স্মরণচিত্র: ‘হিরোশিমা মন আমুর’ ছবির দৃশ্যে নায়ক-নায়িকা।
বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিনগুলোর একটি ৬ অগস্ট ১৯৪৫। পৃথিবীর প্রথম অ্যাটম বোমার আগুনে মার্কিন সেনাদল স্নান করিয়েছিল হিরোশিমা শহরকে। মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত। ঝলসানো পোড়া শরীরের আরও কয়েক লক্ষ জীবন্মৃত প্রাণ সে উপাখ্যানের সাক্ষী। বিশ্বের সংবেদনশীল মানুষ এই অমানবিক ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, সারা বিশ্বের শিল্পী, সাহিত্যিক, চিত্রকরেরা সঙ্গীতে, থিয়েটারে, সিনেমায় গড়ে তুলেছিলেন প্রতিবাদ। মানুষ দেখিয়ে দিয়েছিল, ধ্বংস হয়ে গেলেও হিরোশিমা হারেনি।
দশ-দশটা বছর কেটে গিয়েছে, তখনও জনমানসে টাটকা ক্ষত। বসন্ত এসে গেছে প্যারিসে। নব্য ফরাসি পরিচালকরা সিনেমার প্রথাগত ব্যাকরণ ভাঙার নতুনতর চিন্তা আদানপ্রদানের জন্যে ব্রাসেরির এ দিকটায় বড় বেশি আনাগোনা করে। কাফে প্রোকোপে-র আশপাশ শান্ত নিরালা। তাদের পাঁচ মাথা— জাঁ লুক গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শ্যাব্রল, এরিক রোমার আর জ্যাক রিভেট, সঙ্গে মধ্যমণি ‘দ্য মেন্টর’, আঁদ্রে বাজাঁ। ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার বিষয়, ‘কাইহে দ্যু’ সিনেমা পত্রিকার আসন্ন সংখ্যা। হয়ে যাওয়া কিছু ছবি আর হতে চলেছে এমন কিছু ছবির কিছু সংলাপ, কিছু ভাবনা।
চওড়া রাজপথ, ততোধিক চওড়া ফুটপাত, বেশ অনেকটাই জায়গা নিয়ে ছিমছাম দোতলা ‘কাফে প্রোকোপে’। দোতলাটি অতি প্রিয় অনেকেরই। সাদা ফ্রেমের মধ্যে আঁটসাঁট কাচের জানলার ও পারে বেগুনি স্মোক গুল্মলতা, আর তারও ওপারে শীতের রাতের প্যারিসে ব্রাসেরির আলো-ঝলমলে এলাকা। অ্যালাঁ রেনে যেন কফি নিয়ে বসে অপেক্ষমাণ কারও জন্য। হয়তো বা মনে তাঁর বেশ কিছু অতীত-কথা।
নাৎসি জার্মানি অধ্যুষিত পোল্যান্ডে ইহুদি বন্দিশিবিরের সদস্য অপহরণ আর নিখোঁজ নিয়ে অ্যালাঁ রেনের তৈরি ‘নাইট অ্যান্ড ফগ’ দলিলচিত্রটি তখন কান চলচ্চিত্র উৎসবে হইচই ফেলে দিয়েছে। সমকালীন ফরাসি চলচ্চিত্রকাররা প্রভূত তারিফ করেছেন ছবিটির। অনেকেই ছবিটিকে ফ্রান্সিসকো গোইয়ার পেন্টিং অথবা কাফকা-সাহিত্যর সঙ্গে তুলনায় এনেছিলেন। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো তো বলেই দিয়েছেন, “নাইট অ্যান্ড ফগ ইজ় দ্য গ্রেটেস্ট ফিল্ম এভার মেড।” গোদারের ইচ্ছেয় তাঁর ‘আ ম্যারেড উওম্যান’ ছবিটির প্রদর্শনের আগে অ্যালাঁ রেনের ‘নাইট অ্যান্ড ফগ’ তথ্যচিত্রটি দেখানো হয়। রেনের কৃতিত্ব এখানেই। দশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া পোল্যান্ডের ইহুদি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে অত্যাচারের স্মৃতি নিজস্ব সিনেমার ভাষা ও টেকনিকে ছবির পর্দায় তিনি নিয়ে এসেছিলেন নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়ে।
রেনের প্রথম প্রেম ছিল যদিও নাটক। সতেরো বছর বয়সে নাটকে অভিনয়ের লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের ভাঁস শহর থেকে প্যারিসে এসে জর্জেস পিতোয়েফের ঐতিহ্যশালী নাট্য কোম্পানী ‘থিয়টার দ্যে মাথুরিন্সে’ যোগ দেন। ইউরোপ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টালমাটাল। ফিল্ম সম্পাদনার শিক্ষার্থী হিসেবে অ্যালাঁ রেনে প্রশিক্ষক হিসেবে পান প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জাঁ গ্রেমিলঁ-কে। গ্রেমিলেঁর কনসেপ্টের অভিনবত্ব অ্যালাঁ রেনের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। গ্রেমিলেঁর পছন্দ ছিল এমন এক সূক্ষ্মতা, যা মানুষের চোখ সরাসরি বুঝতে পারে না। কাজ শিখতে শিখতেই ভ্যান গখ-কে নিয়ে তথ্যচিত্র করার প্রস্তাব পান অ্যালাঁ রেনে। ছবিটি ‘ভেনিস বিয়েনাল’ উৎসবে পুরস্কৃত হয়। অ্যালাঁ রেনে-র তখন আধুনিক ও অতি আধুনিক চিত্রকলার উপর দারুণ ঝোঁক।
হিরোশিমায় পরমাণু বিস্ফোরণ। ছবি সৌজন্য : উইকিমিডিয়া কমন্স
ভ্যান গখ আর পল গগ্যাঁর শিল্পী জীবনের যন্ত্রণা আর তা অতিক্রম করে তাঁদের শিল্পসৃষ্টির আবেগ রেনের ক্যানভাসে ধরা দিয়েছিল। এক নতুন ফর্মের তথ্যচিত্রে।
অ্যালাঁ রেনের একটা অদ্ভুত পরিক্রমা ছিল। কয়েক দশক আগের, অতীত হয়ে যাওয়া অত্যাচারিত ধ্বংসপ্রাপ্ত মানুষের ইতিহাসকে সিনেমার দলিলে লিখে যাওয়ার অবিসংবাদিত দক্ষতা। বার বারই রেনেকে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে এবং তাও চলচ্চিত্রের নিজের ভাষায়। প্রযোজক সংস্থা চাইছেন আরও একটা তথ্যচিত্র, ফিরে দেখা হিরোশিমা। ১৯৫৮-র দোরগোড়ায়। হিরোশিমা শহরটি তার শেষ ধ্বংসের রূপ দেখেছে তার এক যুগ আগে। অ্যাটম বোমার সাফল্য, তার নৃশংসতার বিরুদ্ধে মানুষের শান্তি চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার টানাপোড়েনে সাময়িক জয়ী হয়েছে নাপাম বোমা। কিন্তু তার পরের ইতিহাস সৃষ্টির। মানুষই তো জয়ের শেষ কথা বলে! প্রযোজকদের রেনে জানিয়ে দিলেন, এ নিয়ে তথ্যচিত্র আর নয়। কোনও তথ্য বা কোনও চিত্রই নতুন ভাবনায় তৈরি করা যাবে না। বরং, চলতি ফর্মের বাইরে গিয়ে ছোট-ছোট ফ্ল্যাশব্যাকের মধ্যে দিয়ে কাহিনি আর অ-কাহিনি মেশানো বিস্তৃতির আঙ্গিকে গল্পটি বলা হবে।
‘ক্যাফে প্রোকোপে’তে রেনে অপেক্ষা করছেন মারগুইরিতে দুরাসের জন্য। দুরাস ফরাসি এক্সপেরিমেন্টাল চলচ্চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক, চিত্রনাট্যকারও বটে। রেনে ছবির নামও ঠিক করে নিয়েছেন মনে মনে— হিরোশিমা মন আমুর। হিরোশিমা মাই লাভ। হিরোশিমা আমার প্রেম।
আর দুরাসও ঠিক করে ফেলেছেন ছবি শুরুর বিখ্যাত সেই উদ্ধৃতিটি— “ইউ হ্যাভ সিন নাথিং ইন হিরোশিমা, নাথিং!” সত্যিই কি আমরা ক্যামেরার চোখে হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ কখনও দেখেছি? এই ছবিতে প্রারম্ভিক মন্তাজে দেখিয়ে দেওয়া হল, দশক পেরিয়েও কেমন করে মনের অলিন্দে উঁকি মেরে জানান দিয়ে যায় ধ্বংসের ইতিহাস। কখনও নীরবে কাঁদে না সে। রাগ, দুঃখ, অভিমান, বেদনা, হতাশা সবেরই সাক্ষী হিরোশিমা, একটা টেস্টামেন্টের মতো। শহর পুনর্নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু তার প্রতিটি পরতে অতীতের ভয়ঙ্করতার ছবি। হাসপাতালে প্রায়-মৃত শহরের নাগরিকেরা, অসহায় তাদের মুখ, বাক্যহীন। আর মিউজ়িয়ামে সযত্নে রক্ষিত দগদগে হিরোশিমা শহরে মানবসভ্যতার নিধন স্মৃতি। রেনের ক্যামেরা এখানে দেখায় লক্ষ লক্ষ মৃতদের অবিনশ্বর অস্তিত্ব। পোড়া চুল, পোড়া ত্বক, আরও অনেক কিছু। রেনে অ্যাটম বোমা পড়ার মুহূর্ত পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। আমরা অনেক কিছু দেখেছিলাম, অনুভূতিগুলো আনকোরা লেগেছিল। খানিকটা তথ্যচিত্রের ঢঙে মন্তাজের নাটকীয় মিশ্রণ ছবির শুরুতেই রেখে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আমরা কখন যেন মিশে গিয়েছি গল্পের দুটো মুখ্য চরিত্রে, যাদের আমরা চিনি নারী ও পুরুষ হিসেবে। নারী-চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ইমানুয়েল রিভা আর পুরুষ-চরিত্রের ভূমিকায় এইজি ওকাদা। চিত্রনাট্যের মানবিক মুখ সযত্নে সাজানো হয়েছিল তথ্যচিত্র আর কাহিনিবিন্যাসের সূক্ষ্ম সূত্র অনুসরণ করে। রেনে ভেবেছিলেন এবং বলেওছিলেন, ছবিটি করার অসম্ভাব্যতা প্রত্যক্ষ করার জন্যই তাঁর এই প্রয়াস, আর এই অসম্ভাব্যতাই হয়ে উঠেছে ছবিটির মূল কাঠামো। চিত্রসজ্জা হিসেবে এই ছবিটি আধুনিকতায় প্রকাশিত, যা ফরাসি নব্যযুগের অন্যতম সেরা ছবির দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে গেল আজও। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় আখ্যান তৈরি করতে গিয়ে রেনে, নারীটির অতীত প্রেমের বেদনাদায়ক স্মৃতিসম্বলিত কাহিনি শোনান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানরা যখন ফ্রান্স দখল করে, তখন নেভার্স শহরে এক জার্মান সৈনিকের সঙ্গে নারীটির প্রেম হয়েছিল। ফ্রান্সের মুক্তির দিন প্রতিরোধের এক সদস্য স্নাইপার দিয়ে নারীটির জার্মান প্রেমিককে হত্যা করে। সে শূন্যতা সেই নারীর কাছে নিঃশব্দ আবেগের। ভালবাসার স্মৃতি। এক রাতে, তার মা তাকে নেভার্স ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলেন। পরদিন প্যারিসে পৌঁছে স্মরণ করেন, ‘‘হিরোশিমার নাম সব পত্রিকায় রয়েছে।’’ নারীটির কাছে হিরোশিমা শহরে নাপাম বোমার দানবীয় আঘাত কোথায় যেন মিলিয়ে দিয়েছিল নেভার্সের আবেগময় স্মৃতিকে। পুরুষটিরও হারানো কাহিনি আছে। মৃত্যু ও ধ্বংস সে নিজেই প্রত্যক্ষ করেছে, হিরোশিমায় স্বজন হারানোর বেদনা তার হৃদয়ে আজও অমলিন।
১৯৫৯-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে আনুষ্ঠানিক ভাবে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি ‘হিরোশিমা মন আমুর’ ছবিটিকে। উদ্দেশ্য, আমেরিকার সঙ্গে ফ্রান্সের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এড়ানো। সে বছর ওই উৎসবে নতুন সময়ের ছবি ছিল বেশ কয়েকটি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ়’ আর গোদারের ‘ব্রেথলেস’। ‘হিরোশিমা মন আমুর’-কে ফেলে দিতে পারেনি কান উৎসবের জুরি বোর্ড। ফিপ্রেসি সেরা পুরস্কার পেয়েছিল অ্যালাঁ রেনের ছবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy