Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ছোটগল্প

যবনিকা

এখন অক্টোবরের মাঝামাঝি। দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে, কালীপুজো আসছে। ছাতিম ফুলের গন্ধে আকাশ-বাতাস ম-ম করছে। বেশ লাগছে এই অনুভূতিটা। একটা নস্টালজিয়ায় আপ্লুত হয়ে আছি আমি।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

নন্দিতা বাগচী
শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

এই মুহূর্তে আমি আছি তেরো নম্বরে। যদিও এই তেরো নম্বরটা নিয়ে আমার মনে কোনও শঙ্কা নেই। জানি ঘণ্টাখানেক বাদেই হয়তো বারো নম্বরে চলে যাব আমি। তার পর এগারো, দশ, নয়, আট হয়ে এক নম্বরে। কিন্তু এই অপেক্ষা ব্যাপারটা আমার সহ্য হয় না। কোনও রকমে একটা লং জাম্প মেরে এক নম্বরে পৌঁছে যেতে পারলে বেশ হত। ঘুষ-টুস দিয়ে এক নম্বরে পৌঁছে যাওয়া তো আমাদের দেশের মানুষদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু এমন অচল ও অনড় হয়ে পড়ে আছি যে ঘুষখোর দালালটিকেও খুঁজে বের করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমার সঙ্গীসাথীরাও যে কোথায় চলে গেল সব! যেন অকুস্থলে পৌঁছে দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল। আরে বাবা, আমি এক জন অভিনেতা, আমার জীবনের কি একটাই পর্যায়? ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চের মতোই জীবন আমার।

এখন অক্টোবরের মাঝামাঝি। দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে, কালীপুজো আসছে। ছাতিম ফুলের গন্ধে আকাশ-বাতাস ম-ম করছে। বেশ লাগছে এই অনুভূতিটা। একটা নস্টালজিয়ায় আপ্লুত হয়ে আছি আমি।

কমলিকার ভারী পছন্দ ছিল ছাতিম ফুলের গন্ধ। শরৎ-হেমন্তের সন্ধিক্ষণে সারা কলকাতা ঢুঁড়ে খুঁজে বেড়াত ছাতিম গাছ। বলত, তোমাদের কলকাতা বড় রুক্ষ। ইট-কাঠ-লোহা-সিমেন্টে ভরা। সবুজের কণামাত্র নেই। চলো আমাদের আশ্রমে, ছাতিমে ছাতিমে ছয়লাপ হয়ে আছে সে অঞ্চল।

কিন্তু যে দিন অ্যাকাডেমির চত্বরে প্রথম বার এল, উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল ছাতিম গাছগুলো দেখে। তার পর তো তার নিত্যি যাওয়া-আসা সে চত্বরে। তার কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে গিয়ে আলাপটা ধীরে ধীরে প্রেম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। আমার প্রতিটি সংলাপ কণ্ঠস্থ ছিল তার। যে দিন প্রথম বার শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ নাটকটা দেখল, আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। সে রাতে আর নিজের ডেরায় ফিরে যায়নি সে। আমার বাসাবাড়ির নড়বড়ে খাটটায় শুয়ে বিবস্ত্র হয়ে প্রলাপ বকেছিল। বলেছিল “আমি ডেসডিমোনা, আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করো। আমাকে মেরে ফেলো। সে মৃত্যু আমার কাছে হবে শ্যামসমান।”

কে জানে কেমন আছে সে কানাডায়। শুনেছি একটা সঙ্গীত অ্যাকাডেমি করেছে সেখানে। দু-তিন বছর বাদে বাদে দেশে আসে। বড় হল ভাড়া করে প্রোগ্রাম করে। স্বামী মস্ত ব্যবসায়ী। কিন্তু সেখানে কি ছাতিম গাছ আছে?

যাক বাবা, বারো নম্বরে এসে গেছি। তেরো নম্বরটা আমার জন্য লাকিই বলতে হবে। আমার দলের ছেলেরাও এসে আমার খোঁজখবর করে গিয়েছে ঠিক সময়ে। আমিই ভুল বুঝেছিলাম ওদের। এটুকুই পাওনা আমার জীবনে। আমাদের দেশের বেকার, উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো অসময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়।

হ্যাঁ, আমার অসময়েও তো পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল পাড়ার সহদেব মল্লিক, যাঁকে আমরা সবাই সাহেবদা বলে ডাকতাম। টুকটুকে গায়ের রং, টিকালো নাক, লালচে ঢেউ খেলানো চুল আর বাদামি চোখের মণিতে যাঁকে ইয়োরোপিয়ান মনে হত। তিনি নিজেও অবশ্য মজা করে বলতেন, “আই থিঙ্ক আই হ্যাভ আ ড্রপ অব ব্রিটিশ ব্লাড। অতগুলো বছর শাসন করেছিলেন ওঁরা, আমার কোনও পূর্বমাতা কি তাঁদের কারও অঙ্কশায়িনী হননি?’’

‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের সেকেন্দারের চরিত্রে, হেলেন অব ট্রয়ের প্যারিসের চরিত্রে, আন্তিগোনের ক্রিয়ন চরিত্রে, বহু বার অভিনয় করেছি আমি। তবে ওথেলোর চরিত্রটা যেন আমার জন্যই বাঁধা ছিল। সাহেবদা বলতেন, “এই চরিত্রটার জন্য তোর বেশি মেক-আপ দরকার হয় না। বেশ স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু আমি এটা করতে গেলে মুখোশ পরতে হবে, মেক-আপে কুলোবে না।” কথাগুলো শেষ করে হা-হা করে প্রাণখোলা হাসি হাসতেন একটা। বলতেন, “এই হাসিটা কিন্তু আমার হৃদয় থেকে উৎসারিত, নাভি

থেকে নয়।”

তখন মজা করে জবাব দিতাম, “আমাদের অভিনেতাদের আর সঙ্গীতজ্ঞদের নাভিদেশগুলো কিন্তু স্বাস্থ্যে ভরপুর সাহেবদা, কম এক্সারসাইজ় তো করি না।”

সাহেবদা এক চোখ টিপে বলতেন, “আস্তে বল, অঘোরীদের কানে গেলে শকুনের মতো ওত পেতে বসে থাকবে।”

কথাটা মনে পড়তেই গা-টা শিরশির করে ওঠে আমার। অঘোরীরা যে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ায় নরমাংসের খোঁজে আর মানুষের নাভি যে পোড়ে না সে তথ্য জানতাম ওর দৌলতে। অঘোরীদের নিয়ে একটা নাটক করেছিলাম, তখনই জেনেছিলাম।

নানা স্ফুলিঙ্গ খেলা করত সাহেবদার মাথায় আর ফিনিক দিয়ে উঠত তারা মাঝে-মাঝেই। এক বার আমেরিকার বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে গিয়েছিলেন। তাঁকে বিশেষ বিশেষ দর্শনীয় স্থানগুলো দেখাতে চাইলেন প্রবাসীরা। কিন্তু তিনি বললেন, শুধুমাত্র নিউইয়র্কে গিয়ে দেখতে চান কিছু ব্রডওয়ে শো, আর মাথা ঠেকাতে চান লিঙ্কন সেন্টারে।

দেশে ফিরে এসে সে কী উত্তেজনা তাঁর! ‘ফ্যানটম অব দ্য অপেরা’ আর ‘লে মিজারেব্‌ল’ নামে দুটো মিউজ়িক্যাল দেখে এসেছেন তিনি টাইম স্কোয়্যারের ব্রডওয়েতে। কলকাতাতেও তেমনই মিউজ়িক্যাল থিয়েটার করতে চান। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্য নয়, পুরাতনীও নয়। সে সবের উপরে অনেক কাজ হয়েছে আগে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপরে নাটক লিখে মঞ্চস্থ করবেন তিনি। সে সম্পদে অবগাহন নয়, হাবুডুবু খেতে লাগলাম আমরা। সামান্য কয়েকটি মাসের মহড়ায় কি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখা যায়! তখনই তো কমলিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা

হল আমার।

আমার প্রেয়সী যে আমাকে ত্যাগ করেছিল, তার একটা কারণ ছিল। সে একটা মই পেয়ে গিয়েছিল। তরতর করে উঠে গিয়েছিল সে সেই মই বেয়ে। আমার সঙ্গে জীবন কাটালে সাপের মুখে পড়তে হত বার বার। কিন্তু সাহেবদা আমাকে ত্যাগ করলেন কেন? আমি তো তাঁর স্নেহধন্য ছিলাম বরাবর। কোনও ভুল বোঝাবুঝিও হয়নি আমাদের। তবে কি অধস্তনের উৎকর্ষ সহ্য করতে পারে না মানুষ?

নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন তিনি আমাকে। যেমন করে মূর্তি গড়েন মৃৎশিল্পী। কিন্তু আমি যে গুরুমারা বিদ্যে শিখে ফেলব তা হয়তো তিনি ভাবতে পারেননি। আমার কি কিছু করণীয় ছিল এ ব্যাপারে? আমার ভিতরের প্রতিভাই তো আমাকে একটু একটু করে উন্মোচিত করেছিল। তাঁরই পরামর্শে নিজেকে শাণিত করেছিলাম আমি। তবে কেন তিনি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়লেন? আর একটু উদারতা দেখাতে পারলেন না কেন? তবে এ তো আজকের কথা নয়। দ্রোণাচার্যও তো সহ্য করতে পারেননি একলব্যের সাফল্য। শিষ্যের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ যাচনা করেছিলেন তিনি, যেটি বিনা ধনুর্বিদ্যা মূল্যহীন।

আকাশে বেশ মেঘ করেছে। অসময়ের মেঘ। হাওয়াও দিচ্ছে একটু একটু। বেশ ভাল লাগছে আমার। গুনগুন করতে ইচ্ছে করছে ওই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা, যেটা জর্জদার রেকর্ড শুনে তুলেছিলাম আমি। কী যেন ছিল তার বাণী? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, “মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’।” সঙ্গীতে তেমন কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা তো ছিল না আমার, তবে ঈশ্বরপ্রদত্ত একটা কণ্ঠ ছিল। যে কোনও গানই খেলত আমার গলায়। খুব সহজে।

ছাতিম ফুলের গন্ধ আর মেঘ আমাকে রোম্যান্টিক করে তুলেছে আজ। কালিদাসের মেঘদূতের যক্ষ মনে হচ্ছে নিজেকে। ওই অসময়ের মেঘকে বলতে ইচ্ছে করছে, আমার প্রিয়াকে গিয়ে বলো, আমি এক অচিন পথে যাত্রা করেছি আজ, সে যেন মঙ্গলঘটে আম্রপল্লব রেখে যাত্রার মন্ত্রটা পড়ে। আমার এ পথ, এ যাত্রা যেন সুগম হয়।

যাত্রার কথায় মনে পড়ল, আমাদের দলের বৈজয়ন্তদা দল ছেড়ে দিয়েছিলেন। যাত্রা করতে শুরু করেছিলেন বেশি টাকা রোজগারের জন্য। এক দিন তাঁদের মহড়া দেখতে গিয়েছিলাম আমি। তাঁর অট্টহাসি শুনে হেসে ফেলেছিলাম। কংসের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন তিনি। এক ঘর লোকের সামনে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘‘অভিনয়ের কী বুঝিস তুই? ওই এয়ারকন্ডিশনড্‌ হলের স্টেজে কিছু বিদেশি নাটকে আঁতলামো করলেই অভিনেতা হওয়া যায় না। আসল অভিনয় হয় আমজনতার সামনে চারদিক খোলা স্টেজে, যেখানে পর্দার আড়াল থেকে কেউ প্রম্‌ট করবে না, আলোর কারসাজিতে অভিনেতার দোষ-ত্রুটি ঢেকে দেবে না।’’

এমনই ছোট ছোট অপমানের কাঁটায় বিদ্ধ হতাম আমি। শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম তো। তখন ওঁরা নামজাদা অভিনেতা। আমার একাগ্রতা, আমার অনুশীলন আমার ভিতরের ছাই-চাপা আগুনটাকে হয়তো জাগিয়ে তুলেছিল। সেটা ওঁরা সহ্য করতে পারেননি। না সাহেবদা, না বৈজয়ন্তদা।

সাহেবদা যখন আমাকে ত্যাগ করলেন, তখন আমি পাদপ্রদীপের আলোয় ঝলমল করছি। তাই নতুন দল গড়ে তুলতে সময় লাগেনি। খুব উৎসাহিত হয়ে দলের নামটা রাখি আমি। ‘যবনিকা’। তাই শুনে নাকি সাহেবদা ক্রূর হেসে বলেছিলেন, “ওরে, ওর ওই যবনিকা পতনের সময় হয়ে গিয়েছে। পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে মনে হচ্ছে”।

খুব কষ্ট হয়েছিল কথাগুলো শুনে। তবু সংযত রেখেছিলাম নিজেকে। কোনও মন্তব্য করিনি। মিরজাফরের তো অভাব নেই আমাদের জগতে। যে ভাবে তাঁর বলা কথাগুলো আমার কানে এসেছে, ঠিক সেই ভাবেই আমার মন্তব্যগুলোও হয়তো পৌঁছে যেত তাঁর কানে।

আঃ! দলের ছেলেগুলো আমার কান ফাটিয়ে ঝগড়া করছে। বোধহয় আমার পিছনে যে ছিল, তার বাড়ির লোকেরা ঘুষ-টুস দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আমাকে বুঝতে না দিয়েই। অতই সোজা?

এ হল কলকাতা। অন্যায় কাজ করেই দেখুক কেউ, জনতা আছে না প্রতিবাদ করার জন্য? পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেবে। যে কালকেই কোনও মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, সেও যোগ্যতা রাখে আজকের ধর্ষককে উত্তম-মধ্যম দেওয়ার।

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। নতুন নাটকের মহড়া শুরু করলাম আমরা। কাহিনিটা আধুনিক। আমারই লেখা। নাম ‘খোঁজ’। একটি অবৈধ সন্তান তার বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার মায়ের তিন জন প্রেমিক ছিল এবং তিন জনের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক ছিল। তাই তার মা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছে না কোন পুরুষের ঔরসে জন্ম তার। জনান্তিকে বলে রাখি, একটা বিদেশি নাটকের আদলে গল্পটা লিখেছি আমি। কেউ যাতে আঙুল না তোলে, তাই বিজ্ঞাপনে ওই নাটকের নামটা উল্লেখ করে ‘অনুপ্রাণিত’ শব্দটা লিখে দিয়েছিলাম। আসলে ভারতীয় পুরাণ বা গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো নাটক আর দেখতে চায় না এখন জনতা। মুঠোফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মানুষ এখন খুব স্মার্ট। তাই একটা আধুনিক কাহিনির নাট্যরূপ দিতে চেয়েছিলাম। তবে এ কাহিনি কি খুব বেশি আধুনিক? সেই মহাভারতের সময় থেকেই তো অবৈধ সন্তানের জন্ম দেওয়া চলছে।

তা সেই তিন প্রেমিকের এক জন শীতের অতিথি, বাড়ি বাড়ি ঘুরে শাল বিক্রি করে। এক জন মোবাইল ফোন সারায়। তৃতীয় জন ইলেক্ট্রিশিয়ান। এই তৃতীয় প্রেমিকটি আসলে আমি।

গল্পটা যেহেতু আধুনিক সেই হেতু অযথা জটিল না করে সোজাসুজি ডিএনএ টেস্টে চলে যাই আমি। মেয়েটি তিন জনের কাছেই কাকুতি মিনতি করে ডিএনএ পেটারনিটি টেস্ট করাবার জন্য। কিন্তু কাহিনিকে অত সরল করলেও দর্শকরা মেনে নেবেন কেন? সমাজ বলেও তো একটা কথা আছে। নারীর অবৈধ সন্তান হতেই পারে কিন্তু পুরুষ কেন আগ বাড়িয়ে পিতৃপরিচয় দিতে যাবে? তাকে তো কোনও পিতৃত্বের চিহ্ন বহন করতে হয় না।

সে যা হোক, মেয়েটি তার সম্ভাব্য পিতাটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর প্রত্যেকের কাছে গিয়ে তার পিতৃপরিচয় যাচনা করছে। আমার কাছে যখন আসে মেয়েটি, তখন আমি মঞ্চের মাঝখানের ঝাড়লণ্ঠনটা সারাচ্ছিলাম। মানে সারাবার অভিনয় করছিলাম একটা ঘরাঞ্চির উপরে দাঁড়িয়ে। প্রতি শো’য়েই তাই করি। কিন্তু কাল রাতের শো’য়ে কী যে হয়ে গেল! বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছিটকে পড়লাম আমি। শো বন্ধ হয়ে গেল। যবনিকা পতন হল। দর্শকরা হুড়মুড় করে হল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ডাক্তার এলেন। ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। কারণ দেখালেন ইলেক্ট্রোকিউটেড। আগে থেকেই খোলা তার রাখা ছিল ওই ঝাড়লণ্ঠনটায়। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা এত সুন্দর ভাবে পরিকল্পিত ছিল যে সন্দেহের অবকাশ ছিল না।

তবে কি বৈজয়ন্তদা আমার সেই হাসির বদলা নিলেন? নাকি সাহেবদা? তিনি তো বলেইছিলেন যে আমার অভিনেতার জীবনে নাকি যবনিকা পতনের সময় হয়ে গেছে।

ধীরে পাঠক, ধীরে। রহস্যের সমাধান অত সহজে হয় না। কিছু দিন হল মানসিক অবসাদে ভুগছিলাম আমি। এ পৃথিবী কেমন যেন হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়েও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটা নেতিবাচক তরঙ্গ ঘিরে থাকত আমাকে সদাসর্বদা, আর একটা প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আত্মহত্যার নানা উপায় খুঁজছিলাম।

ওই তারটা আমিই খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। একটা সুইসাইড নোট লিখে আমার প্যান্টের পকেটেও রেখে দিয়েছিলাম, “এই আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত হয়েছি আমি। সাহেবদা ও বৈজয়ন্তদার নানা কটু মন্তব্য বিদ্ধ করে আমাকে। উপায়ান্তরহীন হয়ে এ পথ বেছে নিলাম।”

এই মৃত্যু আমাকে মহান করে দিয়েছে। খবরের কাগজের একটা কোনায় একটা ছোট্ট খবরও ছাপা হয়েছে। শিরোনাম দিয়েছে, ‘অভিনেতার জীবনে যবনিকা পতন’। কিন্তু আসল নাটক চলছে এখন পুলিশের সঙ্গে সাহেবদা ও বৈজয়ন্তদার।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে এক নম্বরে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। ঘটাং করে একটা আওয়াজ হল। চুল্লির দরজাটা খুলে গেল। অস্থি নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন আমার অগ্রবর্তী দেহের আত্মীয়েরা। চুল্লিটা আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে তার কয়েক সহস্র ভোল্টের মারণ-তেজ নিয়ে।

কপিকলের দড়িটায় টান দিলেন ঈশ্বর। যবনিকাটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। অন্তরালে চলে যাই আমি। ঈশ্বর করুণাময়। আমি জানি, তিনি আরও দু’টি যবনিকা বুনে চলেছেন উইংসের আড়ালে বসে।

অন্য বিষয়গুলি:

Jabanika Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy