বরিশালের ‘পিছারার খালের’ পাড়ে রেন্ট্রিগাছের নীচে বিজয়া দশমীর মেলায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মিলেমিশে ছোরাখেলা, লাঠিখেলা ছিল নজর কাড়ার মতো। ইয়েদালি চাচার বাড়ি থেকে ইদের দিনে আসা ছোট শাড়ি, কাঁচা মাছ-মাংস, সিমুই, পাটালি গুড় আনন্দ করে নিত দয়াময়ী। পুজো কাটিয়ে নিলু যখন দ্বাদশীর বিকেলে শেষ বারের মতো চলে আসছিল, হারুন নদীর পাড় থেকে চেঁচিয়ে বলেছিল, “আবার আসিস নিলাই, সামনের বার, আসবি তো?” এই রকমই যূথবদ্ধ জীবনের বড় পরিসর আর দুর্নিবার ভৌমটান নানা অনুভবে ফিরে ফিরে আসে স্মৃতির পাতায়। নিবিড় আত্মীয়তা, উৎসবমুখরতা, পারস্পরিক সহযোগ, সব মিলিয়ে এক জমজমাট জীবন। দাঙ্গা দেশভাগ ক্ষমতার আস্ফালন পেরিয়েও সে সব স্মৃতিকথা ফেলে আসা সুখ-দুঃখের সাক্ষ্য বহন করে। পদ্মা নদীর পাড়, খালবিল ও তার আশপাশই ছিল শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিকাহিনির নায়ক নিলুর বিচরণক্ষেত্র। কাহিনিতে উঠে আসে পদ্মাপারের ফেলে আসা দিনগুলির কথা। যেখানে সকালবেলার আলো এসে পদ্মার পাড়ে বিছিয়ে দিত ‘হাজার দুয়ারী ভালোবাসা’, সেখানে কেশব-বরুণ-হারুনদের সঙ্গে নিলু শৈশব কাটিয়েছিল। সেই বেঁধে-বেঁধে থাকার শক্ত গ্রন্থি ছিন্ন হল এক দিন। রাজনীতির পাশাখেলায় বিপর্যস্ত হল শান্তির সাবেকি জীবন। ‘সুপুরিবনের সারি’ ক্রমশ দূরে মিলিয়ে গেল। তবু সে দেশ নিয়ে আবেগ আমৃত্যু বজায় ছিল তাঁর।
এখনও মাঝে মাঝে এ পারের মধ্যরাঢ়ের যবগ্রাম ও পারের কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে টানে। নিলুর মতো তাঁর আইজুলও দেশভাগের বেশ কয়েক বছর পর এ পারের বর্ধমান জেলার এক ক্ষুদ্র জনপদ ছেড়ে চলে যায়। তখন তারও মনে হয়েছে শৈশবের এই বিচরণক্ষেত্র, মাঠ-ঘাট, অলিগলি, দাশু পাঠকের পাঠশালা, নন্দীদের খামারবাড়ি, কুদু কিবরিয়ার পাগল-করা মহরমের নাচ, পাশের ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যার মেলা, নিগন রেল স্টেশন, বর্ধমানের বহিলাপাড়ার সেই একতলা বাড়ি... সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? এ সব এখন অন্য দেশের?
কীর্তিপাশার পৈতৃক ভিটে ছেড়ে আসার সময় একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর। ১৯৪৮ সালে শেষ বারের মতো সাতপুরুষের বাস্তুভিটায় প্রণাম জানিয়ে যখন ফিরে আসছেন, তখন ‘বুক ফেটে কান্না আসছিল’। অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্ররা খানিকটা অভিমানবশতই এ পারে আসতে চাননি। তাঁর মনে হয়েছে, যে দল সংযুক্ত বাংলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল, সেই দল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের নেতৃ্ত্ব দেবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তার চেয়ে পাকিস্তানের বিশ্বস্ত নাগরিক হব। উভয় সম্প্রদায় মিলে নতুন দেশ গঠনের কাজে শামিল হব। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মিলিত ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়ায়, পুলিশের কুনজরে পড়ে এ পারে আসতে বাধ্য হন। দলিত নমশূদ্র সম্প্রদায়ের নেতা যোগেন মণ্ডলও মনে করতেন, যে জমিদার সম্প্রদায়ের হাত থেকে এক দিন মুক্তি চেয়েছি, তাদেরই প্রতিনিধিত্বকারী দল ভারত শাসন করবে, সেখানে গিয়ে কী লাভ। একদা পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী, আম্বেডকর-ঘনিষ্ঠ এই নেতার ও দেশ সম্পর্কে ভীষণ রকম মোহভঙ্গ হলে এ পারে চলে আসেন। আর এক জন মানুষ ভগ্ন হৃদয়ে এ পার ছাড়েন, তিনি মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাসিম। গাঁধীমৃত্যুর ঠিক পরেই তাঁদের বর্ধমানের বাড়ি আক্রান্ত হলে তাঁরাও ও পারে চলে যান। মিহির সেনগুপ্তের স্মৃতিকথা ‘বিষাদবৃক্ষ’-র প্রেক্ষাপট বরিশালের এক বড় জলপথ, পিছারার খাল। এই পিছারার খাল অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। সেখানকার উৎসব, শীতলা, মনসা বা কালীখোলায় মায়ের গলায় রামপ্রসাদী গান, কীর্তন, বুড়ি পিসিমার ব্রতকথা, ছোটবেলার বন্ধুদের কথা সব স্মৃতিপটে ভিড় করে আসে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ সব বিষয়ে অনেকটা নিরাবেগ। মুক্তিযুদ্ধপর্বে ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে আনন্দবাজারের স্থানীয় দফতর খোলা হয়। কাজের অবসরে রাতের দিকে খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হয়, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের তাগিদে “মানুষ তো বাসস্থান বদলাতেই পারে। মাদারিপুরের সেই গ্রামের বাড়ির তুলনায় কলকাতায় তো তেমন খারাপ অবস্থায় নেই। প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হলেও যে নাগরিক উপভোগ পেয়েছি তা কী কম আকর্ষণীয়? দেশ কি একটা ধোঁয়াটে আবেগময় ধারণামাত্র নয়?”
শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন ঢাকার খলিলুর রহমানের কথা। তিনি ছোটবেলায় পড়তেন ময়মনসিংহের নান্দিনায়। পরে পাক সরকারের সেনাবিভাগের কর্তা হলেও তাঁর মন পড়ে থাকে গ্রাম, গ্রামের স্কুল, স্কুলের প্রিয় সর্বোপরি হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধ বাধলে হেডমাস্টারকে আর সে দেশে ধরে রাখা যায়নি। এ পারে ফিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন বর্ধমানের এক গ্রামে। খলিলুর রহমান মাঝে মাঝেই চলে আসতেন বর্ধমানে সেই মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলবেন বলে। শেষ এসেছিলেন কয়েক বছর আগে, অসুস্থ শরীর নিয়ে। মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বর্ধমানের সেই গ্রামে শ্রাদ্ধতর্পণ করার জন্য।
এই রকমই সুনন্দা শিকদার তাঁর ‘দয়াময়ীর কথা’য় দিঘপাইত গ্রামের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সুখ-দুঃখের কথা আমাদের জানিয়েছেন। কুচবিহারের তোর্সা নদীতট থেকে সম্পত্তি বিনিময়ের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের এই দিঘপাইত গ্রামে দয়াদের পাশেই ওঠেন সামসের চাচারা। তাঁরাও শরণার্থী, স্থানীয় ভাষায় ‘রিপুচি’। এই সামসেরচাচা বাড়িতে মুরগি পুষতেন না, পাছে পাশের হিন্দু পরিবারের অসুবিধে হয়। ছোটবেলায় দয়াকে কোলে-পিঠে করে বড় করে তুলেছিল যে মুসলমান ভাগচাষি, সেই মাজমদাদা, যাকে দয়া ‘দাদা’ বলেই ডাকত, সেই দাদাকে ছেড়ে এক দিনও থাকতে হবে ভাবতে পারেনি। দয়ারা ও দেশ থেকে চলে এলে দাদারও মন পড়ে থাকত এ পারে বোনের জন্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর দাদা চিঠি লিখেছিল, ‘আমরা বাঁচিয়া আছি, পথের খরচ জুটাইতে পারিলে একবার তোমার মুখখানি দেখিয়া আসিব।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছর পর হালের দুটো গরু বিক্রি করে এ পারে বোনকে দেখতে এসেছেন দাদা।
ও পারে কিশোরগঞ্জ শহরের হিন্দুদের কাছে দেবব্রত বিশ্বাস ম্লেচ্ছ বলে বিবেচিত হতেন এক সময়। কারণ তাঁরা পারিবারিক ভাবে ব্রাহ্মধর্মভুক্ত। স্কুলে তাঁর সঙ্গে হিন্দু ছেলেরা এক বেঞ্চে বসত না। এই হিন্দুসমাজে এক সময় রবিঠাকুরের গান ব্রাত্য ছিল। তাঁরই এক সহপাঠী ছিলেন, তিনি ব্রাহ্ম নন, নাম বিনোদ চৌধুরী। স্বনামধন্য নীরদ সি চৌধুরীর অনুজ। সেই বিনোদ চৌধুরীর মা বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন বলে হিন্দু পড়শিরা তাঁর বেশ নিন্দেই করতেন। সেই বাড়ির সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্ক ছিল। এ পারেও তেমনই কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল হাসান আজিজুল হকের। আজিজুলদের বাড়িতে পেটভাতের গৃহশিক্ষক ওস্তাদজি থাকলেও তাঁর পিতা চাইতেন ছেলে গাঁয়ের রণমাস্টারের পাঠশালাতেই পড়ুক। কারণ গৃহশিক্ষক ওস্তাদজি বাংলার সঙ্গে উর্দুও পড়াতেন। বাবা চাইতেন, ছেলের প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষাতেই হোক। আজিজুল বরাবরই মেধাবী। পাঠশালার পণ্ডিতমশাই তাকে খুবই স্নেহ করতেন। কিন্তু পণ্ডিতমশাই যখন ক্লাসে পেনসিল চাইলে আইজুল যখন তার ছোট হাতে পেনসিল বাড়িয়ে দিত আনন্দের সঙ্গে, সে পেনসিল তিনি ছুঁতেন না। হিন্দু ছেলেদের কাছ থেকে নিতেন, কারণ ওই পেনসিল সে হয়তো মুখে ছুঁইয়ে ফেলেছে কখনও। খুব কষ্ট পেত আইজুল।
অবিভক্ত ভারতে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে পরস্পরনির্ভর অর্থনীতি স্থাপিত হয়েছিল কৃষিকে কেন্দ্র করে। অধিকারের প্রশ্নেও যৌথ ভাবে লড়াই করেছেন তাঁরা। তাই তো দাঙ্গার মরসুমেও তাঁরা তেভাগার জন্য লড়েছেন। রংপুরের তেভাগা আন্দোলনে পরেশ মজুমদারের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন আব্দুল মোকসেদ। দিনাজপুরের খেতমজুর সমিরুদ্দিনকে পুলিশ হত্যা করলে তির-ধনুকে তার প্রতিশোধ নিয়েছেন শিবরাম মাঝি। পরে শিবরামও শহিদ হন। এই সময় হেমাঙ্গ বিশ্বাস গান বাঁধেন, ‘কত শিবরাম সমিরুদ্দিন মরল দেশের তরে... তারা নিজে মরে মরার দেশে আনল প্রাণের বান’। সমস্যা সমাধানের জন্য যুঝতে যুঝতে একটা সমচেতনা তো গড়ে উঠছিলই, তার চেয়েও উভয় ধর্মের নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক ঐক্য অনেক আগে থেকেই ছিল। জারিগানের আসরে যাঁরা গান করেন, তাঁরা আল্লাহ বা নবির বন্দনার আগে লোকায়ত দেবী বিপদনাশিনীর বন্দনা করে নেন। স্থানীয় লোকদেবতা ও পীর পয়গম্বরকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন তাঁদের রীতি। এ রকম অজস্র উদাহরণ আছে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে সংস্কৃতি-চিন্তায় এই অসাম্প্রদায়িক অবস্থান পরে রক্ষিত হয়নি বলে মনে করেছেন মিহির সেনগুপ্ত। তবুও এ রকম একটা যূথবদ্ধ ভূমিতে দাঙ্গার বীজ বপন করা হল। অন্নদাশঙ্কর রায় মনে করেন, এই দাঙ্গার জন্য শুধু ব্রিটিশের ‘দেশ ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি দায়ী নয়, এর একটা বড় কারণ ছিল জমি। যেখানে শতকরা নব্বই জন চাষি মুসলমান আর শতকরা নব্বই ভাগ জমিই হিন্দুর। তিনি আরও বলেছেন, অধিকাংশ মহাজন, উকিল, মোক্তার, জমিদার, সেরেস্তার কর্মচারী সব হিন্দু। আর প্রজাসাধারণ মুসলমান। এই রকম একটা বৈষম্যের ক্ষেত্রে কখনও স্বাভাবিক সখ্য আশা করা যায়? সেই সূত্রেই অনেক সময় জমিদারের সঙ্গে প্রজার সংঘাতও বেধেছে কিন্তু সেই বিবাদকে একটা স্বার্থপর শ্রেণি হিন্দু-মুসলমানের বিবাদ বলে প্রচার করেছে। সঙ্কটকালে এটাই বড় আকার নিয়েছে।
অনেকটা একই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন মণিকুন্তলা সেন। সাতচল্লিশের অনেক আগে পটুয়াখালির একটা সংঘাতের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, এক বার এক মুসলমান চাষি রক্তাক্ত মাথা হাত দিয়ে চেপে ধরে ছুটে আসছে, পথে এক হিন্দুকে দেখে বলছে ‘বাবু ওদিকে দাঙ্গা, যাবেন না’। মণিকুন্তলা সেন প্রশ্ন তুলছেন, ‘এ দাঙ্গা বাধায় কারা?’ দাঙ্গা যারা বাধিয়েছে তারা কিছু কায়েমি স্বার্থের মানুষ। ও পারের নিম্নবর্গের মানুষকে সুকৌশলে এই কাজে নামানো হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন দেশভাগের প্রাক-মুহূর্তে মুসলমান মননে লোভকে সুকৌশলে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। শঙ্খ ঘোষের ‘সুপুরিবনের সারি’-তে নিলুদের মোটা দেওয়ালের নাটমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট নিলুকে তার বন্ধু হারুন বলেছে, তাদের ‘কায়েদে আজম কইছে, এইসব আমরাই পামু... এইসব একদিন আমাগো হইয়া যাইবে’। এই পুঞ্জীভূত লোভই এক দিন পৈশাচিক প্রত্যাঘাত হয়ে ফিরেছিল। এ পারেও একই কথা হাসান আজিজুল হক শুনেছেন। তাঁদের যবগ্রামের বদু রাখাল গরু চরাতে চরাতে নাচছে আর বলছে, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, মোসলমানদের দেশ হবে পাকিস্তান। একটা হিন্দু মালাউনের জায়গা হবে না সেখানে।’
ছেচল্লিশের ১৬ অগস্টের আগে হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ কি ছিল না এ পারে? মাত্র ছ’মাস আগে ছেচল্লিশের ফেব্রুয়ারি মাসেই তো কলকাতা রাজপথে খেপে উঠেছিল তারুণ্য। হোক না মুসলমান, কিন্তু আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন তো! সেই রশিদ আলির মুক্তির দাবি জানাতে কলকাতার রাজপথে হাজার হাজার হিন্দু ছাত্র মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের পাশে দাঁড়াল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের অসংখ্য সাধারণ মানুষ। শহিদের মৃত্যু বরণ করলেন রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে রসুলেরা। কিন্তু তার পর কেন ঘটল কলকাতার দাঙ্গা? ইংরেজবিরোধী লড়াই কী করে হয়ে উঠল হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ? কলকাতা বিহারের ঘটনার রেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশালে। ভয়াবহ আকার নিল নোয়াখালি, কুমিল্লায়। নোয়াখালির ঘটনাকে তপন রায়চৌধুরী স্বতঃস্ফূর্ত গণসংঘর্ষ বলে মানতে চাননি। এটা ছিল ‘একটা বজ্জাত ধান্দাবাজের সুপরিকল্পিত বদমাইসির পরিণাম। তার নাম গোলাম সারোয়ার।’ এই সারোয়ার পরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সভ্য হয়েছিল। হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, উচ্ছেদের আতঙ্ক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার পর থেকেই শুরু হয় ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে দেশত্যাগ। ক্রমশ হিন্দুশূন্য হতে থাকে ও পার। স্বাধীনতার দু’-তিন বছর পর ও পারের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার নেমে আসে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিকথায় প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ে স্বাধীনতা পেলাম, না কি হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা করে স্বাধীনতা পেলাম? দুই দেশের দুই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চরম দুর্দশার জন্য তৎকালীন অপরিণামদর্শী নেতৃ্ত্বকে দায়ী করেছেন সুনীল, ‘পাকিস্তানের নেতারা যেমন এদেশে থাকা কোটি কোটি মুসলমানের ভাগ্য নিয়ে কোনও চিন্তা করেননি, তেমনই ভারতবর্ষীয় নেতারা উদাসীন থেকেছে পাকিস্তানের কোটি কোটি হিন্দুদের নিরাপত্তা বিষয়ে।” তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সূত্রে জানা যায়, সুরাবর্দি সাহেব তাঁর তরুণ বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুরা যেন না চলে আসেন, তার দায়িত্ব নিতে। তবে সে দায়িত্ব কতখানি পালিত হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।
দক্ষিণারঞ্জন বসু নাটাখোলা গ্রামের পাগল দিনুর একটা গল্প বলেছেন। শান্ত পাগল দিনু শীতের মধ্যরাতে হরি পোদ্দারের খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে চেঁচাতে শুরু করে, ‘ও পোদ্দার মশাই, দ্যাহেন কত্তা, কী নাল ঘোড়া দাবাড় দিছি!’ সকলের চেষ্টায় আগুন নেভে। কেন সে লাগাল এমন আগুন? বিচার বসলে দিনু পাগল বলে, ‘জারা বড় কড়া জারা’। কড়া শীত থেকে বাঁচতে সে এ কাজ করেছে। আজকাল আমাদের চার পাশে বোধহয় এই দিনু পাগলের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে, না হলে আমাদের অজান্তেই হয়তো দিনু পাগল কোনও দিন ‘নাল ঘোড়া’ ছুটিয়ে দেবে।
তথ্যসূত্র: ১। সুপুরিবনের সারি, বটপাকুড়ের ফেনা— শঙ্খ ঘোষ ২। এই পুরাতন আখরগুলি, ফিরে যাই ফিরে আসি— হাসান আজিজুল হক
৩। অর্ধেক জীবন— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪। দয়াময়ীর কথা— সুনন্দা শিকদার
৫। ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত— দেবব্রত বিশ্বাস
৬। বিষাদবৃক্ষ— মিহির সেনগুপ্ত ৭। যুক্তবঙ্গের স্মৃতি — অন্নদাশঙ্কর রায় ৮। বাঙালনামা— তপন রায় চৌধুরী ৯। আপিলা-চাপিলা— অশোক মিত্র ১০। সেদিনের কথা— মণিকুন্তলা সেন
১১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী— শেখ মুজিবুর রহমান ১২। উজান গাঙ বাইয়া— হেমাঙ্গ বিশ্বাস
১৩। ছেড়ে আসা গ্রাম— দক্ষিণারঞ্জন বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy