উদ্বোধনের দিন উপস্থিত (ডান দিক থেকে) সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও সত্যজিৎ রায়।
পশ্চিম বাংলায় দূরদর্শনের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর পূর্ণ হল। পূর্ব ভারতে প্রথম টিভি কলকাতায়। পৃথিবীতে টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুরুর সময় আকাশবাণী কলকাতার ‘বেতারজগৎ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘‘জগতে এমন একটি যন্ত্র এসে গিয়েছে, যাতে একইসঙ্গে কথা শোনা যায়, ছবিও দেখা যায়, তার নাম টেলিভিশন। কলকাতায় টেলিভিশন আসতে আর দেরি নেই, এখন থেকে তরকারি কুটতে কুটতে আঙুরবালার গান শোনা যাবে, আবার তাঁকে দেখাও যাবে।’’ কলকাতায় তখনও টিভি আসেনি। কলকাতার অনেক আগেই ঢাকায় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সূচনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণে ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে কলকাতায় এলেন। কলকাতা ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনা কভার করার জন্যে বাংলাদেশ টিভির ওবি ভ্যান এল। আকাশবাণী থেকে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে আমরা সেই ওবি ভ্যানের ভিতরে ঢুকে টিভির আশ্চর্য কর্মকাণ্ড প্রথম দেখার সুযোগ পাই। কলকাতায় তার বছর চারেক পরে যখন টিভি চালু হল, তখন স্টুডিয়ো প্রোডাকশন প্যানেল ইত্যাদির কাজ শেষ হয়নি। একটি ওবি ভ্যানকে সম্বল করে তার মাধ্যমেই অনুষ্ঠান রেকর্ডিং শুরু হয় এবং ৯ অগস্ট ১৯৭৫ থেকে দু’ঘণ্টার সম্প্রচার আরম্ভ করে দেওয়া হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এখানকার শিল্পীদের সঙ্গে ছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ, হামিদা আতিক প্রমুখ বাংলাদেশের শিল্পীরাও। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের তখনকার ডিরেক্টর জেনারেল জামিল চৌধুরী। রুমা গুহঠাকুরতার নেতৃত্বে ক্যালকাটা কয়্যারের শিল্পীরা উদ্বোধন সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। টিভির পর্দায় প্রথম ভেসে উঠেছিল কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম ঘোষিকা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তর মুখ। ঘোষণার প্রথম বাক্য— নমস্কার, কলকাতা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শুরু হল ব্যান্ড এক, চ্যানেল চারে। ‘টেলিভিশন’ বলা হয়েছিল, কারণ ‘দূরদর্শন’ নামটি এসেছে অনেক পরে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, রাজ্যের তথ্য দফতরের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। টালিগঞ্জের রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো অধিগ্রহণ করে টেলিভিশন সেন্টার তৈরি হয়। টেলিভিশন ছিল আকাশবাণীরই একটি অঙ্গ। তাই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছিলেন আকাশবাণীর তখনকার ডিরেক্টর জেনারেল পি সি চট্টোপাধ্যায়। টেলিভিশন স্বতন্ত্র হওয়ার পর টিভির প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল পি ভি কৃষ্ণমূর্তি।
টেলিভিশন প্রোডিউসার পদে নিয়োগের প্রথম বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হলে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। সাংবাদিক, সম্প্রচারক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী, চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের এত মানুষ চাকরির দরখাস্ত করেন যে, আকাশবাণী ভবনে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার স্থান সঙ্কুলান হয়নি, সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালের প্যারিশ হল ভাড়া নিতে হয়। লিখিত পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেবার জন্যে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে অধ্যাপক, প্রশিক্ষকরা আসেন। এখান থেকে পরিচালক মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার প্রমুখ ছিলেন। চাকরিতে নিয়োগের কথা আমাদের টেলিগ্রাম মারফত জানিয়ে যোগ দিতে বলা হয় সরাসরি পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। আমরা সেখানে টেলিভিশন ফ্যাকাল্টির প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রী হিসেবে যোগ দিই। সত্যজিৎ রায় টিভি ফ্যাকাল্টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তখন ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পরিচালন সমিতির সভায় যোগ দিতে এসে মৃণাল সেন উপস্থিত ছিলেন, আর ঋত্বিক ঘটক ওখানেই তাঁর অধ্যাপনা জীবন শেষ করছেন। ঘটনাক্রমে আমরা একই সঙ্গে এই প্রবাদপ্রতিম পরিচালকদের পাই। কলকাতায় ফিরে আমরা পরম উৎসাহে ওবি ভ্যানের মাধ্যমেই অনুষ্ঠান রেকর্ডিং শুরু করে দিই। কলকাতার দর্শকদের কথা ভেবে আমি ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’ নামে একটি অনুষ্ঠান শুরু করার প্রস্তাব দিই। লক্ষ্য ছিল, সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের ব্যক্তিত্বদের অডিও ভিস্যুয়ালি ধরে রাখা। এই অনুষ্ঠান নিয়মিত সংযোজনা করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শিল্পজগৎ থেকে এসেছেন এম এফ হুসেন, বিকাশ ভট্টাচার্য, পরিতোষ সেন, রামকিঙ্কর বেইজ। শঙ্খ ঘোষের স্ক্রিপ্ট অবলম্বনে একটি অনুষ্ঠান দেখে প্রশংসা করে এক বার সত্যজিৎ রায় বললেন, “কিন্তু তোমাদের ক্যামেরা এত কাঁপে কেন!” আমাদের ক্যামেরার স্ট্যান্ড নেই জেনে তিনি বলেছিলেন, “তবে তো হয়েই গেল!”
খুব সামান্য যন্ত্রপাতি আর একটিমাত্র ছোট স্টুডিয়ো ফ্লোর নিয়ে যাত্রা শুরু। সারা দিন রেকর্ডিং আর সন্ধেবেলা ট্রান্সমিশন, ঘোষণা, সংবাদ পাঠ, সব কিছু। কবি অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ আমাদের অসামান্য সব স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় থেকে, সারা রাত ধরে এডিটিং-এ বসে, অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে সাহায্য করেছেন। তাঁর চলচ্চিত্রবোধ কত গভীর, তা জানবার সুযোগ হয়েছে আমাদের। শঙ্খদার স্ক্রিপ্ট অবলম্বনে ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন’, ‘জন্মদিনের ধারা’, ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে পৃথিবীর প্রথম তথ্যচিত্র ‘রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে’-র মতো নির্মাণে তাঁর কাছে শিখেছি— কেমন ভাবে গভীর বিষয়কে কেন্দ্র করে নান্দনিক অনুষ্ঠান করতে হয়।
প্রথম থেকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল দর্শকদের। প্রথম থেকে টানা দশ বছর আমি ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠানে দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করেছি। দর্শকদের প্রতিটি প্রস্তাব ও অনুরোধকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতাম এবং বর্ষপূর্তিতে তালিকা প্রকাশ করতাম, দর্শকদের কোন কোন অনুরোধ বা প্রস্তাব আমরা মেনে নিতে পেরেছি। তাই দর্শকরাও মনে করতেন এ তাঁদের নিজস্ব মাধ্যম। সেই সাদা-কালো টেলিভিশনের যুগে ৯ অগস্ট আমাদের সূচনার দিনটিতে দর্শকরা ফুল, কেক নিয়ে আসতেন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। প্রথম বর্ষপূর্তিতে আমাদের ট্রান্সমিশনে সংবাদ ছাড়া কেবল বিশেষ ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠানই ছিল দর্শকদের অংশগ্রহণের মাধ্যম। ‘কলকাতায় টেলিভিশন’ বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দর্শকদের মনোনয়ন করা হয়েছিল। সেই রচনাগুলি বিচার করেছিলেন বাইরের অধ্যাপক এবং সাংবাদিকরা। পত্রলিখিয়ে, সেরা প্রস্তাবকদের পুরস্কার দেওয়া হয়। লাইভ অনুষ্ঠানে দর্শক সমাবেশের ছবি এঁকেছিলেন শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা কাজ করতে গিয়ে যে সব ভুল করি, তা নিয়ে ‘টিভিভিটি’ নামে নিজেদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেও একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম।
নবাগত অবস্থায় একটু একটু করে আমাদের পায়ের নীচে মাটি পেতে হয়েছে। মনে পড়ছে, রাজ্যের নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রথম ক্ষমতায় এসেছে। জ্যোতি বসুকে কোথাও পাচ্ছি না, জ্যোতিবাবুর বন্ধু স্নেহাংশু আচার্য আমাকে বললেন, “তুই ওর বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা কর, জ্যোতি ওর শ্যালিকার বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেছে।” অনেক রাতে বাড়ি ফিরে আমাকে সেখানে দেখে জ্যোতিবাবু বিস্মিত, আর আমার জোড়হাত অনুরোধ, “কাল আপনাকে প্রথম ইন্টারভিউটা টেলিভিশনকে দিতে হবে, কাল আর কোনও মাধ্যমকে আপনি দয়া করে ইন্টারভিউ দেবেন না!” জ্যোতিবাবুর প্রতিক্রিয়া, “সে কী!” নাছোড়বান্দা আমার খুলে বলা, “আপনি যদি আর কোনও মাধ্যমকে ইন্টারভিউ না দেন, তা হলে পরের দিন সবাইকে লিখতে হবে বা বলতে হবে যে, আপনি কলকাতা টেলিভিশনকে এ সব কথা বলেছেন। আমরা নতুন, আমাদের কোনও জায়গা নেই, এই সূত্রে আমাদের একটু গুরুত্ব আসবে।” জ্যোতিবাবু তাঁর সেই বিখ্যাত না-হাসি হেসেছিলেন, কিন্তু আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। পরের দিন সব মাধ্যমকেই ‘টেলিভিশনে বলেছেন’ বলে উল্লেখ করতে হয়েছিল। ওইটুকুতেই আমাদের যে কত আনন্দ!
অনেক সামাজিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল দূরদর্শন। ১৯৭৮ সালের বন্যায় সারা পশ্চিমবঙ্গের বন্যাদুর্গত মানুষের কথা এক মাস ধরে তুলে ধরেছিলাম। কোথাও বুকজল কিংবা গলাজল সরিয়ে, কোথাও বা মৃত গরু এমনকি মানুষের মৃতদেহ ঠেলে বন্যাদুর্গত মানুষদের কাছে আমাকে পৌঁছতে হয়েছিল। হিংলো বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে গিয়েছিল। আমরা সেই অঞ্চলে ঢুকে ছবিতে দেখিয়েছিলাম, গাছের মাথায় শাড়ি কিংবা ধুতি আটকে আছে। বন্যার জল উঠেছিল অত উঁচুতে। সেই সব নারী-পুরুষ ভেসে চলে গিয়েছেন, তাঁদের পোশাক আটকে থেকে গিয়েছে। বাঁধ খুলে না রেখে কর্মীরা পিকনিক করতে যাওয়ায় এই দুর্দশা। অনুষ্ঠান প্রচারের পর হিংলো বাঁধ প্রকল্পের চেয়ারম্যানের চাকরি যায়।
সূচনা: কলকাতা দূরদর্শন ভবন।
কলকাতা শহরকে আমরা একটা প্রতিষ্ঠাদিবস দিয়েছিলাম। ২৪ অগস্ট। টিভি অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সমালোচক নিত্যপ্রিয় ঘোষ লিখেছিলেন, ‘‘আমরা বিতর্ক তুলতে পারছি না, কারণ একই সঙ্গে বিনয় ঘোষ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, রাধারমণ মিত্র প্রমুখ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে দিনটির কথা বলছেন, তাঁরা তো সবাই কলকাতা শহর নিয়ে গবেষণা করেন।’’ পরে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার হাইকোর্টে মামলা করেন কলকাতার প্রতিষ্ঠা দিবসের বিরুদ্ধে। কোর্টে রায়ের এই উদ্যাপন বন্ধ হয়।
বাংলা নববর্ষের দিনে ‘নববর্ষের বৈঠক’ অনুষ্ঠান নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি নববর্ষকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে তুলে ধরা। এক-এক বছর এক-একটি বিষয়কে রাখা হয়েছে এই অনুষ্ঠানে, যেমন: বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা, বাঙালির চলচ্চিত্র সৃষ্টি, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের শতবর্ষ। অনুষ্ঠানটির ফরম্যাটও বাছা হয়েছিল বাঙালির প্রিয় আড্ডার ধরনে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেল নববর্ষে অনুষ্ঠান করেছে ওই আড্ডার ফরম্যাটেই। দুর্গাপুজোর চার দিনেও ওই নববর্ষের বৈঠকের ধরন ও মেজাজে অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। রাজনৈতিক বিতর্ক কিংবা মহালয়ার অনুষ্ঠানেও দূরদর্শনের প্রবর্তিত ফরম্যাট বেসরকারি চ্যানেলগুলো গ্রহণ করেছে। স্বাভাবিক। কারণ দূরদর্শন এখানকার প্রথম টিভি চ্যানেল। দীর্ঘ দিন আর কোনও চ্যানেল ছিল না। ফলে কলকাতার টেলি-সংস্কৃতির জন্মই হয়েছে কলকাতায় দূরদর্শনের মাধ্যমে।
সংবাদপত্রের সুবিধে হল, প্রতিদিনের কাগজ ফাইলে থেকে যায়। কিন্তু আমরা সারা জীবন যেন হাওয়ায় ছবি এঁকেছি, হাওয়ায় কথা বলেছি। কিছুই থাকেনি। ৪৫ বছরের সব কিছু যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। সংরক্ষণের ভাবনা প্রথম থেকেই ছিল না। টেকনিক্যাল ফরম্যাট অনবরত বদলেছে এবং পুরনো ফরম্যাটগুলো বাঁচিয়ে রাখার কোনও চেষ্টা আমাদের দেশে হয়নি। কিন্তু আমি সুইডিশ টেলিভিশনের স্টুডিয়োয় দেখেছি লো ব্যান্ড, হাই ব্যান্ড থেকে শুরু করে সব ফরম্যাটকে তারা সজীব রেখেছে এবং প্রয়োজন মতো পুরনো ফরম্যাটের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ব্যবস্থাও রয়েছে।
বেসরকারি চ্যানেলের প্রভাব এবং দাপটের সামনে দূরদর্শন দাঁড়াতে পারল না, এটাই জনপ্রিয় বিশ্বাস। আমি বিশ্বাস করি, দূরদর্শনের কর্মীদের মধ্যে প্রতিভার এবং উদ্যোগের কোনও অভাব নেই। দূরদর্শনের মতো পরিকাঠামোর সুবিধেও বেসরকারি চ্যানেলগুলোর নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণ এবং তার যথাযথ প্রয়োগের অভাবই দূরদর্শনের কাছ থেকে দর্শকদের সরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমি আশাবাদী। দূরদর্শন এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারে, দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনে কলকাতা দূরদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সময়ের ও জীবনের ইতিহাস দূরদর্শনকে বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়।
যে লক্ষ্য নিয়ে প্রসারভারতী তৈরি হয়েছিল, তা অল্প দিনের মধ্যেই আর মনে রাখা হয়নি। কোনও রাজনৈতিক দলই যেন দূরদর্শনকে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা দিতে রাজি নয়। কিন্তু সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ছাড়া দূরদর্শন এই প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আশির দশকের মাঝামাঝি আমি বিবিসি লন্ডনের প্রযোজকের চাকরি নিয়ে ব্রিটেনে গিয়েছিলাম। সেখানে বিবিসি-র সমস্ত ব্যয়ভার ব্রিটিশ সরকার বহন করে, কিন্তু সম্পাদকীয় স্বাধীনতা পুরোটাই বিবিসির হাতে। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার বিবিসির একটি তথ্যচিত্র প্রচারের আগে দেখতে চান, কারণ ছবিটির বিষয় নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড। বিবিসি জানায়, ‘‘আমাদের পলিসি আমাদের প্রযোজকরা জানেন, তাই সেটি আগে দেখে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তা সত্ত্বেও যখন মিসেস থ্যাচার দেখতে চান, তা হলে মিসেস থ্যাচারকে বিবিসির স্টাফ হিসেবে জয়েন করতে হবে। কারণ, বিবিসির স্টাফরা ছাড়া অন্য কেউ বিবিসির অনুষ্ঠান প্রচারের আগে দেখতে পারেন না।’’ সে দিন গভীর রাতে পুলিশ এসে তথ্যচিত্রের ক্যানগুলো তুলে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে কর্মীরা মিলে ধর্মঘট করি। সমগ্র ব্রিটেন তথা ইউরোপের সমস্ত মাধ্যম আমাদের সমর্থনে ধর্মঘটে শামিল হয়। সমগ্র পাশ্চাত্য জগতের বিভিন্ন সংবাদ ও সম্প্রচার মাধ্যম আমাদের সমর্থনে ধর্মঘট শুরু করে। মিসেস থ্যাচার বাধ্য হন ফিল্মের ক্যানগুলো ফেরত দিতে। তাঁকে না দেখিয়েই শেষ অবধি ফিল্মটি সম্প্রচারিত হয়।
দূরদর্শনের মতো ঐতিহ্যপূর্ণ মাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আগামী প্রজন্মকে নতুন করে প্রাণ সঞ্চারের পথ খুঁজতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy