শিক্ষক: জগদানন্দ রায়
বনমানুষের মতো দেখতে প্রাণীটাকে। ‘যেন এক বৃহৎ কৃষ্ণবর্ণ পদার্থ’। সর্বাঙ্গ লোমাবৃত। শরীরের থেকে মাথাটা অন্তত কয়েক গুণ বড়। তেমনি বড় হাত-পায়ের নখগুলিও। উলঙ্গদেহ প্রাণীটিকে এক ঝলক দেখে বিস্ময় আর ভয় মেশানো অনুভূতি হয়। বিশেষ করে তার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর যে কোনও মানুষের কাছে বিকট চিৎকার বলে মনে হবে। তার চিৎকারে ‘চিরসুপ্ত স্তব্ধ প্রান্তরও যেন ভীষণ কোলাহলে কম্পিত হইতে লাগিল’।
‘চিরসুপ্ত স্তব্ধ প্রান্তর’টি আসলে শুক্র গ্রহ। সেখানে উপস্থিত বিজ্ঞানে উৎসাহী এক উনিশ শতকীয় বাঙালি যুবক। এই মুহূর্তে তার মুখোমুখি সেই গ্রহের অদ্ভুতদর্শন প্রাণীটি। কী করবে বুঝতে পারছে না। সে যদি আক্রমণ করে বসে! আক্রমণের বদলে সেই প্রাণী কিছু একটা ইশারা করল। যেন বাঙালি যুবককে সে বলছে তাকে অনুসরণ করতে। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ, ‘তবে তাহার সাধারণ পদক্ষেপ এতই দীর্ঘ যে মানবপদক্ষেপণের দশগুণও ইহার সহিত সমান হয় না।’
কিছুটা পথ পদব্রজের পর নক্ষত্রের আলোয় দেখা গেল এক রকমের মৃত্তিকা-স্তূপ। পথপ্রদর্শক প্রাণীটির ডাকাডাকিতে স্তূপ থেকে বেরিয়ে এল একই রকমের আরও কয়েকটা প্রাণী। তাদের এক জনের হাতে ‘অদ্ভুত-দীপ’। তাতেই চারপাশ আলোকিত। ‘শুক্রের জীবগণ এক প্রকার
নিকৃষ্ট প্রাণীর বাসা সংগ্রহ করিয়া অগ্নি উৎপন্ন করে।’ এরা শাকাহারী। এখানে সূর্যতাপ পৌঁছায় না বলে মাটির অনেক নীচে বিশেষ উপায়ে ফসল ফলায়, ‘শুক্রের আভ্যন্তরীণ তাপ দ্বারা সূর্য্যতাপের কার্য্য সাধিত হয়’।
কল্পবিজ্ঞানের এই ছোটগল্পটির নাম ‘শুক্র ভ্রমণ’। লেখক জগদানন্দ রায়। ১২৪ বছর আগে ‘ভারতী’ পত্রিকার কার্তিক ও অগ্রহায়ণ সংখ্যায় দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল এটি। বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের প্রথম গল্প হেমলাল দত্তের ‘রহস্য’ ছাপা হয়েছিল তার তেরো বছর আগে, ‘বিজ্ঞান দর্পণ’ পত্রিকায়। তবে বাংলা ছোটগল্পে ভিন্নগ্রহের প্রাণীর প্রথম আবির্ভাব এই ‘শুক্র ভ্রমণ’-এই। সত্যজিতের ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ অ্যাং দেখা দেবে এর ঠিক সাড়ে ছয় দশক পরে।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য অন্য কারণে জগদানন্দের খোঁজ করেছিলেন। তখন রবিবাবু ‘সাধনা’ সম্পাদনায় মগ্ন। পত্রিকায় পাঠকদের পক্ষ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রশ্ন থাকত। মাঝে মাঝে এমন উত্তর পাওয়া যেত যার ভাষা স্বচ্ছ, সরল। বিজ্ঞান প্রসঙ্গে এমন প্রাঞ্জল বিবৃতি সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না। জানতে পারা গেল, এগুলি কৃষ্ণনগরের জগদানন্দ রায়ের লেখা, তিনি তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়ে পাঠাতেন। আলাপ হল দুজনের। জগদানন্দের তখন অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা। শরীরও জ্বরে ভুগে রুগ্ন। শিলাইদহের জমিদারি কাজে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে নিলেন। কয়েক বছর পর, শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে, শিক্ষক হিসেবে জগদানন্দকে বেছে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না গুরুদেবের মনে।
গল্প দু-চারটির বেশি না লিখলেও ছোটদের জন্য জগদানন্দ রায়ের বিজ্ঞান বিষয়ক গদ্য রচনার সংখ্যা কম-বেশি ২৭৫। আঠারোটি মৌলিক গ্রন্থ এবং সতেরোটি পাঠ্যপুস্তকের প্রণেতা তিনি। রবীন্দ্রনাথের কথায়: ‘জগদানন্দ রায়ের নাম বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা আর তাদের বাপ-মা সকলেই জানেন। জ্ঞানের ভোজে এ দেশে তিনিই সর্বপ্রথম কাঁচা বয়সের পিপাসুদের কাছে বিজ্ঞানের সহজ পথ্য পরিবেশন করেছিলেন।’ নিবন্ধগুলির শিরোনামেই বোঝা যায়, বিজ্ঞানের সব সংবাদ তিনি সংগ্রহ করতেন নিবিড় নিষ্ঠায়— ‘আচার্য জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার’, ‘আলোক ও বর্ণজ্ঞান’, ‘গ্রহের বাষ্পমণ্ডল’, ‘চুল পাকে কেন’, ‘নূতন চিকিৎসা পদ্ধতি’, ‘সেকালের জন্তুজানোয়ার’ ইত্যাদি। দিনের পর দিন এগুলি প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতী’, ‘প্রবাসী’, ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘সাহিত্য’, ‘প্রদীপ’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘শিশুসাথী’, ‘মানসী’, ‘ভাণ্ডার’-এর মতো পত্রিকায়। তাঁর বইয়ের নামেও মেলে বিষয়বৈচিত্রের আভাস: ‘প্রকৃতি পরিচয়’, ‘গ্রহনক্ষত্র’, ‘পোকামাকড়’, ‘গাছপালা’, ‘মাছ ব্যাঙ সাপ’, ‘বাঙলার পাখী’, ‘শব্দ’, ‘আলো’, ‘চুম্বক’, ‘স্থির বিদ্যুৎ’ প্রভৃতি। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মন্তব্য: “আজকাল বাঙ্গালা মাসিক সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ দেখিলেই পাঠক বুঝিয়া লন যে, প্রবন্ধের নীচে জগদানন্দবাবুর স্বাক্ষর থাকিবে।”
গভীর রাত। শান্তিনিকেতনের খোলা মাঠে হাতে লণ্ঠন আর বিদেশি প্রকাশনার নক্ষত্রপট নিয়ে বসে আছেন জগদানন্দ। সঙ্গে আশ্রমের পুরনো দূরবিন। ছোট লণ্ঠনটি কালো কাপড়ে ঢাকা। তার মৃদু আলোয় তিনি মিলিয়ে নিচ্ছেন পটে আঁকা নক্ষত্রের সঙ্গে আকাশের নক্ষত্রদের। এই দৃশ্য আশ্রমিকদের কাছে পরিচিত ছিল। ‘শান্তিনিকেতনের এক যুগ’, ‘অচেনা রবীন্দ্রনাথ’-এর রচয়িতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তখন নিতান্তই পূর্ববঙ্গীয় বালক। সে বছর হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে খুব উত্তেজনা। ধূমকেতু ব্যাপারটা কী, পিতা সাধ্যমতো বুঝিয়েও সন্তুষ্ট করতে না পেরে বালক হীরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘‘ভাল করে জানতে চাও তো শান্তিনিকেতনের জগদানন্দ রায় মশায়কে পত্র লেখ, তিনি সব কথা ভাল করে বুঝিয়ে দেবেন।’’ সত্যিই তাই হল। চিঠির জবাব এল দ্রুত। দু’পাতা লম্বা চিঠি: “তাতে কী সুন্দর করে যে ধূমকেতুর ইতিবৃত্তান্ত লিখে পাঠিয়েছিলেন সে কী বলব!”— স্মৃতিকথায় লিখেছেন হীরেন্দ্রনাথ।
‘জগদানন্দ বিলান জ্ঞান/ গিলান পুঁথি ঘর-জোড়া।/ কাঁঠাল গুলান কিলিয়ে পাকান,/ গাধা পিটিয়ে করেন ঘোড়া’— ছড়াটির রচয়িতা রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ। খড়্গনাসা, লম্বা, দোহারা জগদানন্দের দেহবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, মাথায় কোঁকড়া চুল। দাঁতে কালো ছোপ। চোখে মোটা কাচের চশমা, ঈষৎ চাপা দুটি ঠোঁট আর সর্বদা বিরক্তিপূর্ণ ভ্রুভঙ্গি দেখে ছাত্ররা ভয় পেত। অথচ আশ্রমের সর্বাধ্যক্ষ থাকুন কিংবা না-থাকুন— মালতীকুঞ্জে অঙ্কের ক্লাস নেওয়া, গবেষণাঘরে হাতে-কলমে বিজ্ঞানের পরীক্ষা দেখানো, ছাত্রদের আহারের তদারকি, সব্জি বাগান পরিদর্শন, সন্ধেবেলায় ভূতের গল্প বলা, কেউ অসুস্থ হলে রাত জেগে সেবা করা— আন্তরিক দায়িত্বে সব সামলাতেন। শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য শাস্তি হিসেবে কোনও ছাত্রের এক বেলার আহার বন্ধ করে দেওয়া হলে তিনিও সারা বেলা না-খেয়ে থাকতেন।
পায়ে একজোড়া পুরনো চটি, মুখে কড়া চুরুট— খবরের কাগজে চোখ নিমগ্ন রেখে শালবীথির প্রশস্ত রাজপথ ছেড়ে ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যেতেন। কৃষ্ণনগরের জমিদার বংশের সন্তান হলেও দারিদ্র তাঁর অঙ্গভূষণ ছিল। স্ত্রীর অকালমৃত্যুর কারণে চারটি নাবালক সন্তানের দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হয়। একটি মেয়ে পঙ্গু ও চিররুগ্ন। একমাত্র পুত্রটি ডাক্তারি পড়ার সময় উন্মাদ হয়ে যায়। বড় মেয়ে অকালে বিধবা হয়ে পুত্র-কন্যা সহ তাঁর কাছে চলে আসে। এত কিছুর পরেও জীর্ণ কুটিরের দাওয়ায় বসে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলি লিখে গেছেন। সরল ভাষায় বাংলার ছেলেমেয়েদের দীক্ষিত করতে চেয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে। সে ভাষার নমুনা: ‘‘সেলাই করিবার সময় পাছে আঙ্গুলে ছুঁচের খোঁচা লাগে, এই ভয়ে আমরা আঙ্গুলে আঙ্গ-স্ত্রাণা লাগাইয়া তবে সেলাই করি। পাছে ইট পাথর কাঁকরের খোঁচা মাথায় লাগে এই ভয়ে গাছের শিকড়গুলিও মাথায় টুপি লাগাইয়া মাটির তলায় চলে। এই টুপিকে বৈজ্ঞানিকেরা মূলত্রাণ নাম দিয়াছেন।”
ছোটদের জন্য ‘গ্রহনক্ষত্র’ বইটি লিখছেন শুনে আমেরিকার ফ্ল্যাগস্টাফ মানমন্দিরের বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিদ লাওয়েল সাহেব খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি জগদানন্দকে মানমন্দিরের বড় দূরবিনে তোলা গ্রহ-নক্ষত্রের একাধিক ছবি পাঠিয়েছিলেন। তার বেশ কিছু ওই বইতে মুদ্রিত হয়। এ ছাড়াও ‘বাঙলার পাখী’-সহ একাধিক গ্রন্থের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা, রামকিঙ্কর বেইজ প্রমুখ। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে নৈহাটিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের বিজ্ঞান শাখার সভাপতি ছিলেন তিনি। অভিভাষণে বলেছিলেন: “বিজ্ঞানের শিক্ষা যখন আমাদের দেশের সর্ব্বসাধারণের অস্থি-মজ্জায় আশ্রয় গ্রহণ করিবে, তখন বুঝিব দেশে বিজ্ঞানের চর্চা সার্থক হইয়াছে।”
জগদানন্দ রায় রবীন্দ্রনাথের একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। কবিতা ও গান রচনার শখ ছিল, বাজাতে পারতেন এসরাজ আর বেহালা। গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার পেয়েছেন। ‘শান্তিনিকেতন’ ও ‘শিশুসাথী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক ছিলেন দীর্ঘ দিন। জীবনের অন্তিম পর্বে বীরভূম জেলা বোর্ড ও লোকাল বোর্ডের সভ্য হন, এমনকি বোলপুর ইউনিয়ন বোর্ড বেঞ্চকোর্টের সাম্মানিক ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব সামলেছেন। সব ভূমিকার পরেও বিজ্ঞানের বার্তা প্রচার করাকেই তিনি জীবনের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন। এই দিক থেকে অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সার্থক উত্তরসূরি তিনি। ১৯৩৩-এর ২৫ জুন ৬৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে বলেছিলেন: “তাঁর কাজ আনন্দের কাজ ছিল, শুধু কর্তব্যের নয়। তার প্রধান কারণ তাঁর হৃদয় ছিল সরস, তিনি ভালবাসতে পারতেন।” ১৮৬৯-এর ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। মাসখানেক হল তাঁর সার্ধশতবর্ষ বিস্মরণের পথে হারিয়ে গিয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: সুবিমল মিশ্র, অরিন্দম সাহা সরদার, মঞ্জুলিকা দাস, মন্দিরা চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy