১৯৩৪ সালে বিশিষ্ট চিত্রশল্পী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ-এর আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর প্রতিকৃতি। সৌজন্যে: গ্যালারি আর্টিস্ট মাইন্ড, ভুবনেশ্বর।
এন্ট্রি: ১
দিল্লি, ২০১৫
তিন জন আমেরিকান সাহেব, পাঁচ জন ভারতীয় অধ্যাপক আর ওয়াশিংটনের এক জন রাগী মেমসাহেব, ন’জন মিলে আমার ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন। এর নাম ফুলব্রাইট। কেন হতে চেয়েছি, এখন সামলাও। এখন উঠে পড়াও যায় না। রাগী মেমসাহেব আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন। বাকি আট জন আমার স্নায়ুর উপর বোমা ফেলতে শুরু করলেন। কিন্তু আমি মনে মনে বললাম, ‘যতই বোমা ফেলো, এই ঘর ছেড়ে যাচ্ছি না। কী করবে করো!’
মেমসাহেব কাগজ থেকে মাথা তুলে প্রশ্ন করলেন, “সো ইউ আর আ প্রোডাক্ট অব কৃষ্ণনগর?”
আমার ইগোতে গিয়ে ঢিল পড়ল। প্রোডাক্ট? কৃষ্ণনগর কি একটা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি?
আমি বললাম, “কৃষ্ণনগর ইজ় আ বিউটিফুল টাউন লাইক জর্জটাউন ইন আমেরিকা, এবং শিক্ষায় ও রুচিতে অক্সফোর্ডের চেয়ে কম নয়, কৃষ্ণনগরের মায়ের নাম নবদ্বীপ। ম্যাডাম, আই ওয়জ় বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ ইন কৃষ্ণনগর।”
এর পর আমার দিকে একের পর এক তির ছুটে আসতে শুরু করল। আমি মাথা ঠান্ডা করে প্রবেশ করলাম রবীন্দ্রনাথে। আমার বিষয় ‘হাইফেনেটেড আইডেন্টিটিজ়’। তার মানে আমেরিকার ভারতীয় লেখক। এশিয়া-আমেরিকার মাঝখানে যে একটা হাইফেন আছে সেটা কী এবং কেন, সেটা খুঁজে বার করা। ভিসা একটা মারাত্মক হাইফেন।
আমি ঠাট্টার ছলে বললাম, “আগে আপনাদের যে ভিসা আইন ছিল, সে তো ভয়ঙ্কর! আপনারা বলেছিলেন কোনও এশিয়ানকে ঢুকতে দেবেন না। তা হলে তো জিসাস ক্রাইস্ট এবং রবীন্দ্রনাথ— এই দু’জনকে ভিসা দেওয়া উচিত হয়নি? আর আজ আমেরিকার দিকে তাকান, আমি যত বার আমেরিকা গিয়েছি তত বার লক্ষ করেছি আমেরিকার হাত এশিয়া, আমেরিকার পা এশিয়া। হাত মানে মোবাইল। পা মানে গাড়ি।”
সে দিন ইন্টারভিউতে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন এশিয়ার প্রথম নোবেল-প্রাপক। আমি রবার্ট ফ্রস্ট, হুইটম্যান, অ্যালেন গিনসবার্গ তুলে তুলে দেখাতে লাগলাম রবীন্দ্রনাথ কী ভাবে এঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, কী ভাবে ‘হাইফেনেটেড’ হয়ে আছেন। কী ভাবে হুইটম্যান বোলপুরের ছেলে হয়ে যেতে পারেন, আর রবীন্দ্রনাথ ব্রুকলিনের খেয়াঘাটে দাঁড়াতে পারেন। আপনারা আজ মরপৃথিবীর নাম দিয়েছেন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’? রবীন্দ্রনাথ লণ্ঠনের আলোয় বসে শান্তিনিকেতন নামে এক অজ পাড়াগাঁয়ে সারা পৃথিবীর মনীষা তুলে এনেছিলেন। তিনি মণিপুর থেকে ওড়িশা, মরাঠা থেকে দ্রাবিড়, কাশ্মীর থেকে রাজস্থান, তুকারাম থেকে কবীর সবাইকে নিয়ে একটা ‘অখণ্ড ভারতী মানস’ তৈরি করেছিলেন। এ কাজ তাঁর আগে কেউ করেননি, তাঁর পরেও কেউ করেননি।
টানা কুড়ি মিনিট বলে আমি থামলাম। কারও আর প্রশ্ন নেই। আমি বুঝলাম, রবীন্দ্রনাথ যে উচ্চতা নিয়ে এই ইন্টারভিউ রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন, সেটা লঙ্ঘন করার শক্তি কারও নেই। রবীন্দ্রনাথ যেন আমার পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন।
রাগী মেমসাহেব আমাকে অবাক করে একটা কথা বললেন, “কুড ইউ প্লিজ় রিড আউট ইয়োর ওন পোয়েম ইন ইংলিশ ট্রানস্লেশন?”
তাই নাকি? আমার কবিতা শুনতে চাইছে? বুঝতে পারলাম, আমাকে নেবে না, সে জন্য ভদ্রতা করছে। ইংরেজি অনুবাদে আমার ‘ঘুষ’ কবিতাটা শোনালাম। যে কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথ, শেষে রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বিষয় ঘুষ, লিখেছিলাম আঠাশ বছর আগে, ‘দেশ’ পুজো সংখ্যায়।
কলকাতায় ফিরে এসে ফুলব্রাইট মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। ও সব আমাদের জন্য নয়। একুশ দিন বাদে একটি ইমেল পেলাম। আমি নির্বাচিত। লিখেছে অনেক কিছু দেবে, সঙ্গে মাসে ভারতীয় মুদ্রায় তিন লাখ।
ছোটবেলায় খেতে পেতাম না স্যর, মাই সেকেন্ড মিল ওয়জ় আনসার্টেন। এখন কী হবে? আমি দেয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় স্কলারশিপ পেয়ে আমি রবীন্দ্রনাথকে বললাম, “আপনি আমায় বাঁচিয়ে দিলেন। আপনি না থাকলে আমি পেতাম না। লোকে বাড়ি এসে অপমান করে যেত। মুখে বলত, ‘কী অন্যায়! আপনি পেলেন না?’ মনে মনে বলত, ‘বেশ হয়েছে! জানতাম, পাবেন না!’”
এন্ট্রি: ২
সন্দেশখালি, ২০১৬
সন্দেশখালির একটি স্কুলে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে। গরিব ঘরের মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি ভারতবর্ষ দেখতে পেলাম। এদের পেটে দানা নেই, মুখে আবেগ নেই, চোখে কৌতূহল নেই। সকালে মার খেয়েছে। বিকেলে বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার মার খাবে। এদেরকে আমি কবিতা শোনাব? আমি এত বড় একটা অন্যায় করতে চলেছি? আমি তাদের শ্রীনিকেতন নামে একটা গ্রামের গল্প বলতে শুরু করলাম। একটা আদর্শ গ্রামের গল্প। রবীন্দ্রনাথ যে গ্রামের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং বাস্তবে করে দেখিয়েছিলেন। কোনও জাত থাকবে না। কোনও ধর্ম থাকবে না। ধানখেতে ধান হবে। সেই ধানের কোনও দলিত নেই, কোনও বামুন নেই। গরিব? সো হোয়াট? বাড়ির উঠোনগুলো হবে জ্যোৎস্নার মতো। ঘাস দিয়ে চপ্পল বানাতে হবে। আর হাতে উঠে আসবে বই। তুমি যা-ই করো, বৃক্ষরোপণ করো, বসন্ত উৎসব করো, কবিতা শোনাও, গান শোনাও... যদি তুমি তোমার দলে নিতে না পারো গ্রামকে, তা হলে তোমার উদ্যাপন ব্যর্থ। তোমার গান, তোমার নাটক, তোমার গল্প, তোমার কবিতা— সব বৃথা, যদি তুমি ওদেরকে জড়িয়ে নিতে না পারো। এই একটি জায়গা, যেখানে প্লেটো, অ্যারিস্টটলথেকে মার্ক্স, গান্ধী কেউই খুব একটা কিছু করেযেতে পারেননি।
উঠোন পরিষ্কার করে নিকিয়ে রাখার পর এক জন মানুষ তার আত্মাকে পরিষ্কার করবে একটা গান দিয়ে, একটা কবিতা দিয়ে— কোথায় হয়েছে? ফ্রান্সে হয়েছে? জার্মানিতে হয়েছে? চিনে হয়েছে? যে মানুষটা নোবেল পাওয়ার পর ভেবেছিলেন, যাক, নর্দমা তৈরি করার টাকা পাওয়া গেল, তাঁকে চৌত্রিশ বছর ধরে শুনতে হয়েছে ‘বুর্জোয়া’। শব্দটা এখন আর তেমন শোনা যায় না। ক্ষমতা সরে গিয়ে যেমন ক্ষমতা আসে, তেমনি পরিভাষা সরে গিয়ে পরিভাষাই আসে। সে দিন সন্দেশখালির স্কুলে আমি কবিতা পড়ব কী করে, এটাই ছিল আমার সামনে বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সন্দেশখালির স্কুলে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল, দিল্লির ইন্টারভিউয়ের চেয়েও কঠিন একটা ইন্টারভিউয়ের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। আমি কি পারব এদের কবিতা শোনাতে? একটা লাইনও কি পারবে এদের আলো দিতে? কে আমি? কী আমার পরিচয়— আমারই সন্তানসম, শুকিয়ে যাওয়া ছাত্রীদের সামনে? নিজের কবিতার বই হাতে নিয়ে পড়ব বলে উঠে দাঁড়িয়ে এত অসহায় আর কখনও লাগেনি। আমি ইতস্তত না করে একটি কবিতা বলতে শুরু করলাম। ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি/ কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক...’ একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজ দিল! কারণ বাজ়িগরের নাম রবীন্দ্রনাথ। হঠাৎ দেখতে পেলাম স্কুলের ভিতর এক অন্য ভারতবর্ষ। পেটে ভাত নেই, তাই বলে একটা কবিতা শুনব না?
এক জন মাস্টারমশাই এসে চিরকুট দিয়ে গেলেন। সেখানে লেখা ‘রূপমকে একটা চাকরি দিন’। চিরকুটটা হাতে নিয়ে আমি কয়েক সেকেন্ড বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি পঞ্চাশ বছরে পঁয়তাল্লিশটি কবিতার বই লিখেছি। এদের এক জন অন্তত আমার একটা কবিতা পড়েছে বা শুনেছে। পঞ্চাশ বছর ধরে কত লোকের শাপ-অভিশাপ বহন করে রোজ সকালে চার ঘণ্টা টেবিলে বসে কত ঝড়জল পেরিয়ে সন্দেশখালি পৌঁছে এটুকু শান্তি পেলাম। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে, কৃষ্ণকলি না থাকলে সেটাও জানতে পারতাম না।
অনুষ্ঠান শেষে সন্দেশখালি ঘুরে দেখলাম। অনেকটা ভিতরে গেলাম। শীত আসব আসব। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মাছের ভেড়ির উপর গোধূলি নামছে। হঠাৎ দেখি, গাছের নীচে একটি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে তার রোগা মা। আশ্চর্য! মনে হল রবীন্দ্রনাথ এখানেও আছেন। যেন কৃষ্ণকলি আর তার মা দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণকলির হাতে একটা কাগজ। চাকরির দরখাস্ত নয়তো? কলকাতায় কাউকে পৌঁছে দিতে হবে। আমাকে চমকে দিয়ে ঘোমটা-ঢাকা মা বলল, “আপনি এখানে একটা সই করে দেবেন গো? আমার এই মেয়ে বিয়ের দরদাম দেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তখন এই কবিতাটা পড়ত আর বলত, ‘আমি এ রকম হব।’”
আমি জ়েরক্স করা কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম, ‘কৃষ্ণকলি মাহাত, এম.এ, পিএইচ. ডি’। কবিতাটা আমি লিখেছিলাম ঝাড়গ্রামের কৃষ্ণকলি মাহাতোকে নিয়ে, যার বাবার একটা হাত বোমায় উড়ে গিয়েছিল, যে কিনা হাটে গিয়ে বাবুই ঘাস বিক্রি করত আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, এমএ, পিএইচ ডি করার পর সে এক দিন জার্মানি থেকে সেমিনারে ডাক পেল। আমি জ়েরক্স কপিতে গোধূলির আলোয় সই করতে গিয়ে কাঁপছিলাম। মনে হল, এই সইটা করতে আমার সারা সন্ধ্যা লাগবে। সারা জীবন লাগবে। কোনও কোনও সই পঞ্চাশ বছরেও করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে, কৃষ্ণকলি না থাকলে, আমি কৃষ্ণকলি মাহাতোকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারতাম না।
সন্দেশখালি ছেড়ে আসার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম অশ্রুবিন্দুর মতো দেখতে কৃষ্ণকলিকে। গাছের নীচে মনে হল স্বপ্নের তাজমহল। যে তাজমহল কোনও শাজাহানতৈরি করেননি। যে তাজমহলকে অশ্রুবিন্দু বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
এন্ট্রি: ৩
গ্রিস, ২০০৭
সক্রেটিসের পাড়ায় গিয়েছিলাম। আথেন্সে এক দিন এক রাত থেকে ক্রুজ়ে করে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে আমরা একটি দ্বীপে এসে পৌঁছোলাম। অপূর্ব সেই দ্বীপের নাম— পারোস। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে বাড়ি। জ্যোৎস্নায় মনে হল পিকাসো পাহাড়টাকে কিউবিস্ট ছবি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বের চোদ্দোটি দেশ থেকে আমরা চোদ্দো জন লেখক আমন্ত্রিত।
আর্জেন্টিনা থেকে যিনি এসেছেন তিনি ঔপন্যাসিক, একটু ত্যাড়াবেঁকা গোছের লোক। আমি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কথা বললাম, তিনি পাত্তা দিলেন না, বললেন, “কে ওকাম্পো?” তিনি ভূমধ্যসাগরের নীল জলে ভাসমান বেবি ডলফিন নিয়ে আমাকে বলে গেলেন। তিনি একটা উপন্যাস লিখছেন, সেখানে পাঁচটি ডলফিন নাকি একটি রাষ্ট্র চালাচ্ছে। তাকে দ্রুত পরিত্যাগ করে আমি আলজিরিয়ার লেখকের সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। ফরাসিতে লেখেন। যেমন লিখতেন আলব্যেয়র কামু, ওই আলজিরিয়া থেকেই। পারোস দ্বীপের মেয়র এলেন এক সন্ধ্যায় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। দ্বীপ চালাতেও মেয়র লাগে মানুষের? মেয়রকে দেখে সবাই অভিভূত।
আমি করমর্দন করে বলেই ফেললাম,“আপনি কি এইমাত্র হলিউড থেকে এলেন মি. অ্যান্টনি হপকিন্স?”
মেয়র হেসে ফেললেন। তিনি যখন মাইকে কথা বলতে উঠলেন, তখন অন্যরাও ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, অ্যান্টনি হপকিন্স। এত এক রকম দেখতে? তিনি কবিতা লেখেন না, কিন্তু কবিতা পড়েন। তাঁকে একটি কবিতা বলতে বলা হল। তিনি দু’-একটা সৌজন্যমূলক কথা বললেন, আমাদের ধন্যবাদ দিলেন, আর বললেন, যদি কোনও কবি লেখক, তিনি যে দেশেরই হোন, পারোসে আসেন, তাঁর থাকা-খাওয়া ফ্রি। এই বার তিনি একটি কবিতা বলবেন। একটু থামলেন, তার পর উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে চললেন, ‘হোয়্যার দ্য মাইন্ড ইজ় উইদাউট ফিয়ার/ অ্যান্ড দ্য হেড ইজ় হেল্ড হাই...’
সবাই স্তব্ধ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন, নীচে ভূমধ্যসাগরের নীল জল, উপরে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কবিতা পাঠ করে শোনাচ্ছেন এক জন মেয়র। আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে মেয়রকে অভিবাদন জানালাম। আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। লেখক শিবিরেরএক জন পরিচালক এসে আমাকে বললেন, “সুবোধ, ক্যান ইউ প্লিজ় রিড আউট দ্য অরিজিনাল বেঙ্গলি পোয়েম?”
আমি মেয়রকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবৃত্তি করে শোনালাম, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির/ জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর’। গ্রিস গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ, সেই পারোস দ্বীপে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনা গেল। বাংলায়। এবং এমন একটি কবিতা, যা গণতন্ত্রের থেকেও সুন্দর।
ডিনার টেবিলে আর্জেন্টিনার সেই লেখক আমার সঙ্গে দশ-বারোটা ছবি তোলার পর বললেন, আমি এক বার ইন্ডিয়া আসতে চাই। এই কবিতাটা শোনার পর আমি আর পারছি না। ইন্ডিয়া আসছি। আমি মুচকি হেসে বললাম, “এই একটি কবিতা শুনে যদি তোমার ইন্ডিয়া আসতে ইচ্ছে করে, তা হলে তুমি রবীন্দ্রনাথের দশটা কবিতা পড়ো, দশ বার আসতে ইচ্ছে করবে, তুমি ডলফিন ভুলে যাবে।”
সে দিন ডিনারে মেয়র আমাকে বললেন, “প্লিজ় টিচ মি দ্য ফার্স্ট টু লাইনস ইন বেঙ্গলি।”
পারোসে সাত দিন ছিলাম। যে সম্মান আর ভালবাসা পেয়েছিলাম, তা রবীন্দ্রনাথের জন্য।
এন্ট্রি: ৪
রিফিউজি ক্যাম্প, কৃষ্ণনগর
রিফিউজি বাড়ির ছেলে আমি। বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নামে কেউ ছিল না। পালিয়ে আসা ফ্যামিলি। কৃষ্ণনগরে আমার বন্ধুরা টিটকিরি দিত, “এই, তোর বাবা পালিয়ে এল কেন রে?”
শরণার্থী হয়েও বাবা মাথা উঁচু করে হাঁটতেন। ছাত্র পড়াতেন। স্কুলে যেতেন। ক্যানসারে বাবা চলে গেলেন, আমি তখন ক্লাস এইটে। এক দিন গোরাদা সকালবেলায় এল। গায়ে কালো চাদর। সাইডব্যাগ থেকে মায়াকোভস্কির বই বার করে কবিতা পড়ে শোনাল। বইটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “মাঝে মাঝে পড়বি, গায়ে জোর আসবে। তোর মা-কে বল তো, আমাকে দুটো রুটি দিতে। দু’দিন খাইনি।”
রুটি খেয়ে গোরাদা বেরিয়ে গেল। দুপুর বারোটায় খবর এল, নেদের পাড়ার মোড়ে গোরাদা টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। সাইডব্যাগে গ্রেনেড ছিল। সেই গ্রেনেড বার্স্ট করে গোরাদা মারা গেছে। আমি মৃত গোরাদার সামনে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছি, তখন গোরাদার মাথার পাশে সাইডব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসা অর্ধদগ্ধ একটি বই দেখতে পেলাম। বইটির নাম ‘গীতবিতান’। আধপোড়া সেই গীতবিতান আমি বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। দিদি একটা ভাঙা হারমোনিয়াম নিয়ে এসেছিল কারও বাড়ি থেকে। দিদি আমাকে শেখাত, ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। দিদি আমাকে শেখাত, ‘পিনাকেতে লাগে টঙ্কার’। দিদি শিখে আসত একটা জানলার শিক ধরে। ভিতরে তার বন্ধু গান শিখত মাস্টারের কাছে।
ক্লাস নাইন টেন ইলেভেন আমি গানের টিউশনি করে পেট চালিয়েছি, পড়া চালিয়েছি। আমাকে আমার বাবা বাঁচাতে পারেনি। দেশভাগ বাঁচাতে পারেনি। রাষ্ট্র বাঁচাতে পারেনি। বাঁচিয়ে দিয়েছিল একটা বই, যার নাম ‘গীতবিতান’।
এন্ট্রি: ৫
আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬
আয়ওয়া নদীর ধারে, জঙ্গলের ভিতর সে দিন আড্ডা জমে উঠল। জঙ্গলের ভিতর সেই আন্তর্জাতিক লেখক শিবিরের প্রায় অর্ধেক উপস্থিত। শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, ইরাক, আফ্রিকা, জার্মানি, সাইপ্রাস, জাপান, রোমানিয়া, তুর্কিস্তান, হাঙ্গেরি, পাকিস্তান, আরও কয়েকটি দেশের লেখক। যে যার নিজের দেশের এক জন করে লেখকের গল্প বলবে। এই ভাবে রাত ভোর হবে।
এক এক জন লেখকের গল্প শুনছিলাম, আর এক-একটা দেশ উঠে আসছিল চোখের সামনে।
একটা ঘটনা ঘটল। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত— তিনটে দেশের আমরা তিন জন লেখক— কী আশ্চর্য, তিন জনই এক জন লেখকের গল্প বললাম, তিনি রবীন্দ্রনাথ!
পাকিস্তানের লেখক বললেন, “যদি রবীন্দ্রনাথকে আমরা সংবিধান করে নিতে পারতাম, তা হলে পাকিস্তান আজকের পাকিস্তান হত না।”
শ্রীলঙ্কা বলল, “আমি যে আমার জাতীয় সঙ্গীতটা গেয়ে শোনাব এখন, তার কথা, সুর রবীন্দ্রনাথের মতো করেই তৈরি।” আয়ওয়া নদীর ধারে সেই রাতের জঙ্গলে মনে হল আমরা শ্রীলঙ্কার জঙ্গল দিয়ে হেঁটে চলেছি।
আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় আসলে একটা গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়। চার পাশে ভুট্টাখেত। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা পৃথিবীর লেখক জড়ো হয় প্রত্যেক হেমন্তে। যাকে বলে ‘ফল রেসিডেন্সি’। দিনে পাঁচ বার সলমন রুশদির নাম শুনতে হচ্ছে এখানে, কেন রুশদিকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হবে। তাঁর সাহিত্য নিয়ে নয়, ফতোয়া নিয়ে হইচইটাই বেশি। আমেরিকাতে যেমন, তেমনি কলকাতাতেও। রুশদির নাম শুনছি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাম এক বারও শুনছি না। এটা আয়ওয়ার পক্ষে দুর্নাম। আজ আমরা আয়ওয়ার লেখক শিবিরে এসেছি। আমেরিকার টাকা আছে, ইচ্ছে আছে। আমেরিকা পারে। তিরিশ-চল্লিশটা দেশ থেকে লেখকদের উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারে।
আমি বললাম, “শুনুন, রবীন্দ্রনাথ লণ্ঠনের আলোয় একটা গ্রামে আয়ওয়া তৈরি করেছিলেন। সেই গ্রামে একটি আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছিলেন, তার নাম বিশ্বভারতী। সেখানে হেমন্তের লেখক শিবির বলে কিছু ছিল না। সারা বছরের, সারা জীবনের লেখক শিবির ছিল। আপনারা অবাক হবেন শুনে ‘শ্যামবুর্গ হাউস’ বলে আয়ওয়াতে যে বাড়িটায় আমাদের শিবির অনুষ্ঠিত হয়, এই বাড়িতেই এসে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ সালে। নোবেল পাওয়ার পরে নয়, আগে। রুশদির ফতোয়ার কথা বার বার শুনছি। ১৯১৬-তে রবীন্দ্রনাথ জাপান থেকে শরীরে ও মনে ভারাক্রান্ত হয়ে সান ফ্রান্সিসকোয় এলেন। হোটেল প্যালেসে উঠলেন। গদর পার্টি তাঁকে খুন করার প্ল্যান তৈরি করল। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশের দালাল। তাদের দু’জন খুনি সকালবেলা পৌঁছে গেল প্যালেস হোটেলের লবিতে। খালসা দেওয়ান সোসাইটির আরও দু’জন খুনি এসে গেল। বেঁধে গেল দু’পক্ষে। খুনিতে খুনিতে ক্ল্যাশ হলে মানবজাতির কল্যাণ হয়। তা-ই হল। নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল লেগে ছক ভেস্তে যায়। রবীন্দ্রনাথকে পুলিশ পাহারায় নিয়ে আসা হল। সে আর এক বিড়ম্বনা। কিন্তু সে সময় আমেরিকা রবীন্দ্রনাথে মুগ্ধ। তিন মাস ধরে আমেরিকার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে যে যে হেডলাইন বেরিয়েছিল, তা আর কোনও কবির ভাগ্যে জোটেনি। ‘দ্য কাল্ট অব টেগোর হ্যাজ় টেকেন দ্য ওয়ার্ল্ড বাই স্টর্ম’। ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’ লিখল, ‘তাঁকে জিশুর মতো মনে হয়।’ কিন্তু তিনি জিশু নন, আমেরিকাকেও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষ সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন। যে বিষ সে দিন জলকলের মুখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ত, সে বিষ এখন হোসপাইপ দিয়ে বেরিয়ে আসছে।”
সে রাত্রে আয়ওয়ার জঙ্গলে যখন ভোর হয়ে আসছে, তখন ইস্তানবুলের তুর্কি লেখক শেষ কথাটি বললেন, “আমার জীবন দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের উপর।”
সবাই জানতে চাইল, “কী রকম?”
তিনি বললেন, “রবীন্দ্রনাথের আটটি খণ্ড অনুবাদ করেছি, আমাদের রাইটার্স ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়েছে, এগারো খণ্ডে শেষ হবে।”
আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ইস্তানবুলের দিকে। বসফোরাসের দিকে। মনে হল, জঙ্গলের মর্মর সকালের আলো নিয়ে আসছে আমাদের জন্য। মর্মর যেন মর্মর নয়, রামকেলি। প্রিয় সুর রবীন্দ্রনাথের। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলানো সোনার কণ্ঠে ভেসে এল আমার শরীরে, ‘স্বপন যদি ভাঙিলে রজনী প্রভাতে...’
এন্ট্রি: ৬
আমি ও গীতবিতান
রবীন্দ্রনাথ না থাকলে কী হত? গ্যোয়টে না থাকলে কী হত? ভার্জিল না থাকলে কী হত? হোমার না থাকলে কী হত? সের্ভেন্তেস না থাকলে কী হত? টলস্টয় না থাকলে কী হত? বাঙালি, বাঙালি হতে পারত না। ভারত, ভারত হতে পারত না। এশিয়া, এশিয়া হতে পারত না। কে আমার আত্মা থেকে রোজ রাতে, ঘুমের আগে, ধুলো মুছিয়ে দিত? যদি ‘গীতবিতান’ না থাকত?
শরণার্থী শিবির কৃষ্ণনগর, কল্যাণী, টালিগঞ্জ, ধূপগুড়ি, লেক গার্ডেনস, সিরিটি, দিল্লি, আমেরিকা, মুকুন্দপুর যেখানে যেখানে আমি বসবাস করেছি— কোথাও ছ’মাস, কোথাও কুড়ি বছর, একটা রাতও আমি কাটাইনি ‘গীতবিতান’ ছাড়া। অন্তত একটা পৃষ্ঠা পড়ে ঘুমোতে গিয়েছি। এই একটি বই আমি একান্ন বছর ধরে পড়ে এলাম। এটাই আমার গীতা। এটাই আমার কোরান। এটাই আমার সংবিধান। এটাই আমার চুম্বন, এটাই আমার ডিনামাইট। যাঁরা আমার নামে কুৎসা করেন, ‘নির্বংশ হবি’ বলে শাপশাপান্ত করেন কোনও কবি, তাঁদের সবিনয়ে বলি, বাবাকে হারিয়েছি ক্লাস এইটে, মা-কে হারিয়েছি, স্ত্রী-কে হারিয়েছি, ছেলে পিএইচ ডি করতে দূর দেশে চলে গেছে, আমি একা কুড়ি তলার শূন্যে, এক গ্লাস জল দেওয়ার কেউ নেই... তবু যে ক’দিন আছি পৃথিবীতে, আমার কিছু হবে না, কিছু করতে পারবেন না... কারণ আমার আত্মায় ‘গীতবিতান’ আছে।
একটা ঘটনা ঘটল। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত— তিনটে দেশের আমরা তিন জন লেখক— কী আশ্চর্য, তিন জনই এক জন লেখকের গল্প বললাম, তিনি রবীন্দ্রনাথ!
পাকিস্তানের লেখক বললেন, “যদি রবীন্দ্রনাথকে আমরা সংবিধান করে নিতে পারতাম, তা হলে পাকিস্তান আজকের পাকিস্তান হত না।”
শ্রীলঙ্কা বলল, “আমি যে আমার জাতীয় সঙ্গীতটা গেয়ে শোনাব এখন, তার কথা, সুর রবীন্দ্রনাথের মতো করেই তৈরি।” আয়ওয়া নদীর ধারে সেই রাতের জঙ্গলে মনে হল আমরা শ্রীলঙ্কার জঙ্গল দিয়ে হেঁটে চলেছি।
আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় আসলে একটা গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়। চার পাশে ভুট্টাখেত। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা পৃথিবীর লেখক জড়ো হয় প্রত্যেক হেমন্তে। যাকে বলে ‘ফল রেসিডেন্সি’। দিনে পাঁচ বার সলমন রুশদির নাম শুনতে হচ্ছে এখানে, কেন রুশদিকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হবে। তাঁর সাহিত্য নিয়ে নয়, ফতোয়া নিয়ে হইচইটাই বেশি। আমেরিকাতে যেমন, তেমনি কলকাতাতেও। রুশদির নাম শুনছি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাম এক বারও শুনছি না। এটা আয়ওয়ার পক্ষে দুর্নাম। আজ আমরা আয়ওয়ার লেখক শিবিরে এসেছি। আমেরিকার টাকা আছে, ইচ্ছে আছে। আমেরিকা পারে। তিরিশ-চল্লিশটা দেশ থেকে লেখকদের উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারে।
আমি বললাম, “শুনুন, রবীন্দ্রনাথ লণ্ঠনের আলোয় একটা গ্রামে আয়ওয়া তৈরি করেছিলেন। সেই গ্রামে একটি আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছিলেন, তার নাম বিশ্বভারতী। সেখানে হেমন্তের লেখক শিবির বলে কিছু ছিল না। সারা বছরের, সারা জীবনের লেখক শিবির ছিল। আপনারা অবাক হবেন শুনে ‘শ্যামবুর্গ হাউস’ বলে আয়ওয়াতে যে বাড়িটায় আমাদের শিবির অনুষ্ঠিত হয়, এই বাড়িতেই এসে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ সালে। নোবেল পাওয়ার পরে নয়, আগে। রুশদির ফতোয়ার কথা বার বার শুনছি। ১৯১৬-তে রবীন্দ্রনাথ জাপান থেকে শরীরে ও মনে ভারাক্রান্ত হয়ে সান ফ্রান্সিসকোয় এলেন। হোটেল প্যালেসে উঠলেন। গদর পার্টি তাঁকে খুন করার প্ল্যান তৈরি করল। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশের দালাল। তাদের দু’জন খুনি সকালবেলা পৌঁছে গেল প্যালেস হোটেলের লবিতে। খালসা দেওয়ান সোসাইটির আরও দু’জন খুনি এসে গেল। বেঁধে গেল দু’পক্ষে। খুনিতে খুনিতে ক্ল্যাশ হলে মানবজাতির কল্যাণ হয়। তা-ই হল। নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল লেগে ছক ভেস্তে যায়। রবীন্দ্রনাথকে পুলিশ পাহারায় নিয়ে আসা হল। সে আর এক বিড়ম্বনা। কিন্তু সে সময় আমেরিকা রবীন্দ্রনাথে মুগ্ধ। তিন মাস ধরে আমেরিকার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে যে যে হেডলাইন বেরিয়েছিল, তা আর কোনও কবির ভাগ্যে জোটেনি। ‘দ্য কাল্ট অব টেগোর হ্যাজ় টেকেন দ্য ওয়ার্ল্ড বাই স্টর্ম’। ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’ লিখল, ‘তাঁকে জিশুর মতো মনে হয়।’ কিন্তু তিনি জিশু নন, আমেরিকাকেও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষ সম্পর্কে সাবধান করে দিলেন। যে বিষ সে দিন জলকলের মুখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ত, সে বিষ এখন হোসপাইপ দিয়ে বেরিয়ে আসছে।”
সে রাত্রে আয়ওয়ার জঙ্গলে যখন ভোর হয়ে আসছে, তখন ইস্তানবুলের তুর্কি লেখক শেষ কথাটি বললেন, “আমার জীবন দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের উপর।”
সবাই জানতে চাইল, “কী রকম?”
তিনি বললেন, “রবীন্দ্রনাথের আটটি খণ্ড অনুবাদ করেছি, আমাদের রাইটার্স ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়েছে, এগারো খণ্ডে শেষ হবে।”
আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ইস্তানবুলের দিকে। বসফোরাসের দিকে। মনে হল, জঙ্গলের মর্মর সকালের আলো নিয়ে আসছে আমাদের জন্য। মর্মর যেন মর্মর নয়, রামকেলি। প্রিয় সুর রবীন্দ্রনাথের। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলানো সোনার কণ্ঠে ভেসে এল আমার শরীরে, ‘স্বপন যদি ভাঙিলে রজনী প্রভাতে...’
এন্ট্রি: ৬
আমি ও গীতবিতান
রবীন্দ্রনাথ না থাকলে কী হত? গ্যোয়টে না থাকলে কী হত? ভার্জিল না থাকলে কী হত? হোমার না থাকলে কী হত? সের্ভেন্তেস না থাকলে কী হত? টলস্টয় না থাকলে কী হত? বাঙালি, বাঙালি হতে পারত না। ভারত, ভারত হতে পারত না। এশিয়া, এশিয়া হতে পারত না। কে আমার আত্মা থেকে রোজ রাতে, ঘুমের আগে, ধুলো মুছিয়ে দিত? যদি ‘গীতবিতান’ না থাকত?
শরণার্থী শিবির কৃষ্ণনগর, কল্যাণী, টালিগঞ্জ, ধূপগুড়ি, লেক গার্ডেনস, সিরিটি, দিল্লি, আমেরিকা, মুকুন্দপুর যেখানে যেখানে আমি বসবাস করেছি— কোথাও ছ’মাস, কোথাও কুড়ি বছর, একটা রাতও আমি কাটাইনি ‘গীতবিতান’ ছাড়া। অন্তত একটা পৃষ্ঠা পড়ে ঘুমোতে গিয়েছি। এই একটি বই আমি একান্ন বছর ধরে পড়ে এলাম। এটাই আমার গীতা। এটাই আমার কোরান। এটাই আমার সংবিধান। এটাই আমার চুম্বন, এটাই আমার ডিনামাইট। যাঁরা আমার নামে কুৎসা করেন, ‘নির্বংশ হবি’ বলে শাপশাপান্ত করেন কোনও কবি, তাঁদের সবিনয়ে বলি, বাবাকে হারিয়েছি ক্লাস এইটে, মা-কে হারিয়েছি, স্ত্রী-কে হারিয়েছি, ছেলে পিএইচ ডি করতে দূর দেশে চলে গেছে, আমি একা কুড়ি তলার শূন্যে, এক গ্লাস জল দেওয়ার কেউ নেই... তবু যে ক’দিন আছি পৃথিবীতে, আমার কিছু হবে না, কিছু করতে পারবেন না... কারণ আমার আত্মায় ‘গীতবিতান’ আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy