মমতাময়ী: ড্যাশের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া। ছবি সৌজন্য : উইকিমিডিয়া কমন্স
সেই রোমান আমল থেকেই ইংল্যান্ডে কুকুর অতি জনপ্রিয় পোষ্য। এ দেশে কুকুর পোষার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বিশ্বস্ত প্রাণীটির প্রতি রাজা-রানি এবং অভিজাত বংশীয়দের অনুরাগ। ব্যক্তিগত দেহরক্ষী থেকে শিকারে সাহায্যকারীর ভূমিকায় বা নিঃসঙ্গকে সঙ্গদানে কুকুর অদ্বিতীয়। ‘রয়্যাল ডগ’ বা রাজারাজড়াদের কুকুর এসেছে জার্মান, চিন, রাশিয়া, এমনকি ভারত থেকেও। ১৬২৫-১৬৪৯ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে রাজত্ব করেছিলেন রাজা প্রথম চার্লস। তাঁর সময়ে জনপ্রিয় হয় একটি ছোট আকারের স্প্যানিয়েল। পরে তার পোশাকি নামকরণ হয় ‘ক্যাভেলিয়র কিং চার্লস’ স্প্যানিয়েল’। দ্বিতীয় চার্লস নিয়ম চালু করেছিলেন, কুকুর নিয়ে পার্লামেন্টেও প্রবেশ করা যাবে।
১৮৩৩ সালের কথা। ইংল্যান্ডের যুবরানি ভিক্টোরিয়া তখন চোদ্দো বছরের কিশোরী। তাঁর মা মেরি লুইসি ভিক্টোরিয়া তিন বছর বয়সি ‘ক্যাভেলিয়র কিং চার্লস’ প্রজাতির একটি স্প্যানিয়েল উপহার পান। মেরি লুইসির দ্বিতীয় পক্ষের একমাত্র সন্তান আলেকজ়ান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়া। ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গী হয়ে উঠবে, এই আশায় তিনি স্প্যানিয়েলটিকে মেয়ের হাতে তুলে দেন। কুকুরটির নাম রাখা হয় ‘ড্যাশ’। ভিক্টোরিয়ার সমবয়সি কেউ না থাকায় ড্যাশই হয়ে ওঠে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী, যেন এক পারিবারিক বন্ধু। বড়দিনে অন্যান্যদের মতো ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে সেও উপহার পেত রঙিন বল ও তার পছন্দের খাবার। বিশ্বস্ত প্রাণীটির প্রতি ভিক্টোরিয়ার ভালবাসার সেই শুরু। সমুদ্রে প্রমোদতরীতে ‘ইয়টিং’ করতে এসেছেন ভিক্টোরিয়া, সঙ্গী ড্যাশ। সমুদ্রে ভেসে চলেছে ইয়ট, তীরে বসে ড্যাশ যেন ব্যাপারটা বুঝে নিল। তার পর ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। সাঁতরে চলল ইয়টের পাশে পাশে। এ ভাবেই আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছিল দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব।
১৮৩৮ সালের ২৮ জুন, মাত্র উনিশ বছর বয়সে রানি হন ভিক্টোরিয়া। সূচনা হয় ‘ভিক্টোরিয়ান’ যুগের। রাজকীয় আচার-অনুষ্ঠানের পালা সাঙ্গ হতেই তিনি ছুটে আসেন ড্যাশের কাছে। নিজের হাতে তাকে আদর-যত্ন পরিচর্যা করে তবেই তাঁর শান্তি। পোষ্যদের প্রতি এমনই মমতাময়ী ছিলেন তিনি। স্যর এডউইন ল্যান্ডসিয়ার ছিলেন পশুপাখিদের চিত্র আঁকায় দক্ষ। তাঁর আঁকা ড্যাশের ছবি দেখে ভিক্টোরিয়া খুব খুশি হন। স্যর ল্যান্ডসিয়ার হয়ে ওঠেন রাজচিত্রকর। ভিক্টোরিয়া তাঁকে দিয়ে তাঁর পোষ্যদের অনেক ছবি আঁকিয়ে নেন। এই ছবি-সংগ্রহের নাম ‘হার ম্যাজেস্টি’স ফেভারিট পেটস’। এর পর আরও দু’বছর বেঁচে ছিল ড্যাশ। ১৮৪০ সালের শেষ দিকে মারা যায় সে। উইন্ডসরের হোম পার্কে যথোচিত মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
রানি হওয়ার পর ভিক্টোরিয়ার বিয়ে ঠিক হয় অভিজাত জার্মান বংশের সন্তান প্রিন্স অ্যালবার্টের সঙ্গে। তিনিও ছিলেন কুকুরপ্রেমী। জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে বিয়ে করতে আসার সময় তিনি তাঁর প্রিয় গ্রেহাউন্ড ‘ইঅস’কে সঙ্গে নিয়ে আসেন। ১৮৪০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। রাজা-রানি চলেছেন মধুচন্দ্রিমায়, তাঁদের সঙ্গী হয়ে চলেছে ‘ইঅস’। ১৮৪১ সালের বড়দিনে ল্যান্ডসিয়ারের আঁকা ‘ইঅস’-এর ছবি স্বামী অ্যালবার্টকে উপহার দেন ভিক্টোরিয়া। এর পর ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট যেখানেই বেড়াতে যেতেন, সঙ্গে সঙ্গে যেত একটা গোটা সারমেয় বাহিনী। তাদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উইন্ডসর হোম পার্কে তৈরি হয়েছিল ‘রয়্যাল কেনেল’, যেখানে শ’খানেক পোষ্যকে রাখার ব্যবস্থা ছিল।
চিনের পিকিং থেকে এসেছিল তুলতুলে ‘পিকিনিজ়’ কুকুর। সেটা একটা ঘটনা— দুর্ঘটনাও বলা যায়। ১৮৬১ সালের ৬ অক্টোবর, দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের সময় সম্মিলিত ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনীর হাতে চিনের তৎকালীন রাজধানী পিকিং-এর পতন ঘটে। চৈনিক সম্রাটের গ্রীষ্মকালীন রাজপ্রাসাদ লুঠ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পাঁচটি লোমশ পিকিনিজ় কুকুরছানা নিয়ে চলে আসে বিজয়ী সৈন্যরা। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন একটি ছানা নিয়ে এসে উপহার দেন মহারানি ভিক্টোরিয়াকে। তিনি তো খুশিতে ডগমগ। লুঠ করে আনা বলে রানি তার নাম রাখেন ‘লুটি’। অচিরেই লুটি সকলের মন জয় করে নেয়, লাভ করে রাজকীয় আদর। ইংল্যান্ডে সেই প্রথম এল এই প্রজাতির কুকুর।
পরবর্তী কালে ভিক্টোরিয়া স্কটল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা ‘কোলি’ প্রজাতির কুকুরের প্রতি আকৃষ্ট হন। নরম লোমে ঢাকা এই কুকুরগুলো ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের সীমান্তে পশুপালকদের সাহায্যের জন্য ব্যবহৃত হত। গবাদি পশুদের তাড়িয়ে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখতে এই কুকুরদের জুড়ি নেই। এদের তাই ‘বর্ডার কোলি’ বা ‘শেফার্ডস ডগ’-ও বলা হত। এই প্রজাতির অনেক কুকুর পোষ্য ছিল রানির। তবে তাদের মধ্যে প্রিয় ছিল ‘শার্প’ ও ‘নোবল’। ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্ট ১৮৬১ সালে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। তার কয়েক বছর পরেই, ১৮৬৬ সালে দু’বছর বয়সি শার্প-এর রাজপরিবারে প্রবেশ ও ভিক্টোরিয়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠা। বদরাগী বলে শার্প-এর একটু দুর্নাম ছিল। তবে রানি ও তাঁর ব্যক্তিগত সচিব জন ব্রাউনের সে ছিল একান্ত অনুগত। লন্ডন থেকে পাঁচশো মাইল উত্তরে স্কটল্যান্ডের পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত বালমোরাল ছিল রানির পছন্দের বেড়ানো ও অবসর কাটানোর জায়গা। ১৮৫২ সালে অ্যালবার্ট তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে বালমোরাল ক্যাসল কিনে নেন এবং তার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেন। ১৮৬৬ সালে লন্ডন থেকে বালমোরালের ছ’মাইল দূরে ব্যালাটার পর্যন্ত রেল যোগাযোগের পত্তন হয়। রাজপরিবারের জন্য তৈরি হয় বিশেষ সেলুন কার। রানি সেখানে গেলে সঙ্গে শার্পের যাওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। ভিক্টোরিয়া যে রোজনামচা রাখতেন তা থেকে জানা যায়, ১৮৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বালমোরালে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। সেখানে রোজকার নানা ঘটনার মধ্যে তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর প্রিয় শার্প-এর কথাও। তেরো বছর রানিকে সঙ্গ দিয়ে ১৮৭৯ সালে শার্প মারা যায়। উইন্ডসরে তার সমাধির উপর রয়েছে একটি সুন্দর ভাস্কর্য— সামনের পা দু’টির উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে শার্প।
তুলনায় আর-এক পোষ্য ‘নোবল’ ছিল শান্ত ও বাধ্য। ভিক্টোরিয়ার হাতের দস্তানা দু’টি সে সব সময় কড়া নজরে রাখত। রেলভ্রমণে সেও হত ভিক্টোরিয়ার সঙ্গী। রানির ডায়েরিতে দেখা যাচ্ছে, ১৮৭৩ সালে সেপ্টেম্বর-শুরুতে তিনি বালমোরালে ছিলেন। ৯ সেপ্টেম্বর তিনি বালমোরাল থেকে ব্যালাটার এসে ট্রেনে চাপেন। ট্রেনে আসার সময় নোবল খুবই শান্ত হয়ে ছিল, সে কথারও উল্লেখ আছে। এক বার বালমোরালে থাকাকালীন নোবল অসুস্থ হয়ে পড়ে। অস্থির হয়ে ওঠেন রানি। ব্যক্তিগত চিকিৎসক স্যর জেমস রিডকে ডেকে নোবল-এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ১৮৮৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, সাড়ে আঠেরো বছর বয়সে বালমোরালে মারা যায় নোবল। সেখানেই সমাহিত করা হয় তাকে। বালমোরাল ক্যাসলের পশ্চিমে বাগানের দিকে এক পায়ে চলা পথের পাশে নোবল-এর সমাধিস্তম্ভের উপর ভিক্টোরিয়ান যুগের প্রতিভূ হয়ে আজও আছে তার ব্রোঞ্জ মূর্তি। নীচে লেখা আছে তার প্রশস্তি।
তবে ‘সিজ়ার’-এর কথা না বললে এ কাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ভিক্টোরিয়ার পর রাজা হন তাঁর দ্বিতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠ পুত্র— সপ্তম এডওয়ার্ড। তাঁর সারমেয়প্রীতি মায়ের মতো। তাঁর প্রিয় কুকুর ছিল ‘জ্যাক’। ১৯০২ সালে জ্যাক মারা যাওয়ার পর ইংল্যান্ডের এক লর্ড সেই বছরই রাজাকে একটি ‘ওয়্যারফক্স টেরিয়ার’ প্রজাতির কুকুর উপহার দেন। তার নাম রাখা হয় ‘সিজ়ার’। অল্প সময়েই রাজার মন জয় করে নেয় সে, হয়ে ওঠে তাঁর সব সময়ের সঙ্গী। তার দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত হয় এক রাজকর্মচারীও। রাজা এডওয়ার্ড মূল্যবান রত্নখচিত রাজদণ্ড ব্যবহার করতেন, যার বাঁটে সিজ়ার-এর মুখ আঁকা থাকত। এমনকি রাজার শয়নকক্ষে তাঁর পালঙ্কের পাশে এক আরামকেদারায় সিজ়ারের শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তার গলার কলারে লেখা থাকত ‘আই অ্যাম সিজ়ার, আই বিলং টু দ্য কিং’।
সেই সময় মোমের মূর্তি তৈরির চল হয়েছিল। রাজা তাঁর প্রিয় পোষ্য সিজ়ারের মোমের মূর্তি তৈরি করতে দিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা দেখার সৌভাগ্য তাঁর আর হয়নি। মূর্তি তৈরির আগেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯১০ সালের ৬ মে বাকিংহাম প্রাসাদে মৃত্যু হয় তাঁর। অনাথ সিজ়ার খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করল। যে পালঙ্কে রাজার মৃতদেহ শায়িত ছিল, তার নীচে জড়সড় হয়ে লুকিয়ে রইল সে।
তার প্রভুভক্তির নিদর্শন দেখা গেল পরে। অন্ত্যেষ্টির জন্য কফিনবন্দি রাজার শবদেহ চলেছে বিশেষ গাড়িতে, উইন্ডসর ক্যাসলের দিকে। দেখা গেল, সেই গাড়ির পিছনে, রক্ষীদের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে সিজ়ারও এগিয়ে চলেছে সৈনিকের মতো। রাজপরিবারের সদস্যরা রয়েছেন তার পিছনে। এর পর সাধারণ মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিজ়ার। তার জীবন নিয়ে বই লেখা হয়, ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হয় তার পিকচার পোস্টকার্ডও।
রাজা এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর রানি আলেকজ়ান্দ্রা বাকিংহাম ছেড়ে লন্ডনের মার্লবোরো হাউসে চলে আসেন। সঙ্গে আসে সিজ়ারও। এ বার সে রানির সহচর। সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যুর চার বছর পর, ১৯১৪ সালের ১৮ এপ্রিল এক অস্ত্রোপচারের সময় দুর্ভাগ্যক্রমে মারা যায় সিজ়ার। মার্লবোরো হাউসেই চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সে। উইন্ডসর ক্যাসলে সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে সপ্তম এডওয়ার্ড ও আলেকজ়ান্দ্রার সমাধিস্তম্ভের উপর তাঁদের যে মূর্তি খোদিত আছে, সেখানে রাজা-রানির সঙ্গে স্থান পেয়েছে সিজ়ারও, তার অপার প্রভুভক্তির পুরস্কার হিসেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy