Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
Uttam Kumar

বাঙালির মহানায়ক

প্রথম দিকে পাঁচ বছরে একটা ছবিও বক্সে ধরাতে পারেননি। খেতাব জুটেছিল ‘ফ্লপ মাস্টার’। কখনও পিরিয়ড পিসের জবড়জং পোশাক পরে সারা দিন অপেক্ষার পর জানা যেত, ‘আপনাকে আর দরকার হচ্ছে না ভাই।’

মহানায়ক উত্তম কুমার।

মহানায়ক উত্তম কুমার।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৩ ০৫:৫৫
Share: Save:

ফড়েদের গজল্লা করার প্রিয় স্পট স্টুডিয়ো চত্বরের এই বটগাছতলাটা। বেছে বেছে মাছ ধরে, সহকারী পরিচালক, বায়োস্কোপে টাকা-ঢালা বাবুদের কাছে নিয়ে গিয়ে, নতুনদের কাছ থেকে কলাটা মুলোটা আদায়ের ফাঁকে এরা বসেন মজলিশে। এই বাস্তুঘুঘুদের কমিশন দিলে ছবিতে মুখ দেখানোর সুযোগ মিলতেও পারে, তা সে ভিড়ের মধ্যে কোনও অধোবদন পার্ট হলেও।

“ওহে ব্রাদার! দ্যাকো, আমাদের নতুন দুগ্গাদাস এয়ে পড়েচে। ঝড় জল তাপ, এনার কোনও কামাই নেই গো! এ দিকে কাজের নামে ঢুঁ ঢুঁ।”

“সে কেচ্ছা জানো না? ‘মায়াডোর’ বলে প্রথমেই একটা হিন্দি বইতে নাকি মুখ দ্যাকানোর চান্স পেয়েচিল। এমনই অভিনয়ের দাপট, সে বই আর হাউসেই এলে না।”

“এ কলির ভীমকে তোরা কোথায় পেলি? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড়ে উড়ে যাবে!”

“একেবারে নতুন আলু আমদানি হয়েচেগাঁ থেকে।”

আজকাল এ সব ছুটে আসা তির তেমন গায়ে লাগে না অরুণের। চামড়া মোটা হয়ে গিয়েছে স্টুডিয়োর বাতাসে। তবে মাঝে মাঝে মন বড় খারাপ হয়। লোকে টানা পাঁচ মাস অপমান সইতে পারে না, পুড়ে যায়। অরুণের হয়ে গেল পাঁচ বছর। পাঁচটা বসন্ত তিনি মাথা খুঁড়ে মরেছেন এই সেট ওই সেট, এই পরিচালক ওই প্রযোজকের থানে। একটা ছবিও বক্সে লাগাতে পারেননি পাঁচ বছরে, কেরানির চাকরি সামলে প্রবল পরিশ্রম করেও।

নিজের উপরে রাগ হয়, হাসি পায়, অভিমান হয়। পাঁচ সিকে পারিশ্রমিকে ভোলা আঢ্যের ‘মায়াডোর’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে (টালিগঞ্জে তোলা) কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবেশী গণেশদা ওরফে গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি গার্স্টিন প্লেসের বেতারবাড়ির নিয়মিত অভিনেতা, ভবানীপুর পাড়ার, ক্লাবের নটগুরু। তাঁর সুপারিশে পোর্ট কমিশনারের চাকরিতে ফাঁকি দিয়ে অরুণ পৌঁছেছিলেন প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মুখে তৎকালীন ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োতে (পরে যেখানে নবীনা সিনেমা হয়)। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় মেট্রো সিনেমার প্রজেকশনিস্ট, এ ছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংযোগ ছাড়াই এই স্বপ্ন দেখা যুবক কিসের ভরসায় জীবনকে নিয়ে এমন বাজি ধরেছিল, তা বোঝা দায়।

চেহারা লগবগে, বাংলা উচ্চারণে জড়তা, মোটা ঠোঁট, ইংরেজি শিক্ষা দুর্বল, সামনে সিলেবাস বলতে হাতে গোনা প্রমথেশ, প্রদীপকুমার, প্রভা দেবী, উদয়ের পথে। অভিজ্ঞতা পাড়ার ক্লাবের অ্যামেচার থিয়েটার, চলনসই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার অভিজ্ঞতা। টিমটিম করা সাংস্কৃতিক পুঁজি বা আভিজাত্য নিয়ে সিনেমাকে সর্বস্ব দিয়ে আঁকড়ে ধরার এই মহাশ্চর্য— আসলে গড়পড়তা হিসেবে ব্যাখ্যা করাই যায় না। লেখক-সাংবাদিক স্বপন মল্লিক তাঁর ‘মহানায়ক রিভিজ়িটেড, দ্য ওয়ার্ল্ড অব উত্তমকুমার’ বইটিতে বলছেন, “উত্তমকুমারের গল্পে নাটক ও রহস্য, সঙ্কল্প এবং ইচ্ছাশক্তি, পেশাদারি হতাশা এবং ব্যক্তিগত ট্রাজেডি সব রয়েছে। তাঁর মতো মনের জোর ছাড়া, যা অন্য যে কাউকে ছিবড়ে করতে দিতে পারত, নিয়তির একটা ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু পেশার ক্ষেত্রে অসম্ভব শৃঙ্খলা তাঁর ছিল, যা উত্তমের নিজের যাপিত জীবনের ঠিক বিপরীত।”

সেই ‘মায়াডোর’ ছবিতে প্রথম বার ক্যামেরার সামনে এক্সট্রার দায়িত্ব সামলালেও সেই ছবির রিল, ক্যান-এর বাইরে এল না আর। কিন্তু ওই ব্যাখ্যাতীত নেশা আরও বেড়ে গেল অরুণের। স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর, থিয়েটার-বায়োস্কোপে পোশাক জোগানের ব্যবসায়ী ধীরেনবাবুর দাক্ষিণ্যে আবার ক্যামেরার সামনে, এ বার নীতিন বসুর পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ‘দৃষ্টিদান’। সে বার সাতাশ টাকা পারিশ্রমিকের অর্ধেক গেল স্টুডিয়োয় ফড়েদের সিগারেট, চায়ের ‘কমিশন’-এ। ছবির নায়ক অসিতবরণের ছোটবেলার রোলে অভিনয় করেছিলেন অরুণ। ‘দৃষ্টিদান’ রিলিজ় করেছিল বটে, কিন্তু সমালোচনায় কোথাও একটি বাক্যও বরাদ্দ হয়নি তাঁর জন্য। প্রতিদিন কাগজের সমালোচনার পাতা ঘেঁটে মুখ ম্নান হয়ে যেত যুবকের। ছ’মাস পরে ‘কামনা’ ছবিতে এ বার জুটল নায়কের পার্ট, বিপরীতে ছবি রায়। ইন্দ্রপুরীতে শুটিং করছেন অরুণ, পাশের ফ্লোরে দাপিয়ে কাজ করছেন খ্যাতনামা প্রদীপকুমার, অ্যামেচার নাটকের সূত্রে যাঁর সঙ্গে সামান্য চেনা ছিল অরুণের। তিনি কাজ দেখতে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেন প্রদীপকুমারের সঙ্গে। অরুণের তখন দশা, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো কাজের সন্ধান! পুরনো সূত্রের কথা বলে আলাপ এগোনোর চেষ্টা করলেন, প্রদীপকুমার বললেন, “ভাই তুমি এসো, সময় নষ্ট কোরো না। তোমায় চিনতে পারছি না।”

এই অপমানের ঢেউ একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে অরুণকে। সেই ঢেউ বা ফ্লপ ছবির কারও নাম ‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সহযাত্রী’। কখনও ‘নষ্টনীড়’, ‘সঞ্জীবনী’। কখনও ফাইনাল টেক-এর মুহূর্তে প্রভা দেবী টিপ্পনী কাটছেন, “এ ছেলে অভিনয় করবে কী! এর তো এখন থেকেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।” হাসির হররা পড়ে যাচ্ছে সেটে। আবার কখনও পিরিয়ড পিসের জবড়জং পোশাক পরে গোটা দিন অপেক্ষার পরেও ফাইনাল টেক-এর ডাক আসছে না। ছ’ঘণ্টা পর কেউ এসে বলে যাচ্ছে, ‘আপনাকে আর দরকার হচ্ছে না ভাই।’ ছবি এক সপ্তাহের মধ্যে হল থেকে উঠে যাচ্ছে। টাইটল কার্ডে নামও উল্লেখ করা হচ্ছে না। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অরুণকে, ‘ইশারা নয় পাতাল সিঁড়ি দু হাত নেড়ে ডাকছে’।

মরিয়া হয়ে উঠলেন এ বার অরুণ। একের পর এক ফ্লপ-এর পর প্রদীপকুমারের ব্যস্ততার কারণে হাতের কাছে নায়ক না পেয়ে ১৯৫০ সালে ‘মর্যাদা’ ছবিতে কাজ দিতে রাজি হলেন পরিচালক সরোজ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু অদ্ভুত এক শর্তে। ওই অপয়া স্ক্রিন নেমটি বদলাতে হবে! নতুন নাম হবে অরূপকুমার। অরুণ ‘নামে কী আসে যায়’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেটে। কিন্তু ছবির আবারও সুপারফ্লপ হওয়া আটকাতে পারলেন না অরূপকুমারও। ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ তকমা তখনই তৈরি হল স্টুডিয়োতে।

তবে এর মধ্যেও সামান্য রুপোলি রেখা ছিল বলেই ‘মর্যাদা’ ফ্লপের পরেও আরও দু’বছর স্টুডিয়োপাড়ায় টানতে পেরেছিলেন উত্তম। সাউথ সিঁথি আর বরানগরের ক্রসিংয়ের কাছে ছিল তখনকার ডাকসাইটে এম পি স্টুডিয়ো। পাহাড়ী সান্যাল এবং আরও কিছু ব্যক্তির সুপারিশে সেখানে মাসিক চারশো টাকা বেতনে স্টাফ আর্টিস্টের চাকরি পেয়ে ডুবন্ত সংসারে হাল ধরেছিলেন সে দিন অরুণ। সেখানে তখন ‘সহযাত্রী’ ছবির কাজও শুরু হবে নতুন পরিচালক গোষ্ঠী ‘অগ্রদূত’-এর পরিচালনায়। ‘কামনা’য় (১৯৪৯) তাঁর নাম ছিল উত্তম চ্যাটার্জি। সব ফেলে নতুন নাম নিলেন অরুণ। উত্তমকুমার। দীর্ঘ দিন খরার পর অলক্ষ্যে নিয়তি নির্ঘাত মুচকি হেসেছিল সে দিন।

তবে চলল না ‘সহযাত্রী’ এবং ওই ১৯৫১ সালে তৈরি আর একটি ছবি ‘সঞ্জীবনী’ও। দ্বিতীয় এই ছবিটিতে বিপরীতে ছিলেন সন্ধ্যারাণী। ছবি আবারও ফ্লপ। আনন্দবাজারে একটি লাইন অবশ্য লেখা হয়েছিল সমালোচনায়— ‘উত্তমকুমার স্থানে স্থানে অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন’। প্রবল ব্যর্থতার মধ্যে এই স্বীকৃতি তাঁকে সামান্য হলেওঅক্সিজেন দিয়েছিল।

এর পর ওই ১৯৫২ সালেই রিলিজ় হল ‘বসু পরিবার’। যার উপর বাকি জীবনের শেষ দাঁওটা লাগিয়ে বাড়িতে বলেই দিয়েছিলেন উত্তম, আর নয়, এই ছবিও ব্যর্থ হলে ফিরে যাবেন কেরানিজীবনে। মেনে নেবেন, অভিনয়ে এসেছিলেন নেহাতই অল্প বয়সের আবেগ উন্মাদনায়। মেনে নেবেন, কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়া, দক্ষতা ছাড়া সমুদ্রে জাহাজ চালাতে নেমে পড়া ঘাট হয়েছে তাঁর।

উনিশশো বাহান্ন সালে ‘বসু পরিবার’, তিপ্পান্নতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ রিলিজ়ের পর কী ঘটেছিল তা আজ ইতিহাস। বাংলা সিনেমা শুধু নয়, সামগ্রিক বঙ্গজাতির অবশ্যপাঠ্য সিলেবাসের মধ্যে তা ঢুকে গিয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গও নয়, গোটা বিশ্বের বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি ব্যক্তিপরিসরেও এক চিরস্থায়ী মুদ্রা কী ভাবে হয়ে উঠলেন উত্তমকুমার, সেই বৃত্তান্তে নিত্যনতুন আলো পড়ছে আজও। তাঁর মৃত্যুর ৪৩ বছর কেটেও যাওয়ার পরেও যে আলো, উত্তমকুমারের হাসির মতোই এক সঙ্গে সম্মোহক এবং নির্মল।

*****

শুধু স্বশিক্ষিত অভিনয়প্রতিভার উত্তরণই একমাত্র রসায়ন নয় উত্তমকুমারের কালজয়ের। মার্লন ব্র্যান্ডো বা সোফিয়া লোরেন, বা এলিজ়াবেথ টেলরকে নিয়ে বিশ্বজোড়া মাতামাতির পিছনে শুধুমাত্র অভিনয় প্রণোদনাই তো কাজ করেনি। ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিজীবনের পাঁচফোড়ন, রহস্য, সব মিলিয়ে এক ভিন্ন মাত্রা না থাকলে তারকার কক্ষপথে স্থির থাকা যায় না। তারকার ভাবমূর্তিকে হতে হয় ব্লটিং পেপারের মতো, যে স্তাবকতা এবং কেচ্ছাকে শুষে নিতে পারে সহজেই।

উত্তমকুমারের ক্ষেত্রে সে সব একটু বেশি মাত্রাতেই ছিল। কোনও অন্যায়বোধ না জাগিয়েও সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের পুরুষ ও নারীর মধ্যে তিনি জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন রোম্যান্সের স্বপ্ন। পাঠক স্মরণ করুন এবং আরও এক বার শিহরিত হন, ‘সপ্তপদী’ ছবির সেই সংলাপে। “ও আমাকে টাচ করবে না।”— চ-এর উপর কি একটু বাড়তি চাপ? সুচিত্রা সেনের ঘাড় ঘুরে যাচ্ছে, ঘন শ্বাস পড়ছে। আসলে তো স্পর্শ করার বাসনা উত্তুঙ্গ হচ্ছে দর্শকের মন এবং শরীরেও। এই স্পর্শ করা এবং তার চেয়েও বেশি না-করার অসামান্য দোলাচলের মধ্যে লুকিয়ে রইল তাঁদের রসায়ন।

পাঠক মনে করুন ‘হারানো সুর’-এ উত্তমের সেই স্বর্গীয় অপ্রতিভতাকে। প্রেমে পড়লে পুরুষ কি আজও এমনই বোকা হয়ে যায় না, এই চূড়ান্ত জেট এজ-এও? রাস্তায় সুচিত্রার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে লাজুক ও বিহ্বল যুবকটি গাছের পাতা ছিঁড়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। মুগ্ধতার এমন পরিসর তো উপমারহিত। আসলে উত্তমকুমার স্বাধীনতার পরে যেন শাপভ্রষ্ট দেবদূত। তিনি আমাদের দোতলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। প্রবল আবেদনময়ী সুপ্রিয়া, ব্যক্তিত্বময়ী অরুন্ধতী দেবী, পাড়ার মেয়ে সাবিত্রী বা ‘চারুলতা’ মাধবী, উত্তম-সান্নিধ্যে স্বচ্ছন্দে গীতিকবিতা হয়ে যেতেন। কেননা, উত্তম বাঙালি সমাজের সব বাস্তবতা মেনেই শেষ পর্যন্ত প্রেমিক। কিন্তু প্রায় কখনওই দায়িত্বহীন প্রেমিক নন। প্রণয়িনী যদি তাঁকে প্রেমিকের বদলে শয়তান হিসেবেও দেখে, তবু বিচলিত হবেন না। উত্তমকুমারের হাসিটুকুই তাঁর প্রায়শ্চিত্ত, অন্য সবাই কৈফিয়ত দিতে গিয়ে হেরে গেছে।

তবে অন্য নায়িকারা গীতিকবিতা হলে, উত্তম-সুচিত্রা জুটি হল সেই মহাকাব্য, যা এই গ্রহে আর কখনও লেখা হবে না। ‘পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’ এই মহাকাব্যে কার অবদান বেশি, তা নিয়ে তর্ক চলে। যদিও এক সাক্ষাৎকারে উত্তম নিজে বলেছেন, তাঁর কেরিয়ারের বারোটা বেজে যাচ্ছিল। রমা এসে তাঁকে বাঁচিয়ে দেন। তাঁর কথায়, “তার আগে তো অন্য নায়িকাদের সঙ্গে প্রেমের ডায়ালগ বলতে গিয়ে মনের মধ্যে কোনও উত্তাপই বোধ করতাম না! এম পি প্রোডাকশনসের ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেন নামে এক নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার নায়িকা এসে গিয়েছে।”

এ তো গেল নায়িকার সংবাদ! নায়ক হিসেবে উত্তমের সাম্রাজ্যে এক জনই সমানে সমানে টেক্কা দিয়ে গিয়েছেন পঞ্চাশের দশকের পরে, বাইনারি-বিলাসী বাঙালির কাছে যা এক শেষহীন তর্কের বিষয়। উত্তম বনাম সৌমিত্র। মোটামুটি একই বৃত্তে পাক খাচ্ছিল এই তর্ক, ’৮০-র জুলাই অর্থাৎ উত্তমকুমারের প্রয়াণ পর্যন্ত। ময়ূরবাহন-কে তুলে এনে সৌমিত্রপন্থীদের বক্তব্য থাকত, রাজবেশী উত্তম নিজেই তো সৌমিত্রর ওই অপূর্ব দ্যুতিতে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন মুখোমুখি প্রথম দৃশ্যে। অন্য দিকে টিম উত্তমের বক্তব্য, ‘স্ত্রী’ ছবিতে সৌমিত্রকে বলে পা ছোঁয়াতে দেননি উত্তম। বিশেষ করে মদ্যপান সংক্রান্ত দৃশ্য এবং সংলাপগুলিতে। এক পক্ষ যদি বলে ‘সংসার সীমান্তে’, অন্য পক্ষের পাল্টা চাল ‘বিচারক’। এক পক্ষ যদি তোলে কবিতা এবং ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদনার কথা, অন্য পক্ষের যুক্তি, স্বপ্রশিক্ষণ, লেগে থাকার জেদ, স্রেফ অভিনয়ক্ষমতা দিয়ে উৎপল দত্ত উচ্চারিত ওথেলো-কে আত্মস্থ করে নেওয়ার (সপ্তপদী) দক্ষতা। এক দলের উচ্ছ্বাস দীর্ঘকায় সৌষ্ঠব নিয়ে, অন্য পক্ষের তুরুপের তাস ভুবনমোহিনী হাসি। এক জনের তীব্র মেধা, অন্য জনের গভীর আবেদন।

ব্যক্তিজীবনে এই দু’জনের সম্পর্ক কতটা সুমধুর এবং আস্থাপূর্ণ ছিল (যা শেষজীবন পর্যন্ত বহু আলোচনায় সৌমিত্র উল্লেখ করেছেন) সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। কারণ বাইনারি-বিলাসী বাঙালির মধ্যে এই তর্ক নিঃসন্দেহে চলবে আরও দীর্ঘদিন। ইতিমধ্যেই যা বঙ্গজীবনের স্থায়ী অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।

*****

নির্মল দে পরিচালিত ‘বসু পরিবার’-এ পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেও যে অভূতপূর্ব যাত্রার সূচনা করেছিলেন উত্তম, আগেই বলা হয়েছে, তা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫২ সালে। মনে রাখতে হবে, সে বছর আমাদের দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হল, ভারতীয়রা প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ পেলেন। মানে দেশের প্রধানমন্ত্রী আর পাড়ার হরিপদ, দু’জনেই একই ভাবে ভোট দিতে পারলেন, দু’জনের ভোটের দাম এক হয়ে গেল। সে বছরই উত্তমের প্রথম সাফল্য। এই সাফল্য সিনেমাতেও এক ধরনের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ছায়া ফেলেছিল, যার ফসল উত্তমকুমার। পরবর্তী সাফল্যও ওই বছরেই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে, যেখানে উত্তমের পাশে পাবনা থেকে আসা সেই সুন্দরী যাঁর সঙ্গে গ্রেটা গার্বোর তুলনা হবে অচিরেই। সেই সুচিত্রা সেনের সঙ্গেই দু’বছর পরেই মুক্তি পেল ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪), এবং অবশেষে ‘শাপমোচন’ (১৯৫৫)।

স্বাধীনতা-উত্তর বিক্ষিপ্ত, স্বপ্নভঙ্গ হওয়া, দেশভাগে জর্জরিত বাঙালির অন্ধকার ঘরে ফুলের মতো সহজ হয়ে এল ভালবাসা। বাঙালির ঘুমে শিউলির ঘ্রাণ ফিরে এল যেন। কানে কানে শুধু এক বার ‘তুমি যে আমার’ বলার এবং শোনার লোভে দিগন্ত পর্যন্ত পৌঁছে যেতে লাগল উত্তরা, পূরবী, দর্পণা, প্রাচী, ইন্দিরারসামনের লাইন।

চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় লিখছেন, “আসলে যে কোনও চরিত্রই অতিকথা বা মিথ-এর জন্ম দিতে পারে, যদি তা কোনও সন্দর্ভের প্ররোচনা পায়। উত্তমকুমার আমাদের সমাজে গল্পে, গুজবে, কেশবিন্যাসে, চালচলনে শুধু সঞ্জীবনী অভিনেতা নন। তিনি যে অতিকথার জন্ম দিয়েছেন তা তাঁর অভিনয় প্রতিভার জন্য শুধু নয়, বরং সেই মুহূর্তগুলোর জন্য যা ওই অভিনয়কে বাস্তবায়িত করে। কিংবদন্তিরও তো ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে। আসলে সুভাষচন্দ্র যে কারণে স্বাধীনতার পরে নেতাজি হয়ে গেলেন, উত্তমকুমারও প্রায় সে কারণেই তাঁর শারীরিক প্রয়াণের পরে এই দীর্ঘ সময়ে মহানায়ক হয়ে থেকে গেলেন। দু’জনেরই ইতিহাস থেকে অন্তর্ধানের সুযোগ ঘটেছিল। সত্যি কথা বলতে কী, তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পরে সুভাষচন্দ্রের আর ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি করার কোনও দায় রইল না। তিনি আছেন, এই তো যথেষ্ট। একই ভাবে সাংস্কৃতিক কৌলীন্য না থাকলেও উত্তমকুমারের ছাড়পত্র আজও এই একুশ শতকে অবাধ। অর্থাৎ তিনি জনসাধারণের এক জন, তিনি প্রান্তিক বলেই কেন্দ্রে আসতে পারেন।”

মনে রাখতে হবে, ‘শাপমোচন’-এর নায়ক কলকাতায় এসেছেন ১৯৫৫ সালে, যে বছর ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায়। সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ ছবির অপূর্বকুমার রায়ের মতো সাংস্কৃতিক আভিজাত্য তার নেই। কিন্তু তারও সেই গ্রাম থেকে কলকাতায় আসা, এবং গ্রাম থেকে শহরে আসার এই উপাখ্যানে উত্তমকুমার, অস্টারলিৎজ়-ফেরত নেপোলিয়নের মতো সাধারণ দর্শকের মন লুঠপাট করে নেন। শহরের মধ্যে এক অন্য রকম গ্রামজীবন যেন তৈরি হয় এবং উত্তমকুমার সেই নগরপল্লিতে লোকগাথার অবিসংবাদিত নায়ক হয়ে ওঠেন। অনেক বামঘেঁষা বুদ্ধিজীবীই সে সময় গুরুত্ব দেননি উত্তমকুমারের শৈলী এবং তাঁর অভিনয়কে। বার বার সমালোচনা হয়েছে তাঁর ইংরেজি উচ্চারণের। কিন্তু ওঁরা হয়তো বুঝতে ভুল করেছিলেন যে, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের সামাজিক অস্থিরতায় রুপোলি পর্দায় এমন এক শান্তিনিকেতন তৈরি করতে পারছিলেন উত্তম, যেখানে শেষ পর্যন্ত স্থিতাবস্থাই ধ্রুবক। তাঁর গরিব চরিত্রগুলি, নায়িকারা বড়লোক হওয়া সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়। উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রের উপস্থিতিতে কখনই বিপন্ন বোধ করে না চালু মতাদর্শ। সঞ্জয়বাবুই অন্যত্র বলছেন, “শাপমোচন ছবি আসলে আমাদের গণতন্ত্রের শাপমুক্তির অতিকথা। ওখান থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের পক্ষে হয়তো সত্যিই সাবেকি ধর্মীয় সামন্ততন্ত্র পেরিয়ে একটা স্বাধীন গণতন্ত্রে পা রাখা সম্ভব। ব্যাপকার্থে ইতিহাসে যা ঘটে থাকে তাকে যদি অভ্যন্তরে নিয়ে আসা যায় তা হলে আবেগের কিছু অতিশয়োক্তি ঘটতেই পারে। সে জিনিস পশ্চিম ভারতে ঘটিয়েছিলেন দিলীপকুমার, রাজ কপূর এবং দেবানন্দ। আর পূর্ব ভারতে একা উত্তমকুমার— অপ্রতিদ্বন্দ্বী।”

এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, যাঁরা সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল সেনকেই শেষ কথা ভেবে এসেছেন, তাঁরা অজয় কর, বিভূতি লাহা, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহের প্রভাবকে বুঝতে চাননি। উত্তমকুমার প্রসঙ্গেও একই উন্নাসিকতা কাজ করেছে। অথচ তাঁর ক্যারিশমা ওই সময়ের অস্থির অশান্ত পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক সঙ্কট পেরিয়েছে সহজে।

অথচ খোদ সত্যজিৎ রায় যে ম্যাটিনি আইডল হিসেবে উত্তমকুমারকেই বেছে নিয়েছিলেন, তা প্রায় নির্বিকল্প হয়েই। তাঁর স্তাবকেরা হয়তো ততটা বোঝেনি তখন, যেটা এই যুগন্ধর পরিচালক নিজে বুঝেছিলেন যে, অরিন্দমের চরিত্রে অন্য কোনও অভিনেতা থাকা বঙ্গদেশে অসম্ভব। বোগার্ট, ব্র্যান্ডো-সহ যৌবনেই হলিউড গুলে খাওয়া সত্যজিৎ, উত্তমের অকালমৃত্যুর পর প্রকাশ্যেই আফসোস করে বলেছিলেন, “আর একটা উত্তম হবে না।” বলেছিলেন, গ্রেগরি পেক-এর তুলনায় বড় অভিনেতা উত্তমকুমার। সত্যজিৎ রায় নিজে শিল্পী, তাই জানতেন, উত্তমকুমার যখন শিল্পী নন, তখনও নায়ক। উপন্যাস, সিনেমা ও খবরের কাগজের পরপারে তারা আমাদের জ্যান্ত রূপকথা, নক্ষত্র।

উত্তমকুমারের সঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে অভিনয় করা শর্মিলা ঠাকুর এক বার ওঁকে নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমাকে বলেছিলেন, “ওঁর অভিনয়ের রেঞ্জ আমাকে এখনও অবাক করে। ‘অমানুষ’-এর উত্তমকুমারের সঙ্গে ‘নায়ক’-এর উত্তমকুমার! ‘দুরিয়াঁ’-র উত্তমের সঙ্গে ‘দেশপ্রেমী’র উত্তম। সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর চরিত্রগুলিকে সামলাচ্ছেন একই রকম সাবলীল ভাবে। একটা বিতর্ক প্রায়ই কানে আসে যে, উত্তমকুমার তথাকথিত সেরিব্রাল অ্যাক্টর ছিলেন কি না। হয়তো মানিকদারও (সত্যজিৎ রায়) এই বিষয়ে গোড়ার দিকে সংশয় ছিল। কিন্তু ‘নায়ক’ ছবি শুরু করার পর তাঁর এই নিয়ে যাবতীয় সংশয় যে কেটে গিয়েছিল, তা পরবর্তী কালে মানিকদার উত্তমবাবু সম্পর্কে মূল্যায়ন শুনলে বা পড়লেই বোঝা যায়। মানিকদা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, উত্তমকুমার শেষ পর্যন্ত এক জন উঁচুমানের থিঙ্কিং অ্যাক্টর। প্রত্যেকটি শট কী ভাবে অনায়াসে এক টেকে উতরে দিতেন উত্তমবাবু। এক বার বুঝিয়ে দেওয়ার পর মানিকদার বাড়তি কিছু বলার থাকত না।”

এখানে যেটা বলার, শুধু উতরে দেওয়াই নয়, উত্তমে শট ইমপ্রোভাইজ়েশন দেখেও চমৎকৃত ছিলেন সত্যজিৎ। সেই বিখ্যাত শটটির কথাই যদি ধরা যায়। শর্মিলা অথাৎ অদিতি গিয়েছেন অরিন্দমের কাছে সই নেওয়ার জন্য। বুকপকেটের কলমটি খুলে সই দিতে গিয়ে উত্তম দেখলেন, কালি শুকিয়ে গিয়েছে। সংলাপ বলতে বলতেই, পাশে রাখা জলের গ্লাসটায় পেনটা একটু ডুবিয়ে বাকি সইটা শেষ করলেন। এটা কিন্তু স্ক্রিপ্টে ছিল না! ঘটনা হল, সকাল থেকে শট-এর জন্য রেডি হয়ে রয়েছেন উত্তম। যত ক্ষণে ক্যামেরা রেডি হয়েছে, ওঁর কলমটির কালি সত্যিই শুকিয়ে গিয়েছে (ঝর্না কলমে যা হামেশাই ঘটত একটা সময়ে, সে ক্ষেত্রে ঝাঁকিয়ে নেওয়া অথবা জলে ডুবিয়ে নেওয়াটাই ছিল বিধেয়)। কিন্তু কী অনায়াস ভঙ্গিতে ওই মুহূর্তের সঙ্কট সামলালেন উনি, যা শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে গেল। শটের শেষে সত্যজিৎ হাততালি দিয়ে উঠেছিলেন আনন্দে।

এই উত্তমবাবুকেই শর্মিলা দেখেছেন ‘অমানুষ’ চরিত্রে একদম বিপরীত, একটি মোটা দাগের মারদাঙ্গা করা মেঠো চরিত্রে। টানা চল্লিশ দিন গোটা ইউনিট সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইউনিট ছিল, অসহ্য গরমের মধ্যে ছিলেন তাঁরা। সকালের খাবার রাত পর্যন্ত রাখা যেত না, গরমে পচে যেত। একটা মেকশিফট স্নানাগার তৈরি হয়েছিল কাঠের পাটাতন দিয়ে। সেখানে সবাই সাবান রাখতেন। প্রত্যেক দিন সকালে দেখা যেত সেই সাবান ইঁদুরে খেয়ে গিয়েছে! মশারি টাঙিয়ে শোওয়া হত, আর ওই মশারির উপরেও চলত ইঁদুরের উৎপাত! শর্মিলার কথায়, “এই সবের মধ্যে উত্তমবাবুকে দেখতাম অবিচলিত। গোটা দিন শট দিচ্ছেন নয়তো হাসিঠাট্টা করে আমাদের মাতিয়ে রাখছেন। কষ্টটা টের পেতে দিচ্ছেন না। আর দিনের কাজ শেষ হলে খোলা গলায় গান গাইছেন, যা ছিল গোটা ইউনিটের বাড়তি আকর্ষণের কারণ।”

এভারেস্টের চূড়ায় অনেকেই ওঠেন। কিন্তু সেখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে যেতে অমানুষিক ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম আর একাগ্রতা লাগে। এমনি এমনি হয় না। শর্মিলার বলা এই ছোট্ট ঘটনাবিন্দুটিতেই আমরা টলমল করতে দেখি উত্তমের আমরণ সাধনাকে, যা তাঁকে পৃথক করে দিয়েছে মিছিল থেকে। মৃত্যুর তেতাল্লিশ বছর পরেও।

*****

ক্রমশ অস্থির, অন্যায্য, অধম সময়ে দাঁড়িয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের ক্লান্ত, ঝাড় খাওয়া, নানা ভাবে অপমানিত মন আজ বোধহয় আরও বেশি উত্তমপন্থী। গত তেতাল্লিশ বছর ধরে তাই উত্তম ক্রমে আসিতেছে!

অথচ সেই ১৯৮০-র ২৪ জুলাইয়ের ঠিক আগে, তখনকার মধ্যবয়সিদের আড্ডায় কানে আসত, গুরু আর নেই সে গুরু! মোটা হয়ে যাচ্ছে, গলা তো দেখাই যায় না, চোখ বলে আর কিছুই নেই, মুখ ফোলা, সূক্ষ্মতা কই, কী সব ‘পার্ট’ করছে! সৌমিত্র-ঝড় তখন কলকাতায় একশো চার ডিগ্রিতে!

কিন্তু আশির পর থেকে এই আজ পর্যন্ত যা ঘটে চলল, তা এক আশ্চর্য উলটপুরাণ যেন! তখনও স্বপ্নের মধ্যে জেগে থাকা মিনার বিজলী ছবিঘর অথবা উজ্জ্বলা পুরবী বসুশ্রীতে ফিরে বাজতে লাগল পঞ্চাশ-ষাট দশকের হারানো সুর। প্রজন্মের পর প্রজন্মে পুনরাবিষ্কৃত হতে থাকলেন উত্তম, বঙ্গজীবনের সেরা ম্যাটিনি আইডল হিসেবে আবারও প্রতিষ্ঠা পেলেন যেন। আজও এই ডিজিটাল যুগেও, উত্তমের হাসির চেয়ে বড় ব্র্যান্ড বাংলা ছবিতে আর কী! আজও পত্রপত্রিকায় উত্তমের বহুচর্চিত গল্পগুলি নতুন প্যাকেজে এলে বিক্রি গ্যারান্টিযুক্ত। সিঁড়িতে বাপ-ছেলের মুখোমুখি সাক্ষাত (কমল মিত্র এবং উত্তমকুমার)— তেলের দাম থেকে অগ্নিবীর, যে কোনও সামাজিক রাজনৈতিক স্যাটায়ার বা মিম-এর উপাদান। এখনও সিগারেট ঠোঁটে চেপে উত্তমের কথা বলার কায়দার দিকে মুগ্ধনয়না হয়ে থাকে তাঁর নাতির ঘরের পুতি-সমা কন্যারা। ঠাকুমা, মা, মেয়ে, নাতনি— তিন বা চার প্রজন্ম উত্তমে খুঁজে নেন নিজেদের সময়মাফিক উত্তমের ম্যাজিক। মুনমুন সেন এক বার বলেছিলেন, তাঁর মেয়েরাও একই ভাবে উত্তমভক্ত, তিনি নিজে তো বটেই! সকালে শুটিং-এ যাওয়ার সময় উত্তম মাঝে মাঝেই তাঁদের বাড়ি আসতেন (সুচিত্রা তখন কমিয়ে দিয়েছেন কাজ), মা রীতিমতো দাপটের সঙ্গে তাঁকে পরামর্শ দিতেন— সে সব মুনমুনের স্মৃতিতে আজও অমলিন।

এখন সময় যত অস্থির, সম্পর্ক যত অনিশ্চিত, যৌনতা যত ইশারাহীন, যাপন যত অশান্ত— ততই বোধহয় উত্তমের বাজার ক্রমবর্ধমান। যে ভাবে সিনেমার বর্ণপরিচয়ের জন্য দর্শক ‘পথের পাঁচালী’-র কাছে যায়, অন্য ভাবে দেখতে গেলে তেমনই শাশ্বত সম্পর্ক, শঠতাহীন হাসি, দিগন্তছোঁয়া প্রেমের সিন্দুক খুলতে উত্তমকুমারের ছবির কাছে মানুষ আজও মিছিল করে যাচ্ছেন। আর সমাজ অর্থনীতির দুর্বিপাকে কান পর্যন্ত জল উঠে এলেও অদৃশ্য কোনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে নিজেকেই বলছেন, ‘এক বার বলো,আমি উত্তমকুমার!’

অন্য বিষয়গুলি:

Uttam Kumar Tollywood Bengali Movies
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy