগও হয়নি। বৌদির ঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালেও বৌদি প্রায়ই অচেতন হয়ে শুয়ে ছিল। সেই বৌদিই উঠে বসে এদের খাওয়াচ্ছে। মৃত্যু মানে থেমে যাওয়া নয়। গাপ্তুও থামেনি। এ সব ভাবনার মধ্যেই অনুপের চোখদুটো এ বার গিয়ে পড়ল গাপ্তুর ছবির উপর। যে ছবিতে ছেলেটি প্রাণ ভরে হাসছে। যেন কিছুই হয়নি। এই তো আমি আছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy