মরণেচ্ছু: গ্যারি মার্ক গিলমোর ছবি: গেটি ইমেজেস
সব সময় মরার জন্য হাঁকপাঁক করেছেন তিনি। অথচ তাঁর মৃত্যুদণ্ড জারি হয়েও বার বার স্থগিত হয়ে যায়! আত্মহত্যা করতে গেলেও ডাক্তাররা বাঁচিয়ে তোলেন! নিজের মৃত্যুর জন্য এমন প্রাণপণ সংগ্রাম, এমনকি নিজের মৃত্যুদণ্ডের সমর্থনে এক জন দুঁদে উকিল খাড়া করার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো আর কোথাও নেই।
ভদ্রলোকের নাম গ্যারি মার্ক গিলমোর। থাকতেন আমেরিকার উটা রাজ্যের একটা ছোট্ট শহর প্রোভো-তে। জীবনের পঁয়ত্রিশটি বসন্ত পার করে দিয়েছেন, অথচ কোনও মেয়েকেই মনে ধরেনি। হঠাৎ এক দিন পাশের শহর ওরেম-এ শ্রীমতী নিকোল ব্যারেট-এর সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দৃষ্টিতেই দু’জনেরই প্রাণ উথাল-পাথাল, দু’জনেরই মনে হয় তাঁরা যেন কত জন্মের চেনা! অবশ্য, ভদ্রমহিলা দু’টি সন্তানের জননী, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদটাও সুসম্পন্ন।
যাই হোক, এক দিন দু’জনে হাত ধরাধরি করে একটা হোটেলে খানাপিনা সারতে গেলেন। কিন্তু হোটেলের দ্বাররক্ষীর সঙ্গে কী যেন একটা কারণে বাধল গ্যারির তর্কাতর্কি, তার পর ধুন্ধুমার কাণ্ড। একেই তো গ্যারি বরাবর রগচটা, তার উপর প্রেয়সীর সামনে অপমান! দ্বাররক্ষীর পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে চালালেন গুলি। অব্যর্থ লক্ষ্য! দ্বাররক্ষীর ভবলীলা সাঙ্গ। দিনটা ছিল ১৯৭৬ সালের ৮ জুলাই।
গ্রেফতার হলেন গ্যারি। খুনের অভিযোগে বিচার চলল ৬ অক্টোবর পর্যন্ত। জুরিরা একবাক্যে মত দিলেন, গ্যারির অপরাধ অমার্জনীয়। বিচার চলাকালীন গ্যারি এক বারও মুখ খোলেননি। জুরিরা মত ঘোষণা করার পর তিনি জজের দিকে ফিরে উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘‘মহামান্য বিচারক! বাকি জীবন জেলে পচে মরার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়, দয়া করে আমায় মৃত্যুদণ্ড দিন।’’
বিচারক সব শুনলেন। ১১ নভেম্বর গ্যারিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল, ১৫ নভেম্বর সকাল আটটায় ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে গ্যারিকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল গ্যারির, তিনি জজ-জুরিদের অজস্র ধন্যবাদ জানালেন। তার পর, নিয়মানুযায়ী গ্যারিকে জিজ্ঞেস করা হল মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছে কী। গ্যারি আনন্দিত স্বরে জানালেন, মৃত্যুবেদির সামনে তিনি শ্রীমতী ব্যারেটকে বিয়ে করতে চান। কারণ, শুধুমাত্র এই কাজটুকুর জন্যই নাকি পৃথিবীতে তাঁদের জন্ম। শ্রীমতী ব্যারেটও এক কথায় রাজি, কারণ তিনি মনে-মনে ঠিক করে রেখেছেন, মৃত্যুদণ্ডের দিন তিনিও আত্মহত্যা করবেন। না হলে তো তাঁকে একা হয়ে যেতে হবে। একটা আলোড়ন-সৃষ্টিকারী খবরের খোঁজ পেলেন সাংবাদিকরা।
ও দিকে নড়েচড়ে বসল আমেরিকার ‘সিভিল রাইটস গ্রুপ’। যার সদস্যদের মতে, প্রাণদণ্ড একটি পৈশাচিক শাস্তি। প্রধানত এদের আন্দোলনের চাপেই ১৯৬৭ সাল থেকে আমেরিকায় কোনও অপরাধীরই প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়নি। তাই, গ্যারির বিচারের রায়ে সারা দেশে তুলকালাম শুরু হয়ে গেল। বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল সংবাদপত্র ও সমস্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠী। তাদের আশঙ্কা, আবার পুরোদমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পক্ষে রাষ্ট্রের এ এক নয়া চাল। উটা কোর্টে শত-শত আবেদন জমা পড়ল গ্যারির প্রাণভিক্ষা চেয়ে।
ব্যাপার-স্যাপার দেখে উটার গভর্নর মৃত্যুদণ্ডের সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করলেন এবং ‘স্টেট পারডন্স বোর্ড’-কে ভার দিলেন বিচারের সিদ্ধান্ত খতিয়ে দেখার জন্য। বোর্ডের মিটিংয়ের তারিখ পড়ল ১৯৭৬-এর ১৭ নভেম্বর।
ও দিকে জেলে বসে এত ঘটনার কিছুই জানতে পারলেন না গ্যারি। তিনি দেখলেন, ১৫ নভেম্বর জেলের ঘড়িতে ঢংঢং করে আটটা বেজে গেল, কিন্তু তাঁর তো মরা হল না! তার পর সব ঘটনা শুনে বেজায় খেপে গেলেন। পরের দিন দেখা গেল, জেলের ভেতর গ্যারি বিষ খেয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছেন।
খবর এল, মিসেস ব্যারেটও একই সময় তাঁর বাড়িতে বিষ খেয়েছেন। তদন্তে জানা গেল, জেলে থাকা গ্যারিকে বিষ সাপ্লাই দিয়েছেন শ্রীমতী ব্যারেটই।
যাই হোক, গ্যারি ও মিসেস ব্যারেটকে সঙ্গে-সঙ্গে ভর্তি করা হল যথাক্রমে ‘ইউনিভার্সিটি অব উটা মেডিক্যাল সেন্টার’ ও ‘উটা স্টেট হসপিটাল’-এ। বড় বড় ডাক্তাররা ছুটে এলেন, যমে-মানুষে টানাটানির পর ডাক্তাররা যমের মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন দু’জনকেই। জ্ঞান ফিরে গ্যারি প্রথমেই দেখা করতে চাইলেন প্রেয়সীর সঙ্গে, কিন্তু ডাক্তাররা ও শ্রীমতী ব্যারেটের আত্মীয়-স্বজন আপত্তি জানালেন। একটা ফোন পর্যন্ত করতে দেওয়া হল না গ্যারিকে। রাগে, দুঃখে, অপমানে গ্যারি জেলের ভিতর শুরু করলেন অনশন ধর্মঘট।
স্টেট পারডন্স বোর্ড হয়তো মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখত, কিন্তু এই সব ঘটনার জেরে ১৭ নভেম্বরের মিটিংটাই গেল ভেস্তে! ও দিকে সিভিল রাইটস গ্রুপ তাদের পক্ষে দাঁড় করাল উটার অ্যাটর্নি জেনারেলকে। ব্যাপার দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন গ্যারি। ৩০ নভেম্বর তারিখে তিনি সৃষ্টি করলেন এক ইতিহাস। জেল-কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাঁর স্বপক্ষে দাঁড় করালেন দুঁদে অ্যাটর্নি রোনাল্ড স্ট্যানজারকে— উদ্দেশ্য, নিজের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য লড়াই।
স্ট্যানজার বিচারসভায় বললেন, ‘‘নিজের জীবন সম্বন্ধে যে কেউ যা খুশি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যদি না তাতে কারও কোনও ক্ষতি হয়। গ্যারি মরবে না বাঁচবে, তা গ্যারিই বুঝবে। গ্যারিকে যদি মরতে না দেওয়া হয়, তা হলে আদালত নাগরিক অধিকারভঙ্গের দায়ে পড়বে।’’ অবশেষে ১ ডিসেম্বর যুক্তি-যুদ্ধে হেরে গেল সিভিল রাইটস গ্রুপ। গ্যারির মৃত্যুদণ্ডের দিন ঠিক হল ৬ ডিসেম্বর।
কিন্তু নাটকের যবনিকা পতনের তখনও বাকি ছিল। রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন গ্যারির বৃদ্ধা মা, শ্রীমতী বেসি গিলমোর। সন্তানের প্রাণভিক্ষা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টও সঙ্গে সঙ্গে সম্মান জানাল এই আপিলকে। ৩ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করে বলল, ‘পূর্বোক্ত ৬ ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে না এবং আবার খতিয়ে বিচার করা হবে।’ ক্ষোভে, নৈরাশ্যে গ্যারি মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন, জেলের দেয়ালে কপাল ঠুকতে লাগলেন, অশ্রাব্য গালাগালি দিতে লাগলেন। সুপ্রিম কোর্টের জজদের হাতের কাছে পেলে হয়তো ভয়ঙ্কর কিছু করে বসতেন, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট পুনর্বিচার করে ১৪ ডিসেম্বর সেই স্থগিতাদেশ তুলে নিল, এবং প্রাণদণ্ডের দিন স্থির করল ১৭ জানুয়ারি। কিন্তু আরও এক মাস অপেক্ষা করতে রাজি হলেন না গ্যারি। মাঝখানে আবার কোনও অঘটন হলে তো মুশকিল! তাই আর্জি পেশ করলেন, পরের সপ্তাহেই তাঁর মৃত্যুদণ্ড হোক।
গ্যারির আশঙ্কা মিলে গেল। সিভিল রাইটস গ্রুপ এ বার আরও জোরদার আন্দোলন শুরু করল। দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, বিক্ষোভও তত ঘনীভূত হয়ে উঠতে লাগল। মৃত্যুদণ্ডের দু’দিন আগে উটা-তে এক বিরাট মিছিল স্তব্ধ করে দিল জনজীবন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে, গ্যারির মৃত্যুদণ্ডের ঠিক সাড়ে ছ’ঘণ্টা আগে, রাত দেড়টার সময় ফেডারাল জজ উইলিস রিটলার তড়িঘড়ি আবারও স্থগিতাদেশ জারি করলেন।
আশ্চর্য ব্যাপার, কিছু ক্ষণ পরেই সেই স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়া হল। ১৭ জানুয়ারি সকালেই গ্যারিকে তড়িঘড়ি ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল।
গ্যারির ইচ্ছে পূর্ণ হল। কিন্তু মরতে চাওয়া কি অপরাধ, না কি ব্যক্তি স্বাধীনতা?— এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy