Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
Sanjay Bhattacharya

আপনার হাতে কবিতা দিয়ে খুব আশ্বস্ত বোধ করি

জীবনানন্দ দাশ যাঁকে এ কথা বলেছিলেন, তিনি লেখক ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। কুমিল্লার এক চায়ের ঠেক থেকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকা। পরে ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘কল্লোল যুগ’, ‘গড় শ্রীখণ্ড’। তখনকার বহু লেখকের একান্ত আশ্রয় ছিলেন তিনি। সাহিত্যচর্চা থেকে ‘মডেল ফার্মিং’— সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রতিটি কাজের মূল প্রেরণা ছিল স্বাবলম্বী মানুষ।

ব্যতিক্রমী: সঞ্জয় ভট্টাচার্য

ব্যতিক্রমী: সঞ্জয় ভট্টাচার্য

জ্যোতিপ্রসাদ রায়
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২০ ০০:৫৬
Share: Save:

গত শতকের ষাটের দশকে (১৯৬৮) মৃত্যুর কয়েক মাস আগে সদ্যবিবাহিতা জ্যোৎস্না গুহ রায়কে বলেছিলেন, ‘‘শোনো মেয়ে, ভূমেনটা খুব বোকা, লিখবার কথা ছিল লিখল না। ওকে আশ্রয় দেবে, স্থিরতা দেবে, বুঝলে।...’’ তাঁর কথাগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছিল সংবেদনশীল এক অভিভাবকের মন। বক্তা, ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। তিনি মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য বার বার শান্তির সংসার থেকে উপস্থিত হয়েছেন অনিশ্চিত সীমান্তে। তবে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাপে অস্থির হলেও কখনও লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি সাহিত্যসেবী মানুষটি। সাহিত্যচর্চা থেকে ‘মডেল ফার্মিং’— সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রতিটি কাজের মূল প্রেরণা ছিল স্বাবলম্বী মানুষ। লক্ষ্য ছিল, সাধারণের সুপ্ত শক্তিকে উসকে দেওয়া। মানুষকে মুক্ত চিন্তার শরিক করে তোলা।

সঞ্জয় ভট্টাচার্য নামটি উচ্চারণ করলে আমাদের তিনটি বিষয় মনে পড়ে। এক, ‘পূর্ব্বাশা’ (বৈশাখ, ১৩৩৯) পত্রিকার সম্পাদক, দুই, কবি, সাহিত্যিক এবং তিন, মানসিক অবসাদগ্রস্ত এক শিক্ষিত সহৃদয় ব্যক্তি, যিনি নিজে হাতে পায়েস রেঁধে প্রিয়জনদের খাওয়াতে ভালবাসতেন। তিরিশের দশকের শুরুতে বন্ধ হয়ে গেল ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘প্রগতি’-র মতো সাময়িক পত্রিকা। সে সময় বাঙালি যুবসমাজের মনের কথা প্রকাশের উদ্দেশ্যে কুমিল্লার অখ্যাত চায়ের ঠেক ‘লক্ষ্মী কেবিন’ থেকে প্রকাশিত হল ‘পূর্ব্বাশা’। যেখানে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃিতর সঙ্গে আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকার চিন্তা-ভাবনার সমন্বয় সাধন সম্ভব হবে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অজয় ভট্টাচার্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, অজিত গুহ, নারায়ণ চৌধুরী, অনিল চক্রবর্তী প্রমুখ তরুণদের উৎসাহ আর ইচ্ছাশক্তিই ছিল ‘পূর্ব্বাশা’-র প্রাথমিক প্রেরণা। সে দিন তাঁদের কিছুটা বিজ্ঞাপনের ছকে অর্থসাহায্য করেছিলেন স্বদেশি শিল্পোদ্যোগী ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত ও ইন্দুভূষণ দত্ত।

আধুনিক সাহিত্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় যেমন ‘পূর্ব্বাশা’ মুক্ত চিন্তার উপর জোর দিয়েছিল, তেমনই সন্ধান করেছিল নতুন লেখকের। তাই লেখার জোরে তরুণ প্রজন্মের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল ‘পূর্ব্বাশা’। উত্তরকালের লেখক থেকে পাঠক— শঙ্খ ঘোষ থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী— প্রত্যেকেই এই সাময়িকপত্রে পেলেন সমকালীন মানসিকতার খোরাক। ‘পূর্ব্বাশা’য় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল: ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘কল্লোল যুগ’, ‘গড় শ্রীখণ্ড’-এর মতো বহু কালজয়ী সৃষ্টি। বাংলা ভাষায় লেখালিখি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই প্রকাশনা থেকে ‘অণিমা-সিরিজ়’-এ অনূদিত হয়ে একে একে বেরিয়েছে তারাশঙ্করের ‘দ্য ইটারনাল লোটাস’ (রাইকমল), মানিকের ‘দ্য বোটম্যান অব পদ্মা’ (পদ্মানদীর মাঝি), ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ (বাংলা ছোটগল্প সংগ্রহ) ইত্যাদি। চট্টগ্রাম থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে কলকাতায় ডেকে এনে ছেপেছিলেন ‘নয়নচারা’ গল্পগ্রন্থ। বিস্মিত ওয়ালীউল্লাহ যখন বলেন, ‘আমি তো তেমন বিখ্যাত নই... আমার বই আপনারা করবেন কেন?’ উত্তরে সঞ্জয় বলেছেন, ‘নয়নচারা প্রতিশ্রুতিময় ভালো সাহিত্য বিবেচনা করেছি বলে প্রকাশ করতে চেয়েছি।’ ধীর-স্থির, আত্মপ্রত্যয়ী এবং অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির জোরে সঞ্জয় ভট্টাচার্য হয়ে উঠেছিলেন সমকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি।

‘পূর্ব্বাশা’-র প্রথম বর্ষের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদ।

শুধু সাহিত্যচর্চা করে মানুষের কল্যাণ-সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। সঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে করতেন, সাধারণ মানুষ যত ক্ষণ না জীবন ও জীবিকায় স্বনির্ভর হয়ে উঠছে, তত ক্ষণ সমাজের ভিত শক্ত হবে না। তাই বন্ধু সত্যপ্রসন্ন দত্ত আর সমমনস্ক জ্যোতিপ্রভা দাশগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে অবিভক্ত বঙ্গের যশোর জেলার বসতপুরে একশো বিঘারও বেশি জমিতে গড়ে তুললেন ‘পূর্ব্বাশা মডেল ফার্ম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড’ (১৯৪৩)। এখানে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের পর দেওয়া হল ঠোঙা তৈরি, কাঁথা সেলাই, বই বাঁধাই, কৃষি সংক্রান্ত কাজ। সমাজের নিচু তলা থেকে মানুষকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন পূর্ব্বাশা লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সত্যপ্রসন্ন দত্ত এবং ডিরেক্টর সঞ্জয় ভট্টাচার্য। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মানুষ যে দিন নিজের শ্রমে রুটি-রুজি জোগাড় করতে পারবে, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা অন্যায় শাসন ও শোষণের আসল চেহারাটা চিনতে পারবে, সে দিন তারা অনুভব করবে মুক্তির স্বাদ।

‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকার স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর আক্ষেপ, ‘পূর্ব্বাশা-চতুরঙ্গের যুগ লেখার মতো একজন লেখকও পাওয়া গেল না বলেই সেই উজ্জ্বল সাহিত্যযুগ অপরিচিত রয়ে গেল এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মত সুদক্ষ সম্পাদকও অজ্ঞাতই রয়ে গেলেন।’ এই কথার ধার বুঝতে হলে জীবনানন্দকেন্দ্রিক গল্প শোনা যাক, যিনি মনে করতেন, ‘...আমার মনে হয় আমাদের দেশে আপনি একমাত্র খাঁটি ভাবুক ও সমালোচক যিনি ধূ.পা. (ধূসর পাণ্ডুলিপি) থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত আমার সমস্ত কাব্যের দোষগুণ ঠিক ভাবে বুঝতে পারেন; আপনার হাতে কবিতাগুলো ছেড়ে দিয়ে আমি খুব আশ্বস্ত বোধ করি।’ (সঞ্জয়কে লেখা জীবনানন্দের পত্র, ১৯৫২)। তার আগে ১৯৪৪-এ ‘পূর্ব্বাশা’ থেকে ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশের পর বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তাঁর জীবনানন্দ-পাঠের অনীহার কথা সরাসরি প্রকাশ করলেন (১৯৪৬)। জীবিতকালে জীবনানন্দ ‘পূর্ব্বাশা’ ছাড়া কোথাও যোগ্য মর্যাদা পাননি বলে সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে আক্ষেপ করেছেন। ‘পূর্ব্বাশা’র দফতরে উপস্থিত হয়ে সঞ্জয়ের কাছে তিনি মেলে ধরেছেন কবিমনে জমে থাকা দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা। তাঁর মনখারাপের কুয়াশা কাটাতে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। ‘পূর্ব্বাশা’-র সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য মনে করতেন, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতাকে যিনি বিশ্বমানে উত্তীর্ণ করেছেন, তিনি জীবনানন্দ দাশ। কোনও শর্ত ছাড়াই হৃদয়ের লেনদেনে যে মহাপৃথিবী তৈরী হতে পারে, তার উজ্জ্বল উদাহরণ জীবনানন্দ দাশ ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মধ্যে গড়ে ওঠা শ্রদ্ধা ও প্রীতির বন্ধন।

উঠতি লেখক মানিকবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অসময়ে, স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাঁর প্রথাভাঙা সৃজনীসত্তাকে। অনেক সম্পাদক-প্রকাশকের কাছ থেকে ফেরত আসা মানিকবাবুর ‘পদ্মানদীর মাঝি’ কিস্তিতে কিস্তিতে ‘পূর্ব্বাশা’য় ছাপিয়েছিলেন সঞ্জয়, যখন বইপাড়ার কেষ্টবিষ্টুরা তাঁর মুখের উপর বলেছিলেন, ‘সময় হলে আপনার বাড়ি গিয়ে বই নিয়ে আসব’। বিপদের দিনে ‘পূর্ব্বাশা’র সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের তারিফ ও সাহায্য পেয়ে বিমর্ষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভিতর থেকে ঝলসে উঠেছিলেন, ‘আমি লিখব— দেখবেন লিখব!’

এ ভাবেই ‘পূর্ব্বাশা’ সম্পাদক, যখন যেখানে যাঁর মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ভাব-সম্পদ লক্ষ করেছিলেন, তাঁকেই যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও বরণ করে নিয়েছিলেন। ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনামী কিন্তু প্রতিভাধর কবি-লেখকদের একান্ত আপনজন। তাই ‘পূর্ব্বাশা’ প্রকাশনা থেকে ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশের পর আমৃত্যু, যে কোনও দুশ্চিন্তায়, বিপদে-বিঘ্নে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ছিলেন জীবনানন্দের পরম আশ্রয়। অর্থকষ্ট বা সম্মানহানির দুশ্চিন্তায়, কখনও বা ভাড়াটের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জীবনানন্দ একাধিক বার দ্বারস্থ হয়েছেন পি-১৩/৫৪ গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের ঠিকানায়।

শত ঝড়-বাদলেও ছায়ায়-মায়ায় যেমন মানিক-জীবনানন্দ-অমিয়ভূষণ-সন্তোষকুমার প্রমুখ উত্তরকালের বাংলা সাহিত্যের কৃতীদের লালন করেছিলেন অভিভাবক সঞ্জয় ভট্টাচার্য, তেমনই সৃজনের ধারা অব্যাহত রাখতে উত্তরসূরির কাছে মিনতি করতেও দ্বিধা করেননি অকৃতদার জীবন-প্রেমিক সঞ্জয় ভট্টাচার্য: ‘শোনো মেয়ে (জ্যোৎস্না), ভূমেনটা খুব বোকা...ওকে আশ্রয় দেবে, স্থিরতা দেবে, বুঝলে। মেয়েরা চাইলে পুরুষ মানুষকে স্বর্গ পাইয়ে দিতে পারে; দিয়ো।’ এ ভাবেই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে পূর্ব্বাশা’র দিগন্তে চিরভাস্বর হয়ে আছেন ব্যতিক্রমী এই সম্পাদক-লেখক।

তথ্য ঋণ : ভূমেন্দ্র গুহ, সত্যপ্রিয় ঘোষ

অন্য বিষয়গুলি:

Sanjay Bhattacharya Poet Writer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy