সেটা ২০১৪ সাল। সদ্য অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন হার্ভার্ডের অধ্যাপক হেনরি স্পিয়ারম্যান। তার পরই টেক্সাসের সান আন্টোনিয়ো-তে মন্টে ভিস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ স্বীকার করে। সেখানে খুন হন স্থানীয় শিল্পী। স্পিয়ারম্যান, যিনি একই সঙ্গে এক জন শখের গোয়েন্দাও বটে, এবং যিনি জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতি বিচার করেন অর্থনীতির নিরিখে, তখন রয়েছেন সেখানে। তাই স্পিয়ারম্যান যে এই হত্যা-রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!
ওয়াকিবহল পাঠক নিশ্চয়ই এই হেনরি স্পিয়ারম্যান-কে মনে করতে পারছেন না। পারবেন কী করে! স্পিয়ারম্যান এক কাল্পনিক চরিত্র। তাঁকে তৈরি করা হয়েছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যানকে মাথায় রেখে। কল্পনার স্পিয়ারম্যানের মতোই ফ্রিডম্যানও তো বাঁচতেন, নিঃশ্বাস নিতেন অর্থনীতির আবর্তেই। স্পিয়ারম্যানের স্রষ্টা হলেন সান আন্টোনিয়ো আর ভার্জিনিয়ার দুই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন অর্থনীতির অধ্যাপক— উইলিয়াম ব্রেট আর কেনেথ এলজ়িঙ্গা। এঁরা যৌথ ভাবে এই রহস্য উপন্যাসগুলি লিখেছেন ‘মার্শাল জেভন্স’ ছদ্মনামে। অর্থনীতির দুই অধ্যাপকের সৃষ্টি এই অর্থনীতিবিদ-গোয়েন্দার রহস্য সমাধানের প্রকরণের পরতে পরতে অর্থনীতির তত্ত্ব নিয়ে লোফালুফি। দেখা হয়েছে কী ভাবে অর্থনীতির প্রভাব ফেলে মানুষের স্বভাব-চরিত্রে।
২০১৪-র এই অপরাধ-রহস্য ‘দ্য মিস্ট্রি অব দি ইনভিজ়িবল হ্যান্ড’-এ স্পিয়ারম্যান চেষ্টা করেন শিল্পীর বিপণনযোগ্যতা এবং মৃত্যুর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে বের করার। বিচক্ষণ অর্থনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি কাজে লাগিয়ে ব্যবহার করেন অর্থনীতির একচেটিয়া তত্ত্ব, কোয়াস-এর অনুমান তত্ত্ব, নিলামের তত্ত্ব এবং অবশ্যই অ্যাডাম স্মিথের যুগান্তকারী কাজকে, যা ‘ইনভিজ়িবল হ্যান্ড’ নামে বিখ্যাত।
স্পষ্টতই হেনরি স্পিয়ারম্যানের গল্পগুলি আর পাঁচটা গোয়েন্দাগল্প থেকে বেশ খানিকটা অন্য রকম। অন্য রকম, কারণ গোয়েন্দা এক জন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। অন্য রকম, কারণ এর লেখকদ্বয়ও অর্থনীতির অধ্যাপক। অন্য রকম, কারণ নোবেলজয়ী অর্থনীতির অধ্যাপক গোয়েন্দাটি সমস্যার সমাধান করেন অর্থনীতির তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে— মার্শাল, কেনস কিংবা অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব নিংড়ে। অন্য রকম, কারণ এই গোয়েন্দাগল্পের রিভিউ ছাপা হয় বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক জার্নালে। অন্য রকম, কারণ নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ক্লাসে পাঠ্য করা হয় এই গল্প। এমন গোয়েন্দা কি আর আছে এক জনও?
কল্পনার গোয়েন্দার প্রয়োজন পড়ে এক জন সঙ্গী বা সহকারী। হেনরি স্পিয়ারম্যানের ক্ষেত্রে এই সঙ্গী হলেন তাঁর স্ত্রী পিজ। তিনি কিন্তু অর্থনীতিবিদ নন। এই একটা বিষয়ে মিল্টন ফ্রিডম্যানের সঙ্গে হেনরি স্পিয়ারম্যানের অমিল। ফ্রিডম্যানের স্ত্রী রোজ় ছিলেন অর্থনীতিবিদ।
বিচ্ছিন্ন ভাবে অর্থনীতির তত্ত্বের প্রসঙ্গ এসেছে রেমন্ড চান্ডলার, স্ট্যানলি গার্ডনার, এডগার অ্যালান পো-র কোনও কোনও গল্পে। কিন্তু নীতিনিষ্ঠ ভাবে অর্থনীতির সূত্র কাজে লাগিয়ে গোয়েন্দাগিরির গল্পমালা সম্ভবত এটিই একমাত্র। এক জন অর্থনীতিবিদ শখের গোয়েন্দা হিসেবে রহস্য উন্মোচন করবেন— এ নিয়ে গল্প লেখার পরিকল্পনা প্রথম করেন উইলিয়াম ব্রেট। তাঁকে উৎসাহ দেন এলজ়িঙ্গা। তিনি অংশগ্রহণও করেন সহলেখক হিসেবে। তিন বছরের প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয় হার্ভার্ডের এই অর্থনীতিবিদ-গোয়েন্দার। ১৯৭৮ সালে। প্রথম বই ‘মার্ডার অ্যাট দ্য মার্জিন’, প্রকাশক টমাস হর্টন অ্যান্ড ডটার্স। সেখানে লেখকের নাম ছিল ‘মার্শাল জেভন্স’। সঙ্গে ছিল কল্পিত এক লেখক পরিচিতি। ‘মার্শাল জেভন্স’ নামটা আসলে তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের দুই ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল আর উইলিয়াম স্ট্যানলে জেভন্স-এর নাম দু’টি জোড়কলম করে।
‘মার্শাল জেভন্স্’-এর সেই গোয়েন্দা গল্প যেন সাবলীল অর্থনীতির পাঠ। ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ লেখা হয়, অর্থনীতি শেখার এর চেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের উপায় হতে পারে একমাত্র আইসক্রিমের মধ্যে ঢুকিয়ে তা খাইয়ে দেওয়া। যাই হোক, তখন থেকেই বইটি কিন্তু অর্থনীতির অনেক প্রাথমিক কোর্সে সম্পূরক পাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৮৯-এর মধ্যেই অন্তত চল্লিশটা মার্কিন কলেজ এবং হাইস্কুলে পাঠ্য হয়ে যায় বইটি। একই সঙ্গে বইটি বাণিজ্যিক ভাবেও তুমুল সাফল্য পায়।
এমআইটি প্রেস লেখকদ্বয়কে অনুরোধ করে হেনরি স্পিয়ারম্যানকে নিয়ে আর একটি রহস্য-উপন্যাস লিখতে। এরই ফলশ্রুতি ১৯৮৫-র বই ‘দ্য ফেটাল ইকুইলিব্রিয়াম’। কোনও একটা ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস’ গোয়েন্দাগল্প ছাপাল, এমন ঘটনা বোধহয় সেই প্রথম ঘটল দুনিয়ায়। এই গল্পে ডেনিস গোসেন নামের এক অর্থনীতিবিদের কর্মজীবন সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমোশন এবং স্থায়ীকরণ কমিটির সিদ্ধান্তে, এবং সেই সঙ্গে তার জীবন সংক্ষিপ্ত হয় আত্মহত্যার কারণে। তার পর সেই কমিটির দুই সদস্য খুন হলে অভিযুক্ত হয় গোসেনের বাগদত্তা মেলিসা শ্যানন। হেনরি স্পিয়ারম্যান জড়িয়ে পড়েন তদন্তে। স্পিয়ারম্যান যখন রহস্যের জিগ্স পাজ়ল-এর টুকরোগুলি জুড়তে শুরু করেন, তখনই ঝড়ের সমুদ্রে একটি বিলাসবহুল লাইনারে খুনি এবং হেনরি মুখোমুখি হন চতুর্থ এবং শেষ ‘ফেটাল ইকুইলিব্রিয়াম’-এর। অর্থনীতি আর থ্রিল সেখানে চলে হাত ধরাধরি করে।
১৯৯৫-তে লেখকদ্বয় লেখেন তৃতীয় বইটি, ‘আ ডেডলি ইনডিফারেন্স’। এই গল্পে স্পিয়ারম্যান যান ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে। সেখানে অর্থনীতির দুনিয়ায় সবচেয়ে বিখ্যাত বাড়ি, ‘ব্যালিয়ল ক্রফট’, যা এক সময় ছিল আলফ্রেড মার্শালের বাড়ি। সেখানেও এক খুনের আবর্তে জড়িয়ে পড়েন স্পিয়ারম্যান, এবং তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁর নিজের জীবনও আছে বিপদের মধ্যে। তিনি সম্মুখীন হন তাঁর জীবনের সব চেয়ে পৈশাচিক হত্যাকারীর। শেষ পর্যন্ত খুনিকে তিনি ধরেন জোগান এবং চাহিদার নিয়মের কিছু জটিল রূপ ব্যবহার করে।
ব্রেট মারা যান ২০১১-তে। তাই শেষ বইটি, অর্থাৎ ‘দ্য মিস্ট্রি অব দি ইনভিসিবল হ্যান্ড’ একাই লেখেন এলজ়িঙ্গা। কিন্তু সেই ‘মার্শাল জেভন্স’-এর যৌথ পরিচয়েই। মানুষ প্রায়শই অযৌক্তিক আচরণ করে এবং ভুল করে বসে— এই অনুমানের উপর নির্ভর করেই রহস্যের সমাধান করেন স্পিয়ারম্যান।
বাস্তবের অর্থনীতির নোবেলজয়ী পল স্যামুয়েলসন বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল এক নতুন ধরনের শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল ব্যক্তি, মাস্টারমাইন্ডকে— যিনি যুক্তিবাদী ‘হোমোইকোনমিক্স’ এবং উদারবাদী।” আর যাঁর কথা ভেবে তৈরি করা হয়েছে স্পিয়ারম্যানকে, সেই মিল্টন ফ্রিডম্যান বলেছিলেন, “রহস্য সমাধানের উপায় হিসাবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ব্যবহারের এই ধারণাটা একেবারেই স্বতন্ত্র।” জন ন্যাশ বলেছিলেন, এই উপন্যাসগুলি অর্থনীতি শেখার ভাল উপায়।
হেনরি স্পিয়ারম্যানের কি আর কোনও প্রশংসা প্রয়োজন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy