স্বাধীন: ১৫ অগস্ট , ১৯৪৭। স্বাধীনতার আনন্দে মাতোয়ারা কলকাতার মানুষজন। যে স্বাধীনতা এসেছে অজস্র সংগ্রামী নায়কের প্রাণের বিনিময়। নিজস্ব চিত্র।
আজও জ্বলে স্মৃতিবাহী সন্ধ্যাপ্রদীপ
শহিদ ক্ষুদিরামের সেই ছোট্ট ঘরে। কোথায় সে ঘর?
পূর্ব মেদিনীপুরে রাজ্যের প্রাক্তন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দদের স্কুল, মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর বিদ্যাপীঠের সুখ্যাতি আছে। প্রথম এগারো-বারো ক্লাস চালু হলে সেখানে যাই পড়তে। এক দিন মন্ত্রীমশাইয়ের বাবা, জ্যোতির্ময় নন্দ, যিনি জ্ঞানী মানুষ হিসেবে সুপরিচিত, ছাত্রছাত্রীদের বললেন, “তোমাদের আরও কিছু জানার আগ্রহ থাকলে বাড়িতে আসতে পারো।”
গেলাম এক গ্রীষ্মের বিকেলে, একাই। বাড়ির সামনে একটি ছোট পাকা ঘর, লোহার গেটে তালা, যার ভিতর ঝুলছে একটি ফাঁসির দড়ি। প্রতীকী। তিনি জানালেন, এখানেই থাকতেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম! ১৯০৮ সালের জানুয়ারি মাসে দিন দশেক ছিলেন। সকালে যোগব্যায়াম, লাঠিখেলা, কুস্তি অনুশীলন করে চলে যেতেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন আখড়ায়। ষড়ঙ্গী পুকুরপাড় হয়ে ভূপতি নগর, এক্তারপুর, জুখিয়া, ইক্ষুপত্রিকা, বায়েন্দা। সেখানে তরুণদের যোগব্যায়াম, লাঠি খেলা, কুস্তি শেখানোর পর থাকত গীতাপাঠ, নির্বাচিত রবীন্দ্র-রচনা, স্বামী বিবেকানন্দ ও সখারাম গণেশ দেউস্করের বাণী ও লেখা থেকে পাঠ। ফিরতে দেরি হত। বাড়ির সবাই অপেক্ষা করতেন ক্ষুদিরাম ফিরে কখন খাবেন দুপুরের খাবার। এই ঘটনা ঘটেছিল জ্যোর্তিময় নন্দের দুই পুরুষ আগে দিগম্বর নন্দের সময়ে। দিগম্বর ছিলেন ক্ষুদিরামের সহযোগী। আখড়ার বিস্তার হয়েছিল আরও পূর্বে নিকুঞ্জবিহারী-আভা মাইতিদের বাড়ির কাছে কলাগেছিয়া, অন্য দিকে গোপীনাথপুর, ভগবানপুর হয়ে বিভীষণপুর। ধুতি-ফতুয়া পরা, পিছনে হাত, উন্নতশির সতেরো বছরের যুবক ক্ষুদিরাম তাঁর ভাষণে নরম গলায় অথচ দৃঢ় প্রত্যয়ে বলতেন, “মাকে যেমন আমরা ভালবাসি (নিজের মাকে হারিয়েছেন দু’বছর বয়সে) তেমনি দেশ-মা-কে ভালবাসতে হবে অন্তর দিয়ে। মা তথা দেশ-মা আক্রান্ত হলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে শত্রুপক্ষের ওপর একটুকুও দেরি না করে।”
আজও নন্দবাড়ির তুলসীমঞ্চের সঙ্গে ক্ষুদিরাম-কক্ষেও নিয়মিত জ্বালা হয় সন্ধ্যাপ্রদীপ। সে দিন যে উদ্দীপনা রেখে গেলেন অগ্নিকিশোর, তা ছড়িয়ে গেল অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য, লবণ আইন ভঙ্গ হয়ে বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো-তে ভগবানপুর থানা ভাঙার উন্মাদনা পর্যন্ত। ১৯০৮ সালেরই ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী মজফ্ফরপুরে দায়রা বিচারক, অত্যাচারী কিংসফোর্ড ভেবে ফিটন গাড়ি লক্ষ করে হেমচন্দ্র কানুনগোর তৈরি যে বোমার বিস্ফোরণ ঘটালেন, তাতে পরাধীন ভারত এক গভীর পুলক অনুভব করেছিল। ভয়ে যে কথা সে দিন কেউ লেখার সাহস দেখাননি, ২৬ মে তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকায় সে কথা লিখলেন: “ভারতের বুকে সর্বপ্রথম অগ্নিবর্ষী বোমার আবির্ভাবে যে প্রবল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিলেতের জনসাধারণের মধ্যে যে অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে তা বিগত ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর আর দেখা যায়নি।” ফল হয়েছিল লোকমান্য তিলকের ছ’বছর সশ্রম কারাদণ্ড, সুদূর মান্দালয় জেলে।
১১ অগস্ট ফাঁসি হয় ক্ষুদিরামের। ক্ষুদিরামের যখন ফাঁসি হয়, দাসপুরের গোকুলনগরে জন্মাননি মেদিনীপুরের জেলাশাসক ডগলাস হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যতম বিপ্লবী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য। তাঁদের বাড়িটা ছিল ক্ষুদিরামের দিদির বাড়ির কাছে। কিশোর প্রদ্যোৎ ঘন ঘন অপরূপা দেবীর বাড়ি গিয়ে বার বার শুনতে চাইতেন ক্ষুদিরামের জীবনী ও কার্যকলাপ। প্রদ্যোৎ যখন বিপ্লবী ভাবধারায় পুরোপুরি মগ্ন, তাঁর ও মামাবাড়ির সকলে স্বদেশি হতে বাধ্য হলেন। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম এমনই এক স্ফুলিঙ্গের নাম।
প্রয়োজন শক্ত নেতা, শক্তিশালী দল
বলেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ‘তরুণের স্বপ্ন’ গ্রন্থে লিখেছেন: “অনন্ত আশা, অসীম উৎসাহ, তেজ ও সাহস লইয়া আমরা আসিয়াছি। আমাদের জীবনস্রোত কেহ কখনো রোধ করিতে পারিবে না।” বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশী যখন মেছুয়াবাজার কেসে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি, তখন সুভাষচন্দ্রও একই জেলে। তত দিনে মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডি মার্চ শুরু হয়েছে, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের খবর এসেছে। আইন অমান্য আন্দোলনে কয়েদিতে জেল ভর্তি। রাতে তালা বন্ধ হয় না। কয়েদিরা ঘুরে বেড়ায়। বম্ব ওয়ার্ডের কথা আলাদা। সেখানে যে জনা কুড়ি বিপ্লবী আটক আছেন, তাঁরা নাকি সাংঘাতিক। তাঁদের জন্য সার্জেন্ট সেপাই সব আছে। সার্জেন্টকে ম্যানেজ করে সুভাষ যান তাঁদের কাছে। সকলে তাঁকে ঘিরে বসলে তিনি বললেন: “স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট ডিসিপ্লিন ও সংগঠন— এই তিনটি হবে ভবিষ্যতের কার্যধারা।” বলতেন ভারতের মতো বৈষম্যপূর্ণ দেশে মুসোলিনির মতো শক্ত নেতা ও শক্তিশালী দল তৈরি না হলে চলবে না। এক দিন সতীশ পাকড়াশীদের চুপি চুপি আড়ালে ডেকে বললেন— “কিছু অস্ত্রের সন্ধান দিতে পারেন? তা হলে বাইরে খবর দিয়ে কিছু কাজ করানো যেতে পারে। গান্ধীজির অহিংস পথে কিছুই হবে না।” উৎফুল্ল হয়েছিলেন বম্ব ওয়ার্ডের বিপ্লবীরা।
হিজলি বন্দি শিবিরে পুলিশের গুলিতে সন্তোষ মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্ত নিহত হলে সেখানেও ছুটে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। বিপ্লবীদের দেহ দেবে না কর্তৃপক্ষ, কিন্তু নাছোড়বান্দা তিনি। ময়নাতদন্তের পর মৃতদেহ কলকাতায় আনলে রাস্তায় আছড়ে পড়ে জনজোয়ার। যেখানেই সুভাষ, সেখানেই জনস্রোত। হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণেও জনপ্লাবন। জেলে অনশন শুরু করলে জেলকর্মীরাও যোগ দেন তাতে।
প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন নির্জন একক পথের যাত্রী। অতলান্ত তাঁর আত্মবিশ্বাস। কবে এক বার দেখা হয়েছিল মহেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে, যাঁর আফগানিস্তানে যথেষ্ট বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতি। তাতেই তাঁর অটুট বিশ্বাস জন্মায় যে, তাঁর সাহায্য নিয়েই তিনি আফগানিস্তান দিয়ে রাশিয়া পৌঁছে তার পর যাবেন ব্রিটিশদের শত্রু দেশ জার্মানিতে। তাই তাঁর মহানিষ্ক্রমণের পথে যাত্রা। তাঁর ঐতিহাসিক বিমান দুর্ঘটনা আজ আশি বছরে পড়ল।
‘স্বদেশকে মা বলিয়া জানি’
স্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। ষাটের দশকে কৃষক আন্দোলনের নেতা আজিজুল হক প্রেসিডেন্সি জেলে ‘অরবিন্দ সেল’ দেখে বলেন, “এরকম ঘুপচি ঘরে কাউকে দিনের পর দিন আটকে রাখলে তাঁর মনে হ্যালুসিনেশন এমনিতেই এসে যায়। শ্রীঅরবিন্দের বাসুদেব দর্শন হ্যালুসিনেশন ছাড়া কিছু নয়।” তাঁকে এক বার ২৩ নং ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে। তিনি নিজের এবং সতীর্থদের বইপত্র নিয়ে এক কোণে একটি ছোট্ট লাইব্রেরির মতো করে ফেললেন। বই পড়া, যোগব্যায়াম, ধ্যান ইত্যাদিতে তাঁর এত মনোযোগ দেখে বাকি বন্দিরা বিস্মিত হতেন।
বিলেত-ফেরত ডাক্তার বাবা কৃষ্ণধন ঘোষ ছেলেকে দার্জিলিং কনভেন্ট স্কুলে পড়িয়ে সরাসরি ইংল্যান্ডের এক ধর্মযাজকের হাতে সঁপে দিলেন, যাতে ছেলে ভারতীয় সংস্কৃতির ছোঁয়াও না পায়। বাবা চাইতেন, ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান অরবিন্দ যেন পুরোপুরি ইংলিশম্যান হয়ে ওঠে। অরবিন্দ কিন্তু আইসিএস পাশ করেও ইংরেজদের গোলামি করতে চাননি। বরোদা মহারাজের চাকরি করার সময়ই বাংলাটা শিখে নিয়েছিলেন চমৎকার। বরোদাতেই ভগিনী নিবেদিতা তাঁর হাতে তুলে দেন স্বামী বিবেকানন্দের ‘রাজযোগ’ বইটি। সেই স্বামীজির প্রতি গভীর আগ্রহের সূত্রপাত।
১৯০১ সালেই অরবিন্দ গোপনে যোগাযোগ করলেন গুপ্ত সমিতিগুলোর সঙ্গে। ১৯০২ সালে বাংলাদেশ গিয়ে তিনি লক্ষ করেন যে, ছোট ছোট বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনকে সফল করতে ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র ও ভগিনী নিবেদিতা-সহ পাঁচ জনের একটি কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠন করেন। দেশমাতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট হয় স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠিতে— “অন্য লোকে স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ, কতকগুলো মাঠ ক্ষেত বন উপবন পাহাড় নদী বলিয়া জানে, আমি স্বদেশেকে মা বলিয়া জানি। ভক্তি করি পূজা করি। সে-ই মা-র বুকের ওপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত হয় তাহা হইলে সে কী করে? নিশ্চিতভাবে আহার করিতে বসে, স্ত্রী পুত্রের সহিত আমোদ করে, না মাকে উদ্ধার করিতে দৌড়াইয়া যায়?”
মজফ্ফরপুরে বোমা বিস্ফোরণের জেরে অরবিন্দ গ্রেফতার হন এবং প্রেসিডেন্সি জেল খাটেন এক বছর। জেল থেকে বেরিয়ে দেশের পুনরুজ্জীবনের তাগিদে জাতীয়তার ভাবধারা দেশময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এক সঙ্গে ইংরেজিতে ‘কর্মযোগিন’ ও বাংলায় ‘ধর্ম’ প্রকাশ করে চলেন। পণ্ডিচেরিতে বসবাস করার তিন-চার বছর পর্যন্ত বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শ্রীঅরবিন্দের। ইংরেজ সরকারের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে চন্দননগরে তাঁর আশ্রয়দাতা মোতিলাল রায় ছদ্মবেশে পন্ডিচেরি পৌঁছে দেখেন, শ্রীঅরবিন্দ চা খাচ্ছেন সামান্য মটরভাজা দিয়ে, থাকছেন ছোট্ট কুটিরে, শয়ন করছেন মাটিতে, খড়ের বিছানায়। চরম আর্থিক দৈন্য, সঙ্গে ইংরেজ গোয়েন্দাদের ভয়। ছিল প্রলোভনও, বাংলায় ফিরে যেতে চাইলে শ্রীঅরবিন্দকে রাখা হবে দার্জিলিঙের মনোমুগ্ধকর বাংলোয়। বাইরে যেতে চাইলে আলজিরিয়ায় থাকতে পারবেন স্বাধীন ভাবে। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে ফরাসি সরকারের উপর চাপ এল তাঁকে বহিষ্কারের। সৌভাগ্যক্রমে কয়েক জন স্থানীয় সজ্জন ব্যক্তি ‘গুড কনডাক্ট সার্টিফিকেট’ দিয়ে রুখে দিলেন সেই অপচেষ্টা। অনাড়ম্বর এবং আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করতে করতে অবশেষে ১৯২৬ সালের ২৪ নভেম্বর সিদ্ধি লাভ করেন শ্রীঅরবিন্দ।
তিনি কবিতা রচনা করেছেন আজীবন, কিন্তু শ্রীঅরবিন্দ রচিত ‘সাবিত্রী’ কাব্যটি অতুলনীয়। অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ২৩,৮০০ লাইনের ‘সাবিত্রী’ মহাভারতের উপকাহিনি। এখানে সূর্যপুত্রী সাবিত্রী ধরায় এসেছেন সত্যবানরূপী আত্মাকে মৃত্যু ও অজ্ঞানতার হাত থেকে বাঁচাতে।
মাথার দাম এক লক্ষ পঁচিশ হাজার
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। রাসবিহারী বসুর তখন গ্রামের বাড়ি বর্ধমানের সুবলদহ ছেড়ে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের পড়াও সমাপ্ত। গ্রামে থাকতেই বিপ্লবী মহড়া শুরু। মাটির ইংরেজ মূর্তি গড়ে লাঠি খেলায় কায়দায় তাকে ভেঙে ফেলাই ছিল তাঁর অনুশীলন। নদিয়ার মুড়াগাছার সাহসী যুবক বসন্ত বিশ্বাসকে শেখাতে থাকেন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড।
এ দিকে ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ শোভাযাত্রায় বেরিয়েছেন, দেশীয় রাজারাও আছেন সৈন্যসামন্ত-সহ। যখন চাঁদনি চকে শোভাযাত্রা, তিন তলা পিএনবির-ছাদ থেকে মহিলাদের ভিড়ে লুকিয়ে বসন্ত বিশ্বাস বোমা ছুড়লেন হাতির মাথায়। ভয়ানক জখম হলেন বড়লাট। বসন্তর সঙ্গে ছিলেন রাসবিহারী। গা ঢাকা দিলেন দু’জনেই। কিছু দিন পরে জখম বড়লাটকে নিয়ে রাখা হল দেহরাদূনের সার্কিট হাউসে। অপারেশন করে একটি করে বোমার টুকরো বার করা হচ্ছে দেহ থেকে। বড়লাটের সঙ্গে এসেছেন জাঁদরেল গোয়েন্দা অফিসার সুশীল ঘোষ। রাসবিহারী কর্মচারীদের ডেকে এক সভার আয়োজন করে নিজেই সুশীল ঘোষকে শুনিয়ে শুনিয়ে বক্তব্য রাখলেন: “যে বা যারা বড়লাটের ওপর আঘাত হেনেছে তাদের গ্রেফতার করে কঠোর সাজা দেওয়া উচিত।” সুশীল ঘোষের ধারণা হল, এ তো এক জন রাজভক্ত কর্মচারী! তিনি বন দফতরে প্রভাব খাটিয়ে ছ’মাসের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে দিলেন রাসবিহারী বসুর জন্য। যাতে রাসবিহারী কলকাতার বাঙালি বিপ্লবীদের সুশীল ঘোষের হাতে তুলে দেন।
কলকাতায় থেকে রাসবিহারী সমস্ত বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে নিলেন, আর বিনিময়ে সুশীল ঘোষকে দিতে লাগলেন বিপ্লবীদের সম্পর্কে ভুয়ো তথ্য। কারও নাগাল পেলেন না গোয়েন্দা অফিসার। সতীশ পাকড়াশী, প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ যে সব বিপ্লবী তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে স্বীকার করেছেন, রাসবিহারী বসুর মতো বলিষ্ঠ, উদ্যমী, নির্ভীক ও উদ্যোগী পুরুষ তাঁরা আর কখনও দেখেননি।
চন্দননগর ও রাজাবাজারে তৈরি বোমা তিনি নিয়ে যান যুক্তপ্রদেশে। ১৯১৩ সালের ১৭ মে বসন্ত বিশ্বাসকে দিয়ে লাহোরের লরেঞ্জ গার্ডেনে আইসিএস গর্ডন সাহেবকে হত্যার জন্য বোমা নিক্ষেপ করান। বসন্ত বিশ্বাস ধরা পড়লেও রাসবিহারী মেথর সেজে মাথায় বিষ্ঠার গামলা নিয়ে সকলের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাসবিহারী বসুর মাথার দাম এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা— ঘোষণা করে ইংরেজ সরকার।
বহু জায়গায় আত্মগোপন করে ছিলেন। বৈষ্ণব সেজে কিছু দিন ছিলেন নবদ্বীপের মদনমোহন মন্দিরে। সেখানে থাকাকালীন খবর পেলেন, রবীন্দ্রনাথ যাবেন জাপান। অতি তৎপরতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় প্রিয়নাথ ঠাকুর সেজে, দুরূহ পদ্ধতি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে, খিদিরপুর ডক থেকে জাহাজে উঠলেন। জাপানে পৌঁছে তিনি আশ্রয় পান জাপানি প্রধানমন্ত্রী তোজোর বিরুদ্ধ পার্টির নেতা মিতসুরু তোয়ামা ও তসুয়োশি ইনুকাইর কাছে। পরে আশ্রয় পান ধনী বেকারি ব্যবসায়ী সোমা পরিবারের কাছে। তাঁদের মেয়ে তশিকোর সঙ্গে রাসবিহারীর বিবাহ হয়। জাপানের ভারতীয় বন্দিদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়েন রাসবিহারী, যা তিনি পরে নেতাজি সুভাষের হাতে তুলে দেন।
অস্ত্র লুণ্ঠনের বিস্মৃত নায়ক
২৬ অগস্ট, ১৯১৪। রডা কোম্পানির অস্ত্র লুণ্ঠন দিবস। সশস্ত্র বিপ্লবের যুগে সারা ভারতে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। সশস্ত্র বিপ্লব চালু রাখতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রয়োজন, অথচ অস্ত্র কেনা ও রাখা আইনবিরুদ্ধ। তাই বার বার ঘটেছে অর্থ ও অস্ত্র লুণ্ঠন। সেই প্রথম বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়ের উপর ভার পড়েছে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র সংগ্রহের।
বার্মিংহামের অস্ত্র-ব্যবসায়ী আর বি রডার একটি বন্দুক বিক্রির কেন্দ্র ছিল কলকাতার ওয়েলেসলি প্লেসে। গুদামঘর পাশেই ভ্যান্সিটার্ট রোডে। ‘আত্মোন্নতি সমিতি’র নেতা বিপিনবিহারীর কাছে খবর ছিল, হাওড়ার রসপুরের তরুণ শ্রীশ মিত্র, যাকে হাবু মিত্র বলে সকলে ডাকে, সে আত্মনিয়োগ করতে চায় দেশমাতৃকার সেবায়। বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় তাকে নিয়ে দেখা করলেন রডা কোম্পানিতে। যে কোনও একটা কাজ দিলেও তার সংসারটা বেঁচে যায়। অনেকের চেষ্টায় অবশেষে জেটি ক্লিয়ারিং ক্লার্কের চাকরি পেলেন শ্রীশ মিত্র। চল্লিশ বার অর্ডার দেওয়া নেওয়ার পর বিশ্বস্ত হলেন রডা কোম্পানির ম্যানেজার এফ বি প্রাইকের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দোরগোড়ায় পররাষ্ট্র সচিব ম্যাকমোহনের পরামর্শ মতো ব্রিটিশ সরকার রডা কোম্পানিকে অর্ডার দিল ৫০টি মাউজ়ার পিস্তল ও ছেচল্লিশ হাজার কার্তুজ কেনার। দুই জার্মান ভাই পিটার পল মাউজ়ার এবং উইলহেল্ম মাউজ়ার দ্বারা নির্মিত বলে এই নাম। এই পিস্তলের বৈশিষ্ট্য প্রয়োজনে একে রাইফেলে সেট করা যায়। বহু দিন চুপচাপ লক্ষ রাখার পর ক্লিয়ারিং ক্লার্ক শ্রীশ মিত্র মলঙ্গা লেনে গিয়ে বিপ্লবী অনুকূল মুখোপাধ্যায়কে খবর দিয়ে এলেন: ‘ট্যাকটিশিয়ান’ জাহাজ থেকে সব অস্ত্রশস্ত্র নেমে গেছে, পুরো কনসাইনমেন্ট ২৬ অগস্ট কাস্টম হাউস (এখন যেখানে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক) থেকে খালাস করে গুদামে নিয়ে যাওয়া হবে। চূড়ান্ত আলোচনায় বাংলার প্রায় সব বিপ্লবী সঙ্ঘ থাকলেও মূল কারিগর দু’জন: ঢাকার মুক্তি সঙ্ঘের শ্রীশ পাল এবং আত্মোন্নতি সমিতির শ্রীশ মিত্র। সঙ্গে থাকবেন অনুকূল মুখোপাধ্যায়, হরিদাস দত্ত, খগেন দাস, প্রভুদয়াল হিম্মত সিংহ প্রমুখ।
১৯১৪ সালের ২৬ অগস্ট, ক্লিয়ারিং ক্লার্ক শ্রীশ মিত্র কাস্টমস অফিসার বার্নেট সাহেবের কাছে মোট ২০২টি প্যাকেট বুঝে নেওয়ার সময় দেখে নিলেন কোন প্যাকেটে কী আছে। ছ’টি মোষের গাড়িতে উঠল অস্ত্রশস্ত্র আর পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজেদের ভাড়া করা সপ্তমটিতে আকাঙ্ক্ষিত ৫০টি মাউজ়ার পিস্তল ও ৪৬,০০০ কার্তুজ। গোটা পথ গাড়োয়ান হয়ে এগিয়ে নিয়ে গেলেন শ্রীশ মিত্র, কুলি সাজলেন হরিদাস দত্ত। বিতরণ হল পরের দিন।
কে পাননি মাউজ়ার পিস্তল! ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ ওড়িশার বুড়িবালামের তীরে টেগার্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঘা যতীন ও তাঁর সঙ্গীদের খণ্ডযুদ্ধ, কাকোরি ট্রেন ডাকাতি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন— সবেতে ব্যবহার হল এই মাউজ়ার পিস্তল। ভগৎ সিংহ, রাসবিহারী বসু, বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়রা রাখলেন একটি করে। এই অস্ত্র লুঠের ঘটনাকে স্টেটসম্যান পত্রিকা বলেছিল ‘দ্য গ্রেটেস্ট ডে-লাইট রবারি’। ঘটনার পরের তিন বছরে বেশির ভাগ বিপ্লবী ধরা পড়লেও ধরা যায়নি মূল নায়ক শ্রীশ মিত্রকে। কলকাতায় যখন ধরপাকড় চলছিল, শ্রীশ পাল রংপুরে তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে শ্রীশ মিত্রকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। পুলিশ খোঁজ পেলে শ্রীশ মিত্র পালিয়ে যান তিব্বতের দিকে। আর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাই আজও ঠিকমতো লেখা সম্ভব হয়নি রডা কোম্পানির অস্ত্র লুণ্ঠনের ইতিহাস, যেমন লেখা হয়েছে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে।
গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের স্মৃতিসৌধে মূর্তি আছে বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়, অনুকূল মুখোপাধ্যায়, গিরীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি হাবু মিত্রকে গড়ে তুলেছেন) এবং হরিদাস দত্তর। কিন্তু কোথাও নেই শ্রীশ মিত্রের মূর্তি। মহাজাতি সদনে সব বিপ্লবীর ছবি থাকলেও শ্রীশ মিত্রের নেই। গণস্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছেন এত বড় কাণ্ডের নায়ক!
যুগান্তর দলের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক
যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের জন্ম তমলুকে। বিখ্যাত উকিল এবং সঙ্গীতজ্ঞ বাবা কিশোরীলাল তমলুকে আসেন রূপনারায়ণ নদীর তীরে শরীর ভাল থাকবে বলে। যাদুগোপালের অন্যান্য ভাই মাখনগোপাল, ক্ষীরোদগোপাল, ধনগোপাল— সবাই স্বনামধন্য। ধনগোপাল ছিলেন আমেরিকার প্রথম স্বীকৃত বাঙালি শিশুসাহিত্যিক। তমলুকের বাড়িতে বাবা পাকা লাঠিয়াল রেখে ছেলেদের লাঠি ও তলোয়ার খেলা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। বাবা-মায়ের উদারনৈতিক শিক্ষার আবহেই বেড়ে উঠেছিলেন ভাইবোনেরা।
তখন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আফ্রিদি জাতির সঙ্গে চলছিল ভারত সরকারের লড়াই। খেলার মাঠে যাদুগোপালরা হতেন আফ্রিদি, আর পালিতের ছেলেরা ইংরেজ। দু’দলের নকল যুদ্ধ হত। এই দেখে বাবার বন্ধু নগেনবাবু হাসিমুখে সকলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলতেন, “বেশ খেলা বার করেছ। মা বর্গভীমার কাছে প্রার্থনা করি, যেন তোমরা বাঙালির ভীরু অপবাদটা দূর করতে পারো। তোমাদের ভিতর দিয়ে যেন নতুন বাঙালি গড়ে ওঠে।”
তাঁর বাড়িতে আলোচনা হত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট ভাই জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যেপাধ্যায়ের বীরত্ব নিয়ে। তাঁকে বলা হত দ্বিতীয় নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। বিলেতে থাকাকালীন শ্বেতাঙ্গরা যখন তাঁকে ‘কালা আদমি’ বলে বিদ্রুপ করত, জিতেন্দ্রনাথ তাদের ঘুসি মেরে ধরাশায়ী করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতেন। যাদুগোপালদের বাবা কাবুলিওয়ালাদের স্বাধীনতাস্পৃহা পছন্দ করতেন। ইংরেজ কাবুল জয় করেছে, কিন্তু কাবুলিওয়ালাদের দমন করতে পারেনি। সন্তানদের শোনাতেন তাদের আত্মসম্মানের গল্প। এক বার তিনি একটি বাচ্চা কুমির পোষার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে কিছুই খেল না, কয়েক দিন পর মারা গেল। ছেলেমেয়েদের বলতেন, এর নাম স্বাধীনতার স্পৃহা। মরে গেল, তবু পরাধীন জীবন স্বীকার করল না। বলতেন, পরের জন্য যারা মরতে পারে তারাই প্রকৃত বাঁচে।
তমলুকে ক্ষুদিরাম আসার আগে যাদুগোপাল হ্যামিল্টন স্কুল ছেড়ে কলকাতার ডাফ কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। গান্ধীজি তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। সেই উপলক্ষে যাদুগোপালরা চাঁদা তুলে পাঠিয়েছেন। ডাফ স্কুল ও কলেজ ছাত্রদের নিয়ে গড়েছেন ‘সুহৃদ সমাজ’। ‘যুগান্তর’ পত্রিকা বিপন্ন হলে, বার্ন কোম্পানিতে ধর্মঘট হলে, আতুর ও দরিদ্রের সেবায় সুহৃদ সমাজ অর্থ সাহায্য করেছে। ১৯১৫ সালে ভর্তি হন মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার জন্য ঠিকমতো ক্লাস করতে পারেননি। পরবর্তী কালে ১৯২২ সালে আবার সুযোগ পেয়ে পরীক্ষা দেন এবং সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ডাক্তারি পাশ করেন।
যাদুগোপাল অনুশীলন সমিতির সদস্য হন ১৯০৬ সালেই, ছাত্রাবস্থায়। আড্ডাখানা ছিল বৌবাজারের চেরি প্রেস। যেখানে সুভাষচন্দ্রকে বলতেন, বিপ্লব চতুরঙ্গ বা চার শক্তির সমন্বয়। ছাত্র বা যুব জাগরণ এবং শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্য দলের ভূমিকা গ্রহণ। যাদুগোপালের পছন্দের কাগজ ছিল ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সন্ধ্যা দৈনিক’, কারণ চলতি বাক্যের প্রয়োগ: ‘লে মাটি দে চাপা’, ‘সুশীলের তুড়ি লাফ’, ‘ফিরিঙ্গিকে বলায় বাপ’, ‘ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মারে’, ‘লাঠি খটাখট বম ফটাফট’ ইত্যাদি। অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই হুড়োহুড়ি করত ‘সন্ধ্যা’ পড়ার জন্য। আর ‘যুগান্তর’-এর ভাষা ও ভাবনা ছিল উঁচু মার্গের।
বাঘা যতীনের ডান হাত যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়কে বলা হত যুগান্তর পার্টির মস্তিষ্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঘা যতীনের নেতৃত্বে ভারতে জার্মান অস্ত্রশস্ত্রে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামের পরিকল্পনা করা হলে যাদুগোপাল ছিলেন বৈদেশিক দফতরের ভারপ্রাপ্ত নেতা। বুড়িবালামের তীরে খণ্ডযুদ্ধে বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর তিনিই পান যুগান্তর দলের নেতৃত্ব। তাঁকে গ্রেফতারের জন্য সরকার ঘোষণা করে দশ হাজার টাকা পুরস্কার। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি গ্রেফতার হন। প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেল হয়ে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে যান। এই জেল থেকে তিনি রাজবন্দিদের ডাক্তার হয়ে যান। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে সূর্য সেন, নরেন সেনরা নানা পরামর্শ নেন। ১৯২৭ সালে মুক্তি পেয়ে তাঁকে বাংলা ছাড়তে হয়। তিনি রাঁচীতে বাস করেন এবং চিকিৎসার কাজ চালিয়ে যান। বিয়াল্লিশের অগস্ট বিপ্লবে আবার গ্রেফতার হয়ে যান হাজারীবাগ জেলে। দেখা হয় রাজেন্দ্রপ্রসাদ, জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রমুখের সঙ্গে। সেখানে তাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক কথাবার্তা যেমন হত, তেমনি চলত যাদুগোপালের চিকিৎসার কাজও।
অহিংসা ও সত্যের আদর্শে উজ্জ্বল
ছোটবেলায় বিদ্যাসাগরকে বলা হত ‘এঁড়ে বাছুর’, বড় বয়সে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে লোকে বলত ‘কালো ষাঁড়’। দু’জনেই ছিলেন মেদিনীপুর জেলার দৃঢ়চেতা মানুষ। টালিগঞ্জ মোড়ে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের যে ক্ষুদ্রকায় আবক্ষ মূর্তিটি রয়েছে, সেখান থেকেই শুরু দেশপ্রাণ শাসমল রোড, শেষ টালিগঞ্জ রেল ব্রিজ। বাঙালিদের মধ্যে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে মৃত্যুর পর দাহ করা হয়েছিল দাঁড়ানো অবস্থায়। ইচ্ছাপত্রে তিনি তা-ই লিখে রেখেছিলেন। ভারত পরাধীন হলেও কখনও কারও কাছে নতি স্বীকার করেননি। তার জন্য তাঁকে হারাতে হয়েছে অনেক কিছু।
কাঁথির চণ্ডীভেটি গ্রামের ছেলে বীরেন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হওয়ার বছরেই বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে আসেন। যোগ দেন আন্দোলনে। পরের বছর আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন কলকাতা হাই কোর্টে, পরে যান মেদিনীপুর কোর্টে। গুজরাতের বারদৌলিতে সর্দার বল্লভভাই পটেল কৃষকদের ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলন শুরুর আগেই বীরেন্দ্রনাথ মেদিনীপুর জেলায় শুরু করেন চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধের আন্দোলন। ১৯২১ সালে সরকার কাঁথি, তমলুক, ঘাটাল অঞ্চলে মোট ২২৭টি ইউনিয়ন বোর্ড গঠন করে, যার মূল উদ্দেশ্য উন্নয়নের নামে ৫০ শতাংশ ট্যাক্স বাড়িয়ে চৌকিদারের বেতন সংগ্রহ। এর বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে বীরেন্দ্রনাথের একক প্রচেষ্টায় সরকারকে বাতিল করতে হয় সব ক’টি ইউনিয়ন বোর্ড। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত অহিংস থাকেনি, কিন্তু লোকাল বোর্ড ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলন বরাবর থেকেছে অহিংস।
এই ঘটনার আগে এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর সরকার চেয়েছিল বিপ্লবী আন্দোলনের আঁতুড়ঘর মেদিনীপুর জেলাকে ভাগ করতে। কিন্তু প্রবল জনমত গড়ে তিনি একাই রুখে দেন জেলা ভাগ। ১৯১৩ সালে দুবদা এলাকায় হয় প্রবল বন্যা। বীরেন্দ্রনাথ যুবকদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আর্তের সেবায়। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি ও আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে জেল খাটেন আট মাস। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু গড়েন স্বরাজ্য দল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও হেমন্তকুমার সরকারের মতে, সেই দলে দেশবন্ধুর পরই দেশপ্রাণের অবদান। ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশন ভোটের ফলাফলে দেশবন্ধু হন মেয়র, দেশপ্রাণকে দেশবন্ধু কথা দিয়েছিলেন চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার করবেন, কিন্তু কথা রাখতে পারেননি। কারণটা স্বরাজ্য দলে দলাদলির ভোট। দলাদলি বাড়াতে গভর্নর বীরেন্দ্রনাথকে বাংলা সরকারের মন্ত্রী হতে প্রস্তাব দেন, বেতন পাবেন বার্ষিক ৬৪,০০০ টাকা। তিনি প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। পদত্যাগ করায় ডায়মন্ড হারবারের আইনসভার পদটি খালি হয়। তখন সেখানকার উপনির্বাচনে দাঁড় করান হয় সতীশ চক্রবর্তীকে। কিন্তু তাঁর সভায় লোকজন আসছে না দেখে বীরেন্দ্রনাথকে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেন, সতীশ চক্রবর্তীর পরাজয়ই হবে তাঁর পরাজয়। দেশবন্ধুর সম্মান রাখতে দেশপ্রাণ বহু সভা করে জিতিয়ে দিলেন সতীশ চক্রবর্তীকে। পরে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের ২৭ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ভোটে জিতে প্রথম বার মুসলিম সদস্য ফজলুল হককে মেয়র হতে সাহায্য করেন।
আর্থিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে ধৃত বিপ্লবীদের পক্ষে এবং মেদিনীপুর অত্যাচারী জেলাশাসক ডগলাস হত্যাকাণ্ডে জড়িত বিপ্লবী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যের হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে মামলা লড়েছেন। কংগ্রেস দলে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের পছন্দ করেননি কখনও, কারণ বরাবর তিনি ছিলেন অহিংস ও সত্যের পূজারি। তার ফলে সারা জীবন পাওয়ার তুলনায়, তাঁকে হারাতে হয়েছে অনেক বেশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy