Advertisement
E-Paper

প্রকৃতির নানা শক্তিই যেখানে কালীর রূপ

সন্ধ্যার জন্ম পাগলাচণ্ডী গ্রামে। আজ তাঁর আশির উপর বয়স। তিনি শোনালেন এই নদীর আখ্যান। শিয়ালদহ থেকে যে রেলপথ বহরমপুরের দিকে যায়, সেই পথেই পাগলাচণ্ডী স্টেশন।

রক্ষা কালী প্রতিমা।

রক্ষা কালী প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র।

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৫:৪৩
Share
Save

দীপান্বিতা অমাবস্যার রাত দখল করে ছিলেন মা কালী। এ বার তাঁরও ফেরার পালা। বাড়িতে বাড়িতে প্রদীপ জ্বলেছে। শুধু সেই মেয়েটির বাড়ি অন্ধকার। আলো জ্বালাতে অনেক মানুষ বহু দিন ধরে রাজপথে। এখনও অনেকের মন ভাল নেই। তবু তাঁরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছে, অন্ধকার ঘুচে গিয়ে যেন আলো আসে। এমনই আশা নিয়ে নদীর বুকে প্রদীপ ভাসিয়েছিল সন্ধ্যা। সন্ধেবেলায় কালো মেয়ে জন্মেছিল, তাই সে মেয়েকে সবাই ডাকত কালী বলে। কালীর মা কিন্তু তাকে কোনও দিন কালী বলে ডাকেনি। ভালবেসে তাকে ‘সন্ধ্যা’ বলে ডাকত।

সন্ধ্যার জন্ম পাগলাচণ্ডী গ্রামে। আজ তাঁর আশির উপর বয়স। তিনি শোনালেন এই নদীর আখ্যান। শিয়ালদহ থেকে যে রেলপথ বহরমপুরের দিকে যায়, সেই পথেই পাগলাচণ্ডী স্টেশন। স্টেশনে নেমে একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় একটা নদীর ধারে। নদীর নাম পাগলাচণ্ডী, সেই নদীর পাশেই পাগলাচণ্ডী মন্দির। পাগলাচণ্ডী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী তিনি, পূজিত হল কালী রূপে।

আগে এখনকার মতো এত মানুষ এই গ্রামে ছিল না। হাতে গোনা গোটা দশেক পরিবার থাকত। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত নদী। প্রবল বর্ষাতেও নদীর কাছে প্রার্থনা করলে পাড়ে ভাঙন হত না। নদীর জল গ্রামে ঢুকত না। গ্রাম ভেসে যেত না নদীর জলে। কিংবদন্তি বলছে, কারও বাড়ি বিয়ে লাগলে নদীর পাড়ে গিয়ে সন্ধেবেলায় পান-সুপুরি দিয়ে নদীকে নিমন্ত্রণ করে আসতে হত। দরিদ্র মানুষ বলে আসতেন, বিয়ের অনুষ্ঠান করতে কী কী বাসনপত্র লাগবে। পরের দিন সকালে নদীর ঘাটে গেলে দেখা যেত, সব বাসনপত্র নদীর পাড়ে রাখা আছে। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে সেই সব বাসনপত্র আবার নদীতে ভাসিয়ে দিতে হত।

এক বার এক মাঘ মাসে এক অসাধু লোকের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের আগের দিন তার স্ত্রী নদীকে নিমন্ত্রণ করে পাঁচটা থালা, একটা সোনার বাটি আর চারটে গামলা চায়। পরের দিন সকালে এসে সেই লোকটির স্ত্রী ঘাট থেকে সমস্ত বাসনপত্র নিয়ে বাড়ি ফেরে। বিয়ের মিটে গেলে সব বাসন ফেরত দিয়ে দিলেও, অসাধু লোকটি সোনার বাটিটা ফেরত দেয় না নদীকে। তাতে নদী খুব রুষ্ট হয়।

আর সে দিনের পর থেকেই নদীতে বাসন ভেসে আসা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যায় হয়েছে বুঝতে পেরে গ্রামবাসী সকলে মিলে ক্ষমা প্রার্থনা করে নদীর কাছে। কিছু দিন পর গ্রামের সবাই দেখে, নদীর ধারে একটি কালো পাথরের চণ্ডীমূর্তি খড়্গ হাতে মাটি ভেদ করে উঠেছে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, দেবী চণ্ডী নদীরূপে এখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছেন। কাজেই গ্রামের মানুষের কাছে এই নদী পরিচিত পাগলাচণ্ডী নদী নামে। লোকবিশ্বাস, নদীতে স্নান করে মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়ে মনোবাসনা জানালে, তা নাকি পূর্ণ হয়। এখনও এলাকার পুরনো মানুষজন কালীপুজোর দিন পাগলাচণ্ডী নদীর জল নিয়ে ঘট স্থাপন করে মা কালী রূপে নদীকে পুজো করে। এক সময় এই নদী ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে জলঙ্গী নদীতে মিশত। ১৮০০ সালের প্রথম ভাগে ভাগীরথী পূর্ব দিকে সরে যাওয়ায় ভাগীরথী থেকে উৎসমুখ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এই নদীর। তার পর থেকে নদীটার কিছুটা অংশ এখনও রয়েছে। মরা নদীর খাতও এখানে গভীর।

সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় ছেলে, পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক দীন মহম্মদ। নদিয়ার নাকাশিপাড়াতে আরও এক নদীর কাছে তিনি নিয়ে গেলেন। লোকমুখে শোনা যায়, এই নদী কৃষ্ণচন্দ্র কাটিয়েছিলেন, তবে কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। নদীটার নাম কলমাচণ্ডী বা কলমা। অনেকগুলো খাল এসে এই নদীর বুকে জল ঢেলে দেয়। এই খালগুলোর মধ্যে রূপের খাল, সুরীর খাল, আজিলা খাল ছিল উল্লেখযোগ্য। শোনা যায়, ধাপাড়িয়া গ্রামের জমিদার প্রাণকৃষ্ণ সরকারের জামাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতাতেই অষ্টাদশ শতকে শুরু হয়েছিল কলমা নদীতে নৌকা বাইচ। নৌকা বাইচের নির্দিষ্ট সময় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। এখনও অনেকে নৌকা বাইচের আগে এই নদীকে পুজো করে চণ্ডী বা মা কালী হিসেবে। প্রার্থনা জানায়, নদীরূপী কালী বা চণ্ডী যেন বাইচের সময় নৌকাকে রক্ষা করে। সেই কারণেই এই পুজো। এক সময় নৌকা বাইচকে কেন্দ্রে করে সারি গান তৈরি করতেন স্থানীয় মানুষেরা। গ্রামে তাঁদের বলা হত ‘বয়াতি’ বা ‘বয়াদার’। যতীন গায়েন, হুজুর সেখ এঁরা এক সময় ছিলেন খুব নামী বয়াদার। এঁদের জায়গা নিয়েছেন রেজাউল করিম, আজাহার সেখ, কিয়ামত দফাদাররা। বৈঠা ওঠানামার তালে তালে গাওয়া হয় এই গান। আজাহার সেখের বাড়ি গিয়ে শুনেছিলাম সারি গান— “এলাম দশের চরণ তলে ভাইগ্যবলে। আর দশ জনায় যা মনে করে/ ও বাবা কটা কে তাই করতে পারে/ ও ধরে এক জনাকে দিতে পারে জেলে/ আর দশে দুয়া কৈরবে বসে/ ও আমার ডুবা তরী কলমাচণ্ডীতে উইঠবে ভেসে/ ও আলিব টাইনবে বসে আল্লা রসুল বলে/ আর হিরিংস (হিংস্র) এক বাদশা ছিল/ ও সে মৌত ভয়ে পালিয়ে গেল/ ও সে জিন্দা নিল মনি জনার কোলে/ভাইগ্য বলে।”

শুধু নদী নয়, গাছকেও কালী হিসেবে পুজো করার রীতি রয়েছে নদিয়াতেই। এক সময় কলমা নদীর তীরেই বাস করতেন খগেন ঘোষ। বয়স এখন তাঁর পঁচাশি বছর। “রোগবালাই একটু থাকলেও কাবু করতে পারেনি খগাকে!” এমন ভাবেই আদরের পরশে বলে ওঠে তাঁর নাতি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অমিত। খগেন থাকেন নদিয়ার বিলকুমারী পঞ্চায়েতের উত্তর বহিরগাছি গ্রামে। এই গ্রামেই পূজিত হন বাস্তুকালী। কী ভাবে পুজো শুরু হয়েছিল জানতে চাইলে খগেন জানান সেই ইতিহাস।

আজ থেকে অনেক বছর আগে সেই গ্রামে একের পর এক লোক অদ্ভুত ভাবে মারা যাচ্ছিল। বিকট রোগ। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। পেট ফুলে যাচ্ছিল। এমন সময় গ্রামের এক প্রবীণ মানুষ মা কালীর স্বপ্নাদেশ পান। অজানা এই রোগ থেকে বাঁচতে গ্রামের ওই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে বাস করতে হবে। তা হলেই পুরো গ্রাম অজানা রোগের মড়কের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সঙ্গে দিতে হবে পাকুড় গাছতলায় মা কালীর পুজো। সেই থেকে শুরু হল পাকুড় গাছকে বাস্তুকালী হিসেবে পুজো। পুজোর আগে গাছকে পরানো হয় লালপেড়ে সাদা শাড়ি। নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় নানা রকম ফলমূল ও মিষ্টি। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, বাস্তুভিটেকে রক্ষা করেন যে কালী, তিনিই বাস্তুকালী। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম মঙ্গলবারে বাস্তুকালীর পুজো হয়। বর্তমানে এই পুজো করেন ধর্ম মৈত্র নামের এক ব্রাহ্মণ পুরোহিত।

আর এক ভিন্নধারার কালীপুজোর খোঁজ পাওয়া যায় হাওড়ার শ্যামপুর দু’নম্বর ব্লকের বৈকুণ্ঠপুর ঘোষালবাড়িতে। মহালয়ার ঠিক আগের অমাবস্যা বা শনিবার দেখে এই পরিবারে হয় সিংহবাহিনী রক্ষাকালী পুজো। সত্তরোর্ধ্ব সূর্যকুমার ঘোষাল স্বপ্নাদেশে পেয়েছিলেন এই দেবীকে। সিংহবাহিনী রক্ষাকালীর মূর্তি তৈরি করেন স্থানীয় মধুসূদন পোড়ে নামের এক শিল্পী। তিনি জানালেন, চতুর্ভুজা কালীর পরনে বাঘছাল। কালীর বাঁ পাশে উপবিষ্ট মহাদেব। আর ডান পাশে বসে থাকা সিংহ। কালীর বাঁ পা থাকবে শিবের ডান কাঁধে, আর ডান পা থাকবে সিংহের পিঠে। এই রূপটি পুজো হয় ঘোষালবাড়িতে। নির্দিষ্ট অমাবস্যার মধ্যরাত থেকে শুরু হয় সিংহবাহিনী কালীর পুজো। ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় খিচুড়ি। আর ভোররাতে সূর্য ওঠার আগে পুজো শেষ করে প্রতিমা নিরঞ্জন করতে হয়।

এই বঙ্গে কালীসাধনা যেন ধর্মাচরণের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ধারা। কখনও নদী, কখনও গাছ, কখনও শিব ও সিংহের উপর দণ্ডায়মানা আদিশক্তি। এক সময় ‘রাজরাজেন্দ্র বাহাদুর অগ্নিহোত্রী বাজপেয় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়’ বঙ্গে দশ হাজার কালী পুজো করার ফরমান জারি করেছিলেন। কারণ ছিল চৈতন্য-পরবর্তী বৈষ্ণব ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করে শাক্ত ধর্মের প্রচার ও প্রসার। সেই প্রভাবও ছড়িয়ে রয়েছে নানা ভাবে, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। কালীতত্ত্বে তাই প্রতিফলিত হয় সমাজতত্ত্বও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kali Puja

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}