মহামারির সময়েও এই দুবলা, পাঁশুটে বাচ্চাটা যে বেঁচে যাবে, ঘুণাক্ষরেও কেউ আশা করেনি। বাচ্চাটার বাবা গরিব স্কুলশিক্ষক। তালপাতায় ছাওয়া মাটির বাড়ি। বেঙ্গালুরু শহরের কয়েক কিলোমিটার দূরের এই বেলুর গ্রামে স্কুল, চিকিৎসা কোনও কিছুরই বন্দোবস্ত নেই। বাচ্চাটার বাবা কয়েক মাইল দূরে অন্য এক গ্রামে রোজ শিক্ষকতা করতে যান।
১৪ ডিসেম্বর, ১৯১৮। কর্নাটকের বেলুর গ্রাম ও তার আশপাশের এলাকা তখন মহামারিতে হাবুডুবু। গ্রামে এত দিন মহামারি ছিল না, কী ভাবে এল তা নিয়ে হরেক কথা। কেউ বলে, রোগটার নাম স্প্যানিশ ফ্লু। বিদেশে সৈন্যদের মধ্যে শুরু হয়েছিল, বেঙ্গালুরুতে যে বড় সেনাশিবির আছে, সেখান থেকেই রোগ ছড়িয়েছে। কেউ আবার বলে, গ্রামের এক জন তীর্থে গিয়েছিল, সে সংক্রামিত হয়ে গ্রামে ফেরে। তার পর থেকেই সারা অঞ্চলে এই অবস্থা। মহামারি ভিন্দেশ এবং বড় শহর থেকেই ছড়ায়, এই সময়ের জনশ্রুতি সে রকমই।
মহামারিটি অদ্ভুত। প্রথমে জ্বর, সর্দি-কাশি, হাঁচি হয়। তার পর রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু, সারা শরীর অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে যায়। অতঃপর খাবি খেতে খেতে নাক, মুখ থেকে বেরিয়ে আসে রক্তের ছিটে। সারা পৃথিবীতে ৫০ কোটি মানুষ এখন এই রোগে আক্রান্ত, ভারতে ১ কোটি ৭০ লক্ষ।
শহুরে লোকেরা এ সব নিয়ে অনেক কিছু জানে। তারা বলে, মহাযুদ্ধের পর ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদে যখন শান্তি চুক্তি সই করা হচ্ছিল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এই জ্বরে ভুগছিলেন। আমেরিকা দেশটা কোথায়, এই গ্রামের লোকেরা ঠিক জানে না। যেমন, হাঁচি-কাশির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া জীবাণু বা ‘ড্রপলেট’ শব্দটাও তাদের অজানা। বিলিতি ডাক্তারদের বক্তব্য, এক-একটি হাঁচি থেকে জীবাণু-ভর্তি ৪০ হাজার ড্রপলেট বেরিয়ে আসে, মারণ-বোমার মতো সেগুলি আশপাশের লোকদের সংক্রামিত করতে পারে।
গ্রামের কুঁড়েঘরে আসন্নপ্রসবা শেষাম্মা এখন সেই জ্বরেই হু-হু করে কাঁপছেন। একটার পর একটা কম্বল চাপিয়েও থামানো যাচ্ছে না কাঁপুনি। মারণ জ্বর, প্রসববেদনা সব মিলেমিশে একাকার।
তবু শেষাম্মা বেঁচে গেলেন। বহু ধকলের শেষে বেঁচে গেল সদ্যোজাত শিশুপুত্রটিও। মাথাটা ভারী, জন্ম-মৃত্যুর টানাটানিতে বুকের খাঁচাটা চুপসে, পেটটা বড়, শরীরে মারণ-জ্বরের নীলাভা তখনও ছেড়ে যায়নি। তবু কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন ঢঙে এই শিশুর নাম রাখা হল সুন্দররাজা। বেলুর গ্রামে জন্ম, বাবার নাম কৃষ্ণমাচারি। সব মিলিয়ে পুরো নাম বেলুর কৃষ্ণমাচারি সুন্দররাজা আয়েঙ্গার।
পরবর্তী কালে দুনিয়া অবশ্য নামটা সংক্ষেপ করে নিয়েছিল— বিকেএস আয়েঙ্গার। করতেই হত। ২০১৫ সালে বিশ্ব যোগ দিবস শুরুর পাঁচ বছর আগেই অক্সফোর্ড অভিধানে ঢুকে এসেছে ‘আয়েঙ্গার’ নামে এক নতুন শব্দ। মানেটাও জানিয়ে দিয়েছে ওই ইংরেজি অভিধান— ‘ঝুলন্ত বেল্ট, কাঠের ব্লক ইত্যাদি উপকরণের মাধ্যমে শরীর ঠিক করার জন্য বিকেএস আয়েঙ্গার উদ্ভাবিত এক রকমের হঠযোগ পদ্ধতি।’ শুধু অক্সফোর্ড নয়, ২০০৪ সালে মার্কিন ‘টাইম’ পত্রিকার প্রচ্ছদে দুনিয়ার ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকাতেও তিনি। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে চিন, জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ৭২টি দেশে এখন তাঁর পদ্ধতি মেনেই যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। দার্শনিক জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি থেকে বেহালাশিল্পী ইহুদি মেনুহিন সকলকেই যোগ শিখিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শ্যামাচরণ লাহিড়ী, স্বামী যোগানন্দ, হৃষীকেশের স্বামী শিবানন্দ, মহীশূরের কৃষ্ণমাচার্য হয়ে ভারতীয় যোগসাধনার যে উজ্জ্বল ধারা, মহামারি-জাতক বিকেএস আয়েঙ্গার তার অন্যতম প্রতিভূ।
মহামারিতে জন্মই শুধু নয়, দারিদ্র্যের কারণে খাওয়া জুটত না, উপরন্তু দশ বছর বয়সে মারা গেলেন বাবা। ছোটবেলায় ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া থেকে টিবি, টাইফয়েড জাতীয় নানা রোগে ভুগতেন সুন্দর। গ্রামের হতদরিদ্র বালকদের জীবনে অবশ্য একশো বছর পরে আজও অপুষ্টি ব্যতিক্রম নয়।
জীবন বদলে গেল মহীশূরে জামাইবাবু কৃষ্ণমাচার্যের বাড়িতে এসে। কৃষ্ণমাচার্যও আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ, সুন্দরের দিদি নামাগিরিআম্মার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে। শিখাধারী, শাস্ত্রবিদ কৃষ্ণমাচার্যের বয়স তখন ৩৭, পাত্রীর বয়স ৯।
এই বাল্যবিবাহ দিয়ে অবশ্য কৃষ্ণমাচার্যকে বোঝা যাবে না। মহীশূরের ডায়াবিটিস-আক্রান্ত রাজা চতুর্থ কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারকে তখন যোগ শেখান তিনি। তার আগে বালক বয়সে শাস্ত্রশিক্ষা করতে বারাণসী চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিব্বত। সেখানে রামমোহন ব্রহ্মচারী নামে গুহাবাসী এক সন্ন্যাসী তাঁকে তিনশো রকম আসন শেখান, যোগ নিয়ে লুপ্ত একটি সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িয়ে দেন। অতঃপর দেশে ফিরে বিয়ে-থা করে থিতু হওয়ার নির্দেশ। কৃষ্ণমাচার্যের বিয়ের গল্প এ রকমই!
কিন্তু এই অলৌকিক গল্পেই কৃষ্ণমাচার্যের একমাত্র পরিচিতি নয়। পঞ্চাশের দশকে হলিউডে মেরিলিন মনরো, গ্রেটা গার্বোদের যোগশিক্ষা দিয়েছিলেন যে ইন্দ্রা দেবী, সত্তরের দশকে আমেরিকায় যোগশিক্ষার সৌরভ ছড়িয়েছিলেন যে পট্টভি জোইস, তাঁরা দু’জনেই পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির শিখাধারী ব্রাহ্মণ কৃষ্ণমাচার্যের যোগশিষ্য।
১৯৩১ সালে এহেন কৃষ্ণমাচার্য সহসা শ্বশুরবাড়ি হাজির। মহারাজের নির্দেশে তিনি তিন মাসের জন্য মুম্বইয়ের যোগকেন্দ্রে যাচ্ছেন, শ্যালকরা যদি কেউ এই সময়টায় মহীশূরে গিয়ে তাঁর বালিকা পত্নীর দেখাশোনা করে! বালক সুন্দরই তখন ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো!
যোগক্ষেম জামাইবাবুর মেজাজ ভয়ঙ্কর! পান থেকে চুন খসলেই বকুনি আর চড়-থাপ্পড়। ভোর চারটে বাজার আগে সুন্দরকে বিছানা ছেড়ে বাগানের পরিচর্যায় যেতে হয়। বাগানের গাছে জল দেওয়া, জামাকাপড় কাচা, অতঃপর স্কুলে যাওয়া ইত্যাদি। ইলেকট্রিক পাম্প তখনও বেরোয়নি, কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলতে হয়। সুন্দর বাড়ির বাইরের একটা ঘরে জামাইবাবুর তিন-চার জন ছাত্রের সঙ্গে থাকে। রাজবাড়ির যোগশালায় এই ছাত্ররা কৃষ্ণমাচার্যের কাছে যোগব্যায়াম শেখে। সুন্দর এক সকালে সেখানে গিয়েছিল আসন, প্রাণায়াম শিখতে। জামাইবাবু তাকে দেখে খিঁচিয়ে উঠেছেন, ‘এই চেহারায় যোগ শিখবে! ভাগ!’ এক দিন সকালে তখনও বিছানা ছাড়েনি সে, সবেগে গালে আছড়ে পড়ল পাঁচ আঙুলের দাগ। ‘মারছেন কেন?’ কোনও মতে ঘুমচোখে প্রশ্ন করেছিল সুন্দর। ‘আবার প্রশ্ন! সাহস কম নয়,’ ফের জামাইবাবুর গর্জন এবং থাপ্পড়। পরে এক ছাত্র বুঝিয়ে দিল, গুরুদেবকে প্রশ্ন করা যায় না। প্রশ্ন করাটা কৃষ্ণমাচার্য ঔদ্ধত্য ভাবেন।
চড়-থাপ্পড়, উপরন্তু পেটও ভরে না। প্রায়ই পচে-যাওয়া, বাসি আধপেটা খেয়ে পেটে কিল মেরে থাকতে হয়। জামাইবাবু বাড়ি না থাকলে দিদি রান্নাঘরে সুন্দরকে ডেকে দু’টি খেতে দেয়, অন্য সময় সাহস পায় না। দিদি-জামাইবাবু শুয়ে পড়লে দু’এক দিন পা টিপে টিপে রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি করে নিয়ে এসেছে বালক। ‘পাপ কাকে বলছ? খিদের জ্বালায় মানুষ অনেক কিছু করে, ওকে পাপ বলা যায় না,’ পরিণত বয়সে তাঁর যোগশিক্ষার ক্লাসে প্রায়ই বলতেন বিকেএস আয়েঙ্গার। ভারতীয় যোগ-ঐতিহ্য বলতে যাঁরা প্রশান্ত মনে শরীরচর্চার কয়েকটি স্থিতধী ভঙ্গি বোঝেন, ভুল করেন। এই ঐতিহ্যে মহামারি, উঠতি বয়সের হাঁইহাঁই খিদে— অনেক কিছু মিশে আছে।
এত দুঃখ, দারিদ্র, তবু যোগগুরু জামাইবাবুর লাথিঝাঁটা খেতে খেতে বেশ কিছু আসন শিখে
নিল সুন্দর।
‘হনুমানাসন,’ নির্দেশ দিলেন জামাইবাবু। সুন্দর আমতা আমতা করে বলল, ‘ওটা জানি না।’ ‘জানার কিছু নেই, এক পা এগিয়ে, এক পা পিছনে করে বসা,’ জানালেন কৃষ্ণমাচার্য। কোনও ক্রমে চেষ্টা করল সুন্দর, উরুর পেশিতে প্রবল টান, রক্ত জমাট বেঁধে যাবে মনে হচ্ছে। জামাইবাবু পিছনে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। এ দিক-ও দিক হলেই মার!
এ হেন ক্ষুধার্ত, দুবলা ছেলেই রাজার হাত থেকে পুরস্কার পেল। ১৯৩৫ সাল। মহীশূরে ওয়াইএমসিএ-এর আন্তর্জাতিক সম্মেলন। রাজার নির্দেশ, কৃষ্ণমাচার্যের যোগশালার ছাত্ররা সেখানে যোগব্যায়াম দেখাবেন। সুন্দর এখানেই পেল তার জীবনের প্রথম পুরস্কার। ৫০ টাকা দিলেন মহারাজ। গুরুর সঙ্গে কৃষ্ণমাচার্যের ছাত্রেরা তখন কর্নাটকের ধারওয়ার, হুবলি ইত্যাদি শহরে যোগব্যায়ামের কসরত দেখিয়ে বেড়ায়।
এই সময়েই মহীশূরের প্রাসাদে এলেন বাঙালি যোগী পরমহংস যোগানন্দ। ক্রিয়াযোগী শ্যামাচরণ লাহিড়ীর ঘরানার এই সন্ন্যাসী আমেরিকা যাবেন, বালক সুন্দরকে সঙ্গে নিতে চাইলেন তিনি। কৃষ্ণমাচার্য বললেন, ‘না, অত দূরে কী ভাবে ছাড়ব? আমার শ্যালক, বাবা নেই। এখন আমারই দায়িত্বে।’ বালক সুন্দরের সে যাত্রা বিদেশগমন হল না।
কয়েক বছর পরে মহীশূর ছেড়ে সুন্দরকে অবশ্য একাই যেতে হল মহারাষ্ট্রের পুণে শহরে। ডাক্তার ভিবি গোখলে কর্নাটকেই সুন্দরদের যোগব্যায়াম দেখেছিলেন। বিখ্যাত ডাক্তার তিনি, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী কারাগারে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনিই চিকিৎসা করেছিলেন। এই সিভিল সার্জন এখন বদলি হয়ে পুণে শহরে। তাঁর অনুরোধ, পুণেতে যোগ শেখানোর জন্য কৃষ্ণমাচার্য যেন তাঁর কোনও ছাত্রকে পাঠিয়ে দেন।
তিরিশের দশকে পুণে তখন ‘হ্যাপেনিং সিটি’। রেসকোর্স আছে, রয়েছে ডেকান জিমখানা ক্লাব। সদ্য চালু হয়েছে মুম্বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের ট্রেন ‘ডেকান কুইন’। স্বাধীনতা আন্দোলনেরও অন্যতম কেন্দ্র। এই শহর বালগঙ্গাধর তিলকের, এখানেই ইয়েরওয়াড়া জেলে গাঁধীজিকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
‘ডেকান জিমখানা’ ক্লাবে সুন্দরকে নিয়ে গেলেন ডাক্তার গোখলে। তাঁর ইচ্ছে, ক্লাবের সদস্যরা যোগ জানুন। কিন্তু উচ্চবর্গের অভিজাত ক্লাব-সদস্যরা দক্ষিণ ভারতের এক অচেনা তরুণকে জায়গা ছাড়বে কেন? ‘যোগে শরীরের ঠিক কী উপকার হয়? রক্ত চলাচল ভাল হয়? কোষ্ঠকাঠিন্য সাফ হয়?’ এ সব প্রশ্নেই সুন্দরকে টিজ়িং শুরু করলেন তাঁরা।
ডাক্তার গোখলে এ বার মঞ্চে উঠে এলেন, ফিসফিস করে সুন্দরকে বললেন, ‘শরীরের ব্যাপার আমি ভাল জানি। ব্যাখ্যা করাটা আমার হাতে ছেড়ে দাও, তুমি যোগের কসরতগুলি দেখাও।’
ডাক্তার গোখলে সেই সময়েই তাঁর এক রোগীকে পাঠিয়ে দিলেন সুন্দরের কাছে। দিনকর দেওধর। এঁর নামেই এখন ক্রিকেটের দেওধর ট্রফি।
দেওধর ক্রিকেটের মাঠে হাঁটুতে চোট পেয়েছেন, সাহেব ডাক্তার অস্ত্রোপচার করতে চান। তিনি ডাক্তার গোখলের কাছে বিকল্প পরামর্শের জন্য এসেছেন। ডাক্তার গোখলে তাঁকে সুন্দরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কী আশ্চর্য! কয়েক সপ্তাহ সুন্দরের কাছে প্রয়োজনীয় যোগব্যায়াম শেখার পর দেওধর হাঁটু ভাঁজ করতে পারলেন, ক্রিকেট মাঠেও ফিরে এলেন মহা সমারোহে।
ক্রিকেটের সঙ্গে সুন্দরের সম্পর্ক ওতেই শেষ নয়। একুশ শতকে তাঁর কাছে এক দিন হাঁটুর ব্যথার জন্যই হাজির বিখ্যাত এক ক্রিকেটার। সচিন তেন্ডুলকর! তাঁকে সুন্দর ওরফে যোগগুরু বিকেএস আয়েঙ্গারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনিল কুম্বলে। এক বিদেশি পত্রিকা সে সময় আয়েঙ্গারকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনার কাছে তো অটলবিহারী বাজপেয়ী আর সচিন তেন্ডুলকর দু’জনেই হাঁটুর ব্যথায় এসেছিলেন। দু’জনের মধ্যে কে ভাল যোগ করেন?’ কৃষ্ণমাচার্যের ছাত্র ঝটিতি উত্তর দিলেন, ‘কেউ না। দু’জনেই ব্যথা সারানোয় উৎসাহী ছিলেন, যোগশিক্ষায় নয়।’
বেলুর গ্রামের ছেলে সেই চল্লিশের দশক থেকে পাকাপাকি পুণের বাসিন্দা। এ শহর তাঁকে কম তো দেয়নি। এখানেই ডেকান জিমখানা ক্লাবে একাধিক বার তাঁর যোগ প্রদর্শন দেখে গিয়েছেন সরোজিনী নায়ডু, কুবলয়ানন্দ, আঁউন্ধের রাজা। পুণের পাশে ছোট্ট রাজ্য আঁউন্ধ। সেখানকার রাজা শরীরচর্চায় উৎসাহী। তিনিই ‘সূর্য নমস্কার’ ব্যায়ামের স্রষ্টা। মুম্বইয়ে কুবলয়ানন্দ আবার কুস্তির ‘দণ্ড’ এবং ‘সূর্য নমস্কার’ দু’টোই একটু অদলবদল করে নিয়ে এসেছেন তাঁর শারীরশিক্ষায়। এই যোগ দিবসে একটা কথা তাই পরিষ্কার বলা যায়। সূর্য নমস্কার একেবারে নতুন শরীরচর্চা, কোনও সুপ্রাচীন, ট্রাডিশনাল যোগভঙ্গিমা নয়।
১৯৪৮ সালটা পুণের ইতিহাসে বীভৎস। দিল্লিতে গুলিবিদ্ধ মহাত্মা গাঁধী, খুনি পুণের নাথুরাম গডসে। শহরে শুরু হল দাঙ্গা, লুঠতরাজ। সেই সময়েই এখানে হাজির দার্শনিক জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি। সুন্দর তাঁর বক্তৃতা শুনতে গিয়েছেন, আলাপও হয়েছে। তিনি যোগাসন শেখান জেনে জিড্ডু তাঁকে হোটেলে ডেকে নিলেন, ‘এই ভঙ্গিগুলি দেখুন তো!’
সুন্দর বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু এত হাঁপাচ্ছেন কেন?’ কৃষ্ণমূর্তি জানালেন, ‘সকালে এক বার করেছি, এখন আবার। দু’বার করলে হাঁপাব না?’
‘তার মানে, ভুল হচ্ছে,’ সুন্দর হাসলেন, ‘এ বার আমাকে দেখুন।...নিন, এ ভাবে করুন।’
দার্শনিক এ বার আর হাঁপালেন না। তাঁর হোটেলের ঘরে এখন রোজ সকাল ছ’টায় যোগ শেখাতে হাজির হন সুন্দর, দার্শনিক অপেক্ষায় বসে থাকেন। ‘যোগ মানে একটাই। আপনার শরীর ধনুকের ছিলার মতো টানটান, আসন এবং প্রাণায়াম সেখানে তূণীরের তির, লক্ষ্য নিজের ভিতরের আত্মা,’ দার্শনিককে জানিয়েছেন সুন্দর।
ইহুদি মেনুহিন। বিখ্যাত শিল্পীর যোগগুরু ছিলেন বিকেএস আয়েঙ্গার (উপরে মূল ছবি)।
চার বছর পর, ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে দিল্লিতে হাজির বেহালাশিল্পী ইহুদি মেনুহিন। ভারতে তখন দুর্ভিক্ষ, মেনুহিন কয়েকটি শহরে অনুষ্ঠান করে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা তুলে দেবেন। পুরোটাই নেহরুর পরিকল্পনা।
মেনুহিন যোগ-উৎসাহী, জওহরলালও। বেহালাবাদকের সঙ্গে গল্প করতে করতে নেহরু বললেন, ‘শীর্ষাসন জানেন? আমি কিন্তু পারি।’ মেনুহিন বললেন, ‘আমিও জানি।’ ঘটনার শেষাংশটি চমৎকার। দেখা গেল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বিখ্যাত সঙ্গীতসাধক দু’জনেই মাথা নিচু করে, পা উপরে তুলে রয়েছেন।
মেনুহিন চান যোগশিক্ষার এক সঠিক গুরু। নেহরু তখন বিশেষ কারও নাম প্রস্তাব করেননি। মুম্বই থেকে জুবিন মেটার বাবা মেহলি মেটা জানালেন, এখানে বিকেএস আয়েঙ্গার নামে এক জন আছেন। অল্প বয়স, কিন্তু জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তিকে যোগ শিখিয়েছেন। দেখতে পারেন।’
এ দেশের বিভিন্ন স্তরে তখন এ ভাবেই আয়েঙ্গারের নাম ছড়াচ্ছে। পুণেতেই তাঁর বাড়িতে এসেছেন গাঁধীজির সহযোগী জয়প্রকাশ নারায়ণ ও তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী। জয়প্রকাশ সায়াটিকার ব্যথা ও ডায়াবিটিসে ভুগছেন। বিকেএস আয়েঙ্গারের দুই কামরার ছোট্ট ঘরে তখন বসার আসবাবও নেই। জয়প্রকাশকে তিনি বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন। পাশের বাড়ি থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আসি।’
‘একদম না’, জেপি এবং প্রভাবতী দু’জনেই উত্তর দিলেন, ‘আমরা মেঝেতে বসতে অভ্যস্ত।’ ক্রমে সায়াটিকা সেরে গেল, ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে এল, আর শুরু হল দীর্ঘস্থায়ী এক সম্পর্ক। জয়প্রকাশ অতঃপর নিয়মিত যোগ করতেন, ১৯৭৯ সালে মৃত্যুর আগে অবধি বিকেএস আয়েঙ্গারের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল তাঁর।
যোগসাধক: বিকেএস আয়েঙ্গারের যোগ সংক্রান্ত একটি বইয়ের প্রচ্ছদ। ডান দিকে, শীর্ষাসনরত জওহরলাল নেহরু
এই চালচুলোহীন, আসবাবহীন বিকেএস আয়েঙ্গার ১৯৫২ সালের সেই সকালে মহারাষ্ট্রের রাজভবনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মেনুহিন জানিয়েছেন, তিনি বিকেএসের সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না। অগত্যা পাঁচ মিনিটের সাক্ষাতের জন্য পুণে থেকে মুম্বই, চার ঘণ্টার পথ উজিয়ে এসেছেন বিকেএস।
রাজভবন সকালবেলায় নিস্তব্ধ। ইহুদি মেনুহিন বললেন, ‘পাঁচ মিনিট কিন্তু। আমি খুব ক্লান্ত। এই সব পারফরম্যান্সে খুব ধকল যায়।’
বিকেএস দমলেন না, ‘বেশ তো। তা হলে আপনি নিশ্চয়ই ভাল ভাবে বিশ্রাম নিতে চান।’
দু’হাতের আঙুল দিয়ে মেনুহিনকে প্রথমে চোখ বন্ধ করে শবাসনে শুয়ে পড়তে বললেন আয়েঙ্গার। বেহালাবাদকের ঘুম ভাঙল ৪৫ মিনিট পরে। ‘আগেও কয়েক জন গুরুর কাছে শিখেছি, কিন্তু মিস্টার আয়েঙ্গারের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই আমি রোজকার যোগচর্চায় মনোযোগী হই,’ লিখেছিলেন ইহুদি মেনুহিন।
দুই বছর পর মেনুহিনের উদ্যোগেই তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। সুইটজ়ারল্যান্ডের স্তাদ এলাকায় থাকেন মেনুহিন। যোগগুরুকে উপহার দিলেন ওমেগা ঘড়ি, পিছনে খোদাই করা: ‘আমার শ্রেষ্ঠ বেহালাশিক্ষক বিকেএস আয়েঙ্গারকে।’
বেহালাবাদক কী রকম? বিকেএস-এর ছাত্রী নিবেদিতা জোশী এখন দিল্লিতে একটি যোগ-স্টুডিয়ো চালান, ‘আয়েঙ্গার যোগ’-এর এক সফল প্র্যাকটিশনার তিনি। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুরলীমনোহর জোশীর মেয়ে নিবেদিতা এক সময় দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। ‘গুরুদেবের কাছে শিখেই আমি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সক্ষম হই,’ বলেন তিনি। আয়েঙ্গার যোগের আসল বৈশিষ্ট্য কী? ‘অসুস্থতা, দুর্বলতা সত্ত্বেও প্রত্যেকের শরীর ঠিক করে দেওয়া। অনেক সময়েই আসনভঙ্গি ঠিকঠাক করতে পারেন না অনেকে, বেল্ট বা ব্লকের মতো উপকরণ তখন কাজে দেয়।’
সুইটজ়ারল্যান্ডে শুরু। অতঃপর বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, আমেরিকা... সর্বত্রই এর পর ছড়িয়ে পড়েছেন আয়েঙ্গার। দেশেও সম্মান কম আসেনি। ১৯৯১ সালে পদ্মশ্রী, ২০০২-এ পদ্মভূষণ ও ২০১৪-তে পদ্মবিভূষণ। বিজেপি ক্ষমতায় থাকার সময়েই বারংবার রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন বিকেএস আয়েঙ্গার। তাঁর জীবনী ‘এ লাইফ অব লাইট’-এর লেখিকা রশ্মি পালকিওয়ালা জানাচ্ছেন, ‘‘কাকেই বা দেওয়া যেত? অনেকে নিবেদিতা, মুরলীমনোহর জোশীর প্রভাবের কথা বলেন। সে তো যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, পুরস্কারে প্রভাব ফেলে, বাস্তব ঘটনা।’ বলতে বলতে জানালেন, ‘বিজেপি হয়তো নিজের স্বার্থেই ওঁকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু দুনিয়ায় সবাই জানে, বিকেএস আয়েঙ্গার আদৌ হিন্দুত্ববাদী ছিলেন না।’
এখানেই তাঁর গুরুর শিক্ষা। মহীশূরে জামাইবাবু কৃষ্ণমাচার্য ছাত্রদের বলতেন, ‘ধ্যানের সময় নিজের ঈশ্বরের কথা ভাবতে পারছ না? বেশ, মা-বাবার কথা ভাবো।’ তাঁর শিষ্য ও শ্যালক সুন্দররাজা আয়েঙ্গারও সেই পথ ছেড়ে এক চুল সরেননি। বছর নয়েক আগে, ২০১১ সালে যোগ শেখাতে চিন-এ গিয়েছেন। সে দেশ বলে দিয়েছে, হিন্দু ধর্ম-টর্মের কথা বলা যাবে না। যোগ শেখানোর ক্লাসে এসে আয়েঙ্গার বললেন, ‘ধর্মের কথা বলতে আমি আগ্রহী নই। কিন্তু আপনাদের ভারতের এক প্রাচীন ঋষির কথা বলি। পতঞ্জলি।’ যোগধর্ম সর্বজনীন, সেখানে জাতপাত, ধর্মধ্বজীদের বেড়াজাল নেই।
২০ অগস্ট, ২০১৪। পুণের হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বিকেএস আয়েঙ্গার। তখন তাঁর বয়স ৯৫ বছর। হাসপাতালের ঘড়িতে তখন ভোর ৩টে ১৫। এ রকম সময়েই ঘুম থেকে ওঠা তাঁর অভ্যেস। বিকেএস রোজ ভোর চারটেয় বিছানা ছাড়তেন, তার পর এক কাপ ফিল্টার কফি খেয়ে প্রাণায়াম এবং যোগাসন।
অতঃপর তাঁর যোগচর্চা হয়তো পৃথিবীর বাইরে এক অনন্তলোকে। সেখানে আর যা-ই হোক, মহামারি নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy