Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Hilsa

ইলিশ ধরতে গেলে পড়তে হয় জলের মন

জানেন পোড় খাওয়া মাছ শিকারিরা। ইলিশের ঝাঁক জলে থাকলে ভেসে আসে এক বিশেষ আঁশটে গন্ধ। বাচ্চার জন্ম দিতে তারা সমুদ্র থেকে আসে মিষ্টি জলের নদীতে। তাদের নিয়েই বাঙালির গঙ্গা-পদ্মার তরজা। এ বছর লকডাউন কমিয়েছে জলের দূষণ, ফলে বাড়বে ইলিশের স্বাদ। সুপ্রতিম কর্মকারইলিশ একা একা থাকতে পারে না। সপরিবার বেঁধে বেঁধে থাকে। ছোট-বড় সকলেই। মামাবাড়ির দাদু বলতেন, ‘গন্ধঝাঁক’।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

সত্তর বছর বয়সি এক মৎস্যজীবী দাঁড়িয়ে ছিলেন রূপনারায়ণের সামনে। জল মাপছিলেন চোখের আন্দাজে। এই ভাবেই জল মেপে তিনি বুঝতে পারেন নদী ভিতরে ভিতরে তৈরি হচ্ছে ইলিশের জন্য। মধুগুলগুলি বৃষ্টি নামল। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিরই একটা রকমফের। এই বৃষ্টির পর ইলিশেরা উতলা হয়ে হঠে। প্রকৃতির এই ভাষা জানেন সনাতন হালদার। এই অধিবিদ্যা বাপ-ঠাকুরদার থেকে পাওয়া। মামারা থাকতেন সুন্দরবনে। ছোটবেলায় মামার দেশে বেড়াতে গেলে দাদু নিয়ে যেতেন তাকে। কখনও নৌকো, কখনও ট্রলারে। দাদুই বলতেন, ইলিশ ধরতে গেলে জলের মন বুঝতে হয়, জলের গায়ের গন্ধ নিতে হয়।

ইলিশ একা একা থাকতে পারে না। সপরিবার বেঁধে বেঁধে থাকে। ছোট-বড় সকলেই। মামাবাড়ির দাদু বলতেন, ‘গন্ধঝাঁক’। ইলিশরা এক সঙ্গে থাকলেই জলের উপর দিয়ে একটা আলাদা আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে। তখনই বোঝা যায় ইলিশের ঝাঁক আছে নদীর বুকে। আর জলের মন পড়তে গেলে চিনতে হয় জলের রং। তার আবার নানা নাম। ডাব জল, গাব জল, মাছ ধোয়া জল, চখা জল, কালো জল, চেরটা জল। চখা জল চোখের জলের মতো পরিষ্কার। আর চেরটা জলে থাকে অনেক শেওলা। সব জলেই কিছু না কিছু ইলিশ থাকেই। তবে ঘোলা জলে ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

স্মৃতিগুলো ঝাঁকিয়ে নিয়ে পাড়ের বাঁধের উপর থেকে নামলেন চরের উপর রাখা নৌকোর কাছে। এই নৌকো করেই প্রতি বার তিনি ইলিশ ধরতে যান। ভালবেসে নৌকোটার নাম দিয়েছিলেন ‘সোহাগী’। মাছ ধরতে, ইলিশ মারতে এই আদরের নৌকোই তাঁর সঙ্গী। এ বার পৃথিবী কিছু দিনের জন্য বন্ধ ছিল। যারা পৃথিবীটাকে শাসন করত, তারা করোনা-আতঙ্কে ঘরবন্দি রেখেছে নিজেদের। তাই একটু দেরি হয়েছে বেরতে। আখেরে তাতে লাভই হল। ইলিশ নিজেকে আরও সুস্বাদু করে তুলল।

‘মাইগ্রের’ একটা ল্যাটিন শব্দ। যার মানে ভ্রমণ। ইলিশ মাছ ভ্রমণপ্রিয়, তাই একে বলে মাইগ্রেটরি ফিশ। কিছু দিন সাগরে, তো কিছু দিন নদীতে। নোনা জলের দেশে থাকে ইলিশ। ওটা তার শ্বশুরবাড়ি। সন্তানের জন্ম দিতে ইলিশকে বাপের বাড়ি আসতে হয়। মিষ্টি জলের নদী ইলিশের বাপের বাড়ি। ইলিশের মা হল গঙ্গা আর মাসি পদ্মা। বছরে দু’বার বর্ষা আর শীতে ডিম ফুটিয়ে সন্তানের জন্ম দিতে ইলিশকে আসতে হয় মা-মাসির কাছে। ঝাঁক বেঁধে সমুদ্র থেকে যখন ওরা ঢোকে নদীর বুকে, তখন তাকেই বলে অ্যানাড্রোমাস পরিযাণ। গঙ্গা ভাগীরথী হুগলি রূপনারায়ণ ব্রহ্মপুত্র গোদাবরী নর্মদা তাপ্তী পদ্মা যমুনা মেঘনা কর্ণফুলি ইরাবতী সবেতেই সাগর উজিয়ে ইলিশ আসে।

গঙ্গা, পদ্মা উজিয়ে যে ইলিশ আসে, তাকে ইলিশ বললেও অন্য নদীতে ইলিশ পাওয়া গেলে, তার আর ইলিশ নাম থাকে না। সৈয়দ মুজতবা আলী ‘পঞ্চতন্ত্র’-এ লিখছেন, নর্মদা উজিয়ে যে ইলিশ আসে, ভৃগুকচ্ছের মানুষের কাছে তা ‘মদার’। পার্সিদের কাছে তার নাম ‘বিম’। সিন্ধু নদ উজিয়ে এলে ওই মাছের নাম ‘পাল্লা’। তামিলরা ইলিশকে বলে ‘উলম’। গুজরাতিরা পুরুষ ইলিশকে বলে ‘পালভো’, স্ত্রী ইলিশকে বলে ‘মোদেন’। তা ছাড়াও ইলিশের অনেক নাম: খয়রা ইলিশ, গৌরী ইলিশ, চন্দনা ইলিশ, গুর্তা ইলিশ, সকড়ি ইলিশ, জাটকা ইলিশ, ফ্যাসা ইলিশ, খ্যাপতা ইলিশ, মুখপোড়া ইলিশ এমন নানা রকম। বাংলাদেশে যে ইলিশ বিলে পাওয়া যায়, তাকে লোকে বলে ‘বিলিশ’।

অন্য মাছের তুলনায় ইলিশের কৌলীন্য বেশি। সাহিত্যিক শঙ্করের কথায় মৎস্য সমাজে ইলিশ একমাত্র উপবীতধারী। তার দু’পিঠে যে দুটো সুতো থাকে, তার নাম পৈতা। আজ থেকে প্রায় ন’শো বছর আগে জীমূতবাহন তাঁর ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে এই বিখ্যাত মাছটির নাম দিয়েছিলেন ইলিশ। আর ১৮২২ সালে মৎস্যবিজ্ঞানী হ্যামিলটন সাহেব এই মাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম দিলেন, হিলসা হিলসা। ১৯৫৫ সালে এই মাছের বিজ্ঞানসম্মত নামটি পাল্টে হল টেনুয়ালোসা হিলসা। এই ‘টেনুয়ালোসা’ শব্দটি ইলিশেরই উপযুক্ত। শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘টেনিয়াস’ থেকে, যার অর্থ পাতলা। ঝরঝরে চকচকে পাতলা শরীরের সুন্দরীর এমন নাম বেশ মানানসই।

যা সুন্দর তাতে কাঁটা থাকে। যেমন গোলাপ। ইলিশ-সুন্দরীর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। তার পেটের কাছের কাঁটা দেখে প্রজাতি ঠিক করা হয়। এই কাঁটাগুলো দেখতে ইংরেজি ‘ভি’-অক্ষরের মতো। যাকে ‘স্কুট’ বলা হয়। এই স্কুটের সংখ্যা অনুযায়ী ইলিশের প্রজাতি পাঁচ রকম। ইলিশের আবার বহুরূপী আছে। ইলিশ-সুন্দরীর মতো দেখতে হলেও স্বাদে-গন্ধে তারা কিন্তু ইলিশ নয়। যেমন, চাপিলা মাছ এবং কই-পুঁটি।

আমাদের রাজ্যে ইলিশের জন্য একটা জল-জঙ্গল তৈরি করা হয়েছে। ২০১৩ সালে রাজ্য সরকারের মৎস্য দফতর তার জন্য একটি আইনও তৈরি করে ফেলেছে। সেই আইনের অধীনে ইলিশের জন্য তৈরি হয়েছে ‘ইলিশ অভয়ারণ্য’। গঙ্গার মোহনা থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত কয়েকটি অংশ ডিম পাড়ার জন্য ইলিশের বড় পছন্দের। যেমন লালগোলা থেকে ফরাক্কা অংশ, কাটোয়া থেকে হুগলি ঘাট, ডায়মন্ড হারবার থেকে নিশ্চিন্তিপুর গদখালি অংশে ইলিশ ডিম পেড়ে তার বাচ্চাদের বড় করে। আর বাংলাদেশে ছ’টি ‘ইলিশ অভয়াশ্রম’ স্থাপিত হয়েছে, যেগুলো মেঘনা অববাহিকা এবং পদ্মা-মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। পদ্মা ও মেঘনা নদী ছাড়াও শাহবাজপুর নদী, তেঁতুলদিয়া নদী, আন্ধারমানিক নদীতেও ইলিশ পাওয়া যায়।

ঘটি আর বাঙালদের মধ্যে চিরকালের লড়াই ইলিশ নিয়ে। বলা ভাল, ইলিশের স্বাদ নিয়ে। সমুদ্রে থাকার সময় ইলিশের শরীর ছোট, পাতলা আর কম স্বাদের হয়। নোনা জলের সংসার থেকে মিষ্টি জলের ঢোকার সময় থেকে ইলিশ পুষ্ট হতে থাকে। তার স্বাদ বাড়তে থাকে। আর লকডাউন ইলিশকে আরও একটু বেশি স্বাদ দিল। লকডাউনে নদীগুলো জলের গুণমান ফিরে পেয়েছে। গঙ্গাও অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে দূষণ। ইলিশ যে সব খাবার খেয়ে বাঁচে, তারা হল নীল-সবুজ শেওলা, কোপেপড, ক্লাদকেরা, রেটিফারের মতো জলে মিশে থাকা খাবার। নদীর জল ভাল হওয়ায় নদীর জলে মিশে থাকা খাবারও উন্নত হয়েছে। ভাল মানের খাবার খেয়ে ইলিশের স্বাদ বাড়বে, এটাই মৎস্যবিজ্ঞানীদের মত।

ইলিশ নদীর যত গভীরে যায়, তত খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয়। তখন সে তার শরীরে জমে থাকা ফ্যাট থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। ফলে শরীরে চর্বির পরিমাণ কমতে থাকে। আর ইলিশ নরম এবং সুস্বাদু হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও মাছের শরীরে কিছু ফ্যাটি অ্যাসিডের জন্ম হয় ও তার নানা রূপান্তর ঘটে। এর ফলেও বাড়ে ইলিশের স্বাদ ও গন্ধ।

বাঙালি দাম্পত্যজীবনের সঙ্গে ইলিশের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির বিয়ের পরবর্তী অবস্থাকে জালে পড়া ইলিশের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আর এক নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনও ইলিশ-প্রেমিক। কলকাতায় থাকলে গঙ্গার ইলিশ তাঁর মেনুতে থাকবেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো লিখেইছেন, ইলিশের স্বাদ দেড় কিলো থেকে পৌনে দু’কিলোয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনই খাঁটি ইলিশের স্বাদের সঙ্গে অন্য কোনও কিছুর সমঝোতা চলে না’। আবার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘সপ্তমী পুজোর দিনে আমি সওয়া দেড় কেজি ওজনের এমন একটা সুলক্ষণ ইলিশ মাছ কিনব, যার পেটে সদ্য ডিমের ছড় পড়েছে।’ সুলক্ষণ বলতে তিনি সেই ধরনের ইলিশের কথা বলেছেন, যার চেহারা একটু গোলাকার, পেট সরু এবং মাথাটা আকারে ছোটখাটো।

‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র একত্রিশটি মাছের উল্লেখ করেছিলেন, যার শেষেরটি ইলিশ। হুমায়ুন আহমেদ মনে করতেন, বাংলা বর্ণমালার শিশুশিক্ষার বইয়ে ‘আ’-তে যদি আম হয়, তা হলে ‘ই’-তে ইলিশ। পদ্মার অরিজিনাল ইলিশ বোঝার উপায় ইলিশের নাক ভাঙা দেখে। ইলিশ যখন পদ্মায় ঢোকে, হার্ডিন ব্রিজের স্প্যানে ধাক্কা খায়। আর তাতেই ইলিশের নাক থেঁতো হয়ে যায়। সেই সব নাকভাঙা ইলিশই আসল পদ্মার ইলিশ। এদেশীয়রা গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের তুলনা টানলেও, বাংলাদেশের মানুষজন গঙ্গার ইলিশকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। তাঁদের তুলনার বিষয় হল, পদ্মার ইলিশে বেশি স্বাদ না যমুনার ইলিশে। সুরমা নদীর ইলিশের স্বাদ বাংলাদেশের মানুষ মোটেই পছন্দ করেন না। কারণ সেটা খেতে গভীর সমুদ্রের ইলিশের মতো। এমনই সব গল্প শুনিয়েছে হিমু।

পরিমল গোস্বামী রেডিয়োতে পড়া এক কথিকায় বলেছিলেন, ‘গীতায় ভগবান বলেছিলেন যে, আমাকে যে যেখানেই ভজুক আমি তাকে তুষ্ট করি। আর ইলিশ আমাদের বলেন, যে যেমন করেই আমাকে ভাজুক, আমি তাকে তুষ্ট করি।’ যম দত্ত মনে করতেন কলকাতার ইলিশের সুগন্ধ বেশি। কমল মজুমদারও তা-ই মনে করেন, পদ্মার থেকে গঙ্গার ইলিশ অনেক ভাল। মজা করে বলতেন, গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর ধরে কোম্পানির (ব্রিটিশদের) তেল খেয়েছে। এই ইলিশকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। স্বামী বিবেকানন্দও মাঝগঙ্গার ইলিশ খেতেই বেশি পছন্দ করতেন। এত কিছুর পরেও একটা কিন্তু আছে। লেখক অমিতাভ ঘোষ মনে করেন, কেউ বাঙালি কি না তার পরীক্ষা নিতে গেলে ‘ইলিশ খেতে পারেন কি না’ জানতে চাওয়ার থেকে জরুরি, তিনি পাঁকাল মাছ খান কি না, শোল-মুলো খান কি না, এগুলো জানতে চাওয়া। ইলিশ-রুই-কাতলা করে আমরা অন্য মাছগুলো হারিয়ে ফেলেছি। আর অতিরিক্ত চাহিদার চাপে ইলিশের মতো মাছও আজ বিপন্ন।

এই কথাগুলো পড়তে যে সময় লাগে, সেই সময়টুকুতেই ইলিশরা মিঠে জলে ১৫ থেকে ১৮ লাখ ডিম পাড়ল। ডিম ফুটে ছয় থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চারা ১২ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে গেল। এর পর খোকা ইলিশ পাঁচ থেকে ছ’মাস নদীতে কাটিয়ে শুরু করল তার ক্যাটাড্রোমাস পরিযাণ। মানে মিষ্টি জল থেকে ফিরে গেল ভাটির টানে, সাগর পানে। বড় হয়ে ফের শীতে আসবে বলে।

অন্য বিষয়গুলি:

Hilsa ইলিশ Ilish Migratory Fish
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy