সারস্বত: স্বামী প্রভানন্দের সঙ্গে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০০০ সালে। ডান দিকে, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ বইয়ের প্রচ্ছদ
বিশিষ্ট বাঙালিদের শতবর্ষ-দুর্বলতা নিয়ে যিনি সর্বদা রঙ্গরসিকতা করতেন, সেই অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ উৎসব এসে গেল। ভাবতে বেশ লাগছে। হাওড়া কাসুন্দের ফ্ল্যাটে বসে অসিতদা বলেছিলেন, ‘অমন যে রবীন্দ্রনাথ, যিনি অনন্তকাল রাজত্ব করবেন, তিনিও নার্ভাস হয়ে আবেদন করে ফেললেন, আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে?’
বিদ্যের জাহাজ অসিতদার সুযোগ্যা সহধর্মিণী, ইতিহাসের বিদুষী অধ্যাপিকা ও লেখিকা বিনীতাদি বলেছিলেন, ‘যে দেশে মানুষ পঞ্চাশ পেরোতেই হিমশিম খেয়ে যায়, সে দেশে শতায়ু হও, এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ কী হতে পারে?’ শুনে ‘তা ঠিক, তা ঠিক’ বলেছিলেন অসিতদা। বুদ্ধিমান বাঙালি বুঝে নিয়েছিল, সশরীরে না হলেও, নিরন্তর কাজের মধ্য দিয়ে শতায়ু হওয়ার একটা দ্বিতীয় পথ আছে।
আমাদের হাওড়া-কাসুন্দিয়ার সেই অধ্যাপক অসিতদার সেন্টিনারি উপলক্ষে কলম ধরার জন্য যে আমি আজও বেঁচে আছি, ভাবতে খুব ভাল লাগছে। অসিতদার আর এক রসিকতা— ‘আমরা যারা হাওড়া থেকে কলকাতা শাসনের চেষ্টা করি, আমাদের পরমায়ু টেন পার্সেন্ট সাবসিডির যোগ্য’, যার অর্থ, নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে বিষাক্ত হাওয়া, ট্র্যাফিক জ্যাম এবং হাওড়া ব্রিজের দৈনন্দিন যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করে জীবিত থাকলে এই শতবর্ষে আমরা তাঁর বয়স ঘোষণা করতাম ১১০ বছর।
অসিতদা আমাদের মধ্যে নেই, আবার আছেন। তাঁকে নিয়ে এখন হইচই নেই, তিনি এখন নিত্য-স্মরণীয় বা নিত্য-উল্লিখিত নন, তবু তিনি বেঁচে রয়েছেন সংখ্যাহীন ছাত্রছাত্রীর হৃদয়ে, যাদের মধ্যে আমিও এক জন।
তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিতান্ত বাল্য বয়সে। হাওড়ায় আমি তাঁর প্রতিবেশী। আমাদের বিহারীলাল চক্রবর্তী লেন থেকে যেখানে সরু যোগমায়া দেবী লেন বেরিয়ে গিয়েছে, সেখানেই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র হিসেবে তিনি আমাদের হিরো। পরীক্ষায় ফার্স্ট ছাড়া কিছুই হন না। দূর থেকে সসম্ভ্রমে দেখেছি, কী শীত, কী গ্রীষ্ম, গলায় মাফলার পরে ঘুরে বেড়াতেন ঠান্ডা লাগার ভয়ে। পুরো নামটাও জানতাম না। ‘হেজোদা’ বলে তাঁর পরিচিতি। এক দিন মা বললেন, ওদের মামার বাড়ি আর আমার মামার বাড়ি বনগাঁর কাছে নকফুলে। আইনমতো তিনি আমার মামা, দাদা নন। কিন্তু তখন সংশোধন করা টু লেট, অতএব সারা জীবন উনি অসিতদা-ই রয়ে গেলেন।
পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটা অসিতদার বদ অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, এই কারণে পাড়ার ছেলেদের সারাক্ষণ গঞ্জনা শুনতে হত। চৌধুরীবাগানের বস্তিতে থেকেও যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার স্বপ্ন দেখা যায়, তা অসিতদাই বিশ্বসংসারকে দেখালেন। ওঁর দাদা বিখ্যাত বর্মা শেল তেল কোম্পানিতে কাজ করতেন, রসিকতা করে অসিতদা বলতেন, উনি কলুর দোকানে কাজ করেন। ওখানে তখন মাইনে-টাইনে অনেক, কিন্তু অসিতদা শিক্ষকতার মতো কষ্টকর কাজকেই বেছে নিলেন। যে দিন তিনি নবদ্বীপ কলেজে চলে গেলেন, সে দিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, ভাল রেজ়াল্ট করতে না পারার সমালোচনা বাড়িতে প্রতিদিন সহ্য করতে হবে না। বেশ মনে আছে, হঠাৎ এক দিন তিনি হাওড়ায় ফিরে এলেন, নবদ্বীপের প্রবল ঠান্ডা আর তাঁর সহ্য হচ্ছে না বলে।
এর পর এক দিন সেই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার হাওড়ার অন্য অঞ্চলে নিজস্ব বাড়িতে উঠে গেলেন। আমি পিতৃহীন হয়ে কোনও ক্রমে রিপন কলেজে আই এ পড়তে ঢুকলাম। অঙ্ক জানি না, ইংরিজি জানি না, বিজ্ঞানে অজ্ঞানে অবস্থায় অধ্যাপক অসিতকুমারের সঙ্গে শিয়ালদহ বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয়ে গেল। বললেন, ‘বাংলা পড়ো, ভাল ছেলেদের ভবিষ্যৎ আছে।’ হাওড়ার ট্রামে উঠে আমার টিকিট কেটে দিলেন। সেটাই তখনকার পরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বেচ্ছাসৌজন্য।
বাংলা সেকেন্ড ল্যাংগোয়েজ ক্লাসের আকার ছোট। আমাদের সহপাঠী ছিল সেতারবিদ নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। সে নানা রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত, অসিতদা পরম যত্নে উত্তর দিতেন। আমি অবাক হয়ে শুনতাম, কোনও রকম প্রশ্ন করার সাহস হত না। আমাদের পাঠ্য ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারি না, বইটাও অর্থাভাবে কেনা হয়নি। পরীক্ষায় ভরাডুবি হওয়ার আশঙ্কায় এক দিন সাহস করে তাঁর বাড়িতে বিনা নোটিসে হাজির হলাম। মনে মনে আশঙ্কা— সব মাস্টারমশাই প্রাইভেট টিউশনি করেন, আমাকে ধাক্কা খেতে হবে। আজও মনে আছে, অসিতদা মোটেই বিরক্ত হলেন না, অনেক ক্ষণ ধরে পড়ালেন। তার পর বললেন, ‘লিখে নাও।’ এর পর আরও বিস্ময়, বাড়ির অন্দরমহল থেকে আমার জন্য শিঙাড়া, জিলিপি এবং চা নিয়ে এলেন। আমার লজ্জার অবধি নেই। অসিতদা বললেন, ‘হাওড়ার ছেলেরা ভাল করতে বাধ্য, তোমার প্রয়োজন হলেই রবিবারে চলে আসবে।’ অথচ তিনি জানেন, কলেজের আট টাকা মাইনে দিতেও তখন আমার কষ্ট হচ্ছে।
এই সময়ই ‘একেবি’, অর্থাৎ অসিতদা এক দিন রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘কমলাকান্ত একটা বস্তাপচা ক্যারেক্টার নয়, এখনও মাথা খাটিয়ে তাকে কাজে লাগানো যায়।’ এই উপদেশে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ‘কমলাকান্তের মার্ক্সবাদ’ বলে একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেললাম। সেখানে বললাম, ভাল ছাত্ররাই পরীক্ষার সমস্ত মার্ক্স তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে কেন? সামান্য একটা নিউ কমলাকান্ত আমাকে কলেজের হিরো করে তুলল সুরেন্দ্রনাথ কলেজের সাহিত্যসভায় এবং আরও যা স্মরণীয়, কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল আমার দিতে-না-পারা মাইনে মকুব করে দিলেন সানন্দে। বললেন, ‘এই কলেজে বনগাঁয়ের বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েছিলেন। তুমিও চেষ্টা করো।’ আমি বলতে গিয়েছিলাম, কমলাকান্তের নতুন আইডিয়াটা আমার নিজের নয়, আর-এক জন দয়া করে ওটা আমাকে দিয়েছিলেন।
এর পরই আমার ভাগ্য বিপর্যয়, লেখাপড়া আর এগোল না। অসিতদার সঙ্গে দেখা হল এক দিন, বললেন, ‘শিবপুরের শরৎ চাটুজ্যেও বি এ পাশ করেননি। তুমি লেখা ছেড়ো না। মাঝে-মাঝে এস।’ অসিতদা কোনও এক সময় যৌথ পরিবার ছেড়ে কাসুন্দেতে ছোট ফ্ল্যাট নিয়ে বিনীতাদিকে জীবনসঙ্গিনী করে চলে এলেন। আমি ভয়ে ভয়ে মাঝে মাঝে যেতাম, ওঁদের কাছে এ দেশের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার ও আমার নতুন প্রভু নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েলের বিচিত্র জীবনের কথা বলতাম। অসিতদা বলতেন, ‘তোমার ভাগ্য ভাল। কলেজে সময় নষ্ট না করে হাইকোর্টপাড়ায় গিয়েছ।’
তার পর এক দিন বারওয়েল সাহেব মাদ্রাজে মামলা করতে গিয়ে আর ফিরলেন না। নিজের শোক এবং দুর্ভাগ্য মুছে ফেলতে গিয়ে আমার কিছু লিখে ফেলবার ইচ্ছে হল এবং ওঁরা দু’জনও আমাকে দেখা হলেই জানতে চাইতেন, লেখা কত দূর এগোল। প্রথম ধারাবাহিকেই অপ্রত্যাশিত সাফল্য অসিতদার কাছে মোটেই ‘উইন্ডফল’ নয়। তিনি বললেন, ‘সেই ভারতচন্দ্র থেকে ভায়া বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিভূতি মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত হাওড়া হচ্ছে সুপার বেস্টসেলারের জন্মভূমি।’
এই সময় প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় ওঁদের বাড়িতে গল্প করতে যেতাম, আর তিনি সারা দিন কলেজ ঠেঙিয়ে, সাহিত্য পরিষদ লাইব্রেরি তছনছ করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে আড্ডা জমাতেন। বিনীতাদি বলতেন, ‘তোমাদের হেজোদা অনেক মূল্যবান সময় অযথা নষ্ট করছেন, এখন ওঁকে বড় বড় বই লিখতেই হবে। ওঁর একটা কড়া ম্যানেজার দরকার।’ মুখ বুজে হাসি চাপতে চাপতে অসিতদা এক দিন বললেন, ‘তোমাকেও এ বার যে কোনও উপায়ে একটা ডিগ্রি সংগ্রহ করতে হবে, বঙ্গবাসী নাইট কলেজ থেকে। অসিতদা নিজেই ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আমার ভয় কাটানোর জন্য বললেন, ‘কোনও চিন্তা নেই, বইপত্তরে খরচ বাড়াতে হবে না, আমার এখানে অনেক বই আছে।’
সে এক আশ্চর্য সময়। শুধু বেঙ্গলি নয়, ইংলিশ, ইকনমিক্স, হিস্ট্রি— সবই বিনামূল্যে অসিতদা আমাকে কোচিং দিতেন এবং সেই সাহায্য না পেলে আমার পক্ষে নামের পিছনে বি এ লেখার সুযোগ হত না। যা তখন আমাকে বিস্মিত করেছিল, অসিতদার অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তি এবং নিখুঁত হস্তলিপি। ঝটপট যা লিখে ফেলতেন তা পুনর্বার পড়ার প্রয়োজন হত না। তিনি রসিকতা করে বলতেন, ‘এটাই হাওড়ার হাওয়া-বাতাসের গুণ, এখানকার জমি যে উর্বরা তা কলকাতার লোকরা এখন বুঝতে শুরু করবে।’
বিনীতাদি বলতেন, ‘ভূতপূর্ব ছাত্র, বর্তমানে মাই ডিয়ার ছাত্র তোমরা, স্রেফ আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করে নিজের হাতে কিছু করো।’ এই ভাবেই বিবেকানন্দ জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘বিশ্ববিবেক’ গ্রন্থের সূচনা। বিনীতাদি বলতেন, ‘ত্র্যহস্পর্শ— হাওড়ার তিন ডেঁপো সন্তান শঙ্করী, শংকর ও অসিতের যৌথ অবদান।’ এই প্রচেষ্টা কাকে উৎসর্গ করা হবে সে নিয়েও একমত।
আমাদের বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন-এর হেডমাস্টার হাঁদুদা, সুধাংশুশেখর— যাঁকে অসিতদাও মাস্টারমশাই বলতেন।
ভাষা, সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস, কত বিষয়েই যে অসিতদার বিপুল অধিকার ছিল, ভাবলে আশ্চর্য লাগে। এক সময় ওঁর বাড়িতে ফোন এল, আমার খুব সুবিধে হল। বই পড়ে সময় নষ্ট না করে ওঁকে অফিস থেকে ফোন করলেই হল, তিনি সানন্দে তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়ে দিতেন, বা বলতেন, ‘আধ ঘণ্টা পরে বই দেখে ফোন করছি, হাওড়ার লোকরা তেমন কিছু জানে না, এই ভুল ভাঙাতে চলেছি। তুমি এনসাইক্লোপিডিয়া না হলেও চলবে, তুমি শিবপুরের শরৎ চাটুজ্যের উইকেটটাই সামলে যাও।’
শিবপুরের শরৎ চাটুজ্যে বি এ ডিগ্রি অর্জন না করলেও বিভিন্ন বিষয়ে ছিল তাঁর অবিশ্বাস্য আগ্রহ, অসিতদা সেই সব অপ্রকাশিত খবর সরস ভাবে বলতেন। কারও বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল না, বলতেন, ‘আমার ছাত্রছাত্রীরা আমার থেকে অনেক বেশি জানে তা অস্বীকার করব কোন দুঃখে?’ বলতেন, ‘পণ্ডিতরা যখন গোমড়ামুখো হয়, তখনই বিপদ।’ সব বিষয়েই তাঁর রস-রসিকতা। এক পণ্ডিত বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে মার খেয়েছিলেন। এনকোয়ারি হবে, ছেলেরা বলল, মারের কথা বললে ভাল হবে না। পণ্ডিত ভেবেচিন্তে এনকোয়ারি কমিটিকে বললেন, ‘‘মারে নাই, কেবল কয়েকটা ‘মাইল্ড পুশ’ দিসে!’’ আমাদের বলতেন—সাহিত্যের সংগ্রামে কাউকে আঘাত করবে না, নিতান্ত প্রয়োজনে কয়েকটা ‘পুশ’ দেবে।
গল্পের অফুরন্ত ভাণ্ডার ছিল তাঁর। কত জনের কত লেখা যে সংশোধন করে দিতেন, একটি পয়সা না নিয়ে যে কত সঙ্কলনের সম্পাদনা করতেন, ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে।
এক দিন প্রশ্ন উঠল, ভাড়াবাড়িতে আর কত দিন থাকবেন। অসিতদা বললেন, ‘‘বাসাড়ে’ কথাটা কলকাতা-হাওড়ায় একটা গালাগালি, যত দিন কেউ ভাড়া বাড়িতে থাকে সে জাতে ওঠে না, তুমি জমি দেখতে শুরু করো। পাশাপাশি দু’খানা বাড়ি হবে, নকফুল গ্রামে মামার বাড়ির মডেলে।’ জমির খোঁজ পেলে বলতাম অসিতদাকে, চলুন দেখে আসি। উনি বলতেন, ‘তুমি ‘চৌরঙ্গী’র লেখক, তোমার নির্বাচনই ফাইনাল, যেন যোগমায়া দেবী লেন থেকে ভাল হয়।’ এক দিন সব ঠিক করে হাওড়া রেজিস্ট্রি অফিসে দু’জনে গেলাম। অসিতদা বললেন, ‘ভালই হল, বাকি জীবনটা এক সঙ্গে থাকা যাবে, তোমাকেও আর রেফারেন্সের জন্য রোজ রোজ ফোন করতে হবে না।’ আমি বললাম, লোকে বুঝতেও পারল না যে আমি আকাট মুখ্যু! কিন্তু বৃহদারণ্য বনস্পতির ছত্রছায়ায় মনের আনন্দে রয়েছি। সে দিন অঘটন ঘটল, যিনি জমি বিক্রি করবেন তিনি হঠাৎ বললেন, ‘আজ হবে না।’
বেজায় বিরক্ত হলেন অসিতদা। বললেন, ‘যে লোকের কথার ঠিক নেই তার কাছ থেকে জমি নেব না।’ পরে লোকটা এক দিন এসে বলল, ‘চলুন আর এক দিন রেজিস্ট্রি অফিসে।’ অসিতদাকে বললাম, তাঁর বিরক্তি কাটেনি, বললেন, ‘নৈব চ।’ যৌথ জমি আর খুঁজে পাইনি, আমি শিবপুরে ছোট্ট একটা জমির খোঁজ পেলাম। অসিতদার রাগ তত ক্ষণে পড়েছে, তিনি সাঁতরাগাছির পুরনো জমিটাই নিলেন। আমাদের পাশাপাশি বসবাসের স্বপ্ন সফল হল না।
নতুন বাড়ির দূরত্ব অনেক, আমাদের সন্ধের আসরটা মাঠে মারা গেল। অসিতদা তাঁর গবেষণাসমুদ্রে ডুবে গিয়ে কত মণিমুক্তা তুলে আনলেন। বিনীতাদি টেলিফোনে বলতেন, ‘তোমাদের সান্ধ্য আসরটা আমরা ভীষণ মিস করি, কিন্তু ও তা মেনে নিয়েছে, বইয়ের মধ্যেই ডুবে থাকে, ফোনের জন্য ওয়েট করে।’
যত দিন বেঁচেছিলেন, অনুসন্ধান ও গবেষণার মধ্যে ডুবে থেকে অসিতদা যে সব কাজ সম্পূর্ণ করে গিয়েছেন তা তুলনাহীন। এখনও তাঁর কীর্তির মূল্যায়ন হয়নি বলাটা ছোটমুখে বড় কথা হবে না। তিনি তবু বলতেন, ‘আমার ছাত্ররাই আমার অ্যাসেট, তারা আমার থেকেও অনেক বড় বড় কাজ করছে এবং করবে, আমার দৌড় তো বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত পর্যন্ত। যে সব সাহিত্য দিকপালের কীর্তি সারা জীবন ধরে মাপজোক করেছি, তাঁরা আমার থেকে অনেক বড় এটা বুঝতে আমার কোনও দিন ভুল হয়নি।’
মনে পড়ছে, আমার সামনে কে এক জন তাঁকে বলল, ‘আপনি বিদ্যের জাহাজ।’ অসিতদা হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, ‘জাহাজকে সমুদ্রে ভাসতে হয় এবং এই সমুদ্র যে সৃষ্টিশীল সাহিত্য তা বুঝতে আমার সারা জীবন কেটে গেল।’
শতজীবী না হয়েও অসিতদার কীর্তি নীরবে ও সগৌরবে শতাব্দীর অগ্নিপরীক্ষা পেরোতে পারল, ভাবতে খুব ভাল লাগছে। অতীব যত্নে ও পরম স্নেহে চৌধুরীবাগানের এক ভাগ্যহীন বালককে সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করার জন্য তিনি যে ‘মাইল্ড পুশ’ দিয়েছিলেন, তার স্মৃতি আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ। তাঁকে আর এক বার প্রণাম।
ছবি সৌজন্য: সর্বানন্দ চৌধুরী, অরিন্দম সাহা সরদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy